দিনান্তে
-মন্দিরা মিশ্র
কার্তিকের পড়ন্ত বিকেলে ‚ ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে ‚ নিবিষ্টমনে ‚ কখনো আকাশের সুর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা ‚ কখনোবা ‚ স্বামীর আসার পথের পানে চেয়ে আছে দামিনী |
হঠাৎই একটা দামী শাল ‚ পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে দিল দামিনীকে |
একি তুমি ? কোথা দিয়ে এলে ? আমিতো তোমার পথ চেয়েই বসেছিলাম‚ আর সুর্য্যদেবের দিনান্তের রংয়ের কারিকুরি দেখছিলাম ‚ আকাশের পানে চেয়ে……..
শক্তিময় বললেন ‚ তুমি ছিলে বিভোর আকাশে | দূর থেকে তোমায় নিরীক্ষণ করে ‚ আমি একটু মজা করেই ‚ পিছনের দরজা দিয়েই ঢুকলাম ‚ একেবারে নিঃশব্দে |
কার্তিকের এই পড়ন্ত বিকেলের নতুন হিম যে তোমার ধাতে সয়না দামিনী | ফুরফুরে হাওয়াতে মনও তোমার এতই উতলা যে ‚ দূর থেকে আমি লক্ষ্য করলেও ‚ তোমার কিন্তু নজরে পড়েনি |
কিন্তু ‚ তাবলে ‚ এখন আবার এই ‚ দামী ‚ নতুন শালটার কি দরকার ছিল বলতো ?
হাঃ হাঃ হাঃ ‚ সত্যিই এবার ‚ তুমি আমায় হাসালে দামিনী ………..
এতোদিন আমার ধারণা ছিল ‚ এসব দিনগুলো মেয়েরাই ‚ বেশী করে মনে রাখে | কিন্তু ‚ তুমি ‚ ছেলের বিদেশ যাওয়া আর নাতির মধুমাখা পরশ বিহনে এতই উতলা যে ‚ আজকের দিনটা স্মরণেও আসেনি তোমার |
আরে ‚ সবাইতো সামনের দিকেই এগিয়ে যায় | পুলস্ত্য ‚ এতো ভালো একটা অফার ‚ সেই সঙ্গে মিত্রারও ওদের ওখানেই একটা জব অফার………
ভাবলে কি-করে তুমি ? ঐ সমস্ত সুযোগ সুবিধা ছেড়ে ‚ এই মৃত্যুপথযাত্রী ‚ দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অবলম্বন হয়ে ‚ এখানে থেকে যাবে ?
ভুলে যাও দামিনী এসব | নিজের দিকে তাকানোর সময় হয়েছে এবার | সারাজীবনতো ‚ ছেলে-মেয়ে-স্বামী আর সংসার করতে গিয়ে ‚ অকালেই বুড়িয়ে গেলে | না লাগলো ‚ তোমার বিদ্যে-বুদ্ধি ‚ না কিছু |
এখন বাতের ব্যাথায় ‚ এতো কাবু যে ‚ প্রাতঃভ্রমণ বা সান্ধ্যবিহারে ‚ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার ক্ষমতাও নেই তোমার |
মনটাকেও একেবারে মেরে ফেলেছ | কোথায় গেল আমার সেই ‚ উচ্ছ্বল ‚ প্রাণবন্ত ‚ সদাহাস্যময়ী দামিনী ? তাকে নিজে-হাতে গলা টিপে মেরে ফেলে ‚ এখন শুধু ‚ দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছ |
শক্তি এবার একটা রজনীগন্ধার টাটকা মালা দামিনীর গলায় পরিয়ে দিতেই………
ও-মা ? সত্যি তুমি পারো বটে | ঠিক মনে রেখেছ ‚ আজকের দিনটা ?
কিযে বলনা দামিনী ‚ মনে রাখাটাইতো স্বাভাবিক |
আজ থেকে ‚ ঠিক পঁয়তাল্লিশ বছর আগের এমনি দিনে ‚ তুমি এসেছিলে ‚ আমার ঘরণী হয়ে |
রেজিষ্ট্রী অফিস থেকে রাঙা বেনারসীতে সেজে ‚ আমারই হাত-ধরে ‚ প্রবেশ করেছিলে ‚ এই বাড়ীতে …….
২
সত্যিগো ‚ এবার আমার একেবারেই খেয়াল ছিল না | আমাদের সেই লড়াই করে ‚ কার্তিক মাসেই বিয়ে করা………..
তোমারতো মাথার ওপর ‚ অভিভাবক কেউ ছিলেনই না | একেবারে নিজেই নিজের কত্তা |
কিন্তু আমি ? উঃ মা-বাবার সঙ্গে লড়াই করে ‚ যখন হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম ‚ তুমিই আমায় ‚ এমনি দিনেই এক কাপড়ে বেরিয়ে আসার বুদ্ধিটা দিয়েছিলে |
কিন্তু তোমার মিট করার এড্রেসটা দেখে আমিতো বুঝতেই পারিনি ‚ যে তুমি একেবারে রেজিষ্ট্রী অফিসে ‚ পাকাপকি বন্দোবস্ত করে রেখেছিলে |
আমাকেতো দু-হাত বাড়িয়ে ‚ সাদরে কাছে টেনে নিলে | তারপর তোমার আয়োজন দেখে আমিতো থ |
আমাকে সাজানোর সব ব্যবস্থা মায় ‚ বেনারসী ‚ গয়নাও ‚ কিছু ত্রুটি রাখনি তুমি |
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ‚ নিজেই সলজ্জ নববধূ হয়ে ‚ তোমার সামনে এসে দাঁড়ালাম |
তুমিও তখন ‚ ধুতি-পাঞ্জাবী পরে দিব্যি বরটি সেজে দাঁড়িয়েছ |
দামিনী ‚ সবই ঐ আমাদের অফিস-কলিগ ‚ জীবনদা আর সুধন্যর কারসাজি | আমাকেও টের পেতে দেয়নি | শুধু ‚ দরকারমত টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়েছে |
দেখলেনা ‚ ওরাই সাক্ষী ‚ বরপক্ষ ‚ কনেপক্ষ স…ব | সত্যি সেই মানুষ দুটোর একজনও আজ নেই |
জানো দামিনী ‚ যে সিঁদুর-কৌটো থেকে ‚ তোমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়েছিলাম ‚ রুপোর ওপরে সোনার জল করে তোমার নাম লিখে ‚ ওটা জীবনদাই আমাকে দিয়েছিল |
তোমার মনে আছে দামিনী ‚ তোমাকে সিঁদুর পরানোর সঙ্গে-সঙ্গে ‚ তুমি ঢিপ করে আমাকে প্রণাম করেছিলে | তাই দেখে ‚ আমরা তিনজনেই হো হো হো করে কি হাসি….
ধ্যাৎ ‚ ছাড়না | সে সেই উনিশ বছরের অপরিণত বুদ্ধির কান্ড …
কেন ছাড়বো কেন ? জানো তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে গেছিল | এতোদিনে ‚ আমি কারো প্রণম্য হলাম | তারপর ‚ ওদের পীড়াপীড়িতে ‚ দুজনে গলা জড়িয়ে ধরে সেই ছবি তোলা ? সে ছবি আজ মলিন ‚ তবু আমাদের ঘরে এখনো সে-ই স্মৃতিটাকে ধরে রেখেছে |
খাওয়া-দাওয়ার পর ওরাইতো আমাদের সঙ্গে ট্যাক্সীতে এসে ‚ আমাদের দরজার ফিতেটা তোমাকে দিয়ে কাটালো | আমাদের ভেতরে ঢুকিয়েই ধড়াস করে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে বলে গেল ‚কাল সকালে অফিস যাওয়ার সময় খুলে দিয়ে যাবো ‚ বলে হা……. হা…..হা …. করে হাসতে-হাসতে চলে গেল |
ওঃ ‚ প্রথম থেকে ওরাই আমাদের পাশে ছিল | আর আজ ‚ দুজনেই চলে গেছে ‚ মহাশুন্যের ওপারে………..
৩
দামিনী শুরু করলো এবার……….
তুমিতো আমায় হাত-ধরে নিয়ে এলে ‚ আমাদের সেই নতুন ঘরে ‚ যেটা আজও আমাদেরই আছে | তারপর সারা..রাত ‚ উঃ ‚ আদরে ‚ সোহাগে……….
দেখ কদিনেরই বা আলাপ ছিল আমাদের ?
মাত্র চার-মাস আগে এক গোধুলিবেলায় ‚ তুমি ফিরছিলে অফিস থেকে আর আমি কোচিং থেকে …..
পেনটা পড়ে যেতেই আমি নীচু হয়ে তুলতে যাচ্ছি ‚ তুমি আমার হাতে ধরিয়ে দিলে স্মিত হেসে |
দুজনে তাকালাম পরস্পরের দিকে ‚ ব্যাস মদনবাণে বিদ্ধ হলাম | অলক্ষ্যে তোমার স্টপেজ পেরিয়ে গেল ‚ তোমার খেয়ালই নেই …..
পরের স্টপেজ নীলরতন — হাঁকতেই ‚ আমার পিছনে ‚ তোমাকে নামতে দেখে অবাক হয়েছিলাম |
এক্সকিউজের স্বরে বললে ‚ আমাকে এক স্টপেজ পিছিয়ে যেতে হবে….
আমি মনেমনে হেসে এগোলাম |
তারপর ‚ টুকটাক কথা ‚ রবিবার হলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত |
তুমিতো এরমধ্যেই বন্ধুদের পরামর্শে রেজিষ্ট্রী অফিসে নোটিস দিয়ে রেখেছ ‚ আমার সম্পুর্ণ অজান্তে |
নতুন বাড়ী বানাচ্ছো ‚ তাও বলনি ……..
কেন বলিনি জানো ? তোমার তখন শিয়রে শমন ‚ বি এ ফাইনাল | সেটাও জেনেছিলাম কায়দা করে ‚ তুমিযে কোচিং থেকে ফিরতে সেটাও…….
শোননা-গো ‚ অনেকতো স্মৃতি রোমন্থন হল ‚ এবার আমায় মালাটা দাও ‚ আমি কখন পরাবো গো ? বললো দামিনী |
মালাটা হাতে নিয়ে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে ‚ শক্তির গলায় পরিয়েই ঢিপ করে প্রণাম করলো |
শক্তি এবার সপ্রেমে ‚ দামিনীর হাতখানা ধরে ‚ ঘরের দিকে যেতে-যেতে বললো ‚ দিনটা ফুরিয়ে গেল…
আমাদের দিনওতো এবার ফুরোবার সময় হয়েছে ‚ সেজন্যেই আজ সব স্মৃতি আওড়ালাম | যদি আর বলার সময় না পাই ‚ কার প্রাণ- সুর্য আগে অস্তাচলে ঢলে পড়ে … কে জানে………সমাপ্ত |