সকালে অনুর বৈশাখ
-অমল দাস
সুমনা রান্না ঘরে বাটনা বাটছে ঠিক সেই সময় বাইরে খেলা ছেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে একছুটে দৌড়ে ঘরে এসে ঝপ করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো নয় বছরের অনু, মা সেই জড়িয়ে ধরার ধকল সইতে গিয়ে প্রায় পড়েই যায়, তবু নিজেকে কোন মতে সামলে নিয়েছে।
–“ ও মা আমায় একটা জামা কিনা দিবা… ওরা সবাই কিনছে…কাইলকে প..লা বৈশাখ, সবাই বইলছে নতুন পরতে হ্য়। আমার তো একটাও নতুন নাই… একটা নতুন এনে দিবা.. মা…”?
অনুর এই আব্দার শোনা মাত্র সুমনার চোখে মুখে এক চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল। সে যেন এক হঠাৎ ঘনিয়ে আসা মেঘ যাতে বৃষ্টিও ঝরছে না, আকাশও মেঘমুক্ত হচ্ছে না। সন্তানের ভালো কে না চায় কিন্তু সুমনা আর কানাইয়ের ঘরে যে আচার অনুষ্ঠান মানেই এক যন্ত্রণা তা কি আর ওই ছোট্ট শিশু বোঝে। তবুও সুমনা মেয়ের গালে একটা হামি দিয়ে মন ভোলানোর চেষ্টা করে। বলে -“মা তোমার তো একখান নতুন আছে.. তুমি ওইটা পরবা, ওইটা তো খুব সুন্দর।”
-“ না মা আমি ওইটা পরছি, একটা নতুন দিবা , বল দিবা…?”
অনুর এই আদুরে সুরের কাছে সুমনা আর কিছু বলে উঠতে পারল না। শুধু বলল, “ঠিক আছে, বাবা আসুক বলে দিবো। যাও এখন খেলা কর”।
অনু ছুটে বাইরে গিয়ে খেলতে খেলতে সবাইকে বলে চলেছে “এই তোরা জানিস… আমার বাবাও জামা আনবে… আমার মা বলছে দেখবি আমিও কাল নতুন জামা প..র..বো ”।
ছোট্ট অনুর মনে এই ঝরে পড়া আনন্দের সুর বয়ে চলা বাতাসের মাধ্যমে সুমনার কানেও পৌঁছলো । কিন্তু তাতে আনন্দিত হওয়ার কিছুনেই বরং চিন্তার ঝুলিটা আর একটু বেড়ে গেল। মেয়ের এই হাসি আনন্দকে বাস্তব রূপ দেওয়ার চিন্তা।
মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ছোট্ট এক মাটির ঘরে সুমনা ও কানাই-এর ১১ বছরের বিবাহিত জীবনের সুখী সংসার। কানাই পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ছাতা সারাইয়ের কাজ করে। কানাইয়ের আয়ের কোন নিশ্চয়তা নেই ,কখন ১০০ টাকা হয় তো কখন ৫০ টাকা আবার কোন কোন দিন হয়তো কিছুই হয়না। আর এই অনিশ্চয়তার আয় কে পুঁজি করেই এক জটিল হিসাব কষে বর্ধিত দ্রব্য মূল্যের সমাজে ওদের বেঁচে থাকা।
আমাদের পূজো পার্বণ যেমন গরীব বড়লোক দেখে আসেনা, ঠিক তেমনি টাকাও ধনী গরীব দেখে তাঁর রাস্তা মাপে না। কারণ একজন ধনী ব্যাক্তি যদি এক কিলো মসুরডাল ১২০ টাকায় ক্রয় করে তবে গরীব ব্যাক্তিকেও ওই একই দাম ব্যয় করতে হবে। যদিও এতে কারো দোষ নেই , দোষ যদি থাকে তা আছে আমাদের সামাজিক ও আর্থিক বণ্টন ব্যবস্থায়। তাই গরিবের ঘরে আচার অনুষ্ঠান স্বাভাবিক ভাবেই একটা বৃহৎ চিন্তার বিষয়।
প্রতিদিন সকাল বেলায় হালকা টিফিন সেরে বেরিয়ে পরে কানাই রুজি রোজগারের জন্যে। সঙ্গে দুপুরে খাওয়ার ভাতও নিয়ে যায়। এই প্রখর রৌদ্রে পায়ে হেঁটেই তাকে মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়াতে হয়। ক্লান্তিকেও সে হার মানায় । সূর্যকে যেন জয় করে সে নিজের থলিতে লুকিয়ে রেখেছে। সূর্যের প্রখর উত্তাপ যেন কিছুতেই ভীত করতে পারছেনা কানাইকে । ভীত হলেই বা চলবে কি করে, তাকে নিজেকে, সুমনাকে আর দুষ্টু মিষ্টি অনু কে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে জীবন যুদ্ধে।
বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় সন্ধ্যা কানাই ফিরে এসে বারন্দার দাওয়ায় বসলো। সুমনা এক গ্লাস নুন লেবুর জল এনে দিলো কানাইয়ের হাতে । ইতিমধ্যে তার সুখের সংসারের সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ ছোট্ট অনু কানাইয়ের কোলে আশ্রয় নিলো। মেয়ের এই স্পর্শে সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল কানাইয়ের শরীর থেকে।
অনু বলে উঠে “ বাবা কাইল সকালে বৈ….শাখ , রাত হই যাবে আমার জামা আনি দাও, মা বলছে তুমি আনবা… কই আনছ”।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানাই বলে –“ হ্যাঁ মা আনব”।
এই কথা শুনেই ছোট্ট অনু বাবার গালে আদরের চুম্বন দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে- “বাবা…. তুমি আমার ভালো বাবা”।
অনুকে বুকে আগলে ধরে এক নিস্পলক দৃষ্টিতে কানাই সুমনার দিকে তাকিয়ে থাকে। এ এক গরিবিয়ানার শুভদৃষ্টি যা নিমেষের মধ্যে হৃদয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের আশা আশঙ্খার প্রকাশ ঘটায় । সে কঠিন দৃশ্য সামনে থেকে দেখলেই মননশীল মানুষ অনুভব করতে পারে। যাই হোক কাল নতুন বছর নতুন দিন একমাত্র মেয়ের আব্দার পূরণ করতেই হবে , পিতৃস্বত্তা তো তাই বলে।
-“ টাকা আছে সুমনা ? থাকলে দেও” নরম সুরে কানাই। কানাইয়ের জমা পূঁজির হিসাব সুমনার কাছেই।
-আছে,… কিন্তু….!
এই “কিন্তু” সুমনার সংসারের আগামী কয়েক দিনের দৈনন্দিন হিসাব ব্যক্ত করে। ঘরের চালে লুকিয়ে রাখা পুঁটলিটা বার করে সুমনা, তাতে ২৫০ টি টাকা আছে । ৫০ টাকা রেখে বাকি টাকা কানাইয়ের হাতে তুলে দেয় সেটা কানাই জানতেও পারলো না।
পকেটে হাত দিয়ে গুনতেই দেখা যায় আজ সারা দিনের আয় ১২০ টাকা । অতএব আর দেরি না করে ৩২০ টাকা নিয়ে সে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
ঘণ্টা দুই পর কানাই ফিরে এসে পোশাকটি অনুর হাতে তুলে দিলে এতে আনন্দে আত্মহারা শিশু মনের অনু । তার চোখে মুখে খুশির আর ভাঁটা নেই। সে এক উত্তাল উজান স্রোত। যা দেখে সুমনার চোখে জল ছলছল করছে। এটাই তো তার মাতৃত্ব, মেয়ের আনন্দে তার হৃদয়ও আনন্দে বিগলিত। মেয়ের এই খুশি কানাইের চোখে মুখেও ফুটে ওঠে সে অনু কে জড়িয়ে ধরে পিতৃ স্নেহের চুম্বন দেয়।
রাতে বিছানায় সুমনা বলে ওঠে-“ পোশাক টা তো ৬০০-৭০০র কম নয়!”
-হম ! ৭০০ টাকা নিছে। উত্তর দেয় কানাই।
-“বাকি টাকা কোথায় পাইলে ? কেউ ধার দিলো…” ?
-“না ঘড়িটা বেঁইচা দিছি ৪০০ টাকায়”।
এই বলে কানাই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
সুমনা আর কোন কথা জিজ্ঞাস করলো না। ঘড়িটা বিক্রিতে কানাইয়ের মনে যে কষ্ট ছিল সেটা বুঝতে পেরেছিল সুমনা।
দাদুর দেওয়া একটা ব্রিটিশ যুগের চেন দেওয়া পকেট ঘড়ি ছিল কানাইয়ের কাছে। পছন্দের বলো বা দাদুর স্মৃতি বলো সম্পদ বলতে ওই একটাই ছিলো। যা এতদিন কানাই আগলে রেখেছিলো। ওই ঘড়িই ছিলো তার সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের সঙ্গী। সে-ই বেলা শেষে বলে দিত এখন ফিরতে হবে অনুর কাছে সুমনার কাছে। ওই ঘড়ির দ্রব্য মূল্য হয়তো বিশেষ নেই কিন্তু ঘড়িটি ছিলো দুর্লভ সেটাই ছিলো তার মূল্য। কিন্তু এই মূল্য তো তার অনুর কাছে কিছুই না । অনুর মুখের হাসি তাকে বিশ্বজয় দিতে পারে, তাই সে ঘড়ি যতই দুর্লভ হোক না কেন এক পিতার কন্যার কাছে সেটা মূল্যহীন। কাল পয়লা বৈশাখ এক নতুন দিনের শুরু সে শুরুটা হোক প্রত্যেক পিতার সন্তানের আনন্দের মধ্যে দিয়ে।
=সমাপ্ত=
👌♥️♥️