অপ্রত্যাশিত চিঠি
-রুদ্র প্রসাদ
পঞ্চম পর্বের পর…..
( ২০ )
কয়েকটা ধাপ নামতেই একটা ক্ষীণ আলোর রেখা চোখে পড়ল । আরও একটু নামতেই দেখি একটা বড়-সড় আন্ডারগ্রাউন্ড ঘর । অগোছালো ঘরের ভেতর দুটো কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে, আলোকিত করার পক্ষে যথেষ্ট না হলেও মোটামুটি ভেতরটা বেশ দেখা যাচ্ছে । যদিও দেওয়ালে রঙ না থাকায়, দেওয়াল গুলোকে কালচে মনে হচ্ছিল, ভালো করে দেখে বুঝলাম, প্লাস্টার করা আছে ঠিকই, তবে অযত্নের ফলে বেহাল দশা । দেওয়ালে কয়েক জায়গায় জলের ছাপও চোখে পড়ল । ঘরটা বড়ই স্যাঁতসেঁতে । ঘরের ভেতর কয়েকটা এক মানুষ সমান উঁচু, প্রমাণ সাইজের সেল্ফ আর একপ্রান্তে দুটো বড় টেবিল রয়েছে, যেখানে ল্যাবে দেখা সেই তিনজন ষণ্ডামার্কা লোক কি যেন কাজে ব্যস্ত । ঘরের অপরপ্রান্তে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম । একটা লোক আঙ্গুল উঁচিয়ে, ধমকে চলেছে আর সামনে তিনটে চেয়ারে তিনজনকে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে ! ভালো করে দেখতেই তিনজনকে চিনতে পারলাম । বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি দাদু, হরিদাদু আর সদ্য পরিচিতা রাই !!!
পকেট থেকে দ্বিতীয় মোবাইলটা বের করে ঘরের ভেতরের অবস্থার ফটো আর ভিডিও তুলে সেনগুপ্ত সাহেবকে পাঠাতে গিয়ে, খেয়াল করলাম নেটওয়ার্ক নেই । একবার মনে হল, ওপরে গিয়ে মেসেজগুলো পাঠিয়ে দিয়ে আবার ফিরে আসব । কিন্তু ঠিক সেই সময়, সামনে দাঁড়ানো লোকটা একটা চড় মারল দাদুকে । দেখে নিজের অজান্তেই চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল । স্থির করলাম, আর দেরী করা ঠিক হবে না । এমার্জেন্সী কিট থেকে পাঞ্চার দুটো বের করে দুহাতের আঙ্গুলে গলিয়ে নিলাম । কমাণ্ডো নাইফটা কোমরের হোল্ডস্টারে ঝুলিয়ে শাবলটাকে ডানহাতে নিলাম । সেল্ফের আড়ালে লুকিয়ে এগোতে এগোতে সকলের অবস্থান লক্ষ্য করছিলাম । দেখলাম ষণ্ডামার্কা লোক তিনটে নিবিষ্ট মনে কাজে ব্যস্ত । আরও একটু এগোতে দেখলাম, রতন আর সেই কমবয়সী ছেলেটা এমনি দাঁড়িয়ে আছে আর আবীর মেঝেতে বসে খৈণী ডলছে, সেল্ফের আড়াল ছিল বলে প্রথমে এদের দেখতে পাইনি । তবে যে লোকটা দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে হম্বি-তম্বি করছে, একপাশ থেকে তার মুখটা দেখে চেনা চেনা লাগলেও আগে কোথায় দেখেছি, মনে পড়ল না । কিন্তু সেই লোকটাই যে পালের গোদা, সে বিষয়ে কোনো সংশয় রইল না । আপাতত কারোর কাছেই কোনো হাতিয়ার চোখে পড়ল না । ওদের সবচেয়ে কাছের সেল্ফটার পেছনে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবলাম, ‘আচমকা আক্রমণে এরা নিশ্চয়ই হক্-চকিয়ে যাবে, আর সেই অবস্থার সুযোগটা আমাকে কাজে লাগাতেই হবে’ ।
( ২১ )
শরীরটা টানটান করে একটা লম্বা শ্বাস নিলাম । ডানহাতের শাবলটা লাঠির মতো করে ধরে মনে মনে প্রস্তুত হলাম । তারপর নিয়মিত চর্চা করা ক্যারাটের শিক্ষা আর মনের সাহস সম্বল করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । প্রথমে রতনের মাথার পেছনে সজোরে শাবলের বাড়ি মেরেই সামনের লোকটাকে একটা জোরালো সাইড-কিকে ছিটকে দিলাম । কমবয়সী ছেলেটা কিছু করে ওঠার আগেই তার চোয়াল লক্ষ্য করে একটা ঘুসি চালিয়ে দিলাম । এবার দেখি, আবীর একটা কাটারী হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে । দেরী না করে পাশের সেল্ফটা তার ওপর উল্টে দিলাম । এবার বামহাতে ছুরিটা নিয়ে তিনজনের বাঁধন কেটে দিলাম । দেখলাম, বাকি তিনটে লোক এদিকে এগিয়ে আসছে । একসাথে তিনজনকে দেখে, চট করে বামদিকে সরে গিয়ে সামনের লোকটার ডানহাঁটুর নিচে একটা শাবলের ঘা লাগাতেই লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল । আর আমিও সুযোগ বুঝে তার মাথায় আর এক ঘা লাগানোর সাথে সাথে বাঁহাতে ধরা কমাণ্ডো নাইফটা পাশের লোকটার পেট লক্ষ্য করে চালিয়ে দিলাম । দুজনকে একসাথে ধরাশায়ী হতে দেখে তৃতীয় লোকটা থমকে গিয়ে অন্যদিকে সরে গেল । তার দিকে এগোতে গিয়ে খেয়াল করলাম পালের গোদা লোকটা উঠে বসে, পকেট থেকে কিছু একটা বের করছে । অনুজ্জ্বল আলোতেও কালো চকচকে জার্মান মাউজারটা চিনতে কষ্ট হল না । দুপাশে বাল্বের আলো থাকলেও ঘরের মাঝখানে বেশ অন্ধকার । আমি সেই সুযোগে চট করে লাফিয়ে একটা সেল্ফের আড়ালে সরে যেতে যেতে শব্দে বুঝলাম, দুটো গুলি পর পর এদিকেই ছুটে এলো । তবে আলো-আঁধারির জন্যই বোধহয় নিশানা ঠিক করে উঠতে পারে নি । দেরি না করে, আড়াল থেকে বেরিয়েই শাবলটাকে লোকটার হাত লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম । হাতে না লেগে কাঁধে লাগতেই লোকটা আবার পড়ে গেল । কাঁধে ঝোলানো কুড়ুলটা বের করে ওপাশের লোকটার এগোতে যাব এমন সময় হঠাৎ একটা ছুরি এসে সেল্ফটার গায়ে লাগল । সচকিত হয়ে দেখি, এ সেই কমবয়সী ছেলেটার কাজ ! বামহাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখের রক্ত মুছে, আবার একটা ছুরি ছোঁড়ার জন্য তৈরী হচ্ছে । কিন্তু ছুরিটা ছুঁড়তে পারল না । আবীরের হাত থেকে ছিটকে কাটারীটা মনে হয় হাতের কাছাকাছি পড়েছিল, সেটা দিয়েই এক কোপে সেই ছেলেটাকে ধরাশায়ী করল হরিদাদু ! বাকি ওপাশের লোকটাকে দেখে মনে হল ভয় পেয়েছে, সেল্ফের ওপাশ থেকে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে । আমার দিকে নজর নেই দেখেই ঘুরে তার পেছনে চলে এলাম । কুড়ুলের উল্টো দিকটা দিয়ে মাথায় মারতে যেতেই বোধহয় বুঝতে পেরে একটু সরে গেল । ঘা টা মাথায় না লেগে পিঠের ওপরের দিকে লাগায়, লোকটা সেল্ফটার সাথে ধাক্কা খেয়ে এদিকে ঘুরল । সঙ্গে-সঙ্গে আমার একটা রাউণ্ড-হাউস কিক সপাটে তার কানের গোড়ায় পড়তেই লোকটা কাটা কলা গাছের মত, ধপ করে মাটি নিল ।
এবার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেই লোকটা দাদুকে টেনে-হিঁচড়ে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর আবীরও সেল্ফ ঠেলে বেরিয়ে এসে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে । দৌড়ে গিয়ে কাঁধের এক জোরালো ধাক্কায় আবীরকে পেড়ে ফেললাম বটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরী হয়ে গেছে । সেই লোকটা দাদুকে টানতে টানতে নিয়ে সিঁড়ির অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে ।
( ২২ )
কিছুটা সামলে পিছু নিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছাতেই ওপর থেকে আরও দুটো গুলি ছুটে এলো । তারপর আবার সব চুপচাপ । একটু অপেক্ষা করে সতর্কভাবে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম । টর্চ জ্বালিয়ে স্টোররুমটা ভালো করে দেখলাম, পাখি উড়ে গেছে । কেউ কোথাও নেই । এগিয়ে দেখলাম বাইরে বেরোনোর দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ । পরীক্ষা করে বুঝলাম, এই মজবুত দরজা ভাঙা, আমার একার পক্ষে সম্ভব নয় । সুতরাং সেই ফোকর গলেই বেরোতে হবে । দুজনকে সাথে নিয়ে কাজটা যথেষ্ট কষ্টকর হবে । কিভাবে করব, ভাবতে ভাবতে নিচে গেলাম । দেখি, সেই কমবয়সী ছেলেটার রক্তে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে আর হরিদাদু চেয়ারে বসে শূন্যদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, কাটারীটা তখনও হাতে ধরা ! আর রাই তখনও অচৈতন্য …!!!
কাছে গিয়ে হাত থেকে অস্ত্রটা সরিয়ে দিয়ে, কয়েক বার ডেকেও কোনো সাড়া পেলাম না । কাঁধে হাত দিয়ে একটু নাড়া দিতে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আমাকে সামনে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ল । দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখেই একটু কড়া ভাবে বললাম, “এখন কান্নাকাটি করার সময় নয় । আরও অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে” । চারপাশে চোখ চালিয়ে দেখলাম একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা । দেখি আবীর আর সেই ছুরিতে জখম লোকটা নড়ে-চড়ে উঠে বসার চেষ্টা করছে বটে, তবে বিশেষ কিছু করার অবস্থায় আছে বলে মনে হল না । তবুও কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে, ঘুসি আর লাথি সহযোগে, দুটোকেই আবার শুইয়ে দিলাম । তারপর আমার নাইলনের দড়িটা থেকে কয়েকটা ছোট ছোট টুকরো করে সবকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে, মুখে গামছা ছিঁড়ে গুঁজে দিলাম । পরে আবার মনে হতে সবার পাগুলোও বেঁধে দিলাম । দড়িটা বেশ ছোট হয়ে গেলেও বাইরে যাওয়ার সময় যদি দরকার পড়ে, তার জন্য এখনও পর্যাপ্ত রয়েছে দেখে ভালো লাগল । ভাবলাম, ‘ভাগ্যিস দড়িটা বড় করে কিনেছিলাম’ ।
এবার রাইকে ধরাধরি করে হরিদাদুর সঙ্গে ওপরে উঠে এলাম । কাঠের প্যাকিং বাক্সগুলোকে সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে ফোকরের কাছে যাওয়ার রাস্তা করে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগল । প্রথমে নিজে বেরিয়ে এসে দড়ির একটা প্রান্ত গাছে ভালো করে বেঁধে দিয়ে আবার ফিরে এলাম । হরিদাদুকে ঠেলে-ঠুলে ফোকর দিয়ে ওপাশে পাঠানোর পর রাইকে কাঁধে তুলে বাইরে বের করে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল ।
( ২৩ )
বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়েই চলেছে । চোখে-মুখে জলের স্পর্শ পেয়ে রাইয়ের জ্ঞান ফিরলেও আচ্ছন্নভাবটা কাটলো না । আমার কাঁধে ভর করে কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে, টলতে টলতে চলতে লাগল । বাড়ির কাছে পৌঁছেছি এমন সময়, বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে পুলিশের সাইরেন কানে এলো । একটু পরেই রাতের অন্ধকার ভেদ করে গাড়ির আলো দেখতে পেলাম । দেখতে দেখতেই পুলিশ এসে পড়ল, সামনেই সেনগুপ্ত সাহেব স্বয়ং ! কাছে আসতেই আমি তাড়াতাড়ি করে বললাম, “অনেক দেরী হয়ে গেছে, ওরা দাদুকে ধরে নিয়ে গেছে । ওদিকের গ্লাসহাউসের পেছন দিকটায় একটা স্টোররুম আছে, সেই স্টোররুমের নিচের বেসমেন্টে একটা লাশ পড়ে আছে । আর বাকি পাঁচজন লোক জখম হয়েছে, তাদের বেঁধে রেখে এসেছি” ।
সেনগুপ্ত সাহেব অধস্তন অফিসারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে, হরিদাদু আর রাইকে পুলিশের জিম্মায় চিকিৎসার জন্য পাঠানো কথা বলে এদিকে আসতেই আমি আবার বললাম, “ওদের বেশি দূরে যেতে দেওয়া যাবে না, তাড়াতাড়ি চলুন”। বাইরে এসে দেখি সেই পিক-আপ ভ্যানটা তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে । মনে মনে ভাবলাম, ‘ভালোই হল, একটা গাড়ি খুঁজে বের করতে পারলেই কেল্লা ফতে’, ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, উত্তেজনার বশে আমার কীর্তির কথা কাউকে বলা হয়নি । পুলিশের গাড়ির দিকে যেতে যেতেই সেনগুপ্ত সাহেবকে অন্য গাড়িটার মোটামুটি বর্ণনাসহ চাকার হাওয়া বের করে দেওয়া, ফুয়েল পাইপে ফুটো করা আর মোবাইল রেখে দেওয়ার করার কথাগুলো বলতেই অ্যাডিশনাল এস.পি. সাহেব “ওয়েল ডান”, বলে আলতোভাবে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন । চলতে চলতেই ফোন করে আমার মোবাইল নম্বর আর গাড়ির কথা জানিয়ে দিয়ে অবিলম্বে নম্বরটা ট্র্যাক করার নির্দেশ দিলেন ।
সঙ্কীর্ণ রাস্তা বলেই পুলিশের গাড়িটা ব্যাক-গিয়ারে পিছিয়ে আনতে হল বালিসাই-তাজপুর সি-বীচ রোড পর্যন্ত । গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া দুজন কনস্টেবল, সেনগুপ্ত সাহেব আর আমি । সেনগুপ্ত সাহেবের কাছে একটা পুলিশ স্পেশাল ০.৩৮ বোরের কোল্ট রিভলবার থাকলেও বাকি দুজনের কাছে আদ্যিকালের ০.৩০৩ ব্রিটিশ লী-এনফিল্ড রাইফেল দেখে খুব একটা ভরসা হল না । ওদের কাছে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে ভেবেই, দাদুর জন্য দুশ্চিন্তা হতে লাগল । ইতিমধ্যে একটা ফোন আসায় সেনগুপ্ত সাহেব কথা বলতে লাগলেন ।
ফোন রেখে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে, আমাকে উৎকণ্ঠিতভাবে বসে থাকতে দেখে সেনগুপ্ত সাহেব বললেন, “ডোন্ট ওয়ারি, এখান থেকে বেরনোর সব রাস্তা বন্ধ, পেট্রলিং টীমকে বলা হয়েছে, এছাড়া কোস্টাল গার্ডের টীমকেও ইনফর্ম করা আছে, প্রয়োজনে সাহায্য পাওয়া যাবে । তাছাড়া লোকেশান ট্র্যাক হয়েছে, আমাদের থেকে তিন-চার কিলোমিটার সামনে আছে । আমরা সঠিক রাস্তায় যাচ্ছি । একটু পরেই ধরে ফেলব, পালানোর কোনো জায়গা নেই”। একটু থেমে আবার বললেন, “তোমার দাদুর কোনো ক্ষতি হতে দেব না, টেক মাই ওয়ার্ড”। বলেই একটা ট্যাবলেটে ম্যাপটা দেখালেন । জিপিএস সিস্টেম অনুযায়ী আমার মোবাইল লোকেশান সামনেই, তবে খুব আস্তে আস্তে যাচ্ছে । নির্দেশ মতোই তবে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার জন্য গাড়ি চলল লাফিয়ে লাফিয়ে । বাইরে বৃষ্টিটাও তখন ধরে এসেছে ।
to be continued…
Chapter 7 (Coming soon, 26th April, 18)