আমিনা
-অমল দাস
মাতৃত্বকালীন যন্ত্রণা নিয়ে গত রাতে চব্বিশোর্দ্ধো আমিনা হাসপাতালে ভর্তি হয়, আজ ভোর রাতেই আমিনার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু । সে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এখনো সে সংজ্ঞাহীন । তার বহু প্রতীক্ষিত সন্তানের মুখ এখনও দর্শন হয়নি। মা সাইদা বিবি পাশেই আছে আর বালিগঞ্জের যে বাড়িতে তারা ভাড়া থাকে সেই বাড়ির রমলা কাকিও সঙ্গে আছেন। আর কেউ নেই এই শুভক্ষণে, নেই জন্মদাতা বাবাও।
আমিনার তার সন্তানকে দেখা মাত্রই জল বিন্দুতে চোখ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে ।সন্তানের মাথায় হাত রেখে সে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। আমিনার এক দীর্ঘ সংগ্রামের ফল হিসাবে এই প্রাপ্তি মিলেছে । আমিনার জীবনমরুভুমিতে এক নদীর সৃষ্টি হয়েছে। সন্তানের গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁটের হাসি আমিনার আঁধার ঢাকা জীবনে এক নতুন সূর্যের আবির্ভাব । তাই তো সন্তানের কপালে স্নেহের চুম্বন দিয়ে সে বলেছিল “তুই আমার প্রাণ তুই আমার সব, তোকে সঙ্গে নিয়েই আমার বাকি জীবন”।
“একটু যদি এদিকে সরে আসেন তাহলে আমি জানলার কাছে বসতে পারি শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছে না, যদি ওই সিট্টা আমায় দেন প্লিজ!” এই কথার মধ্যে দিয়েই আরামবাগ থেকে তারকেশ্বর যাওয়ার পথে দিবাকর চৌধুরীর সাথে আলাপ হয় আমিনা খাতুনের। সেই আলাপ থেকে পরিচয় তারপর একে অপরের কাছে আসা এবং একে অপরের বেদনায় সাড়া দেওয়া, একে অপরের সহমর্মী হয়ে ওঠা।
দিবাকর এক বনেদি পরিবারের সন্তান, কলকাতায় বেসরকারি সংস্থায় চাকরী করে। বয়স- ২৮ হবে । গৌর বর্ণের দিবাকরের পরিবার এই সম্পর্কের বিরোধিতা করে। বিষয়টা স্বাভাবিক আমিনা মুসলিম । তাই তো “ওই মেয়ে বিয়ে করলে বাড়ি ত্যাগ করতে হবে!” বাবা জানিয়ে দেয়।
পৃথিবীতে আমরা মানুষ হয়ে তো জন্মেছি কিন্তু মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে পারিনি ।যা ধর্ম জাতপাতের গণ্ডির চারদেওয়ালে মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে। জাতি যে দুটো , পুরুষ আর নারী! তা রক্তে মেশান গেলনা।
আমিনার পরিবারও সহজে তা মেনে নিতে পারেনি। সাইদা বিবি চুপ থাকলেও আব্বু সুলেমান হুমকির সুরে বলে রেখেছিল “ ওই সম্পর্ক থেকে বেইরে আয় নয়ত ফল ভাল হইবে না, প্রাণ খোয়াইবি তোরা দুজনেই”। কিন্তু আব্বুর এই চোখ রাঙানি যৌবনা আমিনাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। বরং আরও দৃঢ় করে তুলেছিল তার সংকল্পকে ।
আমিনা–দিবাকরের প্রেম মুক্ত পাখির মত খোলা আকাশে পাড়ি দিতে থাকে। কখন ভিক্টরিয়ার ময়দান, কখন মিলেনিয়াম পার্ক, কখন বেলুর মঠ, তো কখন সিনেমা হলের অন্ধকারে মিলেমিশে তারা এক হয়ে যেত । সামাজিক ঝড়ের চিন্তার তোয়াক্কা না করেই তাদের সম্পর্কের নাও এগিয়ে চলে পাল তুলে। বর্ধমানের লজের চারদেওয়ালের ভিতর তাদের পবিত্র প্রেম যৌবনদীর ডাকে সাড়া দিয়ে আস্টে-পৃষ্ঠে মাখোমাখো হয়ে সিক্ত হয়েছে একাধিক বার।
আমিনার সুখ কি আর সুখ ? সেই সুখের কোঠরে এক কঠিন আঘাত হানে আব্বু সুলেমান। অফিস ফিরতি পথে দিবাকরকে পথে ধরে মারধর করে। দিবাকরের করুন আর্তি “ আমায় ছেড়ে দিন , আমি আমিনাকে নিয়ে সুখের ঘর বাঁধতে চাই….., ওর গর্ভে আমার সন্তান আছে….., তাকে আমি নাম দিতে চাই….”। কিন্তু দিবাকর মুক্তি আর পায়নি, শেষ নিঃশ্বাসটা পথের ধুলোয় মিশে যায়। দিবাকরের স্বপ্নের চালাঘর রাস্তায় মিশে মানুষের পদতলে পিষে যায়।
আমিনা দিবাকরের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়। বঞ্চিত হয় দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি থেকে। “দিবাকর তুমি খুব পচা, দুষ্টু যাও তোমার সাথে আরি” এই কথা বলার মানুষটি আজ সাঁঝের আধারের সাথে মিলিয়ে গেছে দূর গগনে। দিবাকর কে জানিয়েছিল “ দিবা আমি প্রেগন্যান্ট…., নষ্ট করতে হবে…., সমাজে মুখ দেখাতে পারবনা”। দিবাকর সাহস জুগিয়েছিল “ না আমিনা আমদের প্রেম এভাবে নষ্ট হবেনা…., এমাসের বেতনটা হাতে আসলেই আমারা বিয়ে করে নেব। কলকাতায় একটা ঘর আমি ভাড়া করে রেখেছি তোমার চিন্তা নেই আর তো কটা দিন……”।
দিবাকরের খুনে সুলেমানের জেল হয়। আমিনার কল্পনার বাসা নদীর প্লাবনে ভেসে যায়। মা সুবেদাই ছিল ভরসা, যে মৃত্যুমুখী আমিনাকে জীবিত করে তোলে মাতৃত্বের আদর স্নেহে। সমাজের ধর্মের ঠিকাদারদের প্রবল কটূক্তি চাপ সহ্য করেও সে তার দিবাকরের ইচ্ছা পুরনে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ । সে সন্তানের জন্ম দেবে তাই তো প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে।
একা আমিনা একটি সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গি ফেরাবে কি উপায়! প্রথম যেদিন দুটি নগ্ন শরীর পরতে পরতে মিশে গিয়েছিল , বন্ধ হয়েছিল বায়ু চলাচলের পথ , উষ্ণনিঃশ্বাস হয়েছিল এক, সেটাই তো ছিল তাদের বিয়ে, যেখানে দুজনারই ছিল আত্মিক সম্মতির কবুলনামা । কোন শক্তিতে সে বোঝাবে যে এটা তার কোন অপরাধ নয়।
সমাজ থেকে বিতাড়িত আমিনা, মা সাইদার হাত ধরে চলে আসে কলকাতার বালিগঞ্জে যে ঘরটি ভাড়া করেছিল দিবাকর। রমলা কাকিই তো বলেছি “সাইদা তোমার চিন্তা করতে হবেনা আমি একটা কাজ যোগাড় করে দেব”। সাইদা ব্যাগের কারখানায় কাজ নিয়েছে, আমিনা সাইদার গতি ধীরে ধীরে এক সমান্তরাল লাইনে চলতে শুরু করেছে। আমিনার গর্ভে পালিত একটু একটু করে বেড়ে উঠছে দিবাকরের ভালবাসার ফসল।
আমিনার অনুরাগ মেশানো আক্ষেপ দিবাকর নাম দেবে বলেছিল… কিন্তু ও তো স্বার্থপর… ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে আমিনাকে… আমিনার সন্তানকে…। তাতে কি আমিনা দিবাকর কে জীবিত রাখবে তার নব জাতকের মধ্যে দিয়ে। লড়াই তো তার একার , দিবাকরের কাছে প্রার্থনা ও যেন উপর থেকে আমিনার পাশে দাঁড়ায় সহায়তা করে।
আমিনার জীবন আঁধারে আজ এক উজ্জল মুহূর্ত। সে তার সন্তান কে নিয়ে আগামী লড়াইয়ে প্রস্তুত । প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সামাজের চোখে “এক কুমারী মায়ের” এগিয়ে চলার পথে বাঁধা লঙ্ঘনে। তাই তো সে পুত্রের নাম রাখে অর্জুন শুধু অর্জুন , সেখানে নেই কোন পদবি, নেই কোন পিতা, আছে শুধু মা আমিনা । মা, যার কোন পদবী হয়না। অর্জুন পরিচিত হবে বড় হবে এক মাত্র মায়ের নামে।
=সমাপ্ত=
মন ছুঁয়ে গেল। দারুণ
ধন্যবাদ