অপ্রত্যাশিত চিঠি
-রুদ্র প্রসাদ
চতুর্থ পর্বের পর…….
( ১৫ )
উত্তেজনার কারনেই বোধহয় বিশেষ ঘুমোতে পারলাম না । যদিও প্রথম দিনের মতো দেরী করেই নিচে এলাম । চুপচাপ চা-জলখাবার খেয়ে, ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । পুকুরের অন্য পাড় দিয়ে যেতে যেতে ছবি তুললাম এলোমেলোভাবে । উত্তর দিকে, প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখি, একটা বেশ বড়সড় জঞ্জালের স্তূপ । সেখানে ছাইয়ের পরিমাণই বেশি, এছাড়াও সারের খালি প্যাকেট, কৌটো, শিশি-বোতল, কাটা ঘাস, আগাছা, লতাপাতা আর প্রচুর শুকিয়ে যাওয়া চারাগাছ চোখে পড়ল । মনে মনে ‘ছাই-গাদা’ বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি, এমন সময় হঠাতই দাদুর লেখা চিঠির শেষ অসমাপ্ত লাইনটা মনে পড়ে গেল । আবার ছাই গাদাটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল, বেশ খানিকটা শিমূল তুলা ! বৃষ্টির জলে ছাইয়ের সাথে প্রায় মিশে গেলেও আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছিল । একটা গাছের ভাঙা ডাল কাজে লাগিয়ে যতটা সম্ভব দেখলাম । কিন্তু পুরো ছাই গাদাটা মোটামুটি নাড়া-চাড়া করেও বিশেষ কিছু পেলাম না, সবই বাতিল জিনিসপত্র । এর চেয়ে বেশি দেখতে চাইলে কোদাল বা শাবল জাতীয় কিছু লাগবে, ভেবেই উঠে পড়লাম । ‘শিমূল গাছটাও এখান থেকে অনেকটা দূরে, তাছাড়া এখন তুলার সময়ও নয়, তাহলে এখানে এতো তুলা এলো কি করে ? একসাথে এতো চারাগাছ শুকিয়েই বা গেল কি করে’ ইত্যাদি ভাবতে ভাবতেই এসে পৌঁছালাম সেই বকুল গাছটার কাছে । চারপাশটা ভালো করে লক্ষ্য করার সাথে সাথে বিভিন্নভাবে ল্যাবের পেছনের দিকের বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম ।
তারপর এদিক-ওদিক ঘুরে, ছবি তুলতে তুলতে, চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে এসে ঢুকলাম ল্যাবে । আগের দিনের মতোই সব চুপচাপ, শুধু মনে হল আজকের ব্যস্ততা যেন একটু বেশি । এদিক-ওদিক দেখছিলাম বটে, মনে মনে চিঠিটার কথাই ভাবছিলাম । যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, তবে দাদু বলতে চেয়েছেন, ‘যেখানেই দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’, ভাবতে ভাবতেই রতনের দিকে চোখ পড়ল । ‘এ কি কোনও সংযোগসূত্র হতে পারে ? না ছাইয়ের গাদায় কিছু সূত্র পাওয়া যেতে পারে ? না রতনই সব রহস্যের চাবিকাঠি ? না রতনের থেকে সাবধান হওয়ার কথা বলেছেন দাদু’ – কিছুই মাথায় এলো না । সবই যেন কেমন ধোঁয়াটে আর জটপাকানো ! এদের সবার হাবভাবই কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হল । সবাই যেন মুখে কুলুপ এঁটে থাকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে !
ল্যাবের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে পেছনের দিকে এসে একটা স্টোররুম দেখতে পেলাম । স্টোররুমের দরজাটা বেশ শক্তপোক্ত । খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, ভেতরে বেশ কিছু বস্তা আর ছোট-বড় কৌটো সাজিয়ে রাখা আছে । ঘরের ভেতরের দিকে রঙহীন প্লাস্টার করা দেওয়াল দেখে বুঝলাম, এই ঘরের দেওয়ালটাই বাইরে থেকে দেখেছি । আরও কিছু দেখার ইচ্ছে থাকলেও হল না, আমাকে এদিকে আসতে দেখেই রতন ঠিক পেছন পেছন এসেছে । আমি অন্যদিকে ঘুরতেই ঘরের ভেতরে গিয়ে একটা খালি বালতি বের করে এনে, দরজাটা বন্ধ করে দিল । আমিও ইতি-উতি দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলাম ।
( ১৬ )
রাতে ঘুম না হওয়ার জন্য চোখ জ্বালা করতে লাগল । আর কোথায় না গিয়ে, ঘরে ফিরে এলাম । বসে বসে ভাবছিলাম, এখন কি করা যায়, এমন সময় সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত সাহেবের মেসেজ পেলাম, লিখেছেন, ‘পুলিশ ব্যাপারটা তল্লাশি করে দেখবে’ । ভাইকে অনলাইন দেখে, ওর সাথে চ্যাট করে আজ রাতের একটা পরিকল্পনা স্থির করলাম । তারপর কি করে সঠিকভাবে রাতের কাজটা করা যায়, ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এলাম । নিচের তলায় আবীর আর বাইরের রান্নাঘরে রান্নার লোক ছাড়া, আর কাউকে দেখতে পেলাম না ।
বসার ঘরে বসে খবরের কাগজ দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, আবীর বেরিয়ে ল্যাবের দিকে যাচ্ছে । কাগজটা রেখে দিয়ে, চারপাশ একবার সতর্কভাবে দেখে নিলাম । উল্টোদিকের ঘরটাতে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এলো । ঘরে একটা বিশাল বুকসেল্ফ আর কম্পিউটার দেখে মনে হল, সেটা দাদুর ঘর । বিছানাটা বেশ পরিপাটি হলেও বইপত্র আর কম্পিউটারের ওপর বেশ ধুলো জমেছে দেখে কি রকম একটা খটকা লাগল । পাশের দুটো ঘরও তথৈবচ ।
রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়েই সিঁড়ির তলার জায়গাটা চোখে পড়তে দেখতে পেলাম, কোদাল, কুড়ুল, বেলচা, শাবল, কাস্তে, কাটারি, ঝুড়ি, বালতি ইত্যাদি রাখা আছে । প্রতিটা জিনিসই বিভিন্ন মাপের দু-তিনটে করে । রান্নাঘরে রাঁধুনীকে ব্যস্ত দেখে, চারপাশটা আর একবার সতর্কভাবে দেখে নিয়ে, সবচেয়ে ছোট শাবল আর কুড়ুলটা হাতিয়ে নিয়ে, ওপরের ঘরে ফিরে এলাম । ছোটখাট জিনিস দু্টো দিব্যি হাতিয়ার হিসাবে দারুণ কাজে লাগানো যাবে । ভাইয়ের সাথে আরও একদফা শলা-পরামর্শ সেরে, স্নান সেরে খেতে এলাম । দাদুর সাথে হালকা কথাবার্তার সাথে সাথে খাওয়ার কাজ সেরে, ওপরে এসে সটান শুয়ে পড়লাম । ক্লান্তির জন্য ঘুম আসতে দেরী হল না ।
( ১৭ )
সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে ব্যাগের জিনিসপত্র নাড়া-চাড়া করছিলাম, এমন সময় রতন এলো । ব্যাগ গোছাচ্ছি দেখেই বোধহয় আর কিছু বলল না । রতন নিচে যাওয়ার একটু পরেই আমি জলখাবার খেতে নামলাম । খাওয়ার পর বললাম, “রাতে একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ব, কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে”।
দাদু একটু উদাসভাবে বললেন, “ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেল তাহলে ?” আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে, ওপরে চলে এলাম । ল্যাপটপে তোলা ছবিগুলো সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর পরিকল্পনামতো সেনগুপ্ত সাহেবকে মেসেজ করলাম । একটু পরেই রিপ্লাই এলো, ‘আমার পক্ষে পুরো ব্যাপারটা খুব ঝুঁকির হয়ে যাবে, প্রাণ সংশয়ও হতে পারে, আমার এই সব ঝামেলায় জড়ানো উচিত নয়, যা করার পুলিশ করবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি । কয়েকটা ফোন সেরে নিচে এলাম । দাদুর সাথে গল্প করতে করতে রাতের খাওয়া শেষ করলাম । “সকাল সকাল বেরব”, বলে ওপরে এসে, চুপচাপ শুয়ে পড়লাম । বেশ কিছু সময় পর ঘরের দরজার বাইরে হালকা পায়ের শব্দ কানে আসতে বুঝলাম, রতনের নজরদারি চলছে । শব্দ না করে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম । বারোটা বাজতেই উঠে তৈরী হতে লাগলাম । প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে, বেরুবার আগে, একই মেসেজ, ভাই আর সেনগুপ্ত সাহেব, দুজনকেই পাঠিয়ে দিলাম — “ইট’স শো-টাইম”।
( ১৮ )
আগের দিনের মতোই, বেরনোর আগে নিচের তলাটা একবার চট করে ঘুরে এলাম । গতরাতের মতোই পুরো বাড়িতে আমি একা । আর দেরী না করে ছাদে উঠে এলাম । কালকের তুলনায় আজ বৃষ্টির বেগটা একটু বেশিই মনে হল । ছাদের কোণায়, নিমগাছের কাছে পৌঁছেই দেখতে পেলাম, গেটের দিক থেকে টর্চ জ্বেলে কয়েকজন এদিকেই আসছে । হাতঘড়ির স্টপওয়াচটা চালু করে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম । লোকগুলো বাড়ির সামনে দিয়ে ল্যাবের দিকে এগিয়ে যেতেই, নিচে নেমে এলাম । যতটা সম্ভব গাছ-গাছালির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে, দ্রুতপায়ে এলাম গেটের কাছে । কালকের মতোই দুটো গাড়ি । হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ি দুটোর কাছে গিয়ে, ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম, আজ গাড়ি দুটোতে কেউ নেই । পরিস্থিতি আমার অনুকূল দেখে একটু খুশিই হলাম ।
এবার এমার্জেন্সী কিট থেকে আমার প্রিয় একফুট লম্বা আর একদিকে খাঁজকাটা, ধারালো কমাণ্ডো নাইফটা বের করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম । দুটো গাড়ির চাকার হাওয়া বের করে ফুয়েল পাইপটা কাটতে কাটতে মনে হচ্ছিল, সময় যেন অতিদ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে । কার্য সমাধা করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝলাম, এই ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা রাতেও প্রচণ্ড উত্তেজনায় ভেতরে ভেতরে বেশ ঘেমে গেছি । যেভাবে তেল পড়ছিল, সেটা দেখে মনে মনে আন্দাজ করলাম, ‘ট্যাঙ্ক যদি ফুল থাকে তো খালি হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে । কালকের মতো সময় নিলে ভালো, এখানেই আটকে যাবে । না হলেও বেশি দূরে যেতে পারবে না । এখন পুলিশ সময়মতো এলে হয়’। পেছনের ফোর্ড এণ্ডেভার গাড়িটার নিচে নিজের একটা মোবাইল, চালু করে, জায়গা মতো স্টিকিং-প্লাস্টার দিয়ে আটকে দিলাম । পুরো কাজটা করে উঠতে অনেকটা সময় লাগল মনে হলেও ঘড়িতে আট মিনিটের সামান্য বেশি হয়েছে দেখে একটু আশ্বস্ত হলাম । যাই হোক, ‘দ্রুত পলায়নের রাস্তাটা কিছুটা হলেও বন্ধ করতে পেরেছি, আর যদি পালিয়েও যায়, তবে মোবাইল লোকেশান ট্র্যাক করে ধরে ফেলতে অসুবিধা হবে না’, এই ভেবে খুশি মনেই তৈরী হলাম ল্যাব অভিযানের জন্য ।
( ১৯ )
ঘুরপথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে পৌঁছালাম ল্যাবের পেছনের দিকের বকুল গাছটার কাছে । চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে চড়ে বসলাম গাছে । ফোকরটা দিয়ে মাথা গলাতেই মাকড়সার ফাঁদ আর নোংরা, সারা মুখে জড়িয়ে গেল । ভেতরে জমাট অন্ধকার । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কিছু ঠাহর হল না । কিছুটা অধৈর্য হয়েই দেওয়াল আঁকড়ে ঝুলে পড়লাম ভেতরে । মাটি থেকে ফোকরের উচ্চতা আন্দাজ করে মনে হল, মেঝে বেশ নিচুতে । যতটা সম্ভব নিঃশব্দে কপাল ঠুকে লাফিয়ে নামলাম । ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল । হাতড়ে হাতড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হল, স্টোররুমটা আমার আন্দাজের তুলনায় বেশ বড় । চারপাশে অনেক ছোট-বড় বস্তা, প্যাকেট, কৌটো ইত্যাদি রাখা আছে । পা টিপে টিপে কিছুটা এগোনোর পর দরজাটা পেলাম । ভেজানো দরজাটা ঠেলে ল্যাবে ঢুকতেই অ্যালকোহলের ঝাঁঝালো গন্ধের সাথে আরও একটা কটু গন্ধ নাকে এলো, যে গন্ধটা সচরাচর শিব মন্দিরের আশেপাশে পাওয়া যায়, গাঁজার গন্ধ । বুঝলাম মৌতাত চলছে । হঠাৎ একটা চাপা শব্দ কানে আসতেই সতর্ক হয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালাম । কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না । মনে হল, যেদিক থেকে এলাম, সেই দিক থেকেই শব্দটা এলো । কিন্তু দেওয়াল পর্যন্ত গিয়েও কিছু দেখতে পেলাম না । বামদিকে যাওয়ার জায়গা নেই বলে এবার ডানদিকে চললাম । অন্ধকারে আবার হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যেতে যেতে, কিছুটা গিয়ে পায়ে শক্ত বাক্সের মতো কিছু ঠেকল । হাত বুলিয়ে মনে হল কাঠের প্যাকিং বাক্সজাতীয় কিছু হবে । সেগুলোকে একপাশে রেখে সরে আসতেই হঠাৎ আবার একটা শব্দ পেলাম । যেন শব্দটা বাক্সগুলোর ওপাশ থেকেই আসছে । বাক্সগুলোর পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতেই একটা সিঁড়ি পেলাম, নিচের দিকে নেমে গেছে ! অদম্য কৌতুহল নিয়ে নামতে লাগলাম, শব্দের উৎসের খোঁজে ।
to be continued…
Chapter 6 (Coming soon, 25th April, 18)