অচেনা শক্তি
-মহেশ্বর মাজি
বিয়ের কদিন বাদেই বঙ্কু পাশের গাঁয়ে সনতদের সাথে ঘুরপথে সাইকেলে করে কয়লা ঠেলতে শুরু করল।
নতুন বউকে মাঝ রাতে একা ফেলে ছুটল, রুজির তাগিদে।
পুরনো সাইকেলটা ওরাই ওকে জোগাড় করে দিয়েছে।
রিংটা এক জায়গায় সামান্য বাঁকা।তাই মাল বেশি নেওয়া যায় না।
নতুন রিং এখন অনেক দাম।এভাবেই চালাতে হবে,কিছুদিন ।
মাত্র দু হাজার টাকায় সাইকেলটা ভালই জুটিয়েছে।
একটু কাজ অবশ্য করালো। কয়েকটা স্পোক আর বল বিয়ারিং লাগাতে শ তিনেক খসল।
প্রথম তিনদিন দু ধামা করে মাল নিয়ে, ঠেলাটা রপ্ত করতে হল।
তিনদিন পর থেকেই সেটা পাঁচ করে নিল।
প্রায় আড়াশো কেজি।
রাত তিনটেই খাদান থেকে মাল নিয়ে সাইকেলগুলো নিঃশব্দে ঝোপ,জঙ্গলের মাঝে সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়।
আবছা অন্ধকারে কোনরকমে ধুলোমাখা রাস্তাটা চোখে পড়ে।
দুদিকে ঘন ঝোপ,ঝাড়।চাঁদের আলো কখনো বাড়ে,কখনো কমে।ঝিঝি ডাকে।
শেয়ালগুলো গর্তে মুখটুকু বের করে একদল মানুষের জীবন সংগ্রাম দেখে।
কিছুক্ষণ তারাও চুপচাপ হয়ে যায়।
…একদিন বঙ্কুর মাথাটা হঠাৎ করে ঘুরে গেল। টাল সামালতে না পেরে ধপ করে সাইকেল সমেত জাকা পড়ল। সামনের বাজারে পুলিশের টহলদারি কড়া থাকে।ভোর পাঁচটার আগেই চাঁদমারি জঙ্গলটা শেষ করে পাঁকা রাস্তা ক্রশ করতে হয়।
পুলিশগুলো ঘামের গন্ধ পায়।তাই সারারাত বড়,বড় ট্রাকগুলো থেকে পকেট উচু করার পরও বাইক হাঁকিয়ে ক্রশিং-এর কাছটাই ভোরবেলাতে গন্ধ শুকে ঠিক এসে যাবে।
একশোটা টাকা না বাগিয়ে ছাড়বে না। পুরো সাইকেল ঠেলে অমানুসিক কষ্টের বিনিময়ে তিনশো টাকা হাতে আসে।
…আর পুলিশ এসে সেই টাকায় ভাগ বসালে মনটা তো ভেঙে যাওয়ারই কথা।
আগের তিনজন তাকে পিছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে গেছে। অন্ধকার রাস্তায় কেউ বেশি কথা বলে না।
এমন কি উজানে দুশো কেজির বোঝাটা টানার সময়ও বুকের দমটাকে আস্তে করে ছাড়তে হয়।
উজানটা শেষ হলেই একটা গ্রাম পড়ে।সেখানে আড়তদার বড়,বড় ওজনদাঁড়ি নিয়ে বসে থাকেন।
হাঁক,ডাক পেলেই তাদের লোক সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে যাবে।
সব মালটা তাদেরকে দিতে হয়।ওদের মুখের উপর কথা খাটে না। এক,একটা মাফিয়া।তাদের হাতে সবরকম লোক মজুত আছে। তাই কেউ প্রতিবাদ করে না।তাতে লাভটা কম হয়।তিনশোটা দুশোই ঠেকে।
… পুলিশ পড়লে।সেদিনটা আর ভাল যায় না।
…বঙ্কু পড়ে গেছে।মাথাটাকে ওঠানোর চেষ্টা করছে।পারছে না। লাটায়ের মত ঘুরছে।অন্ধকারটা আরো প্রগাঢ় হচ্ছে চোখের কাছটায়।
ওদিকে কয়লা বস্তায়,পাদুটো জাকা আছে।
চেষ্টা করেও টানতে পারছে না।
শরীরটা ঘেমে গেল।মাথার ভেতরে হাজারটা বোলতা যেন গুন্ গুণ্ করে উঠল।
চোখের অন্ধকারটা কাটল।
…তবু সাহায্যের জন্য বাকিদের ডাকার উপায় নেয়।ওর চিৎকার শুনে পুলিশের ভোরের চোখ জেগে যাবে।
একশো করে টাকা খসে যাবে।ওটা অনেক কষ্টের।
একশো টাকার মূল্য আজ বঙ্কু জানে।
ওর বউ মা হতে চলেছে।দিন দুই আগে খবরটা জানাল।
এখন তার অনেক দায়িত্ব।ডাক্তার নাকি তার বউকে ভাল,ভাল খাবার খেতে বলেছেন।
তবেই সন্তান হৃষ্টপুষ্ট হবে।
সেই রাতেই বঙ্কু মনে,মনে হিসেব করে নিয়েছিল।
বহালের ডাঙাটা এবছর লোক লাগিয়ে কাটাবে।কম করেও গাড়ি চারেক বাড়তি ধান ঘরে ঢুকবে।
তার বউ হাতের বালা জোড়া দিয়ে এঁড়ে বাছুরদুটো পাল্টে বলদ নেবে।
তাহলে বিঘা তিনেক জমি ভাগেও নিতে পারবে।
বঙ্কুর মনটা ছেড়া বিছানায় কই মাছের মত আনন্দে নেচে উঠেছিল।
বউটাকে দু হাতের আলিঙ্গনে ভরে,সেই রাতে এক ধামা ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিল।
এখন তার মুখটা,বঙ্কুর খুব মনে পড়ে গেল।দুঃখের ঘরে একখানা আলো নিয়ে এসেছে। অভাবের অন্ধকারেও ঘরটায় একটা আলো জ্বলে।
বউটা তার বড় আশাবাদী।স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে।দুঃখের আগুনটাকে মনের ভিতর জ্বলতে দেয় না।
বঙ্কু শেষ শক্তিটুকু জড়ো করে পা টা টেনে তুলল।
প্রচন্ড ব্যথা।এই অবস্থায় চলা যাবে না।
..হঠাৎ একদল মানুষের চিৎকার ভেসে এল।
মশাল জ্বালিয়ে এই জঙ্গলের দিকেই আসছে।
সামনে এলে সাহায্য চাওয়া যাবে।
..ক্রমে,ক্রমে আওয়াজটা পরিস্কার হয়ে বঙ্কুর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
হাতি…হাতি..হাতি!!
একদল হাতির পায়ের শব্দ তার দুকানে ভেসে এল।
বঙ্কুর বুকটা ধক্ ধক্ করে বাজছে।
মানুষগুলো আর এলো না।
বঙ্কুব গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
চেষ্টা করেও কাউকে ডাকতে পারছে না।
গলার স্বরটা হাল্কা শিসের মত বেরিয়ে এল।
সে পরিস্কার দেখতে পেল।একটা দৈত্যাকার হাতি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
বঙ্কু চোখ বুঁজে ফেলল।
..এই বার হাতিটি তাকে শুড়ে করে ধরে পায়ের তলায় পিষে দেবে।বুকটা থেতলে চলে যাবে।
বউ-এর হাসি মুখটা মনে পড়ল।
আর বোধহয় ঘর বাঁধা হল না।
একটু বাদেই বঙ্কু চোখ খুলল।দেখল হাতিটি তার সাইকেলটা শুড়ে করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
কাঁদতে,কাঁদতে হাতির একটা পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। তারপর নিজের পা দুটো টেনে সোজা করে নিল। শরীরটা ঝেড়ে, পেশিগুলোকে ঠিক জায়গায় বসিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডালটা সোজা করে ধরল।তারপর ঠেলতে শুরু করল।
পিছনে তাকিয়ে দেখল হাতিটি নেয়।
কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।
….একটু বাদেই ওর বাকি সাথিরা দৌঁড়ে এসে উপস্থিত হল।
এসেই হাঁপাতে,হাঁপাতে একজন বলে উঠল,কী হয়েছিল তোর?..এত দেরী কেন?
আমরা কখন থেকে তোর পথ চেয়ে বসে আছি।..আজ পুলিশগুলো একটাও নেই। ভোটের মিঝিল আছে। ওখানে চলে গেছে।
…পাশের গাঁয়ে চিতা ঢুকেছিল।জঙ্গলের দিকে তেড়ে এসেছে..শুনেই আমরা দৌঁড়ে এলাম।
…তোর যদি কিছু হয়ে যেত!
বঙ্কু অবাক হয়ে বলে উঠল,চিতা!…ওরা তো সবাই হাতি..হাতি বলে.চিৎকার করছিল।
—তোর মাথা খারাপ হয়েছে?..হাতি কেন আসতে যাবে?.. ওরা দূূর থেকে চিতা,চিতা বলছিল…তুই হয়ত হাতি শুনেছিস।
একজন টর্চটা বের করে জ্বালাল
—ইস!..পড়ে গেছিলি!…এত রক্ত পড়ছে!..এই অবস্থায় এত ভারি সাইকেলটা একা খাঁড়া করলি?…তোর বউ ঠিক কথায় বলে।শালা তুই একটা অসুর।..কেন আমাদের ডাকলে..সাড়া পেতিস না?
..দে..দে..সাইকেলটা আমাকে দে।তুই আস্তে করে আয়।
বঙ্কু বাকি কথাটুকু মনে,মনে চেপে গেল।কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই গেল।
ওর চোখে দেখা হাতিটা কী তাহলে মিথ্যে?… আর তা যদি হয়।তাহলে তার সাইকেলটা সোজা কে করল?
…আর যদি নিজেই করে থাকে।তাহলে ওরকম কেন মনে হল?
কিছু, কিছু জিনিসের আমরা যখন আগাগোড়া কিছু বুঝে উঠতে পারি না। তখন তা দৈব কৃপা বলেই ধরে নিয়।
…এক্ষেত্রেও তাই হল।
পরের দিন বঙ্কুর বউ, পোঁয়াতি অবস্থাতেও সারাদিন উপোশ করে গনেশ ঠাকুরের পুজো দিল।
——সমাপ্ত—-