প্রতীক্ষা
-চিন্ময় মহান্তী
ছেলেটা বসে থাকে বিমর্ষ বিকেলে পড়ন্ত রোদ গায়ে মেখে।
আজ আর তাকে ডাকার মতো কেউ নেই , সব হারিয়ে গেছে ! স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে আবদার করার কেউ নেই ! ‘ মা ,বাবা অফিস থেকে ফেরেনি ? ‘ জিজ্ঞেস করারও কিছু নেই ! ছেলেটাকে স্কুলে দিতে যাওয়ার পথে সেই আন্টির সঙ্গে বাবার দেখা করার কারণটা আজ ছেলেটার কাছে পরিষ্কার। আন্টির দেওয়া লজেন্স খেয়ে সেদিনের খুশি আজ ছেলেটার চোখের জল। অপলক দৃষ্টিতে ছেলেটা তাকিয়ে থাকে আকাশে উড়ে যাওয়া বকের সারির দিকে। বকের উড়ে যাওয়ার মতো কেন উড়ে গেল তার বাবা ? তার কোনো সঠিক তত্ত্ব খুঁজে পায় না ছেলেটা।
বাবা চলে যাওয়ার পর তাকে বুকে করে মা চলে এসেছিল ছেলেটার মামাবাড়ি , কিন্তু সেখানেও তাদের সেদিন কেউ ঠাঁই দেয় নি। অসহায়তার দিনে আপন জনের দুরে সরে যাওয়ার এক মূর্ত চিত্র সেদিন সে দেখেছিল। দাদু দিদা জীবিত থাকলে কি হতো তা নিয়ে ভাবার সময় হয় নি ,মামীর মুখের সরাসরি , ‘ উপরি কারো জন্য এই ঘরে জায়গা নেই ‘ বলাতে। মামার অপ্রতিবাদী মুখে ছেলেটা সেদিন দেখেছিল পুরুষের স্ত্রৈণ রূপ। মা সেদিন কাঁদতে কাঁদতে তাকে কোলে করে ফিরে এসেছিল এই বাসায়। তারপর থেকে একবারের জন্যও কারও কাছে হাত পাতে নি। সেলাই শিখেছিল পুষ্পা কাকীমার কাছে।
সূর্যটা ডুবে গেল মেঘের ওড়না সরিয়ে নীল আকাশের বুকে। ছেলেটা উঠে হাঁটতে শুরু করল সেই দিকে , যেখানে আজও সন্ধ্যা কালে প্রদীপ জ্বালিয়ে তার মা , স্বামী ও পুত্রের মঙ্গল কামনা করে। ছেলেটার ভীষণ রাগ হয় যখন পূজো দিতে গিয়ে মা , বাবার নামে পূজো দেয়। সে একদিন মাকে বলেওছিল , ” তুমি যার মঙ্গলের জন্য আজও ব্রত করো সে তো তোমার কথা ভাবে নি। ” উত্তরে মা বলেছিল , ” সে না ভাবুক , তবুও তো সে তোর বাবা। ” তারপর ছেলেটা দেখেছিল মায়ের চোখে জল। মা কষ্ট পাবে ভেবে আর কোনোদিন সে বাবার বিষয়ে কথা বলেনি। অনেক সুহৃদ ব্যক্তি মাকে উপদেশ দিয়েছিল থানা পুলিশ করতে , মা তখন ছেলেটাকে দেখিয়ে বলেছিল , ” থানা পুলিশ করে কি করবো ? আমাকে তো সে একটা দামী উপহার দিয়ে গেছে। ভুল বুঝলে নিশ্চই একদিন ফিরে আসবে ! ”
ঘরে ঢুকে ছেলেটা দেখে মা দেওয়ালে টাঙ্গানো বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বলছে , ” তুমি কি আর কখনো ফিরবে না সৌম্য , আমি যে আজও তোমার প্রতীক্ষায় বেঁচে আছি। ” ছেলেটার উপস্থিতি টের পায় না মা। মাকে দেখে ছেলেটার রাগ হয় সেই লজেন্স আন্টির প্রতি। ফিরে এসে বসে উঠানের টগর গাছটার তলে। মনে পড়ে এই গাছটার তলে তার বাবা ঘোড়া হতো আর সে পিঠে চড়ে উঠানময় ঘুরতো। কতই না রঙ্গিন ছিল সেই দিনগুলি। ছেলেটার মনে প্রশ্ন জাগে ,” বাবার কি মনে আছে সেই দিনগুলির কথা ? ” সে দু’ হাতের তালু দিয়ে মুখটা ঢেকে বলে , ” বাবা তুমি একবার এসো , আমরা দুজনে মিলে সেই পুরনো ঘোড়া ঘোড়া খেলাটা একবার খেলি। ” তার আকুল আবেদন আকাশে বাতাসে ভাসতে থাকে। দরজার সামনে রজনীগন্ধার কুঁড়িগুলো ধীরে ধীরে পাঁপড়ি মেলতে শুরু করে।