স্কাউন্ড্রেল
-অমল দাস
-মম আমি বেরোচ্ছি
-এখন এতো তাড়া কীসের ? সকাল থেকে বলছি তৈরি হয়ে নে , না আর একটু ঘুমোই।
-ওহ্ মম এখন এ কথা বলে লাভ নেই।
-আচ্ছা দাঁড়া দাঁড়া টিফিনটা নিয়ে যা, বেলায় খিদে পেলে খেয়ে নিস।
-ওহ্ মম ডোন্ট ওরি আমি রাস্তায় খেয়ে নেব।
-তোকে বললাম আমি সঙ্গে আসি , একদম কথা শুনিস না আজকাল তুই।
-মম তুমি ওখানে গিয়ে কি করবে , মাছরাঙা পাখির মত সেন্টারের সামনে গিয়ে হাঁ হয়ে বসে থাকতে হবে। এটা আমি লাইক করি না। বাবা মায়ের হাত না ধরে যারা এক পাও চলতে পারে না তাদের তো আমার ভালই লাগে না। এখনো যদি একা না বেরোয় আর কবে?
এই কথা গুলি বলতে বলতে লেখা নিজের ব্যাগটা গুটিয়ে নিয়ে পাদুকায় পা গলিয়ে বেরনোর জন্য তৈরি।
-হ্যাঁ বুঝেছি অনেক বড় হয়ে গেছিস ! কদিন আগেও আমি ছাড়া চলত না। মৃদু হাসতে হাসতে বলল মা পৃথা।
-ওহ্ মম ! ওসব দিন ভুলে যাও প্লিজ, আমি আসছি।
লেখা ষ্টেশনের দিকে চলে গেল। ও এবার মাস্টার্স শেষ করেছে। এখন চাকরীর চেষ্টা করছে। পড়াশুনায় বেশ ভালো এবং হাবভাবেও চঞ্চল। দেখতে সুশ্রী না হলেও একেবারে ফ্যালনা নয়। আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদে খুবই নজর কাড়ে। ওর নাম রূপলেখা আদুরে নাম লেখা। লেখা পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু বন্ধুরা তো ‘লে’ ডাকেই অভ্যস্ত।
আজ রাজ্য সরকারের উৎসব আছে সারা বাংলা জুড়ে। না কোন পূজা পার্বণ বা লতা পাতা ঘাস মাটির উৎসব নয়। সরকারী কর্মী নিয়োগের পরীক্ষা আছে। তাই সারা বাংলা জুড়েই একটা উৎসবের মত হৈ-হুল্লোর ভাব। ট্রেনে বাসেও অতিরিক্ত চাপের কথা মাথায় রেখে বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও তা সীমিত, সরাকারি ভাবে বলতে তো পারবে ব্যবস্থা করেছিলাম!
রবিবার ছুটির দিন হলেও আজ একটা জমজমাট ভাব ব্যারাকপুর ষ্টেশনে , উৎসাহী ছেলে মেয়েদের প্রচুর ভীড়। অধিকাংশই কলকাতায় পরীক্ষা দিতে যাবে। ট্রেনেও ভীড় হবে আশা করা যায় । ষ্টেশনেই লেখা’র কয়েকজন বান্ধবীর সাথে দেখা, তারাও উৎসবে সামিল হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে পথে নেমেছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো তারা জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠবে, লেডিজে নয়। কারণ সেখানে বেশী ভীড়ের আশঙ্কা।
ট্রেন এলো সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো । কতেক নামতে পারলো কতেক পারল না, কিন্তু সকলেই উঠে গেল। সেই নিয়েই কামরার ভিতরে বেশ হৈ হট্টগোল বেঁধে গেল।
কখনো ছেলেরা টিজ করছে তো কখনো মেয়েরা। মর্ডান মেয়ে তাই দমে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। গাছের আম কি শুধু শুধু পাকে! তার জন্য পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর প্রয়োজন।
এখানেও তাই একে ওপরকে টিজ আদান প্রদান করতে লাগলো। হৈ-হুল্লোর জমে উঠলো।
এভাবেই হেলতে দুলতে ঠেলতে ঠ্যালাতে ধীরে গতিতে যখন বিধান নগর ট্রেন এসে দাঁড়াবে ঠিক সেই সময় লেখা পিছনে ঘুরে এক যুবকের গালে সটান কষে চড়, স্কাউন্ড্রেল ! জানোয়ার বাড়িতে মা বোন নেই? নোংরামি করতেই ট্রেনে ওঠো ? মেয়ে দেখলেই লোল ঝরে? ছোটলোক কোথাকার ?
যুবক গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু শুনল কিনা বোঝা গেল না , সে এই আকস্মাৎ ঘটনায় হতভম্ব । লেখার বান্ধবী দল আর বাকি কম্পার্টমেন্টের লোকজন হাঁ হয়ে ঘটনার দিকে প্রত্যাশী চোখ খুলে চেয়ে রইল। কথাগুলো পিছনে দাঁড়ানো যুবকের বন্ধুদের তীরের মত বিঁধল।
একজন লেখা’কে রক্তচক্ষু করে জিজ্ঞাসা করল মারলে কেন ? কি অপরাধ করেছে ? টিজ তো তোমারও করছো অনেকক্ষণ ধরে, আমরা তো রিয়্যাক্ট করিনি!
-এমনি… মেরেছি ? জিজ্ঞাসা করো তোমার গুণধর বন্ধুকে, অসভ্য কোথাকার ? একটু মুখ ঝামটা দিয়েই বলল লেখা।
ভীড়ের মধ্যে একজন যুবক জিজ্ঞাস করল , শুভ্র কি হয়েছে রে ? বল কি হয়েছে তারপর দেখাচ্ছি মজা।
বোঝা গেল অভিযুক্ত যুবকের নাম শুভ্র , সেও আজ পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে।
শুভ্র ভালোমন্দ কিছুই বলল না মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
বন্ধুরা লেখা’কে জোরাজুরি করতে লাগলো কেন মেরেছো ? কি অন্যায় করেছে ?
-ও আমাকে টাচ করেছে।
-এতো ভীড়ে টাচ হতেই পারে তাই চড় দিতে হবে ? এতই অচ্ছুৎ সাবিত্রী তো লেডিজে কেন ওঠেন নি ? এক বন্ধু রেগে বলল।
-কোথায় উঠবো তোমার কাছে রায় নিতে হবে ? এটা ব্যক্তিগত।
আর একজন যুবক উচ্চ স্বরে -সে বুঝলাম কিন্তু ওর অপরাধটা কি ?
-তোমার ওই স্কাউন্ড্রেল বন্ধুটাকে জিজ্ঞাস করো কি করেছে । পিছনে দাঁড়িয়ে অসভ্য ইতরের মত আমার লোয়ার পোর্সান ছুঁয়েছিল তাই শিক্ষাটা দিয়ে দিলাম।
একবন্ধু বলল –কি করে ছুঁলো , কি দিয়ে ছুঁলো ? ওর দুটো হাত-ই তো উপরে, তোমার বান্ধবীদের জিজ্ঞাসা করো ওরা তো দেখেছে! আর তোমার থেকে একটু ডিস্ট্যান্সেই আছে, কি করে ………
কথাটা শেষ হল না লেখা বলে উঠলো কি করে ছুঁলো জানি না আমার অস্বস্তি লেগেছে আমি মেরেছি ।
লেখার বান্ধবীরা লেখাকে চুপ হতে বলল ছেলেদের রাগ দেখে। এদিকে যুবকরাও ক্ষিপ্ত তারা শুভ্রকে বার বার জিজ্ঞাস করছে ‘কি হয়েছে বল তুই’। কিন্তু শুভ্র বিশেষ কিছু না সাড়া দিল না । বলল , চুপ হয়ে যা ঝামেলা করে লাভ নেই।
শুভ্রর এই জবাবে উদ্যমী যুবক দল একটু স্তিমিত হয়ে গেল।
চ্যানেলের ভিতর থেকে দু এক জন বলে উঠলো, নিশ্চয়ই কোন কিছু করেছে না হলে চড় খেয়ে কেউ চুপ থাকে বিনা অপরাধে।
কথাটি শুভ্রর কানে পৌঁছাতেই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে যায়। সে চিৎকার করে বলে ওঠে , চুপ আছি বলে আমি অপরাধী ? চুপ থাকাটা আমার ভদ্রতা। ট্রেনেই গেটেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি ঠেলে ফেলে দি ! না কি আমি দু চার ঘা লাগিয়ে দেব কানের পাশে ? তাহলে কি আমি নিরাপরাধ প্রমাণ হবো …?
চ্যানেলের লোকজন চুপ হয়ে গেল কথা শুনে। মেয়েরাও চুপ , যারা গেটের কাছাকাছি ছিল তারাও একটু ভিতরে ঠেঁসে আসার চেষ্টা করল।
শুভ্র কিছু বলল না বলে বন্ধুরা একটু উদাসীন হল এবং একসময় শিয়ালদা এসে যে যার মত পরীক্ষার সেন্টারের দিকে চলে গেল।
লেখার পরীক্ষা সিট পড়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হিন্দু স্কুলে। স্কুলের গেটের কাছেই একটা বসার জায়গায় সে বসে খাতার পাতা উল্টাচ্ছিল একমনে।কিছুক্ষণ পর চোখ ঘোরাতেই দেখে অনতি দূরে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে।
সে আবার ভাবল স্কাউন্ড্রেলটা আবার এখানেও , দিনটাই বুঝি আজ খারাপ। পরেই আবার একটু ভীত হল ছেলেটি আমাকে ফলো করছে না তো চড় মারলাম বলে? মনে মনে একটু শঙ্কিত হতে লাগলো সে। যদিও শুভ্রর আকাশে মেঘের দেখা নেই তবুও লেখার মনে একটা ঝড়ের আশঙ্কা জন্ম নিল।
এরই মধ্যে পরীক্ষার সেন্টারে এন্ট্রি হতে লাগলো লেখা দ্রুততার সাথে ভিতরে চলে গেল। জীবনের প্রথম চাকরীর পরীক্ষা দিতে এসেছে আজ লেখা তাই একটু নার্ভাস আছে তবে ভীত নয় সে । লেখার সামনের বেঞ্চে কোন পরীক্ষার্থী নেই লেখার পাশের জনও অনুপস্থিত , ঠিক পিছনেই একজন আছে কিন্তু সেদিকে লেখার ঘুরে দেখাই হয় নি। পরীক্ষা চলছে বেশ শান্ত ভাবেই। সময় আর বেশী নেই। লেখা একটু চিন্তিত । তার ম্যাথ গুলো সলভ্ হোল না ভালো, এদিকে সামনে পাশে কেউ নেই যার কাছে একটু সাহায্য চাইতে পারে। কোন রকমে পিছনে হেলে সে একবার মৃদু জানতে চাইল, ম্যাথ করেছেন ?
যার উদ্দেশ্যে সেও সাড়া দিয়ে বলল, হ্যাঁ করেছি?
একটু হেল্প করবেন ?
-বলুন কোনটা?
এভাবে মোটামুটি দশখানা ম্যাথ সে জোগাড় করে নেয়। পরীক্ষার শেষ হলে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য যখন পিছনে তাকায় যুবকটি তখন ঘুরে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে । লেখা ডাক দিল শুনছেন , আপনাকেই ডাকছি !
যুবকটি ঘুরে তাকাতেই লেখা অবাক এবং কিছুটা লজ্জিত । কারণ যার থেকে সে হেল্প নিল সে যে সেই স্কাউন্ড্রেলটা যাকে সে চড় মেরে এসেছে ট্রেনে। ধন্যবাদ আর মুখ থেকে বেরোলো না লেখার। শুভ্র একটু কাছে এসে বলল, স্কাউন্ড্রেলটা একটা মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়াতে ভালোবাসে আর বিনা অপরাধে মার খেয়ে মার দেওয়া অপরাধীকে মাফও করতে পারে।
এই বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। লেখা লজ্জিত কতটুকু হল তা বোঝা গেল না কিন্তু মুখের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল সে তাকে অপরাধীই ভাবে ট্রেনের ঘটনার জন্য। সে আরও ভাবল অন্যায় করেও ভালো দেখানোর জন্য চোরের মায়ের মত গলাবাজী করে গেল। পরক্ষণেই লেখার মনের মধ্যে সন্দেহ ঢুকে গেল হয়তো বদলা নিয়ে নিল সে অঙ্কের ভুল উত্তর দিয়ে ।
বাড়িতে ফিরেই লেখা অঙ্কের খাতা খুলে সলভ করতে বসে পড়লো । যখন সব শেষ হল তখন দেখল শুভ্রর বলা উত্তর গুলো সবই ঠিক , তবে সে নিজে যে কটা করেছে সব ঠিক হয়নি। ইতিমধ্যে রশ্নি ফোন করে লেখাকে, কি রে এক্সাম কেমন হোল তোর ?
-ওভার অল ঠিকই আছে। তোর ?
-ওই হলো তবে খুব খারাপ হয়নি আশাকরি।
-জানিস তো ট্রেনের সেই ছেলেটা আমার পিছনে বসেই এক্সাম দিয়েছে। একটু ভয় হয়েছিল ওকে দেখে তবে তেমন কিছু করেনি।
লেখা যে তার দ্বারা উপকৃত সেটা বেমালুম জিভে আসা জলের সাথে ঢোঁক গিলে নিল।
-একটা কথা বলি ?
-বল!
-ছেলেটির কোন দোষ ছিল না রে… আমার ব্যাগের থেকে বেরনো ছাতার বাটটাই তোর পিছনে……….
– ওহ্ গড ! আমি এতো বড় একটা কাণ্ড ঘটালাম তুই তখন বললি না কেন?
– বলা বা জিজ্ঞাসা করার আগেই তো ওকে চড় কষিয়ে দিলি তখন আর বলে কি করতাম? তাহলে এই ভুলের জন্য ওরা তোকেই………
-প্লীজ আর বলিস না ।
লেখার বুকের ভিতরটা যেন হঠাৎ বেশী জোরেই আন্দোলিত হতে লাগলে, টেনশনে শ্বাস প্রায় থেমে আসে। সে ফোনটা রেখে দিল। লজ্জায় আর প্রিয় বান্ধবীকে জানাতেও পারলো না যে সেই ছেলেটাই তাকে সহযোগিতা করেছিল এবং লেখার দ্বারা কৃত অপরাধের মাফও করেছিল।। সে গভীর অনুশোচনায় পড়লো , সে অনুতপ্ত অপ্রাসাঙ্গিক নির্বোধ আচরণের জন্য। লেখার মনে এক আক্ষেপ জমা হল সে আর হয়তো কোন দিন মাফ চাইতে পারবে না । পারলে হয়তো সে অপরাধ মুক্ত হতো। তবে এই শিক্ষাটা অবশ্যই আত্মস্থ করতে পেরেছে যে বাইরে থেকে যা দেখা যায় বাস্তবে তা নাও হতে পারে , যা অনুভবে আছে তা হয় তো ভবেই নেই। যেটা বর্ণনে আছে তা হয়তো ঘটেই নি। যা অস্পৃশ্য তা স্পর্শেই হয়তো মনোরম সুখ । আর সেই স্পর্শ সুখই এখন লেখার মনের গহীনে দাগ কেটে চলেছে অহরহ।
ডাইনিং টেবিলে বসে মা পৃথা ডাক দিল , লেখা এসে থেকে ঘরেই আছিস পরীক্ষা, বুঝি ভালো হয়নি? চিন্তা করিস না মা এখানে আয় চা খেয়ে যা।
লেখা উত্তর দিল , তুমি খাও মম আমার কিছু ভালো লাগছে না।
=সমাপ্ত=
অসাধারণ!
ধন্যবাদ
সুন্দর গল্প
ধন্যবাদ
দারুণ
ধন্যবাদ
Valo laglo….seser kotha gulo khub sotti
অশেষ ধন্যবাদ বন্ধু