Site icon আলাপী মন

পথেই তোমার দেখা

পথেই তোমার দেখা
-অমল দাস

 

দিদির বাড়ি থেকে দুপুরের খাওয়া সেরে বেলা তিনটা নাগাদ দ্বীপায়ন কাকদ্বীপ রেলস্টেশন-এ হাজির। বাড়ি ফিরতে হবে পরের দিন বিশেষ কাজ আছে । ট্রেনে উঠে একটা ভাত ঘুম দিয়ে দেয় নিশ্চিন্তে। ট্রেন লক্ষ্মীকান্তপুর থামতেই ৭১ এর প্রেক্ষাপট, ঠিক যেন শরণার্থী নেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতীয় ট্রেন বেনাপোল সীমান্তে এসে দাঁড়াল, আর সেই সঙ্গে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে  হাজার হাজার শরণার্থী তড়িঘড়ি ট্রেনে উঠার জন্য লাফিয়ে পড়ল একসাথে। এই গোলযোগের মধ্যেই দ্বীপায়নের চোখ খুলে গেল। আর শিয়ালদা কোলে মার্কেটের মত যে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল তা থেকে রেহাই পেতে কান কে শুধু মাত্র মানসিক স্বান্তনা দিল “অল ইস ওয়েল”।

 

ওই প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে এক ৬০ উর্দ্ধ বৃদ্ধা মহিলাকে নিয়ে এক তরুণী চ্যানেলে ঢুকে দ্বীপায়নের দিকে পিছন ফিরে কোন মতে দাঁড়াল। দ্বীপায়ান কৌতূহল বসত উপরের দিকে দেখল কিন্তু তরুণীর মুখমণ্ডলের দেখা মিলল না । তরুণী তার লম্বা চুল বাঁধতে ব্যস্ত। সম্ভবত ভিড়ে চুলের বাঁধন খুলে গিয়েছিল। দ্বীপায়ন তরুণীর রেশমি লম্বা কেশের সৌন্দর্যটা নিমেষে চাক্ষুষ করেনিল। যদিও মুখমণ্ডল তখন অধরা, তবুও যেন ওর মন বলে উঠে – থাকনা তোমার কেশ খোলা,  কোন ক্ষতি তো সে করছেনা…..! বাঁধারই বা প্রয়োজন কি….!  বেশ ভালোই তো লাগছে…. হলাম না হয় বাউল আনমনা ।

 

সামনের স্টেশনে আসতেই বৃদ্ধা ও তরুণী বসার সুযোগ পেয়ে গেল একদম দ্বীপায়নের মুখমুখি। দ্বীপায়নের নজর এতক্ষণে তরুণীর উপর স্থাপিত হল। চুলের কিছু অংশ কানেরকাছ থেকে ঝুলে তরুণীর একটি চোখ ঢেকেছিল, শ্যামলা গড়ন, লাস্যময়ী লম্বা টানা চোখ সঙ্গে ঠোটে আলত মুচকি হাসির ছোঁয়ায় এক অপূর্ব রূপ ধরা দিয়েছিল দ্বীপায়নের চোখের লেন্সে। ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনের ভিতর এই সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করার ইচ্ছা জাগল প্রবল ভাবে, মন যেন আজ প্রতিষ্ঠিত কোন এক  ফটোগ্রাফার । কিন্তু উপায় নেই, তাই ইচ্ছাটাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হল ।

অল্পক্ষণের মধ্যেই বৃদ্ধার জল পানের ইচ্ছার মাধ্যমে তরুণীর নাম জানা গেল অমৃতা। ব্যাস ওইটুকই আর বোঝা গেল বৃদ্ধা অমৃতার দিদিমা। তড়িঘড়ি দ্বীপায়ন পকেট থেকে মোবাইল বার করে ফেসবুকের আকাশে হাজারো তারার ভিড়ে অমৃতা নামক তারার অনুসন্ধানে ঝাপিয়ে পড়ল। না পদবী ,না গোত্র, না ঠিকানা, তার উপর যদি নিজস্ব ছবি না দেওয়া থাকে তবেই হল। কিন্তু কথায় বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়,  সে পেল, অমৃতার খোলাচুলের একটা সেলফিতে এসে চোখ আটকে গেল , সেখানে লেখা এঞ্জেল ঘোষ অমৃতা এবং প্রোফাইলের কিছু ছবি দেখে নিশ্চিত হল যে এই ললনা অমৃতাই। যে হরিণী নিমেষে ঘায়েল করতে পারে শত শত শিকারীকে তার ওই শ্যামা রূপ যৌবনে, যে সামনে বসে হৃদয়ে বসন্তের দোলা দিয়ে চলেছে অনবরত।

অমৃতাও নিজের মোবাইল বার করে ঘাটতে লাগল । হঠাৎ নোটিফিকেশনে ম্যাসেজ দেখে দ্বীপায়নের দিকে ফিরে তাকাল। সামনা সামনি চোখাচুখিতে দ্বীপায়ন লজ্জিত হয়ে মাথা নত করল । সে ভাবলে এভাবে রিকোয়েস্ট পাঠানো ঠিক হয়নি। লজ্জিত দ্বীপায়নের গাল লাল হয়ে উঠে যা অমৃতাও সহজেই পরখ করেছিল।

 

অমৃতা পাশের এক বধূর শিশুকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল যা দেখে দ্বীপায়নের মন ছোট্ট শিশুতে নিজেকে দেখে আদর চুম্বনের উষ্ণ পরশ নিতে লাগল,  অমৃতা হয়ত ইচ্ছা করেই শিশু টিকে অতি আদর করতে লাগল যাতে সামনের পুরুষটির ফাগুনি হৃদয় প্রেম আবেগে টুকরো টুকরো হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে। আর সেই দৃশ্যের রসাস্বদন করতে পারে অতি আনন্দে। শহুরে যুবতী তাই ভাবনাটাও অতি আধুনিক।

 

একে অপরের চোখের খেলা হয়ে চলেছে ।এ ভাবেই কিছু সময় অতিক্রান্ত, হঠাৎ মোবাইলের টোনে দ্বীপায়নের সম্বিৎ ফেরে,  চোখ রাখতেই অপ্রত্যাশিত ভাবে লক্ষ্য করে একটা ম্যাসেজ – “এটাই কি আপনার কাজ না অন্য কাজও…. আছে”?

হ্যাঁ ম্যাসেজ টা অমৃতাই দিয়েছে । অপ্রত্যাশিত । যা দেখে আকস্মিক ভীত দ্বীপায়ন আধো সুরে লিখে পাঠাল –আ…জ্ঞে …মা…নে…?

-“এই… রাস্তায় মেয়েদের নাম শুনেই সার্চ তারপর বন্ধুত্বের রিকোয়েস্ট”।

সঙ্গে রাগী ইমোশন দিয়ে লিখে পাঠাল অমৃতা।

বিনয়ের সাথে দ্বীয়াপায়ন লিখল –“না.. আসলে আপনাকে দেখে……”।

-“কি… আমাকে দেখে”?

-“সত্যি করে বলছি খোলা চুলে আপনাকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল..তাই…”

-“এই কামরায় তো আরও মেয়ে আছে আর কাকে ভালো লেগেছে? আর কাকে কাকে এভাবে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন”?

-“প্লীজ আপনি আমায় খারাপ ভাবছেন! আমি শুধু আপনাকেই…”

-“হুম আপনি খারাপ তো অবশ্যই, আমায় ভালো করে দেখলেন না বুঝলেন না.. আলাপ….”।

-“আমি আলাপ করতে চাইছি মানে আপনি সত্যিই সুন্দরী। আর খারাপ ভালো যা আছি আপনার সামনেই, পরখ করে নিন”।

এই জবাবে অমৃতা খানিক চুপ! কি বলবে ভেবেই পাচ্ছেনা। মনে মনে একটু উৎফুল্লও হল কারণ ওই কথার মধ্যে তো তার রূপেরও প্রশংসা আছে।

আবার দ্বীপায়ন লিখল-চুপ হয়ে গেলেন যে ? রাগ করলেন? সরি! আমি আপনাকে আঘাত করতে চাইনি।

অমৃতা ম্যাসেজটি দেখল কিন্তু আর কোন সাড়া দিলনা। সে একমনে দ্বীপায়নের প্রোফাইল দেখতে লাগল। মাস খানেক আগে লেখা একটি কবিতায় অমৃতার চোখে ধরা পড়ল। অমৃতা মনে মনে ভাবতে লাগল বাঃ লেখাটা তো বেশ সুন্দর , এটা কি ওই লিখেছে ? না……! যদি ওর লেখাই হয় তবে ও’কি কবিতার মতই ! না বাস্তবটা অন্য ! যাই হোক লেখাটা দারুন। একটা লাইক দিয়ে বসে।

দ্বীপায়ন তা দেখে প্রশ্ন  করে-“ আপনি কি আমার প্রোফাইল ঘাটছেন”?

অমৃতারও উত্তর তৈরি – না, তা করতে যাব কেন?

-ওই যে পুরনো একটা পোস্ট-এ লাইকে দিলেন…। তাই ভাবলাম….।

-আপনার ভাবনা ভুল, লেখাটা সামনে এল তাই…. .

 

দ্বীপায়ন মোবাইল থেকে চোখ তুলে অমৃতার দিকে তাকাল, সে যে মিথ্যা বলছে তা ওর লাজুক নয়নেই ধরা পড়েছিল। এবার একটু মশকরা করেই লিখেছিল- “সত্যি বলছি আপনার চোখ দুটো অসাধারণ”।

এই প্রশংসায় অমৃতার একটু অহং জাগল কিন্তু প্রকাশ পেলনা। অমৃতার চুল আর চোখ অহং-এরই বিষয়। সেই স্কুল জীবন থেকেই কত যুবক এই আঘাতে ঘায়েল হয়েছে। কত যুবক কলেজ পথে সূর ধরেছে “ইয়ে কালি কালি আঁখে” ।  তা তো অমৃতাই জানে। এতে আর নতুন কি ? তাই সে একটু বিরক্ত দেখিয়ে লিখল-“ কি করব ? চোখ দুটো আপনার হাতে দিয়ে দি? আলমারিতে তুলে রাখবেন যত্ন করে”।

এই ম্যাসেজ দ্বীপায়নের হৃদে একটু আঘাত দিল –“সরি ! এটা আপনি কি বলছেন ? চোখ আপনার সৌন্দর্যের সম্পদ, ওকে কাজলের আড়ালে যত্নে রাখুন, এভাবে অন্যের হাতে তুলে দেবেন না”।

অমৃতা ম্যাসেজটি দেখে নিজেতে লজ্জিত হল। সে অনুশোচনায় পড়ল ওই কথাটা ওভাবে না বললেই হতো। কেন যে বললাম।এর পর দুজনাই চুপ হয়ে রইল কেউ কাউকে আর ম্যাসেজ বিনিময় করল না। শুধুই দর্শন।

“না ওকে দেখতে আহামরি খারাপ নয়। হাবভাবেও একটা ভদ্রতা আছে। দু তিনটি লেখাও তো দেখলাম বেশ ভালো লেখে। মনটাও হয়ত ভালো”- অমৃতার হৃদয়ে আরও অনেক ভাবনা..মনে না না প্রশ্ন….।

অবশেষে গড়িয়া স্টেশনে ট্রেন থামল, অমৃতা তার দিদিমাকে নিয়ে নেমে গেল।  দ্বীপায়নও পিছু পিছু নেমে গেল। সে ভুলেই গেছে যে তার গন্তব্য গড়িয়া নয়, হুগলীর বাঁশবেড়িয়ায়। তাকে ফিরতেই হবে ,তার পরের দিন বিশেষ কাজ আছে। কিন্তু কোন  সম্মোহনে সে অমৃতাকে অনুসরণ করছে সে নিজেও জানেনা। সে শুধু নির্বোধ বালকের মত এগিয়ে যেতে থাকে।

দ্বীপায়নকে দেখে  অমৃতার মৃদু হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোনে। এই দীর্ঘ যাত্রা পথে বৃদ্ধ দিদিমা যে কিছুই খেয়াল করেননি তা একদম নয়, কিন্তু তিনি নাতনির দুনিয়ায় দখলদারি দিতে ইচ্ছুক ছিলেনা। গড়িয়া হাটের বাসে উঠে কেবল শুধু বললেন-“ অনেক হয়েছে দিভাই এবার ফিরতে বল, আমাদের বাড়িতে রাতে জায়গা হবেনা কিন্তু”।

একটু লাজুক হয়ে অমৃতা দিদিমার গাল টিপে বলে ওঠে – “ও.. দিদা তুমি না কি  যে বল…”!

অমৃতা মোবাইল বার করে ফেসবুকে ম্যাসেজ দিল “ আলাপের আগেই আমাদের দেখা হল , কিছুটা আলাপও হল, সবই ভালো, বাকিটা পরে হবে! এখন পিছু ছাড়ুন , আপনাকে বাড়িও তো ফিরতে হবে ”।

মোবাইলে আওয়াজ হওয়াতে দ্বীপায়ন ম্যাসেজটি খুলে দেখে, মনে মনে লজ্জিত হয়ে উঠল । সত্যিই তো এটা আমি কি করছি ? কেনই বা ওর পিছু করছি ? ও বড্ড খারাপ ভাবল আমায়। না না খারাপ মনে হয় ভাবেনি, ওই যে বলল আলাপ পরে হবে। ও নিশ্চয়ই কথা বলবে। এই ভাবতে ভাবতেই অমৃতার বাস ছেড়ে গেল। অমৃতা জানলা দিয়ে মুচকি হাসিতে একবার ফিরে দেখল, দ্বীপায়নেরও নজর এড়ায় নি। প্রত্যুতরে সে উষ্ণ হাসির আভাস ভাসিয়ে দিল দক্ষিণা বাতাসে, যা অমৃতার হৃদয়ের ঈশান কোনে সঞ্চিত হয়ে রইল আগামীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য।

দ্বীপায়ন ই এম বাইপাসের বাসে উঠে মুকুন্দপুর নেমে বন্ধুর ভাড়া ঘরে রাত্রি যাপন করল। সকালে নতুন দিন, নতুন সূর্য, নতুন মানুষ, নতুনের পথে চলা-এই ভাবনায় রাত অতিবাহিত, কানে ভেসে এল ভোরের পাখির কূজন।

 

 সমাপ্ত

 

 

 

Exit mobile version