স্বপ্নের দিন

স্বপ্নের দিন (কেট চপিন)

অনুবাদে – বর্ণালী জানা সেন 

 

ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া আর কী! নাহলে আচমকা তার হাতে কড়কড়ে এই পনেরো ডলার! বিশ্বাসই হয়না। টাকার ভারে পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া ব্যাগটা উপচে পড়ে। বুকের ভেতরটা উথলে ওঠে মিসেস সমার্সের। উফফ এত টাকা একসঙ্গে কখনো দেখেননি তিনি। নিজেকে এত কেউকেটা বহুদিন মনে হয়নি তাঁর।
কিন্তু এত টাকা খরচ করেন কীভাবে! না না, ভালোকরে ভেবেচিন্তে যা করার করতে হবেখন। স্বপ্নের ঘোরে দু-একদিন কেটে গেলেও মনে মনে হিসেব নিকেশ চলে পুরোদমে। খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। এখন তাড়াহুড়ো করে পরে কপাল চাপড়ালে চলবে না। মাঝরাতে সবাই গভীর ঘুমে…কিন্তু মনে মনে তাঁর হিসেব চলে যায়। নানান ভাবনা খেলে মাথায়। খুব গুণে গেঁথে খরচ করতে হবে টাকাগুলো।
জেনির জুতোর জন্য মোটামুটি যা খরচ হয় তার সঙ্গে আর দু-এক ডলার যোগ করলেই একটা ভালো জুতো হয়ে যাবে। সে জুতো টেঁকসইও হবে। ওটা আগে কেনা দরকার। ওর জুতোটা তো ছিঁড়ে একেবারে ফর্দাফাঁই। তারপর জেনি, ম্যাগ আর ছেলেদের নতুন শার্টওয়েস্ট-এর জন্য কয়েক গজ কাপড়ও কিনতে হবে। পুরনোগুলো অবশ্য রিফু করে চালিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু টাকাটা যখন হাতে এলই! আর ম্যাগের এবার একটা গাউন না হলেই নয়। দোকানে কাচের শোকেসের ভেতরে কত সুন্দর সুন্দর ডিজাইন দেখে রেখেছেন তিনি। সস্তার কাউন্টারে খুব একটা কিছু দামও হয়তো পড়বেনা। এই কেনাকাটা করেও নিজের জন্য দুজোড়া মোজা কি হার কেনা যাবে না! খুব যাবে। হ্যাঁ হ্যাঁ দুজোড়াতেই এখন অনেকদিন চলে যাবে। সূঁচ সুতো নিয়ে রিফু করার হাত থেকে অন্তত কিছুদিনের জন্য রেহাই। ও আর হ্যাঁ ছেলের জন্য মাথার ক্যাপ আর মেয়েদের জন্য কেতাদুরস্ত সেলার হ্যাট কিনে নিলেই ব্যাস। তাঁকে আর পায় কে! তাঁর বাচ্চারা নতুন জামাকাপড় পরে ঝলমলিয়ে বেড়াবে এই ভেবেই তাঁর আনন্দ…তাঁর শান্তি। এমন সুযোগ আর কবারই বা এসেছে তাদের জীবনে!
নতুন নতুন কল্পনায় নিজেকে বড় অস্থির লাগে। দু চোখের পাতা এক হয় না রাতে। মিসেস সমার্স হওয়ার আগে এমন রঙিন ফুরফুরে দিন তিনি অনেক দেখেছেন। পড়শিরা নিজেদের মধ্যে সেসব কথা বলাবলিও করে। তখনও তিনি মিসেস সমার্স হওয়ার কথা ভাবেননি। পুরনো দিনের কথা আর ভাবেন না তিনি। অতীত খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চান না তিনি। সংসারের নিত্য অভাব অভিযোগ মেটাতে মেটাতেই দিন গেল তাঁর। তাঁর জীবনে কোনো অতীত নেই…ভবিষ্যতের ছবিটাও খুব আবছা। শুধু মনে হয় বিরাট এক দৈত্য গিলে খেতে আসছে তাঁকে। তবে ভগবানের ইচ্ছায় সে দৈত্যটা কোনোদিন কাছে আসে না।
দরাদরি কাকে বলে মিসেস সমার্সের চেয়ে ভালো আর কেই বা জানে! কোথায় কোন জিনিসটা সস্তায় বিকোচ্ছে সব তাঁর নখদর্পণে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে লক্ষ্যবস্তুটার দিকে এগিয়ে তাকে হাশিল করে নেওয়ার শিল্পটা একেবারে নিখুঁতভাবে রপ্ত করেছেন তিনি। দরকার হলে ভিড়ের মধ্যে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে নিজের জায়গায় পৌঁছে যেতে পারেন…তারপর যতক্ষণ না পালা আসে দোকানির সামনে ঠায় দাঁড়িয়েও থাকতে পারেন। সকাল থেকে রাত। জীবন তাঁকে এইটুকু ধৈর্যের শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু জিনিসটা তাঁর চাই। সেটা না নিয়ে এক পাও নড়েন না তিনি।
দেখতে দেখতে চলে এল সেই দিন। আজ কেনাকাটা করবেন তিনি। শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছে আজ। দুপুরে হালকা কিছু খেয়ে নেবেন কি? খাওয়ার কথা একবার মনে হয়েছিল বটে কিন্তু খাওয়া আর হয়নি। বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়ে…জিনিসপত্র গুছিয়ে গাছিয়ে নিজে তৈরি বেরোনোর ব্যস্ততায় দুপুরে খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন তিনি।
দোকানের কাউন্টারে ভিড় নেই তেমন। শোকেসে শার্টের কাপড়, নকশা তোলা লন ক্লথ দেখতে দেখতে ব্যস্ত শত শত ক্রেতার ভিড় ঠেলে কাউন্টারে যাওয়ার কথা ভেবেই দুবার ঢোঁক গেলেন মিসেস সমার্স। নিজের রিভলভিং চেয়ারটায় বসে যান আরো কিছুক্ষণ। পা দুটো যেন অবশ হয়ে আসে। শেষমেশ চেয়ার ছেড়ে উঠে কাউন্টারের ওপর আপন মনে দুটো হাত মেলে দেন। হাত তাঁর অনাবৃত। কোনো গ্লাভ নেই। হঠাৎইহাতে যেন কোনো নরম স্পর্শ এসে লাগে…আহ কী তুলতুলে জিনিসটা…একেবারে পেঁজা তুলো! কী এটা! এ যে রাশি রাশি সিল্কের মোজা! পাশের বোর্ডেই দাম লেখা। এখন সেল চলছে। অনেক কম দামে মিলছে এই মোজা। দু ডলার পঞ্চাশ সেন্টের বদলে মাত্র এক ডলার আটানব্বই সেন্ট। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো কমবয়েসি সুবেশা মেয়েটি চটজলদি এগিয়ে আসে তাঁর সাহায্যে… ‘ম্যাডাম আমাদের এইসব সিল্কের হোসিয়ারি একদম নতুন। আপনি চাইলে পরখ করে দেখতে পারেন’। মিসেস সমার্সের মুখে চওড়া হাসি। নিজেকে খুব দামি মনে হয় তাঁর। মোজা তো কোন ছার যেন আস্ত এক হিরের মুকুট কিনতে এসেছেন তিনি। কত সাধাসাধি এদের… ‘ম্যাডাম একবার পরীক্ষা করে নিন… একবার পরে দেখুন’। উফফ পারেও বটে! তবে সেই নরম তুলতুলে জিনিসটাকে কিছুতেই হাত থেকে ছাড়তে পারেন না তিনি… বার বার ছুঁয়েও সাধ মেটে না। হাতে লেগে থাকে জিনিসটার নরম আদর। মোজাদুটো দুহাতে তারিয়ে তারিয়ে দেখেন…সাপের মতো হিলহিলিয়ে জিনিসটা তাঁর আঙুলের মাঝখান দিয়ে গলে পড়ে। শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় তাঁর। তাঁর শুকনো বিবর্ণ দুটো গালে বিন্দু বিন্দু রক্ত জমা হয়। দোকানি মেয়েটির দিকে মুখ তুলে তাকান তিনি… ‘এরমধ্যে সাড়ে আট সাইজের কিছু হবে’।
‘ হবে…প্রচুর হবে। এছাড়া অন্য সাইজের মোজা কমই রয়েছে দোকানে’।
রঙের যেন মেলা বসেছে…আসমানি, ল্যাভেন্ডার। তাছাড়া কালো, বাদামির নানা শেড আর ছাই রঙের মোজা তো রয়েছে ঝুড়ি ঝুড়ি। একজোড়া কালো মোজা বেছে নেন তিনি। অনেকক্ষণধরে খুঁটিয়ে দেখেন…যেন বুনোটটা একবার যাচাই করে নিচ্ছেন ভাবখানা এমন। দোকানি বলে ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। হাজার ঢুঁড়েও এ জিনিস মেলে না।
‘এক ডলার আটানব্বই সেন্ট…তাই তো? ঠিক আছে এই মোজাজোড়াই দিন তাহলে’…এই বলে তিনি পাঁচ ডলারের নোট বাড়িয়ে দেন দোকানির দিকে। বাকি টাকা আর মোজার প্যাকেটটার জন্য কাউন্টারে একটু অপেক্ষা করেন মিসেস সমার্স। ইসস্‌কতটুকু একখানা প্যাকেট দিয়েছে দেখো! তাঁর তেল চিটচিটে ঝোলা ব্যাগে প্যাকেটটা যেন হারিয়েই গেল।
সস্তার কাউন্টারের দিকে আর পা বাড়ালেন না মিসেস সমার্স। লিফ্‌টে করে সোজা ওপরের তলায়। এখানে মহিলাদের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। ঘরের একটা ফাঁকা কোণে গিয়ে নিজের পুরোনো সুতির মোজাটা খুলে সদ্য কেনা রেশমি মোজাটা পায়ে গলিয়ে নেন তিনি। এসব তিনি কী করছেন…কেন করছেন …সে নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাতে চান না। এখন আর কোনো যুক্তি তক্কো ন্য…নিজের কাছে কোনো জবাবদিহিও নয়। মাথায় আর কিচ্ছু নেই তাঁর। রোজকার দিনযাপনের গ্লানি থেকে শুধু একটু মুক্তি চাই ব্যাস। এখন তিনই যা করছেন স…ব যন্ত্রের মতো। জীবনে এতসব দায়িত্বের বোঝা নিয়ে নিরন্তর লড়াই…হাঁফিয়ে গেছেন তিনি। একটু ছুটি চাই তাঁর।
নিজের রক্তমাংসের ওপর নরম রেশমের ছোঁয়া। প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যায়। গদিমোড়া এই চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়তে মন চাইছে তাঁর …এই মুহূর্তের বিলাসিতাটুকু শুষে নিতে চাইছে প্রাণ। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেন তিনি। তারপর একটানে খুলে ফেলেন নিজের জুতো। সুতির মোজাটা গোল্লা করে ছুঁড়ে দেন নিজের ঝোলা ব্যাগে। তারপর সোজা চলে যান স্টোরের জুতো সেকশনে। বসার চেয়ারটা নিজের মাপমতো ঠিক করে নেন। কোনো জুতোই আবার পছন্দ হয় না তাঁর। এটা নয় ওটা…এটা নয় সেটা..খালি খুঁত খুঁত করেই যান। নতুন মোজাজোড়ার সঙ্গে কোন জুতোখানা মানাবে ঠিক করতে হিমসিম খেয়ে যায় দোকানের কর্মচারী। তাঁরও মন ওঠেনা কিছুতে। শেষমেশ নিজের স্কার্ট খানা একটু উঁচুতে তুলে পা-টা সামনের দিকে বাড়িয়ে চকচকে, সরু মুখো বুট জোড়ার দিকে তেরছাভাবে চান। তাঁর পায়ের গড়ন…গোড়ালি এত সুন্দর! এগুলো কি তাঁর নিজের শরীরেরই অংশ! বিশ্বাস হয় না। এই সুন্দর পায়ের সঙ্গে মানানসই, ফ্যাশনদুরস্ত জুতো তাঁর চাই-ই চাই। দোকানের ছোঁড়াটাকে সাফ জানিয়ে দেন দাম দু-এক ডলার বেশি হোক…কিন্তু জিনিসটা তাঁর পছন্দের হওয়া চাই।
কতদিন হয়ে গেল এক জোড়া গ্লাভ কেনা হয়নি। কখনো সখনো দু একটা হয়তো কিনেছেন…তাও আবার সস্তার কাউন্টার থেকে। অত সস্তার জিনিস হাতের মাপমতো হবে…খাপে খাপে বসবে তা আশা করাটাও বোকামি। এবার তিনি আসেন গ্লাভ কাউন্টারে। কাউন্টারের নরম গদিতে কনুইটা ভর দিয়ে দাঁড়ান। এক সুন্দরী কমবয়সি মেয়ে মিষ্টি হেসে দামি চামড়ার গ্লাভে তাঁর হাত দুটো ঢেকে দেয়। কবজির ওপর গ্লাভটাকে একটু চেপে বোতামগুলো লাগিয়ে দেয় মেয়েটি। গ্লাভ পরা ছোট্ট সুন্দর হাত দুখানা দেখে দোকানি ও ক্রেতা…দুজনেই চুপ খানিক্ষণ। মিসেস সমার্সের এখন খুব তাড়া। আরো অনেক কেনাকাটা বাকি আছে তাঁর।
রাস্তায় কয়েক পা হাঁটলেই ম্যাগাজিন স্টল। দোকানের তাকে রাশি রাশি বই…ম্যাগাজিন। দুটো দামি ম্যাগাজিন কিনে নেন তিনি…সেই পুরোনো দিনের মতো যখন এমন শৌখিন বিলাসিতায় অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। প্যাকেট ছাড়াই ম্যাগাজিনদুটো নিয়ে রাস্তায় নামলেন তিনি। রাস্তার মোড়ে এসে স্কার্ট খানা একটু তুলে নিজেকে ভালো করে জরিপ করে নিলেন তিনি। তাঁর রেশমি মোজা, নতুন জুতো, হাতের খাপে খাপে বসা দামি গ্লাভ তাঁকে যেন আমূল বদলে দিয়েছে। নিজের ওপর এখন তাঁর অগাধ আস্থা। এই রাস্তার শত শত মানুষের ভিড়ে নিজেকে আর মোটেই ছোট মনে হচ্ছ না তাঁর। আজ তিনি এদেরই একজন।
হাঁটতে হাঁটতে খুব খিদে পেয়ে গেছে তাঁর। অন্য সময় হলে বাড়ি ফেরা অবধি পেটের খিদে পেটেই চেপে রাখতেন তিনি। বাড়ি ফিরে একটু চা বানিয়ে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় মুখে দিয়েই চলে যেত। কিন্তু আজ ভেতর থেকে কে যেন বলছে ‘ নিজেকে আর কষ্ট দিয়ো না’।
ওই রাস্তার কোণাতেই তো রেস্তরাঁ রয়েছে একটা। কিন্তু ওই কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সুযোগ তাঁর কোনোদিন হয়নি। বাইরে থেকে হাঁ করে রেস্তরাঁর জানালার দামি রেশমের পর্দা…দেওয়ালের ঝলমলে স্ফটিক…মান্যিগণ্যি বাবু বিবিদের কাছে আলতো পায়ে ওয়েটারদের ঘোরাফেরা…শাহি খানা পরিবেশনের দৃশ্য তিনি দেখেছেন। আজ তিনি নিজেই কাচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন। তাঁকে দেখে কেউ অবাক হয় না। কেউ অবজ্ঞায় মুখ বাঁকায় না। এতক্ষণ মিথ্যেই ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। ছোট্ট একটা টেবিলে গিয়ে বসে পড়েন তিনি…একদম একা। তাঁকে দেখামাত্রই অর্ডার নিতে ছুটে আসে ওয়েটার। কাঁড়ি কাঁড়ি তো আর খাবেন না তিনি। ভালো কিছু খাবার অল্প করে চেখে দেখবেন…ওই যেমন গোটা ছয়েক ব্লু পয়েন্ট *, একটা প্লাম্প চপ আর তার সঙ্গে একটু স্যালাড…ডেজার্টের মধ্যে একটা ক্রেম ফ্রাপে** আর একটু রাইন ওয়াইন। সবশেষে এক কাপ কফি।
খাবার আসতে এখনো ঢের দেরি। একা একা বসে উশখুশ করেন মিসেস সমার্স। রয়ে সয়ে গ্লাভ জোড়া খুলে টেবিলে রাখেন তিনি। তারপর একটা ম্যাগাজিন বের করে একটু চোখ বুলিয়ে নেন। ম্যাগাজিনের জোড়া পাতাগুলো ছুরির ভোঁতা দিকটা দিয়ে কাটতে থাকেন। আজ খুব ভালো লাগছে তাঁর। চারপাশের সবকিছুই খুব সুন্দর…বড় মায়াবি। বাইরে থেকে এতদিন যা মনে হত রেস্তরাঁর পরদাগুলো তারচেয়েও বেশি ধবধবে…আর দেওয়ালের স্ফটিকগুলোও যেন আরো ঝলমলে। তাঁর পাশে কত লোকজন…কেউ তাঁর দিকে নজর করছে না। তিনি ছোট্ট টেবিলটায় বসে নিজের মতো করে খেয়ে যান…এটা বুঝি তাঁর বাড়ির টেবিল…একদম তাঁর নিজস্ব। একটা হালকা বাজনা আসছে কানে। মৃদু বাতাস ভেসে আসছে জানালা দিয়ে। তৃপ্তি করে খাবারে কামড় দেন তিনি…প্রাণ ভরে স্বাদ নেন। আলতো করে চুমুক দেন সোনালি মদে। রেশমের মোজার ভেতর পায়ের আঙুলগুলো ঘষে নেন একবার। খাবারের দাম নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাঁর। খাবারের দাম মিটিয়ে ওয়েটারের জন্য বাড়তি একটা কয়েন রেখে দেন ট্রে-তে। আহ্লাদে আটখানা ওয়েটার মাথা নীচু সেলাম ঠোকে তাঁকে…বুঝি কোনো দেশের রাজকন্যা তিনি।
ব্যাগে এখনো টাকা রয়েছে। এবার কী করা যায়! হঠাৎ ই তাঁর চোখে পড়ে দুপুরের সিনেমার পোস্টার। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হলে ঢুকে তিনি দেখেন সিনেমা শুরু গেছে এর মধ্যে। হল একেবারে ভর্তি। এদিক ওদিক দু একটা খালি সিট পড়ে রয়েছে। তারই একটায় তাঁকে নিয়ে বসায় দ্বাররক্ষী। দামি দামি হাল ফ্যাশানের পোশাক আশাক পরে মহিলারা সব এসেছেন সময় কাটাতে। সিনেমা দেখার অছিলায় পপকর্ন আর ক্যান্ডি দিয়ে মুখ চালানো আর নিজেদের জামাকাপড়ের বিজ্ঞাপণ দেওয়া…হলে এসে এই তো তাদের কাজ। তবে মনোযোগী দর্শকও অবশ্য কিছু রয়েছে…সত্যিকারের সমঝদার। তাঁরা এসেছেন ছবির টানে। তবে মিসেস সমার্স যেভাবে সবকিছু হাঁ করে গিলে খাচ্ছিলেন তেমনটা আর কেউ করেনি…সামনের বড় পর্দায় হেঁটে চলে বেড়ানো অভিনেতা অভিনেত্রী থেকে শুরউ করে চারপাশের লোকজন…সবার মাঝে…সবকিছুর ভেতরে একেবারে ডুবে গেছেন মিসেস সমার্স। পর্দায় মজার দৃশ্য দেখে তিনি হাসেন…তারপরেই কেঁদে ভাসান। তাঁর পাশে বসা বাহারি পোশাক পরা মহিলাও ডুকরে কেঁদে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে একটু আধটু কথাও বলেন তাঁরা। ছোট চৌকো ফিনফিনে লেসের রুমাল দিয়ে মুখ চেপে হেঁচে ওঠেন সে মহিলা। মিসেস সমার্সের দিকে নিজের ক্যান্ডির বাক্সটা একবার বাড়িয়ে দেন।
সিনেমা শেষ। বাজনা থেমে যায়। শ্রোতের মতো লোকজন বেরিয়ে আসে রাস্তায়। স্বপ্নের ঘোর ভেঙে যায়। আবার সবাই বাস্তবের মাটিতে। যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে ট্রামের জন্য অপেক্ষা করেন মিসেস সমার্স।
ট্রামে উল্টো দিকে বসা মানুষটা একদৃষ্টে নজর করে যায় তাঁকে। তাঁর রুক্ষ ফ্যাকাশে মুখের ভাষা কি মানুষটা পড়ে ফেলতে চায় তবে! কী লেখা আছে ওই মুখে…ওই দুটো আকুল চোখে…মানুষটা অবাক হয়। সে মুখে বিশেষ কিছুই দেখতে পান না তিনি। তবে ভগবান যদি দেখার মতো চোখ দিতেন তাঁকে তাহলে হয়তো তিনি এক নজরেই পড়ে ফেলতে পারতেন সামনে বসা ওই ছোট্ট খাট্ট ওই মহিলার মনের ক্তহা…জেনে ফেলতেন তাঁর সেই ভীষণ আকুতি…এই গাড়ি যেমন চলছে চলুক…চলতেই থাকুক…আজ কাল পরশু…সারাজীবন!
*এক ধরণের ঝিনুক যা লং আইল্যান্ডের ব্লু পয়েন্টে পাওয়া যায়।
** এক ধরণের ফলের রস।

‘স্বপ্নের দিন’ গল্পটি কেট চপিনের ‘ আ পেয়ার অফ সিল্ক স্টকিংস’ এর অনুবাদ।

Loading

Leave A Comment