অপ্রত্যাশিত চিঠি
-রুদ্র প্রসাদ
প্রথম পর্বের পর…
( ০৪ )
যাত্রাপথে পেরিয়ে এলাম অনেক ছোট-বড় জনপদ । গঙ্গা পেরিয়ে দামোদর আর রূপনারায়ন ছাড়াও বেশ কয়েকটা নাম না জানা নদ-নদী পড়ল । নদীর বুকে জায়গায় জায়গায় জেগে ওঠা চড়া আর প্রায় বুজে আসা নদীগর্ভে ক্ষীণ জলধারার জন্য তাদের নদীসুলভ না দেখালেও পারাপারের সেতুর বিস্তার দেখে তাদের অতীতের প্রকৃত ব্যাপ্তি অনুমান করতে কষ্ট হয় না । দু-তিনটে স্বল্প বিরতি ছাড়া মোটামুটি দ্রুতই এলাম । প্রায় চার ঘন্টার বাসযাত্রা শেষে নামলাম, জায়গাটার নাম তাজপুর মোড়, বালিসাই । আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানলাম তাজপুর সৈকতে যাওয়ার জন্য ট্রেকার আর টোটো চলে, আমাকেও ঐ পথেই যেতে হবে । একটা শেয়ারের টোটোতে উঠে ঠিকানা বলতেই পাশে বসা এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বললেন, “সঙ্গে আসুন, আমিও ওদিকেই যাচ্ছি । আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দেব ।” বালিসাই-তাজপুর সি-বিচ রোড ধরে যাওয়ার সময় নজরে পড়ল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকটা বাড়ি-ঘর, বেশ কিছু ফিশারী আর ফাঁকা জমি । রাস্তায় কিছু ট্যুরিস্টদের গাড়ি, সাইকেল আর মোটরসাইকেল ছাড়া লোকজনের বিশেষ আনা-গোনা চোখে পড়ল না । কিছুটা আসার পর টোটো থামিয়ে দিয়ে সেই ভদ্রলোক বললেন, “এখানে নেমে ঐ বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে চলে যান । একটু এগিয়ে মোড় ঘুরলেই কাঁটাতারের বেড়া দেখতে পাবেন । ওটাই ভৌমিকবাবুর বাড়ি” । বিদায়ী নমস্কার জানিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম ।
পৌঁছে দেখি, গাছ-গাছালির ভেতরে যে একটা বাড়ি আছে, বোঝার উপায় নেই । সামনের নুড়ি বিছানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, ‘সবুজায়ন’ কথাটা যেন চাক্ষুষ করলাম । শুনশান বাড়ির চারপাশে, গোধূলি বেলার আলো-আঁধারিতে যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধুই সবুজের সমারোহ । ডোরবেল বাজিয়ে কোনও কাজ হ’ল না । বেশ কয়েক বার ডাকা-ডাকি করার পর একজন মধ্য চল্লিশের লোক এসে দরজা খুলে বাইরে এল । কাকে চাই, কোথা থেকে আসছি, কেন এসেছি ইত্যাদি জেরায় রীতিমত জেরবার করে, শেষ পর্যন্ত দাদুর লেখা চিঠি দেখাতে তবে, ভেতরে যেতে দিল । জিজ্ঞেস করলাম, “দাদু, হরিদাদু – এরা সব কোথায় ?” লোকটা উত্তর না দিয়ে, ইশারায় বসতে বলে চলে গেল । বুঝতে পারলাম, লোডশেডিং, ঘরে যে অনুজ্জ্বল আলোটা জ্বলছে, সেটা সম্ভবত সোলারের আলো । চোখ বুলিয়ে দেখলাম, ঘরে একটা জলচৌকি, একটা টেবিল, তিনটে চেয়ার আর একটা পেল্লায় বই বোঝাই শো-কেস । বেশির বই উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত হলেও সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা ছাড়া, বেশ কিছু গল্পের বইও আছে । বেশ খানিকক্ষণ দাদু এলেন, সঙ্গে হরিদাদু, বললেন, “যাক, এসেছ তাহলে, ভেবেছিলাম আসবেই না” । প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই জড়িয়ে ধরলেন, বুঝলাম এখনও যথেষ্ট শক্তি ধরেন । শুধু হরিদাদুকে দেখে মনে হল কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছেন । ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসার পর বললেন, “অনেকদূর থেকে এসেছ, হাত-মুখ ধুয়ে নাও । চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে” । বলেই হাঁক দিলেন, “রতন …”। এক বছর তিরিশের স্বাস্থ্যবান যুবক আসতে তাকে বললেন, “দাদাকে ওপরের ঘরে নিয়ে যা” । রতনের পেছনে অপরিসর সিঁড়ি ভেঙে উঠার সময় খেয়াল হ’ল, বাইরে জমাট অন্ধকার । দোতলার পশ্চিম দিকের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে যখন ঘরের আলোটা জ্বালালো, তার গেঞ্জির তলা দিয়ে বেরিয়ে আসা পেশিবহুল হাতটা দেখে মনে মনে তারিফ করতে করতে ভাবলাম, ‘নিয়মিত শরীরচর্চা করে নিশ্চয়ই’ ।
আমাকে ঘর দেখিয়ে রতন চলে যাবার পর দেখলাম, ঘরটা বেশ বড় হলেও একটা বড় বিছানা, টেবিল-চেয়ার আর আলনা ছাড়া, আর কিছু নেই । একসাথে না হলেও ঘরের পাশেই বাথরূম । জামাকাপড় ছেড়ে মাকে ফোন করে নির্বিঘ্নে পৌঁছানোর আর এখানকার খবরাখবর দিলাম । ফোনে কথা বলার সময় মনে হ’ল, দরজার বাইরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে । কিন্তু বেরিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না, এমনকি, পুরো দোতলায় আমি ছাড়া, আর কেউ নেই !
নিচে নেমে যেতে দাদু বললেন, “তুমি চা-টা খাও । আমাকে একটু যেতে হবে । পরে কথাবার্তা হবে” । চা-জলখাবার খেয়ে ওপরে এসে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করছি, এমন সময় কারেন্ট এলো । উজ্জ্বল আলোয় লক্ষ্য করলাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হলেও ঘরটা ভীষণ স্যাঁতসেঁতে, চারপাশে এত গাছপালা থাকার কারণেই মনে হয় । ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, মোবাইল, পাওয়ার ব্যাঙ্ক – সব চার্জে বসিয়ে, কি মনে করে এমার্জেন্সী কিটটা নিজের কাছে রেখে দিলাম । হঠাৎ খেয়াল হ’ল, পুরো বাড়িটা কেমন আশ্চর্য রকম নিঃস্তব্ধ, যেন কোনও জনপ্রাণীই নেই ।
এরপর বেশ কিছু সময় ফেসবুকে মগ্ন ছিলাম । রতনের ডাকে বুঝলাম, খাওয়ার সময় হয়েছে । ল্যাপটপটা বন্ধ করে নিচে এসে দেখি, আয়োজন বিস্তর ! দাদু বললেন, “তোমাকে রোজ রাতে একটা করে স্থানীয় বিশেষ পদ রান্না করে খাওয়াব । আজ সামুদ্রিক কাঁকড়া । খেয়ে দেখ, এমনটা তোমাদের শহরে কোথাও পাবে না” । যদিও কাঁকড়া খুব একটা পছন্দ করি না, তাও জোরাজুরিতে শেষ পাতে খানিকটা খেতে হল । খাওয়ার পর দাদু বললেন, “ক্লান্ত আছ, এখন বিশ্রাম নাও” ।
ওপরের ঘরে এসে ফোনে কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম, মাথাটা ঝিম্-ঝিম্ করছে । ফোনটা রেখে শুয়ে পড়ার জন্য মশারিটা ঠিক করতে করতে বুঝতে পারলাম অস্বস্তি বাড়ছে । হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে । বাথরূম সেরে কোনোমতে টলতে টলতে ফিরে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম চোখ জড়িয়ে আসছে …!!!
( ০৫ )
সকালে ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে । অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসে কালকের কথা ভাবছিলাম । এলোমেলো চিন্তা-ভাবনা করতে করতে প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে ঘরে এসে জামাকাপড় বের করতে গিয়ে বুঝলাম, কেউ আমার ব্যাগ হাতড়েছে ! আপাতদৃষ্টিতে সব ঠিকঠাক মনে হলেও দেখলাম, অন্যকিছুই খোয়া যায়নি, শুধু দাদুর চিঠিটা নেই ! খালি খামটাই রয়েছে …!!!
মনের খচ্-খচানিটা চেপে নিচে নেমে এসে জানলাম, আমার জন্য দাদু অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু দেরী দেখে একটু আগেই প্রাতরাশ সেরে কোথাও বেরিয়েছেন । হরিদাদুকেও কোথাও দেখতে পেলাম না ।
জলখাবার খেয়ে ক্যামেরা আর হ্যান্ডিক্যামটা নিয়ে বাড়ির চারপাশটা দেখব বলে বেরিয়ে, ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারলাম, জায়গাটা আমার অনুমানের চেয়ে ঢের বড় আর অজস্র গাছ-পালাতে ভর্ত্তি । বাড়ির ভেতরে-বাইরে সবুজ রঙ আর নামটাও ‘সবুজ বীথি’ দেখে মনে মনে হেসে ফেললাম ।
পূর্বদিকে, বাড়ির পেছনের দিকটায় একটু এগোতেই দেখি আরও একটা ঘর, তবে কাচ দিয়ে ঘেরা । কাছে গিয়ে দেখি, বৃহৎ কর্মকাণ্ড ! ঘর না বলে কাচ দিয়ে ঘেরা একটা বড়-সড় জায়গা বললে অত্যুক্তি হয় না । দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড় ! আন্দাজে মনে হ’ল, এই একটা ঘরের ভেতর, প্রমাণ সাইজের স্কোয়াশ কোর্ট, কমপক্ষে গোটা কুড়ি, অনায়াসে ঢুকে যাবে । ভেতরে ঢুকতেই আগে চোখে পড়ল হরেকরকমের ছোট-বড় চারাগাছ – কোনোটা টবে, কোনোটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে, কোনোটা আবার মেঝেতে তৈরি করা কৃত্রিম শয্যায় ….। এক একটির এক একরকম রূপ । কয়েকটাতে আবার কিছু রঙ-বেরঙের নাম না জানা ফুল ফুটে রয়েছে ।
এই সবই দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম, হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হ’ল – সামনে দাদু ! অ্যাপ্রন আর গ্লাভস পরে, আমার দিকে পেছন ফিরে, সাথের তিনটে ষণ্ডামার্কা লোককে অনুচ্চস্বরে কিছু বলছিলেন । আমার আসাটা খেয়াল করেন নি ।
পেছনে হঠাৎ করোর উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ফিরে দেখি, রতন । গলা খাঁকরি দিয়ে, যেন প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি জোরেই বলল, “দাদা এখানে ! আর আমি ওদিকে খুঁজছিলাম” । আওয়াজ পেয়ে দাদু এগিয়ে এসে বললেন, “এসেছ ভালো, সবকিছু ঘুরে দেখ । তবে, কোনও কিছুতে হাত দিও না । কিছুক্ষণ আগেই বিষাক্ত ঔষধ দেওয়া হয়েছে” । হাবভাবে মনে হ’ল না যে, আমি এখানে এসেছি বলে খুশি হয়েছেন, বরং একটু বিরক্তই মনে হ’ল ।
মাথা নেড়ে, “আচ্ছা”, বলে চারদিকটা ঘুরে দেখতে দেখতে একটা খুব সুন্দর ফুল দেখে ক্যামেরাবন্দী করতে যাব, এমন সময় একটা ক্রুদ্ধ আর ঘড়ঘড়ে আওয়াজে তাকিয়ে দেখি, কাল সন্ধ্যায় জেরা করা সেই মাঝবয়সী লোকটা, ছবি তুলতে বারণ করছে ! দাদু দেখে, একটু হেসে, বললেন, “এখানে ছবি-টবি তুলবে না । এই ঘরের ভেতর যত চারাগাছ দেখছ, সব গুলোই আর কিছুদিন পর বাইরে যাবে । এখনও পর্যন্ত ওগুলো খোলা আলো-বাতাস পায়নি । বাইরে যাওয়ার আগে ছবি তোলা নিষেধ, নজর লেগে যাবে । এদের যতসব কুসংস্কার আর কি” ।
“ঠিক আছে”, বলে ক্যামেরার লেন্স খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে ভাবছিলাম, ‘একজন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হয়েও দাদু এই সমস্ত ফালতু কুসংস্কার প্রশ্রয় দিচ্ছেন কি করে ! ছবি তোলার জন্য ডেকে এনে এখন নিজেই বারণ করছেন !’ অবাক হয়ে এই সব ভাবতে ভাবতেই ফুলটার দিকে চোখ পড়ল, সত্যিই খুব সুন্দর । ছবি তোলার লোভ সামলাতে না পেরে, ক্যামেরাটা ব্যাগে ঢোকানোর আছিলায় হ্যান্ডিক্যামটা অন করে দিলাম । ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোটামুটি ল্যাবের ভেতরের হাল-হকিকৎ যতটা সম্ভব রেকর্ড করতে করতে ভান করলাম যেন, ব্যাগে ঢুকছে না বলে বাধ্য হয়েই হ্যান্ডিক্যামটা হাতে রাখতে হয়েছে । মনে মনে ভাবলাম, ‘ভাগ্যিস, বড় ব্যাগটা সঙ্গে আনি নি, না হ’লে হয়ত এটাকেও ব্যাগে ঢোকাতে বলত’ ।
সতর্কভাবে চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে লক্ষ্য করলাম, দাদু, রতন, মাঝবয়সী লোকটা ছাড়াও তিনটে লোক আর একটা কমবয়সী ছেলে রয়েছে । দাদু চারাগাছগুলোর কাছে গিয়ে একটা ক্লিপবোর্ডে আটকানো কাগজে কিছু নোটস্ নিয়ে রাখছেন । কিন্তু দেখে মনে হ’ল, লেখা নয়, যেন এমনি আঁকিবুকি কাটছেন ! বাকিরাও কিছু-না-কিছু কাজ করছে বটে, তবে দেখে মনে হ’ল না তারা কেউই এধরনের কাজে অভ্যস্ত ! শুধু রতনকে দেখলাম, কিছু না করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে আড়চোখে আমাকে দেখছে । বুঝলাম, আমাকে নজরে রাখাই ওর কাজ । কিছু সময় ল্যাবে কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম ।
ঘরে এসে কয়েকটা ফোন সেরে, ভাইকে হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজ করলাম, ‘বেশ কিছু সন্দেহজনক ঘটনা দেখছি, আলোচনা করব’ । একটু পরে রিপ্লাই এলো, ‘লাঞ্চের পর’ ।
দুপুরে খেতে এসে দেখি, দাদু একটু যেন গম্ভীর হয়ে আছেন । ‘কি হয়েছে ?’, জিজ্ঞেস করাতে খানিকটা উষ্মা নিয়েই বললেন, “এমনিতে তো কোনো খোঁজ-খবর রাখোই না, নেহাত চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালাম বলেই এলে । ব্যস্ততার মাঝে ভালো করে দুটো কথাও বলা হ’ল না আর এদিকে তোমার ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেল ! তুমি তো বিকেলেই চলে যাচ্ছ ?”
হেসে বললাম, “এই কথা ? কিন্তু আজ বিকেলে তো যাচ্ছি না । আরও দুদিন থাকব । জন্মাষ্টমী আর স্বাধীনতা দিবসের ছুটি কাটিয়ে তবেই ফিরব । এবার খুশি তো ?”
“সত্যি বলছ !” – জিজ্ঞেস করলেন বটে, তবে অভিব্যক্তিতে মনে হ’ল না খুব একটা প্রসন্ন হয়েছেন ! কিছু না বলে, মাথা নেড়ে সায় দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম । মোটামুটি চুপচাপ খাওয়া শেষ হ’ল । লক্ষ্য করলাম, এখানেও হরিদাদু অনুপস্থিত ।
to be continued…
Chapter 3 (Coming soon, 22nd April, 18)