অন্যরকম  ভ্যালেনটাইন

 অন্যরকম  ভ্যালেনটাইন

 –কৃষ্ণা মিত্র 
আজ রতনের বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল। রাতের  শেষ লোকাল ধরে ফিরছে। ট্রেনের কামরা পুরো ফাঁকা । জানলা  দিয়ে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে  থাকতে থাকতে একটা ছবিই চোখে ভাসে  রতনের।
চারটে মানুষের  সংসার রতনের। বউ চাঁপা, ছেলে কচি  আর মেয়ে ময়না। এরাই রতনের জগৎ । দেউলটিতে বাড়ি। সেখান থেকে ফুল নিয়ে গিয়ে কোলকাতার ফুটপাতে বসে বিক্রি করে। যা রোজগার হয়, তাতে কোনোমতে চলে যায়। ঐ নুন আনতে পান্তা ফুরোয় গোছের। তবে রাতে বাড়ি ফিরে যত কম টাকাই চাঁপার হাতে দিক না কেন ,চাঁপা হাসিমুখে তাই দিয়েই সংসার চালায়। কোনো অভিযোগ করে না।
চরম কষ্টের দিনেও চাঁপা নিজে না  খেয়ে রতনের সামনে খাবার  এগিয়ে দিয়ে বলে, “ আমার খুব অম্বল হয়েছে। আজ আর কিছু খাব না । “
রতনও সব বুঝতে  পেরে বলে, “ আজ আমারও খুব খিদে পাচ্ছিল। তাই প্ল্যাটফর্মে ডিম পাউরুটি খেয়ে এসেছি। ” দুজনেই দুজনের  কাছে ধরা পড়ে যায়। তারপর সেই খাবারই দুজনে ভাগ  করে খায়।
চাঁপা আজ দশদিন হল অসুস্থ । জ্বর ছাড়ছে না , সঙ্গে কাশি । গ্রামের হেলথ সেন্টারে দেখিয়েছে। কিন্তু কিছুই কাজ হয় নি। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে  ওর চিকিৎসা করাতে হবে।  অনেক টাকার দরকার । কিন্তু কিছুতেই কোনো পথ খুঁজে পায় না। সারাদিন ফুল বিক্রি করে রাতে যখন বাড়ি ফেরে তখন দেখে চাঁপা নাকে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঠের জ্বালে রান্না করছে। যতই আঁচল চাপা দিক, ধোঁয়া কি আটকানো যায়! তাই আরও বেশি কাশতে থাকে। রতনকে দেখে চাঁপা কাশি লুকানোর চেষ্টা করে। বুঝতে পারে রতন। আর তাই নিজের অক্ষমতার জন্য আরও বেশি কষ্ট পায়। ভগবানের কাছে সবসময় প্রার্থনা জানায়— তিনি যেন একটা রাস্তা দেখান, যাতে চাঁপার চিকিৎসা করে ওকে সুস্থ করে তুলতে পারে। চাঁপা ছাড়া আর কেই বা আছে ওর মতো অনাথের!  তাছাড়া চাঁপার কিছু হলে কচি, ময়না— ওরাও তো মাতৃহীন হয়ে পড়বে!
তবে  গত এক সপ্তাহ ধরে ওর বিক্রি বাট্টা বেশ ভালোই হয়েছে। কিছু একটা বিশেষ উৎসব নাকি চলছে। একজনকে বলতে শুনেছে , এটা নাকি ভালোবাসার  উৎসব । আজ ছিল সেই উৎসবের বিশেষ দিন। রোজের খেটে খাওয়া রতন এত কিছু বোঝেনা। বোঝেনা ভালোবাসার আবার উৎসব কি করে হয় ! জানেনা ভালোবাসার বিশেষ দিন কেমন করে আসে ! ওর প্রসাধনহীন মন বাড়ী থেকে বেরোনোর সময় শুধু এইটুকু বোঝে, আজ যদি বেশী বিক্রী হয় তাহলে ও ওর চাঁপার জন্য কিছুটা টাকা আলাদা করে রাখতে পারবে চিকিৎসার জন্য। চাঁপাকে চোখের আড়াল করতে চায় না,  ভালোবাসা ভরা পিপাসু চোখ দুটো দেখার জন্য বার বার দরজার দিকে পিছু ফিরে দেখে। দোকানদারী করতে করতে লাল হৃদয়টা কতবার যে ওর প্রিয়তমার ছবি দেখে আর ভাবে কতক্ষনে আবার ফিরে গিয়ে ওর মুখটা দেখতে পাবে হিসেব রাখতে পারে না। সারাদিনে বাস্তবের জমিতে পাঞ্জা কষা অনুভূতিগুলো কতবার যে নিজের অজান্তেই চাঁপাকে আর ওর শরীরের কষ্টটাকে মনে করে খেয়ালই থাকে না। তাই ভালোবাসার জন্য ভাঁড় থেকে বের করে আনা আরও ভালোবাসার এত আয়োজনের হৈচৈ কেন সেটা রতনের মাথায় ঢোকে না। কিন্তু ওর আশা ভরা ব্যবসায়ী মন তাই আজ ইচ্ছে করেই অন্যদিনের চেয়ে বেশি ফুল এনেছিল, বিশেষ করে গোলাপ।সব ফুল বিক্রি হয়ে গেছে আজ। যাই হোক, এই উৎসবের দৌলতেই ওর হাতে বেশ ভালো টাকা এসেছে, তা দিয়ে চাঁপার চিকিৎসা  করাতে পারবে। কালই চাঁপাকে শহরের  ভালো ডাক্তারের কাছে  নিয়ে যাবে রতন। ঠিকমতো চিকিৎসা করাবে। আজ অনেকটা চিন্তামুক্ত লাগছে।
চাঁপা আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবে।
জীবনের সাথে প্রতি নিয়ত যুদ্ধ করা, কম পড়ালেখা জানা রতন ভ্যালেন্টাইন শব্দটার মানে জানে না, আন্তরিকতা কাকে বলে বোঝে না। সে শুধু জানে তার চাঁপাকে, বোঝে চাঁপাই তার আঁধার ঘরের প্রদীপের আলো।
সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment