Site icon আলাপী মন

বড়দিন

বড়দিন (রিং ডব্লিউ লার্ডনার)
অনুবাদে -বর্ণালী জানা সেন
রাত পোহালেই বড়দিন। বসার ঘরে বসে সময় আর কাটে না কার্টার দম্পতির…মানে টম আর গ্রেস কার্টার। সময় কাটাতে একটু গল্প করে…আর একটু পড়ার ভান। তাও ঘড়ির কাঁটা যেন আর নড়েই না। যে চিন্তাটা এখন তাঁরা মনে আনতে চান না সেটাই যেন আরো বেশি করে হানা দিয়ে যায় মনের কোণে। বড়দিনের ছুটিতে তাঁদের দুই ছেলে মেয়েই বোর্ডিং থেকে বাড়ি ফিরেছে। ছেলে জুনিয়র এই উনিশে পড়ল। মেয়ে গ্রেস দু বছরের ছোট। জুনিয়র এখন ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে। আর মেয়ে এখনও স্কুলে। এইবার কলেজে ঢুকবে।
বাপ মা শখ করে নাম রাখলে কী হবে জুনিয়র তার নিজের তার নিজের নামটা বদলে করেছে টেড। আর নাম বদলের পর তার বোণ গ্রেস এখন ক্যারোলিন। নতুন নামেই তারা বেশি স্বচ্ছন্দ। বাবা-মাকে তারা বলে দিয়েছে এই নতুন নামেই ডাকতে। বড়দিনের আগের রাতে বসার ঘরে বসে শুধু ছেলে-মেয়ের কথাই ভাবেন কার্টার দম্পতি…ভাবেন তাদের মতিগতির কথা। কী যে ওরা চায় কে জানে!
এখানকার আরো কত ছেলেই তো ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে। তারা তো দিব্যি একুশ তারিখে বাড়ি ফিরে এল। ওইদিনই তো ছুটি পড়ল। সবাই এল, এলনা শুধু টেড। এল তার টেলিগ্রাম। তার নকি কী সব জরুরি পরীক্ষা। পড়াশোনা নিয়ে সে সাংঘাতিক ব্যস্ত। তাই বাড়ি ফিরতে তার তার তিনদিন দেরি হবে। এই পরীক্ষায় উৎরোতে পারলে পরের টার্মে নাকি পড়ার চাপ অনেক কমবে। তারপর ফ্যাকেশে মুখ, চোখের তলায় এক পোঁচ কালি নিয়ে ছেলে যেদিন টলতে টলতে বাড়ি ফিরল তার মা তো রেগেই কাঁই। এই কচি ছেলেপুলেগুলোকে এত পড়ার চাপ দেওয়ার কোনো মানে হয়! পড়ে পড়ে বাছার শরীরের কী হাল হয়েছে! বাপের অভিজ্ঞ চোখ। তিনি যা বোঝার বুঝে যান। মনে শুধু একটাই চিন্তা। নেশা করার ঝোঁকে বিষাক্ত কিছু খেয়ে ফেলেনি তো ছেলে! হে ভগবান এই নেশার ঘোর যেন জলদি কেটে যায়। ছেলের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
মেয়েও বাড়ি ফিরেছে দেরি করে। তার নাকি জামাকাপড় সব এদিক ওদিক হারিয়ে গিয়েছিল। সেসব খুঁজে…গুছিয়ে গাছিয়ে তবে সে আসতে পেরেছে।
ছেলে মেয়ের বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় বাবা-মায়ের খুব মন খারাপ। তবে তাঁরা যথেষ্টই বিচক্ষণ। ছেলে মেয়ের কাছে কিচ্ছুটি প্রকাশ করেননি। এবার খুব জাঁকজমক করে বড়দিন পালন করবেন তাঁরা। নিজেদের কষ্ট ভুলে উৎসবের জন্য সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন। এবারের বড়দিনে ছেলে-মেয়েকে একেবারে চমকে দেবেন তাঁরা। ছেলে মেয়ের মুখে একটু হাসি…এর চেয়ে বড় পাওনা বাপ-মায়ের আর কীইবা আছে! ছেলেমেয়ের জন্য এবার প্রচুর উপহার কিনেছেন তাঁরা। টম যখন তাঁর নিজের ছেলের বয়সি ছিলেন তখন তাঁর বাপের সারা বছরে যা রোজগার ছিল তার দ্বিগুন কি তিন গুণ টাকা তিনি খরচ করছেন এই সব উপহারের পেছনে। বছর খানেক আগেও কি এত টাকা খরচের কথা ভাবতে পারতেন তিনি! তাঁর ভাগ্য তো ফিরল এই সেদিন। তার তৈরি নতুন ওয়াটার প্রুফ রংটা জেনারেল মোটর্স কিনে নেওয়ার পর। সেই দৌলতেই না শহরতলিতে আজ তাঁর এই বিশাল বাড়ি…এত বিলাসিতা…এত বৈভব। এই রাজকীয় বিলাসিতার কথা তাঁদের বাবা-মা কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছেন! আজ তাঁদের অবস্থা ফিরেছে। তাঁদের ছেলেমেয়েরা যে আরাম…যে স্বাচ্ছন্দ্য আজ পাচ্ছে তা তাঁরা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি।
ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়েছে মিউজিক রুমের ভেতর। পিয়ানোর ওপরে, পিয়ানোর বেঞ্চে, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সব উপহারের প্যাকেট। সব ঝলমলে রঙিন ফিতে দিয়ে মোড়া। কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়, কোনোটা ভারি, কোনোটা হাল্কা। একটা প্যাকেটের ওপর টম আরেকটা প্যাকেটের ওপর গ্রেসের নাম লেখা। চাকর-বাকরদের জন্যও রয়েছে গোটা কয়েক প্যাকেট। বাকি সব টেড আর ক্যারোলিনের। বিশাল এক বাক্সে ক্যারোলিনের জন্য রয়েছে সীলের চামড়ার কোট। আগে ভাড়া বাড়িতে থাকার সময় বছরে যত ভাড়া গুনতে হত তত টাকা দাম কোটটার। এতো কিছুই নয়। আরো বেশি টাকা খরচ করে মেয়ের জন্য গয়না কিনেছেন বাবা-মা। ওপালের* ব্রোচ…সোনার ওপর ওপাল বসানো ব্রেসলেট…আরেকটা ওপালের আংটি…তার চারপাশে আবার হিরে বসানো।
হিরে মুক্তো নয়…ওপালই গ্রেসের বরাবর পছন্দ। ইচ্ছে করলেই আজ তিনি নিজের জন্য ওপালের একখানা গয়নার সেট কিনতেই পারেন। কিন্তু কীসে যেন একটা বাধে। থাকগে মেয়ের জন্য কিনেই তাঁর সুখ। মেয়েকে এই গয়নায় সেজে উঠতে দেখেই তাঁর শান্তি। তারপর মেয়ের জন্য বাক্সভর্তি রেশমের মোজা, অন্তর্বাস, গ্লাভ আর রুমাল তো রয়েইছে। আর টেডের জন্যও কম কিছু নেই…তিনশো ডলারের ঘড়ি, বালজাকের রচনাবলীর ডিল্যুক্স সংস্করণ, স্টিলের পাত বসানো গলফ স্টিক…পোর্টেবল ফোনোগ্রাফ। আর আসল চমকটাই তো এখনও বাকি…সেটা রয়েছে গ্যারাজে। ঝাঁ চকচকে নতুন গাড়ি…কালো রঙের গরহ্যাম সেড্যান…যাকে বলে আভিজাত্যের শেষ কথা। এরপাশে টমের এক বছর পুরোনো গাড়িটাকে নেহাতই ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে। আবহাওয়া ভালো থাকলে এই ছুটিতে গাড়িটা নিয়ে টেড এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে পারবে। সামনের বসন্তে কি গ্রীষ্মের ছুটিতেও বাড়ি এসে গাড়িটা চালাতে পারবে। কিন্তু গাড়িটা ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যেতে পারবে না। ওখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের প্রাইভেট কার চালানো মানা।
টেডের তখন তিন বছর বয়স। আর ক্যারোলিনের এক। সেই তখন থেকে বড়দিনের আগের রাতে বাচ্চাদের মোজায় নানা রকমের খেলনাপাতি ঝুলিয়ে রাখেন টম আর গ্রেস। বাজার থেকে সস্তায় কেনা সব খেলনা। ষোলো বছর হয়ে গেল আজ। এবারই বা এটা বাদ যাবে কেন? মোজা ভর্তি খেলনা দেখলে ছেলে মেয়েরা মজা পাবে খুব। এবারে তাই মোজার ভেতরে ঢুকল একটা খেলনা পুতুল…নিগ্রো ডান্সিং ডল…মিউজিক বক্স…খেলনা বেড়াল…পেট টিপলেই সেটা আবার ম্যাঁও করে ডেকে ওঠে। ছেলে মেয়েদের আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে মা…বড়দিনের আগের রাতে কিন্তু লক্ষ্মী ছেলের মতো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। নাহলে কিন্তু সান্টা ক্লজ আর আসবে না।
মায়ের কথা শুনে সাত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার বান্দা ওরা নয়। ছেলে মেয়ে দুজনেরই আগে থেকে বন্ধুদের কথা দেওয়া আছে। শহরে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ওদের পার্টি খানা-পিনা রয়েছে। বিয়াত্রিস মার্ডকের সঙ্গে ক্যারোলিন বেরিয়ে গেল নাটক দেখতে। বিয়াত্রিসের সঙ্গে রয়েছে ওর উনিশ বছরের দাদা। নাটক দেখে রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরেই ওরা ফিরবে। ক্যারোলিনকে নিতে সাড়ে ছটার সময় বাড়িতে গাড়ি নিয়ে হাজির বিয়াত্রিসের দাদা। আর ওদিকে ক্লাশের দুই বন্ধু হার্ব ক্যাসল আর বার্নার্ড কিং-এর সঙ্গে টেড গেল হকি ম্যাচ দেখতে। বাবার গাড়িটা নিয়ে যেতে চেয়েছিল টেড। বাবাকে তখন একটু মিথ্যেই বলতে হল…গাড়িটার ব্রেকটা তো খারাপ হয়ে পড়ে আছে। টেডকে এখন কোনো মতেই গ্যারাজের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না…অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত। দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়েই টেড আর ক্যারোলিন পল মার্ডকের কেতাদুরস্ত রোডস্টারে হু…শ করে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় মাকে বলে গেল বারোটার মধ্যেই ফিরে আসবে…খুব বেশি হলে ঘণ্টা খানেক দেরি হলেও হতে পারে। আর আগামীকাল রাতে তারা বাড়িতেই থাকবে।
ছেলে মেয়েরা সেই কখন বেরিয়েছে। তাদের পথ চেয়ে বসে আছেন বাবা মা। ওরা না ঘুমোনো অবধি যে মোজাটায় খেলনা ভরে ঝোলানো যাচ্ছে না। ওরা যে টের পেয়ে যাবে! আর মনে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করার কোনো মানেই হয় না। মনে মনে অধৈর্য হয়ে ওথেন গ্রেস।
‘ কটা বাজে এখন’…রাতে খাওয়া দাওয়ার পর যে বইটা ‘পড়তে’ শুরু করেছিলেন তার তিন নম্বর পাতা থেকে মুখ তুলে স্বামীকে শুধোন গ্রেস।
‘ আড়াইটে’ ( বারোটার পর থেকে প্রতি পনেরো কুড়ি মিনিট অন্তর এই একই প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে তাঁকে)।
‘ ওদের কিছু হয়নি তো?’
‘ কিছু হলে আমরা জানতে পারতাম’…শান্ত গলায় জবাব দেন টম।
‘ এমনটা হওয়ার কথা নয়…কিন্তু ধরো এমন কোনো জায়গায় ওদের দুর্ঘটনা ঘটল যেখানে বাড়িতে খবর দেওয়ার মতো আশে পাশে কেউ নেই তখন কী হবে? মার্ডক ছেলেটা কেমন গাড়ি চালায় আমরা তো কেউ জানিনা’।
‘ না না ও তো টেডেরই বয়সি। এই বয়সের ছেলেপুলেরা একটু জোরে গাড়ি চালায় বটে…তবে ওরা ভালো চালায়। ওদের একটা দায়িত্ব আছে…চিন্তা কোরো না’।
‘ তুমি কী করে জানলে?’
‘ আমি ওদের কয়েক জনকে গাড়ি চালাতে দেখেছি’।
‘ সবাইকে তো আর দেখনি?’
‘ পৃথিবীর কজন দেখেছে শুনি?’
‘ আজকালকার ছেলেপুলেরা এত বেপরোয়া…কোনো কান্ডজ্ঞান নেই ওদের’।
‘ ওহ এত চিন্তা কোরো না তো। হয়তো ওদের আরো কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে…দেখো গে হয়তো কোথাও খাওয়া দাওয়া করছে একসঙ্গে’।
টম উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ান। ভালো করে চারিদিকটা জরিপ করে নেন… ‘আজকের রাতটা ভারি সুন্দর। আকাশের সব কটা তারা গোনা যাচ্ছে’। মখে বললে কী হবে। তারাভরা আকাশের দিকে তাঁর মন নেই। মনটা তাঁরও আজ বড় বিক্ষিপ্ত। থেকে থেকেই তাঁর চোখ চলে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। ওই দূরে কি কোনো গাড়ির আলো দেখা যায়! নাহ তাঁর মনের ভুল। আবার নিজের জায়গায় এসে বসেন তিনি।
‘ কী গো কটা বাজে’…ছটফট করে ওঠেন গ্রেস।
‘ কুড়ি মিনিট বাকি’।
‘ মানে? কীসের কুড়ি মিনিট?’
‘ তিনটে বাজতে’।
‘ তোমার ঘড়ি নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। তোমায় এক ঘণ্টা আগে জিগ্যেস করলাম। তুমি বললে আড়াইটে’।
‘ আমার ঘড়ি একদম ঠিক আছে। তুমিই ঘুমিয়ে পড়েছিলে’।
‘ মোটেই না। আমি দু চোখের পাতা এক করিনি’।
‘ না, তুমি করেছিলে। তুমি শুতে যাচ্ছনা কেন বল তো?’
‘ তুমিই বা যাচ্ছ না কেন?’
‘ আমার ঘুম পায়নি’।
‘ আমারও পায়নি। টম তোমার এভাবে জেগে থাকার কোনো মানেই হয় না। আমি তো জেগে আছি অন্য কারণে। আমাকে তো মোজাটার একটা সদ্গতি করতে হবে নাকি। আর তাছাড়া আমার ঘুমও আসছে না একদম…কিন্তু তোমার অমন হাঁ করে বসে থাকার কোনো মানে আছে কী?’
‘ ওরা বাড়ি ফেরা না অবধি আমার দু চোখের পাতা এক হবে না’।
‘কী বোকা বোকা সব কথা। এত চিন্তার কী আছে শুনি? বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে একটু আমোদ-আহ্লাদ করছে। তোমারও তো একদিন ওই বয়স ছিল নাকি?’
‘ যা বলেছ। যখন বয়স ছিল তখন ছিল’। খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে জাহাজের খবরগুলো পড়ার বৃথা চেষ্টা করে যান টম।
‘ হ্যাঁ গো কটা বাজে’…গিন্নি আবার সেই একই প্রশ্ন।
‘ তিনটে বাজতে পাঁচ’।
‘ ওরা কি রাতে মার্ডকদের ওখানে থেকে যাবে নাকি?’
‘তাহলে তো আমাদের একটা খবর দিত’।
‘ টেলিফোন করে আমাদের হয়তো ঘুম থেকে জাগাতে চায়নি’।
তখন তিনটে কুড়ি। সামনের গেটে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
‘ ওই তো ওরা এসে গেছে’।
‘ আমি বলেছিলাম না অত চিন্তার কিছু নেই’।
ছুটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান টম। রাস্তায় মার্ডকদের দামি গাড়িটার আবছা অবয়ব দেখা যায়। গাড়ির ভেতরে অন্ধকার। আলোগুলো কি সব খারাপ হয়ে গেল নাকি?
‘ গাড়িতে কোনো আলো নেই। বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। যাই গে একবার নীচে নেমে দেখি…আলোটা ঠিক করতে পারি কিনা’।
‘ না যেতে হবে না’। চেঁচিয়ে ওঠেন গ্রেস। ও ছেলে নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে খন। গাড়িটা তো এখন দাঁড়িয়েই রয়েছে। আলো জ্বালিয়ে শুধু মুধু ব্যাটারি পুড়িয়ে হবেটা কী?’
‘ ওরা ভেতরে আসছে না কেন?’
‘ হয়তো কোনো পার্টি টার্টির প্ল্যান করছে’।
‘ সে তো ঘরে বসেও করতে পারে’।
‘দাঁড়াও আমি এক্ষুণি নীচে গিয়ে ওদের বলছি যে আমরা এখনো জেগে আছি’।
এবারেও বাধা দেন গ্রেস… ‘ না না যেতে হবে না’।
গিন্নির কথা শুনে জানালার ধারেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন টম।
ঘড়ির কাঁটা তখন চারটে। হেড লাইট জ্বালিয়ে গাড়িটা চলে যায়। বাড়িতে ঢোকে ক্যারোলিন। বাবা-মাকে জেগে থাকতে দেখে সে অবাক।
‘ এ কী? তোমরা এত রাতে কী জেগে বসে রয়েছ কেন?’
টম একটা কিছু বলতে যান। কিন্তু গ্রেস থামিয়ে দেন তাঁকে… ‘এই আমরা বসে বসে একটু গল্প করছিলাম। ওই আগেকার ক্রিসমাসের কথা…অনেক দেরি হয়ে গেছে তাই না?’
‘ কে জানে …ঠিক বলতে পারব না’।
‘ কিন্তু টেড কোথায়?’
‘ সে কী? এখনও বাড়ি ঢোকেনি? আমরা তো ওকে হকি ম্যাচের ওখানে নামিয়ে দিয়েও চলে গেলাম। তারপর তো ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি’।
‘ ঠিক আছে তুমি শুয়ে পড়’…মা অভয় দেন মেয়েকে… ‘ তুমি খুব ক্লান্ত এখন’।
‘ হ্যাঁ ভীষণ। নাটকের পর আমরা অনেক নাচানাচি করেছি। কাল ব্রেকফাস্ট কখন?’
‘ আটটায়’।
‘ ওহ মা নটায় হয়না?’
‘ কেন হবে না। কিন্তু তুমি তো বড়দিনে সবসময় তাড়াতাড়ি উঠে যাও’।
‘ হ্যাঁ সে যাই…কিন্তু আজ …’
‘ কার সঙ্গে বাড়ি এলে?’ বাবা শুধোন মেয়েকে।
‘ কেন পল মার্ডক আর…আর বিয়াত্রিস’।
‘ তোমাকে খুব উস্কো খুস্কো আর এলোমেলো লাগছে’।
‘ ওই একটা ‘এলোমেলো’ সিটে বসতে দিল যে!’…নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেলে মেয়ে। তারপর বাব মাকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেয়। বাবা-মায়ের বেশি কাছে ঘেঁসার সাহস হয় না তার।
মেয়ে চলে যাওয়ার পর মুখ খোলে টম… ‘ মার্ডকদের আদব-কায়দা তো দারুণ। অতিথিকে বাড়ি বয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা লড়ঝড়ে সিটে বসিয়ে দিল’!
চুপ করে শুনে গেলেন গ্রেস।
‘ তুমি শুতে চলে যাও। আমি টেডের জন্য অপেক্ষা করছি…গিন্নিকে জানিয়ে দেন টম। কর্তার কথা শুনে হাঁ হাঁ করে ওঠেন গ্রেস… ‘ তুমি তো মোজাটার ব্যবস্থা করতে পারবে না’।
‘ আমি তো ওটাতে এখন হাতই দেব না। ওটা সকালে মানে বেলার দিকে করলেও চলবে’।
‘ সে যাই হোক তুমি শুতে না গেলে আমিও যাব না’।
‘ ঠিক আছে আমরা একসঙ্গেই যাব। টেডও মনে হয় একটু পরেই চলে আসবে। ওর বন্ধুরাই ওকে দিয়ে যাবে। ওরা এলে আমরা ঠিক গাড়ির আওয়াজ পাব’।
ছটা বাজতে দশে অবশেষে টেড যখন বাড়ি ফেরে তখন কারো টের পেতে আর বাকি রইল না। ক্রিসমাসের জন্য রাতভর অনেক কেনাকাটা করেছে ছেলে। হাতে মস্ত একটা প্যাকেট নিয়ে সে ঢুকল ঘরে।
সাড়ে সাতটায় নীচে নেমে চাকর বাকরদের নির্দেশ দিয়ে দেন গ্রেস…ব্রেকফাস্ট হবে নটায়। ফায়ার প্লেসের ধারে পেরেক পুঁতে মোজাটা ঝুলিয়ে দেন তিনি। এবার মিউজিক রুমে ঢুকে দেখে নিতে হবে সব ঠিকঠাক রয়েছে কিনা। টেডের টুপি আর কোটটা সরিয়ে নেন তিনি। মিউজিক রুমেই ওগুলো ফেলে চলে এসেছে ছেলে। নটার একটু আগে ওপর থেকে নেমে আসেন টম। গিন্নিকে বলেন এবার ছেলে মেয়েদের ডেকে দিতে।
‘আমিই ওদের ডেকে দিচ্ছি’ এই বলে গ্রেস চলে যান ওপরে। টেডের ঘরের দরজাটা আলতো করে খোলেন। ছেলে এখনও ঘুমে কাদা। ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে দরজাটা বন্ধ করে এবার ঢোকেন মেয়ের ঘরে। মেয়ের ঘুম এখনও পুরোপুরি ভাঙেনি। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। মাকে দেখে ঘুম জড়ানো গলায় আবদার করে ওঠে মেয়ে… ‘এখনই উঠতে হবে নাকি মা? মাইরি বলছি এখন দাঁতে কিছু কাটতে পারব না। মোল্লাকে বল না আমাকে একটু কফি দিয়ে যেতে। আজ আবার মার্ডকদের ওখানে ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন। সাড়ে বারোটার সময়…আরো দু-এক ঘণ্টা এখন ঘুমিয়ে নিতে পারব’।
‘ কিন্তু সোনা আজ যে একটার সময় আমাদের ক্রিসমাসের খাওয়া দাওয়া আছে’।
‘ ওহ মা খুব ভুল হয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম আমাদের খাওয়া দাওয়াটা রাতে’।
‘ তোমার উপহারগুলো দেখবে না?’
‘ হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেখব। তবে একটু পরে দেখলে হয় না মা?’
গ্রেস রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান। রাঁধুনিকে বলতে খাওয়া দাওয়া একটার বলে সন্ধে সাতটায়। কিন্তু তিনি তো সিগনেকে অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছেন যে বিকেলটা আজ ছুটি দিয়ে দেবেন। দুপুরে অত ভারি খাওয়া দাওয়ার পর সন্ধেটায় তিনি ভেবেছিলেন হাল্কাফুল্কা কিছু খাবার বানিয়েই চালিয়ে নেবেন।
ছেলেমেয়েরা কেউ নীচে নামেনি। প্রাতরাশের টেবিলে শুধু কর্তা গিন্নি। একা একাই খেতে হল তাঁদের। বসার ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে আবার একটু গল্প গুজব করেন…ভাবনা চিন্তা করেন। কখনো বা একটু পড়ার ভান। ছেলেমেয়েদের এই রকম সকম দেখে আর চুপ থাকতে পারেন না টম… ‘তোমার কিন্তু ক্যারোলিনের সঙ্গে এবার একটু কথা বলা দরকার’।
‘ সে আমি বলব। তবে আজ নয়। আজ যে বড়দিন’।
‘ আমাকেও টেডের সঙ্গে কথা বলতে হবে দেখছি’।
‘ সে বোলো কিন্তু আজ নয়’।
‘ আমার মনে হয় আজ রাতেও ওরা বেরোবে’।
‘ না না আজ রাতে ওরা বাড়িতেই থাকবে। আমাকে যে কথা দিয়েছে। সবাই মিলে আজ আমরা সন্ধেটা একসঙ্গে কাটাব’।
‘ আমি এখনও বলছি অত আশা করো না’।
ছেলেমেয়েরা যখন নীচে নামে তখন সন্ধে গড়িয়ে গেছে। বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে হামি দিয়ে বড়দিনে শুভেচ্ছে আর আদর জানাতে কোনো ভুলচুক হয়না তাদের। মার্ডকদের বাড়িতে ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন নেওয়া হয়ে গেছে সে জন্য মা-বাবার কাছে বারবার ক্ষমাও চেয়ে নেয় তারা।
‘ আমি আর বোন দুজনেই ভেবেছিলাম যে আমাদের খাওয়া দাওয়া সন্ধে সাতটায়…তাই আরকি’…সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করে টেড।
‘ এ বাড়িতে ক্রিসমাসের খাওয়া দাওয়াটা বরাবরই একটায় হয়’…ছেলেমেয়েদের খামখেয়ালিপনা দেখে আর চুপ থাকতে পারেন না টম।
‘আসলে আজ যে ক্রিসমাস সেটাই মাথা থেকে একেবারে বেরিয়ে গিয়েছিল’…টেডের একেবারে সোজাসাপটা জবাব।
‘ ওখানে ঝোলানো মোজাটা দেখেও কিছু মনে পড়ল না?’
এবার দু ভাইবোনেরই চোখ যায় খেলনাপাতি ঠাসা ওই মোজাটার দিকে।
‘কিন্তু মা আমাদের ক্রিসমাস ট্রি কোথায়?’
‘ রোসো রোসো সব আছে। আগে মোজাটা তো দেখ’।
‘ মা আমাদের হাতে আর একদম সময় নেই। এক্ষুনি বেরোতে হবে। আগে কি আমরা ক্রিসমাস ট্রি টা দেখতে পারিনা?’
‘ হ্যাঁ কেন পারবে না?’…ছেলেমেয়েকে নিয়ে মিঊজিক রুমের দিকে পা বাড়ান গ্রেস। চাকরবাকরদেরও তলব করা হয় ঘরে। সাজানো গোছানো ক্রিসমাস ট্রির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সবাই। মেয়েকে কাছে টেনে নেন গ্রেস… ‘তোমার উপহারগুলো দেখবে না?’
‘এখন সবকটা প্যাকেট খুলে দেখার সময় নেই মা। তুমি শুধু বল কোনটা স্পেশাল’।
বিরাট বাক্সটার মোড়ক খুলে মেয়ের ওভারকোট খানা বের করেন গ্রেস। আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে ক্যারোলিন… ‘ওহ মা করেছটা কী?’ এ যে সীলের চামড়ার কোট’।
‘ একবার পরে তো দেখো’ মেয়ের কাছে বাপের আবদার’
‘ এখন নর…পরে…এখন এখদম সময় নেই’।
‘ আরে এইটে তো দেখো’ এই বলে মেয়ের গয়নার বাক্স খোলেন মা।
‘ ও মা! এ যে ওপাল’।
‘ মণিমুক্তোর মধ্যে এইটেই আমার সবচেয়ে পছন্দের’।
‘ কেউ যদি কিছু মনে না করে আমি একটা কথা বলি…মাঝপথে নাটকীয় গলায় বলে ওঠে টেড … ‘আমি ফিরে আসার পর এই উপহারের প্যাকেট ট্যাকেট খুলব। তোমরা আমায় যা দিয়েছ সবই খুব পছন্দ হবে আমার। আর গাড়িটা যদি ঠিক না থাকে তাহলে তো আমাদের ট্যাক্সি ডাকতে হবে…তারপর ট্রেন ধরতে হবে…সে অনেক ঝক্কি’।
‘ মনে হয় গাড়িটা ঠিকই আছে। একবার এসো তো আমার সঙ্গে গ্যারাজে। দেখি গাড়িটার কী হাল। হ্যাট কোট চাপিয়ে টেড একেবারে বেরোনোর জন্য তৈরি। মাকে আলতো করে চুমু খেয়ে এবার সে বেরিয়ে পড়ে… ‘ওহ মা খুব ভুল হয়ে গেছে। তোমার আর বাবার জন্য তো কোনো উপহারই আনা হয়নি। কলেজে শেষ তিনদিন তো দম ফেলারই ফুরসৎ পাইনি। ভেবেছিলাম কাল রাতে একটু কেনাকাটা করব। কিন্তু বাড়ি ফেরার তাড়াতে মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে গেল। তারপর দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেল সব’।
ছেলেকে সান্ত্বনা দেন মা… ‘ওহ সোনা অত ভাবতে হবে না। ক্রিসমাস তো তোমাদের মতো ছেলেপুলের জন্য। আমাদের বয়স হয়েছে। আমাদের উপহার টুপহার না হলেও চলে’।
চাকর বাকরেরা এসে তাদের উপহারের প্যাকেট নিয়ে মালিক মালকিনকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে যে যার মতো সরে পড়ে।
মিউজিক রুমে এখন শুধু মা আর মেয়ে।
‘ আচ্ছা মা কোন দোকান থেকে কোটটা কিনেছ’।
‘ কেন? লয়েড অ্যান্ড হেনরিজ’।
‘ ওরা সব ধরণের পোশাক আশাক রাখে তাই না?’
‘ হ্যাঁ’।
‘ মা, আমি যদি এটা বদলে অন্য একটা নিই তুমি কি খুব রাগ করবে?’
‘ একদম নয় সোনা। তোমার যেটা খুশি নিতে পার। তবে এটা একটু বেশি দামি তো! তবে তাতে কিছু যায় আসে না। তোমার পছন্দ হলেই আমি খুশি। কাল বা পরশু আমরা একসঙ্গে তাহলে শহরে যাব। কিন্তন মার্ডকদের বাড়িতে ওপালের গয়নাগুলো পরে যাবে না?’
‘ না মা। কোথায় হারিয়ে ফেলব…তাছাড়া গয়নাগাঁটি পরতে আমার অত ভালো লাগে না’।
‘ তাহলে ওগুলোও বদলে নেওয়া যাবেখন। যাও তৈরি হয়ে নাও। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে’।
এই কথাটা শোনারি অপেক্ষায় ছিল ক্যারোলিন। একছুটে চলে যায় সে। একা ঘরে গ্রেসের মাথায় কত হাবিজাবি ভাবনা খেলে যায়।
ওদিকে ছেলেকে নিয়ে গ্যারাজের দরজা খোলেন টম। গ্যারাজে পাশাপাশি দুটো গাড়ি দেখে। একটু অবাকই হয় টেড… ‘ বাবা দুটো গাড়ি কবে থেকে হল’।
‘ নতুনটা আমার নয়’।
‘ তবে কার?’
‘ তোমার। এক্কেবারে নতুন মডেল’।
‘ বাবা, এ তো দারুণ চমক। কিন্তু এটাকে তো পুরোনোটার মতোই দেখতে’।
‘ পুরোনো গাড়িটা তো দারুন কাজের। তবে তোমারটা আরো ভালো। গাড়িটা চালিয়ে বুঝবে কী আরাম! মনে হবে পাখির মতো আকাশে উড়ছ। গাড়িতে গ্যাস ভরে দিয়েছি আমি’।
‘ বাবা আমি পুরোনোটাই নিয়ে যাই কেমন?’
‘ কেন? পুরোনোটা কেন নেবে?’
‘ বাবা, আসলে আমার বার্নেস স্পোর্টস রোডস্টারের খুব শখ…ওই পল মার্ডকের যেমন আছে। শুধু রংটা একটু আলাদা হলেই আমার চলবে। তাই এই গাড়িটায় হাত না দেওয়াই ভালো। তাহলে তুমি এটা ফেরত দিয়ে দিতে পারবে বা বার্নি কোম্পানিকে এই গাড়িটা দিয়ে সস্তায় একটা রোডস্টার পেয়ে যেতে পারো’।
অনেকক্ষণ কোনো কথা যোগায় না টমের মুখে। রীতিমতো বুরবক বনে গেছেন তিনি। অনেক পরে মুখ খুলতে পারেন… ‘ আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। আমার গাড়িটাই নিয়ে যাও। দেখি তোমার গাড়িটা নিয়ে কী করা যায়’।
দাদার জন্য অপেক্ষা করছিল ক্যারোলিন। হঠাৎ কিছু একটা মনে মাকে ডেকে ওঠে… ‘ ওহ মা আমার একদম মনে ছিল না। তোমার আর বাবার জন্য এই দুটো টিকিট… “জলি জেন” এর। কাল রাতে এই নাটকটাই তো আমরা দেখলাম। দারুণ। তাই তোমাদের জন্য টিকিটটা নিয়ে এলাম। তোমাদের খুব ভালো লাগবে দেখে নিও’।
‘ কিন্তু নাটকটা কখন?’
‘ কেন? আজ রাতে’।
‘ কিন্তু সোনা, আজ তো আমরা কোথাও বেরোব না। তোমরা কিন্তু কথা দিয়েছ আজ বাড়িতে থাকবে’।
‘ আমারা আমাদের কথা রাখব’…জবাব দেয় ক্যারোলিন। কিন্তু সন্ধেবেলা মার্ডকরা আসতে পারে। ওরা আরো কয়েকজন বন্ধু বান্ধবকেও আনবে। এখানে নাচা গানা হবে। জোরে গান চলবে। আই আমি আর টেড ভাবলাম এই এই হই হট্টগোলে তোমাদের হয়তো আসুবিধে হবে। তাই সন্ধেটা তোমরা যদি বাইরে কাটিয়ে আস…’
‘না না সোনা এ কী কথা! আমাদের কথা ভেবে নাটকের টিকিট এনেছ তাতেই মন ভরে গেছে। তোমরা একটু আমোদ আহ্লাদ করবে তাতে আমাদের আবার কী আসুবিধে হবে? তোমাদের আনন্দেই আমাদের আনন্দ।
‘ না না তা নয়। ভাবলাম তুমি আর বাবা একসঙ্গে একটু নিজেদের মতো করে একটু ভালো সময় কাটাতে পারবে…তাই আনলাম এই টিকিটটা’।
‘ আমাদের সবচেয়ে ভালো সময় কাটে তো তোমাদের নিয়ে…আমাদের দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে আমরা সারা সন্ধে গল্পগুজব করে কাটাব…এর চেয়ে ভালো কিছু তো আমি ভাবতেই পারিনা’।
‘ আসলে মা জানো তো মার্ডকরা নিজেরাই যেচে এই নেমন্তন্নটা নিল। ওরা নিজেরাই আসবে বলল। আমি তো আর মুখের ওপর না বলতে পারি না। ওরা এতবার আমাদের নেমন্তন্ন করেছে। সত্যি বলছি মা, নাটকটা কিন্তু তোমাদের দারুণ লাগবে’।
‘ রাতে বাড়িতেই খাবে তো?’
‘এখনও পর্যন্ত তো তাই ঠিক আছে। তবে আমাদের যদি একটু দেরিও হয় তুমি আর বাবা একটু অপেক্ষা করবে না? সাতটা কুড়ির ট্রেনটা ধরে নাও…সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে। একটাও সিন আর মিস করতে হব না। মা নাটকের প্রথম অ্যাক্টটা কিন্তু সত্যিই দারুণ। আমাদের মনে হয় খিদে পাবে না। তাও সিগনেকে হালকা কিছু একটা বানিয়ে দিতে বোলো…যদি খেতে ইচ্ছে করে’।
ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে যায়। চর্ব চোষ্য সাজিয়ে বড়দিনের ভোজে বসেন টম আর গ্রেস। মুখে কেউ বিশেষ কিছু তুলতে পারেন না। ষোলো পাউন্ডের টার্কির রোস্ট দেখের জিভে তাঁদের জল এল না। আসলে খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেছে তাঁদের। একটু কিছু মুখে তুলতে হয় তাই খেতে বসা। সিগনের হাতের রান্নাটা আজ বেড়ে হয়েছে…আকাশ আজ বেশ পরিষ্কার…এই নিয়ে টুকটাক কথা চলে তাঁদের। ছেলেমেয়ে আর বড়দিনের প্রসঙ্গ কেউই পারতপক্ষে তোলেন না।
আজ ছুটির দিন। বাড়িতে কিছু করারও নেই। তার ওপর হাতে দুখানা থিয়েটারের টিকিটও রয়েছে। দেখে আসাই যাক। ছটা দশের ট্রেনটা ধরলেই হবে। আর রাতের খাওয়ারটা না হয় মেট্রোপলেই হয়ে যাবে। টমের এই প্রস্তাবে গিন্নি কিছুতেই রাজি নন। ছেলে মেয়ে ফিরে যদি দেখে বাড়ি ফাঁকা তাহলে যে ওদের মন খারাপ হবে। কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নেন টম।
কর্তা গিন্নি বাড়িতেও বসে থাকেন। অনন্ত সময় যেন আর কাটেনে। সন্ধে সাতটা বেজে যায়। ছেলে মেয়ের টিকির দেখা নেই। অগত্যা তাঁরা ট্যাক্সি ধরে সোজা স্টেশনে চলে যান। তারপর ট্রেন ধরে শহরে। যাওয়ার পথে দুজনে গম্ভীর। কথাবার্তা হলনা বিশেষ। গ্রেস ভেবেছিলেন নাটকটা দেখে মনটা অন্তত ভালো হবে। কিন্তু এত রদ্দিমার্কা নাটক তিনি জীবনে দেখেননি। ওই যে দুটো নাটক আছে না ‘ক্র্যাডল স্ন্যাচার্স’ আর ‘সেক্স’…ওগুলো সবচেয়ে বাজে জিনিসগুলো নিয়ে জগাখিচুড়ি পাকানো একটা নাটক। যাচ্ছেতাই!
কোনো মতে নাটক শেষ হতেই টম বলে… ‘এখন আমি আমি আমার গিন্নিকে কোভ ক্লাবে নেমন্তন্ন করছি। সকালে, দুপুরে, সন্ধেতে তুমি কিচ্ছু ভালো করে মুখে তোলোনি। এই উৎসবের দিবে তোমায় আমি অনাহারে রাখতে পারিনা। আমারও বাবা খুব খিদে পেয়েছে…তার ওপর তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে’।
স্পেশাল থালি অর্ডার দিয়ে খাওয়ার শেষ করতে দুজনেরই নাকানি চোবানি অবস্থা। তেষ্টা মেটাতে পর পর ছয় পেগ হাই বল* নিয়ে নেন টম। তাও যেন মনটা ফুরফুরে হয়না। থেকে থেকেই কেমন যেন গুমরে ওঠে ভেতরটা। গ্রেসও হাই বল নেন এক পেগ। মনটা ক্ষণিকের জন্য একটু খুশি খুশি লাগে। ফেরার পথে ট্রেনটা যত বাড়ির দিকে আসে মনটা কেমন যেন তিতকুটে লাগে।
বাড়ি ফিরে দুজনেরই চোখ কপালে। বসার ঘরের একেবারে ছত্রখান অবস্থা…যেন খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে একটা। টেড আর ক্যারোলিন অবশ্য নিজেদের কথা কিছুটা হলেও রেখেছে। তারা বাড়ি থেকে বেরোয়নি। মার্ডকরা যেখান থেকে যত পারে বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে এনেছে। ঘরের অবস্থা দেখেও মালুম হয়। টেবিলে মেঝেতে ফাঁকা গেলাস গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঘরময় ছাই আর সিগারেটের টুকরো। পেরেক থেকে খেলনা ভরা মোজাটা কে যেন আনাড়ি হাতে ছিঁড়ে নামিয়েছে। খেলনাগুলো সব মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে। গ্রেসের প্রিয় কার্পেটে দুটো বড় বড় ফুটো…সিগারেটের ছাই টাই পড়েছে বোধহয়।
গিন্নিকে হাত ধরে মিউজিক রুমে নিয়ে যান টম… ‘তুমি কিন্তু তোমার উপহারের প্যাকেটটা এখনও খোলোনি’।
‘ সে তো তুমিও খোলোনি…ওরা এই ঘরে আসেনি। খুব একটা নাচা নাচা মনে হয় হয়নি’।
গিন্নির কাছ থেকে নিজের উপহারটা নেন টম। উৎসব অনুষ্ঠানে পরার জন্য হিরে বসানো কাফ বোতাম। আর কর্তার কাছ থেকে গ্রেস পেলেন ওপালের আংটি।
‘ওহ টম। কী দারুণ!’
আজ তাঁদের উৎসব। শুধু তাঁদের দুজনের।
‘ চল কাল রাতেই কোথাও বেরিয়ে পড়ি। তাহলে এই জিনিসগুলোও পরা হয়ে যাবে’।
‘ হ্যাঁ তার জন্য আজ রাতে ভালো করে বিশ্রাম নিতে হবে’।
‘ তুমি ওপরে যাও আমি এক্ষুনি আসছি’।

‘ বড়দিন’ গল্পটি রিং ডব্লিউ লার্ডনারের ‘ওল্ড ফোকস ক্রিসমাস’ গল্পের অনুবাদ।
• এক ধরণের অ্যালকোহল মেশানো পানীয়।

Exit mobile version