পরিণতি
-চিন্ময় মহান্তী
১
হাতের কালশিটে দাগটাতে পুরাতন ঘি বোলাতে বোলাতে রমা তাকিয়ে ছিল খড়ের চালার দিকে। ক্ষণিক পূর্বেই তার নেশাগ্রস্ত স্বামী চেলা কাঠ দিয়ে সোহাগ করেছিল হাতে , তার স্মারক হতে একটি যন্ত্রনা থেমে থেমে উঠছিল ।
একগুচ্ছ পুঁই শাক হাতে উঠানে দাঁড়িয়ে বিনু কাকিমা ডাক দিলেন , ‘ রমা -ও রমা , কই গেলি ? নে কয়টা শাক নিয়ে এলুম। ‘ বিনু কাকিমা রমার বাপের ঘরের মেয়ে আর সেই সূত্রেই রমার সঙ্গে তার ভাব ভালবাসা একটু বেশি। রমা বিনু কাকিমার ডাক শুনতে পেয়েই তড়িঘড়ি বাম হাতের কালশিটে দাগটা আঁচল দিয়ে ঢেকে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা পিঁড়ি আগিয়ে দিয়ে বলল ,” বসুন কাকিমা। ” বিনু কাকিমা বললেন , ” না রে রমা অনেক কাজ পড়ে আছে , নে-নে শাক কটা রাখ দিকিনি। ” রমা তার ডান হাতটি বাড়িয়ে দিল বিনু কাকিমার দিকে। তিনি শাক কটা রমার হাতে দিয়ে বললেন , ” কই মনাকে দেখছিনে ? ” মনা , রমার স্বামী ; তার পুরো নাম মনতোষ কিন্তু সেই যে ছোটোবেলায় তার মা আদর করে মনা বলে ডাকত সেই থেকেই সে গ্রামের লোকের কাছে মনা নামেই পরিচিত হয়ে আছে। বিনু কাকিমার মুখ থেকে অনাগত সম্ভাব্য প্রশ্ন শেষ করতে রমা উত্তর দিল , ” এই তো এই মাত্রই মুড়ি খেয়ে ক্ষেতে গেল , আজ ট্রাক্টরে চাষ দেবে তো তাই। ” এইখানে রমা যে অতি সুকৌশলে মিথ্যা অভিনয় করল তা প্রৌঢ়া বুঝতে পারলেন না। বিনু কাকিমা আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করার অবকাশ না পেয়ে বললেন , ” আচ্ছা , আসি রে। ” রমা সম্মতি জানাল। বিনু কাকিমা পশ্চাৎমুখী হতেই সে বাম হাতটির দিকে তাকিয়ে দেখল , আঁচলের ঢাকা ঠিকঠাকই আছে।
রমা আজ পর্যন্ত স্বামীর সমস্ত অত্যাচার গোপন করে এসেছে। বিশেষত বিনু কাকিমার কাছে কখনো কিছু বলেনা। তিনি রমার বাপের বাড়ির গ্রামের মেয়ে , জানতে পারলে সেই খবর রমার বাবা মা জানতে পেরে বৃদ্ধ বয়সে কষ্ট পাবে ভেবে রমা এই পথ অবলম্বন করেছে। এছাড়াও অপর একটি কারণ আছে , কোলের ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে স্বামীর সকল অত্যাচার সহ্য করে চলেছে। হায়রে অবলা নারী! সহ্য কোনো কোনো সময় প্রশ্রয় হয়ে উঠে অত্যাচারের মাত্রাকে অধিকতর তীব্র করে তোলে এবং তার পরিণতি ভয়াল আকার ধারন করে ।
২
দুপুর গড়িয়ে সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়তে শুরু করেছে। রমা বারান্দায় মাটির দাওয়ার উপর বসে আছে। তার অবিন্যস্ত চুলগুলি হালকা বাতাসে এলোমেলো উড়ছে । কোলের সন্তানটি রমার কোলে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মানুষটা সেই যে চেলা কাঠ দিয়ে সোহাগ করে গেল এখনো ফিরল না। তারই আগমনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে রমা। ভাতের হাঁড়িটা ফ্যান ঝরতে সেই যে উপুড় করেছে এখনো তেমনই রয়েছে। তার উপর কিছু মাছি ভনভন করে উড়ে উড়ে বসছে। বাসের বেড়াটা টপকে একটা বিড়াল ঢুকে পড়ল ঘরে , সেদিকে রমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
ঘরের ভেতরে কিছু গড়ানোর একটা শব্দ উঠল। বিড়ালটা ম্যাও ম্যাও করে কেঁদে উঠল। রমা সেটাকে তাড়াতে উঠে গিয়ে দেখল হাঁড়ির ভাত মাটির উপর পড়ে রয়েছে , হাঁড়িটি একদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে কোলের ছেলেটিকে একটি খাটের উপর শুইয়ে , পড়ে থাকা ভাতগুলি হাঁড়িতে কুড়াতে লাগল।
হঠাৎ বাইরে একটা শোরগোল শোনা যেতে রমা শকড়ি হাতেই বাইরে বেরিয়ে দেখল , তাদের উঠানে প্রচুর মানুষের ভিড়। সে কৌতুহলী হয়ে ভিড় ঠেলে দেখল তার স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে শুয়ে রয়েছে। রমা হুমড়ি খেয়ে পড়ল স্বামীর বুকে। হৃদপিন্ডটার কাছে কান রেখে সে কোনো স্পন্দন অনুভব করতে না পেরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে সে বার বার বলতে লাগলো , ” তুমি যদি নেশা না করে বড় রাস্তায় হাঁটতে তাহলে হয়তো আজ এই পরিণতি হতো না ! বারবার নিষেধ করলে শুধু আঘাত করে গেলে ! ” রমার বাড়ির উঠানের ভিড়টা ক্রমে পাতলা হতে শুরু করল। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো কোলের শিশুটির কান্না।