সুমনের লাল প্রীতি

সুমনের লাল প্রীতি
-চিন্ময় মহান্তী


পরমানন্দের শিশুপুত্র দুধ পান করিতে না চাহিলে , তাহার মাতা তাহাকে কোলে করিয়া লইয়া গিয়া মঙ্গলা গাভীর সদ্যজাত বাছুরটির প্রতি পুত্রের মনোনিবেশ করাইয়া দুধ পান করাইয়া থাকে। নিত্য এইরূপ করিতে করিতে পরমানন্দের পুত্রের ইহা অভ্যাসে পরিনত হইয়াছে। মাতাকে গোঁদোল হাতে দেখিলেই সে মঙ্গলা গাভীর বাছুরটির প্রতি তর্জনী অঙ্গুলি দ্বারা নির্দেশ করে। ইহা দেখিয়া পরমানন্দ মধ্যে মধ্যে তাহার স্ত্রীর প্রতি রুষ্ট হইয়া বলে , ” এটা ভালো করছো না মন্দিরা ! ওর মনটা অন্য দিকে ঘুরে যাবে।”  মন্দিরা স্বামীর কথা এক কানে লইয়া অপর কান দিয়া বাহির করিয়া দিয়া আপন সুবিধাটি বুঝিয়া লয়। বাছুরটির নিকট লইয়া গেলে পুত্রকে দুধ পান করাইতে তাহাকে বিশেষ বেগ পাইতে হয় না। উক্ত কারণে ইহা বন্ধ করিতে মন্দিরার বিশেষ আগ্রহ লক্ষিত হয় নাই। 


বর্তমানে পরমানন্দের পুত্র গুটি গুটি হাঁটিতে শিখিয়াছে। মন্দিরা পুত্রকে দুধ পান করাইবার পেতলের গোঁদোলটি সযত্নে আলমারিতে তুলিয়া রাখিয়াছে। দূর হইতে মন্দিরা ‘ আমার সুমন সোনা ‘ বলিয়া ডাকিলেই তাহার পুত্র খিল খিল করিয়া হাসিয়া ছুটিয়া আসিতে গিয়া টাল সামলাইতে না পারিয়া আছাড় খাইয়া মাটিতে পড়িয়া গিয়া কাঁদিয়া ওঠে , মন্দিরা ছুটিয়া গিয়া তাহাকে কোলে তুলিয়া মঙ্গলার বাছুরটির নিকট লইয়া গেলে তাহার সমস্ত কান্না থামিয়া যায়। বাছুরটির সহিত তাহার সখ্যতা দেখিয়া মন্দিরাও মধ্যে মধ্যে অভিভূত হইয়া পড়ে। সুমন যখন তাহার কচি কচি অঙ্গুলি দিয়া বাছুরটির মাথায় হাত বুলাইয়া দেয় , তখন সে মাথাটি অবনত করিয়া তাহার আনুগত্য প্রদর্শন করে। মঙ্গলাও নিষ্পলক দৃষ্টিতে ইহা দেখিতে থাকে। কিন্তু একমাত্র পরমানন্দ ইহা সুনজরে দেখিতে পারে না। তাহার মনে একটি আশঙ্কা সর্বদা কাজ করিয়া থাকে , অত্যধিক পশুপ্রীতি ভবিষ্যতে তাহার পুত্রের লেখাপড়ার অন্তরায় হইবে। মন্দিরা যে কিছুতেই ইহা বুঝিবে না তাহা পরমানন্দ বিগত আড়াই বৎসরে সম্যক উপলব্ধি করিয়াছে। কোনো উপায় না দেখিয়া পরমানন্দ, মঙ্গলা গাভীর সহিত তাহার বাছুরটি বিক্রয় করিবার মনস্থ করিল। কোনো কারণ বিহীন বিক্রয় করিলে মন্দিরার নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হইবে , ইহা অনুভব করিয়া সে সংসারে একটি কৃত্রিম অভাবের বাতাবরণ সৃষ্টি করিয়া মন্দিরাকে বলিল , ” দেখো এই অভাবের সময় গাই রেখে কি হবে ?  তা ছাড়া এখন তো তেমন দুধও দেয় না। এখন বিক্রি করে দি। খোকার জন্য অল্প দুধ কিনলেই হবে। শুধু শুধু বাড়তি খরচ। পরে বরং হাতে টাকা পয়সা এলে কিনে নেওয়া যাবে। ” মন্দিরা প্রথমে সম্মত না হইলেও সংসারের উপরি খরচ কমাইতে হইবে ভাবিয়া রাজি হইয়া গেল। 

মঙ্গলার বাছুরটির গায়ের লাল রং দেখিয়া সুমন তাহাকে ‘ লাল ‘ বলিয়া ডাকিত। ক্রেতা আসিয়া মঙ্গলার সহিত লালকে লইয়া গেল। পরমানন্দ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল। সুমন ঘরের ভেতর খেলিতেছিল , সে জানিতেও পারিল না যে তাহার প্রিয় ‘ লাল ‘ তাহাদের ঘর ছাড়িয়া অন্যের ঘরে চলিয়া গেল। মন্দিরা দেখিল যাইতে যাইতে লাল বারংবার পশ্চাৎ ফিরিয়া চাহিয়া কিছু একটার খোঁজ করিতেছে। তাহার চোখের কোনায় জল আসিয়া পড়িয়াছে। ক্ষণিক পরে মঙ্গলা এবং লালকে দেখিতে না পাইয়া মনিকা ঘরে ঢুকিয়া দেখিল , তাহার পুত্র খেলিতে খেলিতে মাদুরের উপর শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। মন্দিরা ঘুমন্ত পুত্রের মুখের পানে চাহিয়া একটি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলিয়া আপন গৃহকর্মে মগ্ন হইল।
ঘুম ভাঙিতেই সুমন উঠিয়া চক্ষু যূগল কচলাইতে কচলাইতে অভ্যাসবশত লালের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়া দেখিল , লাল এবং মঙ্গলা নাই ; উহাদের বাঁধিবার খুঁটি দুইটি ফাঁকা পড়িয়া রহিয়াছে। সুমন তাহার মাতার নিকট গিয়া মাতার আঁচল ধরিয়া জানিতে চাহিল , ‘ লাল , লাল। ‘ মন্দিরা ছলনার আশ্রয় লইয়া পুত্রকে বলিল , ” ওরা বেড়াতে গেছে , কিছুদিন পর ফিরে আসবে। ” মাতার মুখ হইতে উক্ত কথাটি শুনিয়া সুমন ছুটিয়া সেই স্থানে গেল , যেস্থানে দুইটি খুঁটিতে মঙ্গলা ও লাল পাশাপাশি বাঁধা থাকিত। মন্দিরা ক্ষণিক পরে পুত্রের নিকট আসিয়া দেখিল , লাল যে খুঁটিতে বাঁধা থাকিত সেই খুঁটিটি দুই হাতে ধরিয়া সে কাঁদিতেছে। মন্দিরা আপন দুই চক্ষুর কোনায় অঙ্গুলি দিয়া অশ্রু মুছিল। লালের মা যেদিন তাহাদের ঘরে আসিয়াছিল মন্দিরা সেইদিন শঙ্খ উলু দিয়া তাহাকে বরণ করিয়া তাহার নাম রাখিয়াছিল মঙ্গলা ,সেইদিনটি অদ্য মন্দিরার মানসপটে সুস্পষ্ট হইল । সে পুত্রের হাত ধরিয়া আনমনে বলিল , ‘ সবই মায়া সোনা ! ‘ মাতার কথার মর্মার্থ অনুধাবন করিতে না পারিয়া সুমন কাঁদিতে কাঁদিতে বারংবার বলিতে লাগিল , ‘ লাল , লাল ! ‘

Loading

Leave A Comment