অপ্রত্যাশিত চিঠি
-রুদ্র প্রসাদ
( ০১ )
কয়েক দিন হল, একটানা বৃষ্টি হয়ে চলেছে । আজও সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার । সারারাত এক নাগাড়ে ঝরার পরও বিরাম নেই । এখনও টিপ্-টিপ্ করে পড়ে চলেছে । আর এই রকম আবহাওয়ার সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলছে লোডশেডিং । সোলার এনার্জির আর কতটুকু ক্ষমতা !
এমন একটা মনোরম সকালকেও উপভোগ করতে পারছিলেন না প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি । পঁচাত্তর পেরিয়েছেন বেশ কিছুদিন হল, কিন্তু মাঝারি উচ্চতার নির্মেদ শরীরে এখনও সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি সময় । কাজ নিয়েই মেতে আছেন নিজের খেয়ালে । বয়সের ভারে পাতলা হয়ে আসা ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল আর পরিচ্ছন্ন – পরিপাটি পোশাকে সদা প্রাণোচ্ছল মানুষটার আজ হঠাৎ হল টা কি !!! দুদিন হল দাড়ি কামাতে ভুলে গেছেন । খাওয়া – দাওয়া সারছেন অন্যমনস্কভাবে । নিজের প্রিয় আরাম কেদারাটায় বসেও ভেতরে ভেতরে ছটপট করছিলেন তিনি । সুন্দর সকালের আপাত শান্ত প্রকৃতির বৃষ্টিভেজা অনুপম রূপ, বা সাউণ্ড সিস্টেমে বাজতে থাকা পছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল …’ – কোনও কিছুই কাঙ্ক্ষিত মানসিক শান্তি দিতে পারছিল না । মাঝেমাঝেই উঠে ঘরময় পায়চারি করছিলেন অস্থিরভাবে আর সময়ে সময়ে শক্ত হয়ে উঠছিল বয়সের সাথে চারটে দাঁত হারানো চোয়াল দুটো । কখনও নিষ্ফল আক্রোশে মুঠো করছেন আঙুল । কোনওভাবেই অস্বস্তিটা ভুলতে পারছেন না । বেশ কিছু সময় একভাবে বসে থাকার পর উঠলেন, মনস্থির করে গলা তুলে ডাক দিলেন, “হরি, এই হরি” ।
মিউজিক সিস্টেমটা বন্ধ করতে করতেই হাজির হরি । দেখে আশ্বস্ত হলেন, সেই কর্মজীবনে প্রায় সমবয়সী সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন একে, এই অবসরোত্তর জীবনে এখনও একমাত্র বিশ্বস্ত ও অনুগত সহচর, মেদিনীপুরের এই রাখহরি মন্ডল – আজও টিকে আছে । বললেন, ‘জলখাবার আর চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে, গরম করে নিয়ে আয় ।”
হরি চলে যাবার পর নিজের বন্ধ কম্পিউটারটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হেসে ফেললেন, আসলে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও আজকালের সোশ্যাল মিডিয়াতে অভ্যস্ত নন তিনি, বড়জোর ই-মেলটুকু করতে পারেন । বেশি কিছু করতে ইচ্ছে তাঁর করে না, নাহলে হয়ত আজকের দিনে যোগাযোগ অনেক সুবিধাজনক হত । ভদ্রলোক এবার গিয়ে বসলেন নিজের লেখার জায়গায়, না চাইতেই কিছু ব্যক্তিবিশেষ বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাহায্যপ্রার্থী হতে হয় বলে চিঠিপত্র নিয়মিত লিখতে হয় তাঁকে, লিখতে বসে নিজের ভাবনায় ডুবে গেলেন ভদ্রলোক, আবারও জুড়িয়ে গেল হরির গরম করে দিয়ে যাওয়া চা – জলখাবার । সময় গড়িয়ে চলল ।
এক সময় লেখা শেষ করে খাম বন্ধ করতে করতে হরিকে ডাকলেন । হরি এলে বললেন, “এগুলো খুব জরুরী চিঠি । তাড়াতাড়ি যা, আজকের ডাকে দেওয়া চাই । দুটোর মধ্যে রেজিস্ট্রি করে দিবি, বুঝেছিস ।”
চিঠিপত্র নিয়ে হরির চলে যাওয়ার পথে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আনমনে ভাবতে লাগলেন, ‘চিঠিটা সময়মতো পৌঁছাবে তো ? আবেদন কার্যকর ঠিক সময়মতো হবে তো ? অতিবিলম্ব না হয়ে যায় ।’
অন্যমনস্কভাবে দৈনন্দিন কাজকর্ম শেষ করে রাতে শুতে গিয়েও মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল ভাবনাগুলো, ‘চিঠিটা সময়মতো পৌঁছাবে তো ? সাহায্য আসবে তো ? না এলে কি করণীয় …..’। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন । হঠাৎ অস্পষ্ট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর, আবছায়ায় বুঝতে পারলেন ঘরের ভেতর দু-তিনজন লোক কিছু যেন খুঁজে চলেছে । ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে শুনতে পেলেন, “উঠে পড়েছেন দেখছি । ভালোই হল, এবার বলে ফেলুন জিনিসটা কোথায় রেখেছেন । তাহলে আর কষ্ট করে খুঁজতে হয় না” । বিছানা হাতড়ে বুঝলেন টর্চলাইটটা বিছানায় নেই । ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ ঘরের মধ্যেকার সোলারের আলোটা জ্বালালো । আলোয় সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখতে পেয়ে সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এ কি ! তুই ! এখন এখানে ….!!!!”
( ০২ )
সদাই কর্মচঞ্চল লবনহ্রদের অফিসে দিনের শেষবেলায় হাতের কাজ মোটামুটি শেষ করে নিজের ডেস্কে বসেই মোবাইলে গেম খেলছিলাম । ওদিকে আমাদের গ্রুপ লিডার অপূর্বদা লিস্ট বানাচ্ছিলেন । আগামী বুধবার অফিসেরই এক সহকর্মীর ( ডিপার্টমেন্ট আলাদা হলেও সখ্যতা আছে ) বিয়ে, কে কে যাবেন, কি উপহার দেওয়া হবে ইত্যাদি আলোচনা হচ্ছিল । হঠাৎ পাশের ডেস্ক থেকে পৌষালী বলল, “রুদ্র, তুই কি পরবি ? শেরওয়ানী পরিস, তোকে বেশ মানাবে ।”
মোবাইল থেকে মুখ তুলে বললাম, “ক্ষেপেছিস ! আমার যা চেহারা, তাতে ওসব পরলে পুরো কাকতাড়ুয়া লাগবে ।” দেখলাম কথাটা শুনে কৃষ্ণাদি তাঁর সেই বিখ্যাত হাসিটা দিয়ে নিজের ডেস্কের দিকে হাঁটা দিলেন । অন্যদিকে দেখি, গোলাপ না অর্কিড – কিসের তোড়া ভালো হবে, সেই নিয়ে শিব শঙ্করদা আর ভূষণদার ভেতর চাপান-উতোর চলছে । একটু সুখটানের আশায় অমল, অশোক আর প্রদীপদার সাথে বেরতেই যাব, এমন সময়ই পেছনে ধনঞ্জয়দার বিখ্যাত গলা, “এই যে, পটলডাঙার চারমূর্তি, বলি সব চললেন কোথায় ?”
অশোক বলল, “দাদা, আপনারা প্ল্যানিংটা করুন, আমরা এই দু-মিনিটে আসছি ।”
ধনঞ্জয়দা গম্ভীর হয়ে বললেন, “এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে । আপনাদের মুখাগ্নি পরে করলেও চলবে ।” কি আর করা যায়, বিরস বদনে ফিরে এলাম । দেখি পৌষালী মুখ টিপে টিপে হাসছে ।
যাই হ’ক, শেষ পর্যন্ত ঠিক হ’ল, কেনাকাটার দায়িত্ব কৃষ্ণাদি আর পৌষালীর, খরচ যা হবে পরে হিসাব করে সকলে সমান ভাগে ভাগ করে নিলেই চলবে, বাকিদের সময়ে পৌঁছে গেলেই হবে ।
মনে মনে একটা মতলব ভেঁজে ডিপার্টমেন্টাল হেড সুধাংশু স্যারের কেবিনে গিয়ে কথাটা বলতে, স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বললেন, “বিয়েবাড়িতে যেতে চাইছ না ? … হুঁ … ঠিক আছে । তবে শুক্রবার যেন ডুব মেরো না ।” ঘাড় নেড়ে বাইরে এলাম । শেষে যখন সকলে বেরতে যাবে এমন সময় অপূর্বদা গলা তুলে বললেন, “সবাই ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবেন আশা করছি ।”
আমার পাশ থেকে অমল ফুট কাটল, “না হলে ফ্লাইটটা মিস হয়ে যাবে !”
পাশ থেকে প্রদীপদা অস্ফুটে শুধু, “হুঁ” – বলে থেমে গেলেন । হাসি-ঠাট্টা করতে করতে আমরা অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম ।
( ০৩ )
পার্কিং থেকে বাইকটা নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ভাবছিলাম, অযাচিতভাবে বেশ কয়েকদিন ছুটি পাওয়া গেল, শনি-রবি এমনিতে ছুটি, সোমবার – জন্মাষ্টমী, মঙ্গলবার – স্বাধীনতা দিবস, বুধবার – বিয়েবাড়ি, বৃহস্পতিবার – বৌভাত — সব মিলিয়ে ছ-দিন । বাড়িতে আমি একা, মা-বাবা বোনের বাড়িতে, ভাইও বাইরে – কি করা যায় …।
ফেরার পথে সাবওয়ে থেকে বাটার নান আর চিলি চিকেন নিয়ে নিলাম । রাতে খেতে বসে মনে হ’ল, কোথাও একটা ঘুরে আসতে পারলে মন্দ হত না । ভাবতে ভাবতেই গত সপ্তাহে আসা একটা চিঠির কথা মনে পড়ল, ছিলাম না বলে নিচে সিকিওরিটির লোকেরা নিয়ে রেখেছিল, পরে পেয়েছিলাম বটে, তবে দেখা হয়নি । তারপর কাজের চাপে বেমালুম ভুলে গিয়েছি । খাওয়ার পর বেশ কিছু সময় খোঁজার পর চিঠিটা পেলাম, দেখি প্রেরক – শ্রী শুভ্রাংশু শেখর ভৌমিক । মনে পড়ে গেল এক উচ্ছল চিরতরুণ মানুষের কথা । বোটানিস্ট ভদ্রলোক আমার স্বর্গীয় দাদুর বন্ধু । অকৃতদার মানুষটির সাথে দীর্ঘকাল যোগাযোগ করা হয়নি ভেবেই লজ্জিত হলাম । এতদিন পর কি মনে করে চিঠি লিখলেন, ভাবতে ভাবতে চিঠিটা খাম থেকে বের করলাম । মনে মনে বয়স হিসেব করে হাতের লেখার তারিফ না করে পারলাম না, লিখেছেন …,
“স্নেহাস্পদেষু বড় দাদুভাই,
আশা করি পরম মঙ্গলময়ের অশেষ কৃপায় সপরিবারে কুশলে রয়েছ । দীর্ঘদিনের নীরবতার কারণ হিসাবে বলি, পারিপার্শ্বিক নানাবিধ কারণবশতঃ যোগাযোগ হয়নি । অভিমান কিছুটা আছে বটে, তবে অভিযোগ নেই । আমি আর হরি বহাল তবিয়তে, কোনোক্রমে এখনও টিকে আছি ।
গত কয়েকদিন যাবত তোমার কথা খুব মনে পড়ছে । একবার এসে ঘুরে যাও । আমার পক্ষে এদের সান্নিধ্য ছেড়ে বেরোনো মুশকিল । বয়সও হয়েছে, আজ আছি – কাল নেই । জরুরী অনেক কিছু আছে, জনান্তিকে বলার মতো । তোমার ছবি তোলা আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা যদি এখনও আগের মতো থাকে, চলে এসো, মস্তিষ্কের পুষ্টি হবে ।
ঈশ্বরের কাছে তোমার মঙ্গল ও সার্বিক উন্নতি প্রার্থনা করি । তোমার মা-বাবা-ভাই-বোন — সকলকে আমার শুভেচ্ছা দিও ।
সত্ত্বর সাক্ষাৎ হবে, বৃদ্ধকে নিরাশ করবে না, এই আশা করি ।
আশীর্বাদান্তে,
ইতি,
তোমার গাছ দাদু,
শুভ্রাংশু শেখর ভৌমিক ।
৬ই আগস্ট ২০১৭
পুনশ্চঃ যেখানেই দেখিবে ……”
চিঠিটা পড়ে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম, সম্বিত ফিরল মোবাইলের আওয়াজে । মায়ের ফোন – কি করছি, কি খেয়েছি ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নবাণ সামলে চিঠির কথা বললাম । এ ও বললাম যে, কাল যাব । দেখলাম সম্মতি সহজেই পাওয়া গেল । মায়ের সাথে কথা বলে ঘুমোতে গিয়েও পুরোনো কথাই ভাবছিলাম । অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে দাদুর সাথে ।
সকাল থেকে উঠেই একটা অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিলাম, অনেকদিন পর আবার একা একা কোথাও যাচ্ছি । প্রাতরাশ সেরে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম । ফার্স্ট এড আর এমার্জেন্সী কিটটা পরীক্ষা করে দেখলাম ঠিকই আছে । কাজ গুছিয়ে সাড়ে এগারটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম । প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে বাইকটা পরিচিত সার্ভিস সেন্টারে জমা করে দিলাম । চায়না টাউনে দুপুরের খাওয়া সেরে দুটোর সময় বাসে উঠলাম, ধর্মতলা থেকে । গন্তব্য – তাজপুর । জানালার ধারে বসার পেয়ে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মাথায় চিঠির কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল ।
to be continued…
Chapter 2 (Coming soon, 21st April, 18)