হরিশ
-চিন্ময় মহান্তী
হরিচরণ ও শ্যামলী দুই জনের অভাবের গৃহে যেদিন পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জোৎস্না আপন অপরূপ মায়া মন্ত্র লইয়া উপস্থিত হইল ,সেই দিন দম্পতির সকল অভাব যেন পূর্ণ হইয়া উঠিল , আনন্দ বাঁশির সুরে মাটির গৃহখানি নৃত্য মগ্ন হইল । পরম স্নেহে হরিচরণ নাম রাখিলেন ‘ হরিশ ‘। নামটি বর্তমান যুগে পুরাতন হইলেও হরিচরণের মনে ধরিয়াছে , তাহার ও গৃহিণীর নামের অাদ্যক্ষর জুড়িয়া তিনি অনেক ভাবিয়া নামখানি স্থির করিয়াছেন । নামকরণ পর্ব সমাপন হইলে পুরোহিত উপযুক্ত দক্ষিনা পাইয়া আশীর্বাদ করিয়া বিগলিত হৃদয়ের সহিত গৃহ অভিমুখে চলিয়া গেলেন ।
সেইদিনের ছোট্ট হরিশ ক্রমে বড় হইয়া উঠিতেছে । আধো- আধো মধুর কথা পরিস্ফুট হইতেছে । কখনো কখনো পুলকিত হইয়া হাসিলে শ্বেত পদ্মের ন্যায় শুভ্র দন্ত বাহির হইয়া পড়ে , তাহা দেখিয়া দম্পতির হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া খুশির ঝরনা ধারা বহিয়া যায় ।
আজ কি একটা কাজ লইয়া হরিচরণ গ্রামের বড় বাড়ি গিয়াছিলেন । সেখান হইতে ফিরিয়া গায়ের গেঞ্জিটা খুলিতে খুলিতে বলিলেন -” ওদের ছেলেটাকে প্রাইভেট ইস্কুলে ভর্তি করেছে , আমাদের খোকার মতোই বড় হয়েছে , আমাদের খোকাকেও ভর্তি করবো । ” শ্যামলী কোনও উত্তর করিলেন না, তিনি জানেন এমন অভিলাষ তাহাদের পূর্ণ হইবার নহে । আকাশ কুসুম কল্পনা করিয়া মরিবার ইচ্ছা তাহার নাই। পূর্বেই বড় বাড়ির বধূর কাছ হইতে তথ্য লইয়াছেন -” বিস্তর খরচ ।” শুনিয়া স্বপ্নটাকে মনের অতলে চাপা দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন । আজ স্বামীর মুখ হইতে অনুরূপ ইচ্ছা শুনিয়া তাহার চোখের কোণা হইতে দুই ফোঁটা গলিত মুক্তা ঝরিয়া ভূমে পতিত হইয়া শুকাইয়া গেল , তাহা কাহারও দৃষ্টি গোচর হইল না । ‘ কই গো একটু জল দাও ‘- বাক্যটি কানে পৌঁছাই বা মাত্র সম্বিত ফিরিয়া আসিল ,ঘটিতে করিয়া জল আনিয়া দিলেন । নিজেকে ঠিক রাখিতে না পারিয়া -পূর্বেই যে তিনি ভাবিয়াছিলেন এবং বিস্তর খরচের কারনে তাহা তাহাকে বলেন নাই ,আজ তাহা বলিয়া ফেলিলেন । ঘটির জল এক টানে পান করিয়া ঘটিটি নামাইয়া একটি অক্ষমতার দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া হরিচরণ বাহির হইয়া গেলেন । শ্যামলী নিজ রন্ধন কার্যের নিমিত্ত শুষ্ক পত্র কুড়াইতে গেলেন ।
হরিশ পাঁচ বৎসরে পদার্পণ করিল । ইতিমধ্যেই সে মায়ের মুখ হইতে শুনিয়া অনেক ছড়া মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে । সরল অক্ষর শিখিয়া যুক্ত অক্ষর লিখিতে শিখিতেছে । হরিচরণ তাহার কচি আঙ্গুল ধরিয়া গ্রামের সরকারী স্কুলের অভিমুখে চলিলেন । স্কুলে পৌঁছাইয়া ভর্তির কাগজ পত্রে সই করিয়া ছেলেকে শ্রেণীকক্ষে বসাইয়া নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরিতেছিলেন । পথে হরিচরণের শুভাকাঙ্খী বন্ধু মনীষের সহিত দেখা হইয়া গেল । মনীষ দীর্ঘদিন হইল চাকরি সূত্রে কলিকাতায় থাকেন । কোনও এক বড় কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করেন , কি পদ হরিচরণ তাহা জানেন না আর জানিবার ইচ্ছাও কখনো প্রকাশ করেন নাই । দুই জনের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর মনীষ জিজ্ঞাসা করিলেন -‘ কোথায় গিয়েছিলি ?’ উত্তরে হরিচরণ বলিলেন – ‘ এই তো গাঁয়ের ইস্কুলে , ছেলেকে ভর্তি করতে ।’ ছেলেকে ভর্তি করার কথাটা মনীষের প্রশ্নে না থাকিলেও হরিচরণ পরবর্তী প্রশ্ন এড়াইতে আগাম বলিয়া দিলেন । শুনিয়া মনীষ প্রীত হইয়া বলিলেন -” আচ্ছা , ছেলেকে ভালো করে পড়াশুনা করা , বড় হলে আমি যে কোম্পানীতে চাকরি করি সেখানে চাকরির ব্যবস্থা করে দেব ।” কথাটা শুনিয়া হরিচরণ আনন্দিত হইলেন । শ্যামলীর ইচ্ছে যে ছেলেকে বড় কোনও সরকারী চাকুরে করা সেই কথাটা চাপিয়া গেলেন । মনে মনে ভাবিলেন যদি কখনো তাহা সম্ভব না হইয়া ওঠে তাহা হইলে হাসির পাত্র হইয়া উঠিবেন । তিনি যে দরিদ্র , আর দরিদ্রের স্বপ্ন প্রকাশ্যে বাহির করিলে তাচ্ছিল্য ব্যতীত কিছুই জোটেনা । মনীষ -‘ আজ একটু তাড়া আছে , পরে দেখা হবে ‘ বলিয়া চলিয়া গেলেন । হরিচরণও আপন গৃহাভীমুখে চলিলেন । আজ ছেলেকে লইয়া পুনরায় স্বপ্ন বুণিতে আরম্ভ করিলেন ।
স্কুল -কলেজের পাঠ সম্পন্ন করিয়া হরিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইল । খরচ বাড়িতে লাগিল, যাহা সম্পূর্ণরূপে প্রদান করিতে হরিচরণ অসমর্থ হইতেছিলেন । ইতিপূর্বের খরচ তিনি বহু কষ্টে চালাইয়া আসিয়াছেন , সাথে হরিশও কিছু কিছু বৃত্তি পাইয়াছে । কিন্তু বর্তমান বিস্তর খরচ চালানো প্রায় অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে । শ্যামলী স্বামীর চিন্তিত মুখ দেখিয়া তাহার শেষ অলঙ্কারটুকুও বন্ধক দিতে হরিচরণের হাতে অর্পণ করিয়াছেন । হরিচরণ প্রথমে অস্বীকার করিলেও –” ছেলে চাকরি করলে কত গহনা গড়িয়ে দেবে ” শ্যামলীর মুখের এই কথাতে আশা পাইয়া রাজি হইয়াছেন। বাবার কষ্ট দেখিয়া হরিশ কিছু ছেলে মেয়ে জোগাড় করিয়া টিউশন আরম্ভ করিয়াছে । চারিদিক হইতে টাকা গুছাইয়া হরিশের পড়াশুনা চলিতেছে ।
ভাল নম্বর পাইয়া পাশ করিয়া হরিশ চাকুরীর চেষ্টা করিতেছে । দুই দিন আগে জানিয়াছে ,সে একটা সরকারী চাকুরীর পরীক্ষায় পাশ করিয়াছে । সাক্ষাৎকার পর্ব ভালো ভাবে হইলেই চাকুরী । খবরটা চাউর হইতেই সম্বন্ধ আসিতে লাগিল । হরিশ বিবাহে রাজি নয় বলিয়া অনেককেই ফিরাইয়া দিয়াছে । খবরটা কানে যাইতেই মা বলিলেন – ” শোন বাবা আমার তো অনেক বয়স হলো , এবার মা লক্ষ্মী ঘরে নিয়ে আয় ।” মায়ের আদেশ শুনিয়া ,মায়ের কষ্ট হইবে ভাবিয়া হরিশ রাজি হইয়া গেল । মা খুশি হইয়া মনে মনে বলিলেন – ‘ পাগল ছেলে ।’
হরিচরণের গৃহ সকাল হইতে ব্যস্ততা মুখর হইয়া উঠিয়াছে ।
মুকুন্দপুর হইতে হরিশের সম্বন্ধ আসিবে । শ্যামলী রন্ধনশালা হইতে নড়িবার অবকাশ পাইতেছেন না । মুকুন্দপুরের বড় বাড়ির সম্বন্ধ বলিয়া কথা । ওনারা বলিয়াছেন ছেলে দেখিয়া ওনাদের পছন্দ ,বাড়ি তো করিয়া লইবে । ওনারা অনেক বড় মনের মানুষ ,আর ওনাদের গৃহের মেয়ে তাহাদের গৃহে বধূ হইয়া আসিবে ভাবিয়া শ্যামলী মনে মনে গর্ব বোধ করিতেছেন । একটা চকচকে গাড়ি আসিয়া হরিচরণের উঠানে দাঁড়াইল । হরিচরণ দেখিলেন গাড়ি হইতে কয়েকজন সুবেশ পুরুষ ও সুবেশী মহিলা বাহির হইলেন । হরিচরণ তাঁহাদের লইয়া ভেতরের ঘরে বসাইলেন । শ্যামলী একমুখ ঘোমটা টানিয়া জল ও চা পরিবেশন করিয়া খাবার সাজাইবার নিমিত্তে চলিয়া গেলেন । যতক্ষনে খাবার আসিল ততক্ষণে বিবাহের সমস্ত কথা হইয়া গেল । খাবার খাইয়া রন্ধনের প্রশংসা করিয়া তাহারা চলিয়া গেলেন ।
পাঁচদিন পর । হরিশ সাজিয়া গুজিয়া তৈরী হইয়া মা বাবার সহিত মেয়ে দেখিতে বাহির হইয়া গেল । মুকুন্দপুরে আসিয়া যখন পৌঁছাইল তখন বড় বাড়ির সমস্ত আয়োজন সমাপন হইয়াছে । তাহাদের বসাইয়া, বাড়ির কর্তা গৃহিণীর উদ্দেশ্যে বলিলেন – ‘মেয়েকে নিয়ে এসো ।’ মেয়ে আসিল সাথে চা জলও । হরিশ দেখিল পূর্ণিমার চন্দ্র যেন এই গৃহে আসিয়া গৃহের ঔজ্বল্য বাড়াইয়া দিয়াছে । এই রূপ সে আগে কোথাও দেখিয়াছে বলিয়া মনে করিতে পারিল না । রূপের চ্ছটায় সে এতটাই ভাসিয়া গেল যে হাতের গরম চা শীতল হইয়া তেমনি রহিয়া গেল । একটি মাত্র কথাই জিজ্ঞাসা করিল -‘ তোমার নাম কি ?’ মিষ্টি গলায় উত্তর আসিল -‘ পূর্ণিমা ‘ । মেয়েটি লাজুক বদনে অন্তঃপুরে চলিয়া গেল । হরিশ রূপের সহিত নামের সাযুজ্য খুঁজিতে বিশ বাঁও জলে ডুবিয়া গেল । অবশেষে বিড়বিড় করিয়া বলিল – ” নামের সঙ্গে রূপ যথাযথ হয়েছে ।” মায়ের কানে কানে বলিল -‘ পছন্দ ‘ । হরিচরণ শ্যামলীর ইঙ্গিতে বুঝিলেন ছেলের পছন্দ হইয়াছে । উভয় পক্ষ স্থির করিলেন ছেলে চাকুরী পাইবার পর বিবাহ সম্পন্ন হইবে ।
কিছু দিন পর চাকুরীর সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হইল । হরিশ উৎকণ্ঠা লইয়া দিন যাপন করিতে লাগিল । এক একটি মুহূর্ত কাটাইয়া ওঠা যেন দায় হইয়া উঠিতে লাগিল । অবশেষে ফল পাইল তাহার চাকুরী হইয়াছে , বর্ধমানে পোস্টিং । খবর শুনিয়া হরিচরণ মিষ্টি কিনিবার নিমিত্তে কিছু টাকা গ্রামের বড় বাড়ি হইতে ঋণ করিয়া লইয়া আসিয়া মিষ্টি কিনিয়া গ্রামের সমস্ত লোককে বিতরণ করিলেন । শ্যামলীর চোখ হইতে কয়েক ফোঁটা জল বাহির হইয়া পড়িল , এ অশ্রু আনন্দের । দীর্ঘ কয়েক বৎসর যে স্বপ্ন তিনি পুষিয়া রাখিয়াছিলেন আজ তাহা পূর্ণ হইল ।
পরের দিন হরিশ মা বাবাকে প্রণাম করিয়া চাকুরীস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হইল । মা ডাকিলেন – ‘ দুগ্গা দুগ্গা ।’
মুকুন্দপুর হইতে বিবাহের তোড়জোড় আরম্ভ করিয়া দিলেন । বাবার চিঠি পাইয়া হরিশ ছুটি লইয়া গৃহে উপস্থিত হইল । বিবাহের শুভ দিনে সানাইয়ের সুরে হরিচরণের গৃহ ও সারিডি গ্রাম মুখর হইয়া উঠিল । রজনীগন্ধা ফুলে সজ্জিত গাড়িতে চড়িয়া হরিশ বিবাহের উপলক্ষে রওনা হইয়া গেল । চারিদিকে উৎসুক জনতা চাহিয়া দেখিল ,সেদিনের ছোট্ট হরিশ আজ বৌ আনিতে যাইতেছে ।
ভোরবেলায় যখন হরিশ বৌ লইয়া গ্রামে আসিল তখনো গ্রাম সম্পূর্ণ জাগে নাই । যাহারা জাগিয়াছে তাহারা বৌ দেখিয়া অভিভূত হইয়া বলিতে লাগিল – ” আহা কি রূপ , হরিশের নজর আছে বলতে হয় ।” দুর হইতে শ্যামলী এইরূপ কথোপকথন শুনিয়া শান্তি পাইলেন । এ শান্তি কতকালের জন্য তাহা একমাত্র অন্তর্যামীই জানিতে পারেন । নব বধূকে প্রথা অনুযায়ী দধি খাওয়াইয়া ,নিজের কাপড়ের খুঁট দিয়া মুখ মুছাইয়া , প্রদীপ ও শঙ্খ ধ্বনি দিয়া বরণ করিয়া লইলেন । বিবাহের সমস্ত নিয়ম কানুন শেষ হইল । হরিশের ছুটিও শেষ হইয়া আসিল । হরিশ মায়ের নিকট বৌকে রাখিয়া চাকুরিতে যোগদান করিতে চলিয়া গেল ।
ইতিমধ্যে হরিচরণের গৃহে প্রমীলার আবির্ভাব হইয়াছে । সে নিত্য আসিয়া নব বধূর সহিত গল্প জমাইয়া থাকে । শ্যামলী নব বধূকে জানাইয়া দিয়াছেন প্রমীলাকে গ্রামের লোক কুটিলা বলিয়া ডাকিয়া থাকে । কিন্তু সৌজন্যতার খাতিরে তাহারা তাড়াইতে পারেন না । প্রমীলা নব বধূর সহিত সেই গল্প জমাইয়া থাকে যাহাতে কচি মস্তিষ্কে বিস্তর প্রভাব পড়িয়া যায় । গল্পে গল্পে শুধু স্বামীর সহিত বাহিরে থাকি বার যে আনন্দ , তাহা বর্ণনা করিয়া বধূর মস্তিষ্কে অল্প অল্প করিয়া বিষ ঢালিতে থাকিল । ঊনিশ বৎসর বয়স্ক মস্তিষ্কে সেই বিষ ক্রমে অলক্ষ্যে ছড়াইয়া পড়িল। শাশুড়ীর সহিত খুট খাট নিত্য হইয়া উঠিল । প্রলয় যখন আসিয়া উপস্থিত হইয়া থাকে তখন কেহ তাহারে রুধিয়া রাখিতে পারে না ।
হরিচরণ কড়া রৌদ্রে সমস্ত ক্ষেতের জল দেখিয়া আসিয়া দাওয়ায় বসিয়া বলিলেন – ‘ শ্যামলী জল দাও ‘ । শ্যামলী কি একটা কাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন , বৌমাকে বলিলেন – ‘ বৌমা একটু জল দিয়ে দাও তোমার বাবাকে ‘। প্রসাধনে ব্যস্ত বৌমা ভিতরের ঘর হইতে তীব্র ঝাঁঝাল স্বরে বলিল -‘ কেন আপনি পারছেন না ‘। এই ছাড়াও আরো দুই একটি কটু কথা শুনাইয়া দিল । শ্যামলী আর সহিতে না পারিয়া দুই একটি কথা তিনিও শুনাইয়া দিলেন । বধূ দরজার খিল তুলিয়া দিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল । বৃদ্ধ হরিচরণের আর জল পান করা হইল না । তিনি দরজার কড়া নাড়িয়া ভীত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন – ‘ দরজা খোল মা ‘। কিন্তু বধূ তাহাতে প্রথমটায় কর্ণপাত না করিলেও কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুলিল । হরিচরণ জিজ্ঞাসা করিলেন -” তুমি কি হরিশের চাকুরীস্থলে থাকতে চাও ?” বধূ চোখের জল মুছিয়া সম্মতি জানাইল । পরদিন বৃদ্ধ চিঠি লিখিলেন – ” বাবা হরিশ তুমি তোমার বৌকে নিয়ে গিয়ে শান্তিতে থাকো ।”
চিঠি খুলিয়া পড়িয়া হরিশ বুঝিল কিছু একটা গন্ডগোল ঘটিয়াছে । সে দেরি না করিয়া গৃহের অভিমুখে রওনা হইল । কি ঘটিয়াছে তাহা চিন্তা করিতে করিতে কখন যে পৌঁছাইয়া গেল তাহা বুঝিতে পারিল না । গৃহে আসিয়া যখন পৌঁছাইল তখন সন্ধ্যা নামিয়াছে । কাঁধ হইতে থলেটা নামাইয়া রাখিল , দেখিল গৃহের পরিবেশ থমথমে হইয়া রহিয়াছে । সে মা বাবার নিকট জানিতে চাহিল কি ঘটিয়াছে , কিন্তু তাহারা কিছুই বলিলেন না । সারা রাত্রি বধূর মুখ হইতে মায়ের নিন্দা শুনিয়া তাহার আর ঘুম আসিল না । সে জানে তাহার দেবী মা কখনোই অন্যায় করিতে পারেন না , এ তাহার বধূ কেন ,কেহ বিশ্বাস করাইতে সমর্থ হইবে না । কিন্তু বিশ্বাস না করিলেও বধূর মন রাখিতে বিশ্বাস করিয়াছি এইরূপ ভান করিয়া রহিল । সকালে উঠিয়া বধূ তাহার ব্যবহার্য যাহা কিছু ছিল সমস্ত গুছাইয়া লইল । হরিশ মা বাবাকে প্রণাম করিল ,ঠিক যেমনটা চাকুরিতে যোগদান করিতে যাইবার পূর্বে করিয়াছিল । মা বাবা আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন – ‘ সুখে থেকো ।’ উহারা দুইজনে বাহির হইয়া গেল । যত দূর চোখে দেখিতে পাইলেন বৃদ্ধ দম্পতি চাহিয়া রহিলেন । বধূ একটি বারের জন্যও পিছন ফিরিয়া চাহিল না । হরিশ একবার পিছন ফিরিয়া দেখিয়া পুনরায় সন্মুখে চাহিয়া চলিয়া গেল । শ্যামলীর নিষ্পলক চোখ হইতে দরদর করিয়া জল বাহির হইয়া পড়িল । বক্ষ হইতে কেহ যেন হৃৎপিন্ড উপড়াইয়া লইয়া চলিয়া গেল , তাহার এইরূপ মনে হইতে লাগিল । পৃথিবীর সকল রঙ তাহার চোখে ধূসর ঠেকিতে লাগিল । হরিচরণ আপন সহধর্মিণীকে নানা প্রকার বাক্য প্রয়োগ করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন । এই বলিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকিলেন , পৃথিবীতে কে কাহার ! তাহার দীর্ঘ জীবনের হিসাবে একটা যে ভুল রহিয়া গিয়াছিল তাহা আজ বুঝিতে পারিলেন । বড় বাড়ি হইতে আসিলেই সকলের মন যে বড় নাও হইতে পারে তাহার উদাহরণ সদ্য দেখিলেন ।
হরিশ ধীরে ধীরে স্ত্রৈণ হইয়া উঠিয়াছে। মনের প্রবল ইচ্ছা থাকিলেও মা বাবাকে দেখিতে আসিবার ক্ষমতা সে হারাইয়া ফেলিয়াছে । দুই বৎসর হইল সে সারিডি গ্রামে আসে নাই । বৃদ্ধ হরিচরণ নিজেকে সহায়হীন ভাবিয়া সংসারের দৈনিক হাটমশলার খরচ চালাইবার জন্য একটি দুগ্ধবতী গাভী পালন করিয়াছেন । তাহারই খোরাক জোগাড় করিতে মাঠে গিয়াছিলেন । মাথা হইতে ঘাসের বস্তাটা সশব্দে উঠানে ফেলিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন শ্যামলী শুইয়া আছেন । হরিচরণ জানিতে চাহিলেন -‘ তোমার কি হয়েছে ?’ শ্যামলী উত্তরে বলিলেন -‘ শরীর খারাপ ।’ এমতবস্থায় শ্যামলীর দুই দিন কাটিল । হরিচরণ গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের নিকট হইতে ঔষধ লইয়া আসিয়াছেন , কিন্তু তাহাতে কোনরূপ উন্নতি হয় নাই । মনে মনে অশুভ চিন্তা করিয়া হরিচরণ তাহাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়া দিলেন । ডাক্তার আসিয়া রুগী দেখিয়া অনতিদূরে হরিচরণকে ডাকিয়া বলিলেন – ” আপনার স্ত্রীর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে , লাস্ট স্টেজ , কিছু করার নাই ।” ডাক্তার চলিয়া গেলেন । হরিচরণ ইহাকে সত্য বলিয়া স্বীকার করিয়া লইতে পারিতেছেন না । হু হু করিয়া কাঁদিতে ইচ্ছা করিল , কিন্তু পাছে শ্যামলী টের পান তাহা ভাবিয়া কাঁদিতেও পারিলেন না । এযাবৎ কোনও দিন তিনি তাহার অর্ধাঙ্গিনীকে কষ্ট দেন নাই আজও তাহা পারিলেন না । শ্যামলী হরিচরণের মুখ দেখিয়া বুঝিলেন তিনি আর বাঁচিবেন না । ইঙ্গিতে তাহাকে কাছে ডাকিয়া ক্ষীণ কণ্ঠে বলিলেন – ” এক বার খোকাকে আসতে বলো , বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।” হরিচরণ মৃত্যু পথ যাত্রী শ্যামলীর কথা রাখিতে গ্রামে গেলেন । ভাবিয়া পাইলেন না কি ভাবে দ্রুত খবরটা হরিশকে জানাইবেন । হরিশ যবে তাহার বৌ লইয়া চলিয়া গেল সেইদিন হরিচরণ তাহার হাতে একখানি ফোন দেখিয়াছিলেন কিন্তু সেইদিন এতটাই শোক পাইয়াছিলেন যে ফোন নম্বর লইতে ভুলিয়া গিয়াছেন । অগত্যা কলগা হাতড়াইয়া ছেলের চাকুরীস্থলের ঠিকানা লেখা ছেঁড়া খাতা খানি বাহির করিয়া চিঠি লিখিলেন – ” বাবা হরিশ তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা তোমাকে দেখে যাওয়া ।”
চার দিন হাসপাতালের বিছানায় শুইয়া শ্যামলী ভাবিতে লাগিলেন এই বুঝি তাহার ছেলে আসিল । কিন্তু তিনি ছেলেকে দেখিতে পাইলেন না । হরিচরণও পত্নী শোকে বিহ্বল হইয়া দুর্বল হইয়া যাইতে লাগিলেন । হঠাৎ চারদিনের দ্বিপ্রহরে পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়া হরিচরণের ভালবাসার শিকল কাটিয়া শ্যামলী চলিয়া গেলেন। ডাক্তার আসিয়া নাড়ি দেখিয়া বলিলেন -‘ গত হয়েছেন ।’ আজ হরিচরণ চিৎকার করিয়া কাঁদিলেন । তাহার কান্না দেখিয়া কষ্ট পাইবার কেহ রহিল না । হরিচরণের কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া গেল ।
পিতার চিঠিখানি পড়িয়া হরিশ আর নিজেকে সম্বরণ করিতে পারিল না । সে প্রবল প্রতাপ লইয়া বৌয়ের নিকট কথাটা পাড়িল । হরিশের এরূপ মূর্তি সে আগে কখনো দেখে নাই । ভীত হইয়া সেও হরিশের সহিত যাইতে চাহিল । দুই জনে যখন গ্রামের পথে ঢুকিল তখন দেখিল গ্রামের পথ জুড়িয়া খই ছড়ানো । হরিশ বুঝিল ………………। তাহাদের দেখিয়া ষাটোর্ধ্ব ভবেশ খুড়ো বলিলেন -” বাবা তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হইল না ।” কথাটা হরিশের বক্ষে তীরের ফলার মতোই বিঁধিল । হরিশ ও তাহার বৌ শ্মশান অভিমুখে চলিল । যখন শ্মশানে আসিয়া পৌঁছাইল তখন তাহার মাকে চিতার উপর শুয়াইয়া দেওয়া হইয়াছে । হরিশ সেমতাবস্থায় মায়ের পা জড়াইয়া হু-হু করিয়া কাঁদিতে লাগিল । তাহার মায়ের মৃত্যুর কারণ হিসাবে নিজের বৌকে দোষী সাব্যস্ত করিতে লাগিল । পূর্ণিমাও স্থির রহিতে পারিল না , শাশুড়ীর ভালোবাসার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত তাহার মনে পড়িতে লাগিল । সেও চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল । সমস্ত শ্মশানময় সেই কান্নার রোল পাক খাইতে লাগিল । চেতনার অমাবস্যা নিঃশেষ হইয়া যখন পূর্ণিমা আসিয়া উপস্থিত হইল তখন অনেক দেরি হইয়া গিয়াছে ।