অপ্রত্যাশিত চিঠি – পর্ব ৮/৮

অপ্রত্যাশিত চিঠি
-রুদ্র প্রসাদ

 

 

সপ্তম পর্বের পর …

( ২৮ )

সন্ধ্যায় ড্রেসিংয়ের পর একা একা বসে পুরো ব্যাপারটা ভাবছিলাম, একটু তলিয়ে ভাবতেই কয়েকটা জিনিস পরিষ্কার হল, প্রথমতঃ আমি প্রথম দিন থেকেই পুলিশ আর চোরা-কারবারী, উভয়পক্ষের নজরে ছিলাম । দ্বিতীয়তঃ এখনকার প্রথম সাক্ষাতে পরিচয় পেয়েই চেনার ভান করলেও সেনগুপ্ত সাহেব আমার উপস্থিতির কথা আগে থেকেই জানতেন, নিজের অথবা ঘোষ ম্যাডামের সোর্স থেকে । তাছাড়া আমি না থাকলেও পুরো ঘটনাটা স্বাভাবিকভাবেই ঘটত, কারণ পুলিশ – এনসিবি ক্রমশই তাদের জাল গুটিয়ে আনছিল । মাঝখান থেকে আমি ঢুকে জড়িয়ে পড়েছি ।
ভাইকে ফোন করলাম । পুরো ঘটনাটা গুছিয়ে বলতে একটু সময় লাগল । ফোন রাখার পর মনে হতে লাগল, ‘দাদু প্যাকেটটা নিয়ে কি করলেন’, ভাবতে ভাবতেই চিঠিতে লেখা কথাগুলো মনে পড়ল । হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মাথায় এলো, সেনগুপ্ত সাহেবকে ফোন করতে গিয়েও করলাম না । আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার । কয়েকটা ফোন সেরে, কালকের মতোই খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম । খেয়াল করলাম, বাম কাঁধের ব্যথা ছাড়া আপাতত আর কোনো অসুবিধা নেই ।

( ২৯ )

আজ শুক্রবার । গতকালই ফিরে যাওয়ার প্ল্যান ছিল, কিন্তু হল না । সব ফর্মালিটি সেরে উঠতে দশটা বেজে গেল । দাদু অনেকটাই সুস্থ । হরিদাদুকেও অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছুটা শান্ত করা গেছে । সেনগুপ্ত সাহেবই গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন । সঙ্গে ডাক্তার, কম্পাউণ্ডার, রাঁধুনী আর পুলিশ, মোট চারজন সঙ্গী হল । সেনগুপ্ত সাহেব আশ্বাস দিলেন যে সন্ধ্যার আগেই সমীরের বডি পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন, তার মধ্যেই পোষ্ট-মর্টেম হয়ে যাবে । গাড়িতে আসার পথে বিশেষ কোনো কথা হল না । তাজপুর পৌঁছে নতুন রাঁধুনীকে আর রান্না করার দরকার হল না । সকলের জন্য লাঞ্চ-প্যাকেট আনা হয়েছিল, সে গুলো দিয়েই আহার পর্ব সমাধা হল ।
ওপরের ঘরে এসে আর্মস্লিং থেকে হাতটা বের করতেই যন্ত্রণা বেশ ভালো টের পাওয়া গেল । একটু সময় বিশ্রাম নিয়েই নিচে নেমে এলাম । কম্পাউণ্ডারের নাম শুভঙ্কর বাবু, তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, দাদু আর হরিদাদু ল্যাবের দিকে গেছেন, ডাক্তার জ্যোতির্ময় বাবু ও পুলিশ প্রদ্যোৎ বাবু সঙ্গে আছেন । রাঁধুনী শঙ্করদাকে দেখলাম জলখাবারের ব্যবস্থায় ব্যস্ত । আপাতত সেই প্যাকেটটার খোঁজ করার জন্য দাদুর ঘরে গেলাম । খুব বেশি মেহনত করতে হল না । আমার আন্দাজ সঠিক ছিল । ঠিক যেখানে ভেবেছিলাম, প্যাকেটটা সেখানেই আছে । এবার পুলিশ এলে শুধু বলে দিলেই চলবে । ঘর থেকে খুশি মনেই বেরিয়ে এলাম ।
বসার ঘরে বসে অলসভাবে একটা পত্রিকা নাড়া-চাড়া করছিলাম, এমন সময় পুলিশ এলো । একটু পরে সকলে মিলে গেলাম স্থানীয় শ্মশানে । চিতায় সমীরের বডিটা তোলা হতেই হরিদাদু কান্নায় ভেঙে পড়ল । দাহকার্য সম্পন্ন করে উঠতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল ।

( ৩০ )

বাড়ি ফিরে দেখি সেনগুপ্ত সাহেব এসেছেন, দাদুর বয়ান নেবেন । শ্মশান থেকে ফিরেছি বলে আর দাঁড়ালাম না । স্নান সেরে, জামাকাপড় পাল্টে নিচে এসে চা নিয়ে বসতে বসতে দেখি বয়ান নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে । দাদু বলছিলেন আর একজন পুলিশের লোক সেটা খাতায় লিখে নিচ্ছিলেন । এক জায়গায় এসে সেনগুপ্ত সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “প্যাকেটটা এখন কোথায় ?” দাদু কিছু বলার আগেই আমি বললাম, “ওটা দাদুর বিছানার বালিশের ভেতরে আছে”। দাদু কোনো কথা না বলে, শুধু সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়লেন ।
সেনগুপ্ত সাহেবের দৃষ্টি আমার দিকে দেখেই বললাম, “দাদু চিঠিতে ‘পুনশ্চঃ’ বলে লিখেছিলেন, ‘যেখানেই দেখিবে ছাই …’। আমি প্রথমে ধরতে পারি নি । অসমাপ্ত লাইনের বাকি কথাগুলো ভেবে, শুরুতে রতনকেই মূল টার্গেট ভেবেছিলাম, কিন্তু পরে বুঝেছি রতনকে অন্য কেউ পরিচালনা করছে । তাই কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল । পরে পেছনের দিকে পুকুর পাড়ে ছাইয়ের গাদায় শিমূল তুলা পড়ে থাকতে দেখেছিলাম । দাদুর ঘরে ঢুকেও মনে হয়েছিল যে ঘরটা বেশ কয়েকদিন ব্যবহার হয় নি । পুরো ধারণাটা দানা বাঁধতে সময় লেগেছে । আজ এসে দুয়ে দুয়ে চার করে সব মিলিয়ে দেখার পর নিশ্চিত হয়েছি । আসলে আমি একটা সময়ে দাদুকেই সন্দেহ করেছিলাম । এমনটা ভেবেছিলাম, হয়তো কোনোভাবে দুষ্ট চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এখন ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি চাইছেন বলেই আমাকে ডেকেছেন । কিন্তু যখন দেখলাম, চিঠির লেখা আর ল্যাবের ক্লিপবোর্ডের নোটশিটের লেখা, দুটো একেবারে আলাদা হস্তাক্ষর, তখন দাদুর ব্যাপারটা খানিকটা আঁচ করেছিলাম । তবে ঐ ইমপস্টারকে ওখানে দেখে সত্যি সত্যিই চমকে গিয়েছিলাম”।
এতোক্ষণ চুপ করে থাকার পর দাদু মুখ খুললেন, “ওরা কি কম ক্ষতি করেছে ? কতো প্রাণ অবহেলার বলী হয়েছে ! দিনের পর দিন চারাগুলোকে বিনা পরিচর্যায় ফেলে রেখেছে । কতো সবুজের হত্যা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই …”, বলতে বলতেই তাঁর গলা ধরে এল । ইতিমধ্যে সেনগুপ্ত সাহেব নির্দেশে পুলিশ প্যাকেটটা নিয়ে এসেছে, দেখলাম প্যাকেটটা একটা ন্যাকড়া জড়িয়ে বালিশের ভেতর রাখা ছিল । সেই জন্যই ছোট্ট প্যাকেটটা লুকোতে একটু বেশিই তুলা বের করতে হয়েছে ।
যখন সেনগুপ্ত সাহেব বাকিদের নিয়ে দাদুর বয়ান আর মাদকের প্যাকেট গুছিয়ে উঠতে যাবেন, এমন হরিদাদু এসে বলল, “সাহেব, আমি খুনী, আমার শাস্তি হওয়াই উচিত”। শুনে সেনগুপ্ত সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আপনি যা করেছেন তার জন্য সাজা নয়, আপনার পুরস্কার পাওয়া উচিত । কিন্তু বিভাগীয় গোপনীয়তার জন্যই কোনো কিছু প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না”। একটু থেমে, “তবে আপনাদের মতো কতিপয় আদর্শবাদী মানুষের জন্যই মনুষ্যত্ব আজও টিকে আছে”, বলেই পুলিশী কায়দায় বুট ঠুকে স্যালুট্ করলেন ।

( ৩১ )

ডাক্তারী পরিচর্যা আর নতুন রাঁধুনীর রান্না খেয়ে ওপরে এসে কয়েকটা ফোন সেরে নিলাম । ক্লান্তির জন্য ঘুমও পেয়েছে দেখে আজ আর ফেসবুকে ঢুকলাম না । মনে হল, ব্যথাটা বেশ কম, তবে সারতে সময় লাগবে । সমীরের ব্যাপারটা ছাড়া বাকি সব কিছু মোটামুটি ভালোভাবে মিটেছে বলে ভালোই লাগছিল । আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম ।
সকালে দাদুর সাথে ল্যাবে গিয়ে দেখি একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা ! দাদুকে অস্ফুটে বলতে শুনলাম, “সব শেষ করে দিয়েছে”, কথাগুলো হাহাকারের মতো শোনাল । কাছে গিয়ে বললাম, “শেষ থেকে আবার শুরু কর, নতুন করে সাজিয়ে তোলো তোমার সবুজবীথি”। চারপাশটা দেখতে দেখতে অনুচ্চস্বরে দাদু বললেন, “হুঁ, করতে তো হবেই । সবুজ না থাকলে যে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে” ।
হরিদাদুকে দেখলাম কিছুটা সামলেছে । কথা বলে জানতে পারলাম, প্রথমদিন এসে যখন আমি ওপরের ঘরে ফোনে কথা বলছিলাম, তখন হরিদাদুই গিয়েছিল আমাকে সব কিছু জানিয়ে সাবধান করার জন্য । কিন্তু আমার কাছে পৌঁছানোর আগেই তাকে রতন ধরে ফেলে । তারপর থেকেই বেসমেন্টে বন্দী থাকার জন্য আমি আর দেখতে পাই নি ।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর দাদুর ঘরে বসে গল্প করছিলাম, এমন সময় হরিদাদু এসে বলল, “দাদুভাই, আমার একটা কাজ করে দেবে ?” “কি কাজ ?” জানতে চাইলাম । “সমুর অস্থিটা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে ? আমি পরে সময়মতো গয়ায় তার পিণ্ডদানের ব্যবস্থা করব । শত খারাপ হলেও সে আমার …”, বলতে বলতেই আবার তার দুচোখ জলে ভরে গেল । সম্মতি দিতে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা লাল শালুতে মুখ বাঁধা ভাঁড় দিলো ।

( ৩২ )

সন্ধ্যায় ডাক্তারের সাথে কথা বলে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট করিয়ে নিলাম । মনে মনে ভাবলাম, ‘আরও সাতদিন বিশ্রামের বন্দোবস্ত হল বটে, তবে কাল বিকেলে মা-বাবার ফিরে আসার আগেই বাড়ি পৌঁছাতে হবে । না হলে কপালে অশেষ দুঃখ আছে । এখন এই অবস্থায় যাওয়ার কথা কি করে বলা যায়’, ভাবতে ভাবতে দাদুর কাছে গেলাম । দেখি দাদু এর মধ্যেই কয়েকজন লোক ঠিক করে ফেলেছেন, তারা কাল থেকে ল্যাবে কাজ করবে । আমি সময় করে বললাম, “দাদু, এবার তো আমাকেও যেতে হবে । তবে পরে আসব আর নিয়মিত যোগাযোগ রাখব – কথা দিচ্ছি”। দাদু নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন । রাতের খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম ।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন সূর্য ওঠেনি । তৈরী হয়ে নিচে নেমে এসে দেখি দাদু, হরিদাদু – সবাই আমার অপেক্ষায় রয়েছেন । দাদু একটা গাড়িও ঠিক করে দিয়েছেন আমার যাওয়ার জন্য । প্রাতঃরাশ সেরে বিদায় নিতে যেতে দুজনেই জড়িয়ে ধরলেন । আগামী বড়দিনের ছুটিতে সবাইকে নিয়ে আসব’, প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম । জানালা দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে, দুই বৃদ্ধের ওপর যে ঝড় বয়ে গেল গত কয়েকদিন ধরে, সেটাই ভাবছিলাম । নির্বান্ধব দুটি মানুষের কথা মনে হতেই একটু খারাপ লাগল । গাড়ির ব্যাকসিটে বসে গা এলিয়ে দিতে দিতে খেয়াল হল নিজের অজান্তেই চোখের কোণদুটো ভিজে গেছে । মনে মনে বললাম, খুব তাড়াতাড়িই আবার আসব … ভালো থেক তোমরা’।।

।। সমাপ্ত ।

Loading

Leave A Comment