গল্প

ঈশ্বরের মুখোমুখি

ঈশ্বরের মুখোমুখি

-অরুণ কর

 

সব সময় ভিড়ে ঠাসা বাসে জানলার পাশে সিট পাওয়াটা লটারী পাওয়ার মতো। কিন্তু বাস চললেও তবে তো হাওয়া! ভাদ্রের বিজবিজে গরম।বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি হয়নি বটে, কিন্তু তাতে বাতাসে ভ্যাপসা ভাব কিছুমাত্র কমেনি।বাসটা ঢিকির ঢিকির করে চলতে চলতে ওয়েলিংটনে এসে একেবারে ন যযৌ ন তস্থৌ। কিন্তু যাবেই বা কি করে?পরের দিন রথযাত্রা যে! রাস্তার দুপাশে নানা আকার ও প্রকারের রথের সংস্থা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা, বিকিকিনি চলছে রাস্তা জুড়ে। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলের তারস্বরে কান্না শুনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ফর্সা টুকটুকে চেহারা। বড়োজোর বছর চারেক বয়স। দেখতে দেখতে সে মায়ের হাত ছাড়িয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দিতে শুরু করলো।কালো বোরখা পরিহিতা তরুণী মা তাকে সামলাতে না পেরে পিঠে বসিয়ে দিলেন এক ঘা।তাতে ফল হলো বিপরীত, কান্না এবং গড়াগড়ির বেগ গেল বেড়ে।

তরুণীর সঙ্গে বোরখা পরিহিতা অন্য একজন বর্ষীয়াসী মহিলা ছিলেন। তিনি বললেন,দে না বহু,খেলেনাহি তো হ্যায়, মুন্না রো রহা হ্যায়– বলে তিনি নিজেই রথের দরাদরি শুরু করলেন। বাচ্চাটা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ়ার হাত ধরেছে।সুযোগ বুঝে নিজেই আঙুল দিয়ে পছন্দের রথ দেখাচ্ছে।বিস্তর দরাদরি করে কেনা হলো রথ। তরুণী মা রাগে গজগজ করতে করতে এগুচ্ছেন, বুকের কাছে দুহাতে রথখানা আকড়ে ধরা শিশুটি প্রৌঢ়ার কোলে।

একটু এগোতেই শিশুটি ছটফটিয়ে নেমে পড়লো প্রৌঢ়ার কোল থেকে। এক হাতে রথখানা ধরে রেখে অন্য হাতে কি যেন দেখাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি পথের পাশে দোকানে সাজিয়ে রাখা জগন্নাথ,বলভদ্র, আর সুভদ্রার ছোট ছোট মুর্তি। তরুণী প্রচন্ড রেগে শিশুটিকে হিড় হিড় করে টানতে লাগলেন। কিন্তু সে দু কদম মাত্র,রথখানা আলগোছে রাস্তার উপর নামিয়ে রেখে শিশুটি ততক্ষণে আগের মতই ভূমিশয্যা নিয়েছে, সঙ্গে গগনবিদারী কান্না আবার দুচার ঘা পড়ল বাচ্চাটার পিঠে । কিন্তু তাতে কেবল কান্না এবং রাস্তায় গড়াগড়ির বেগ বৃদ্ধি হল,ওর গাত্রোৎপাটনের লক্ষণ দেখা গেল না। প্রৌঢ়া তরুণীর আগুন ঝরা মুখের দিকে একবার অপরাধীর মতো সঙ্কুচিত দৃষ্টিতে চাইলেন। তারপর মৃদু স্বরে স্বগতোক্তি করলেন স্রিফ গুড়িয়াহি তো হ্যায়! আবার শুরু হলো দরাদরি। শিশুটি ততক্ষণে দোকানির হাত থেকে জগন্নাথ,বলভদ্র এবং সুভদ্রাকে নিয়ে রথের মধ্যে স্থাপন করতে ব্যস্ত। বোরখার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো একটা মলিন থলি, মেটানো হলো দাম। শিশুটি ততক্ষণে রথের দড়ি ধরে টানতে শুরু করেছে। চোখে জল, কিন্তু মুখে উপছে পড়া খুশী। রথের মধ্যে তিন মুর্তি নির্বিকার।

Loading

9 Comments

Leave A Comment

You cannot copy content of this page