কন্যা সন্তান
-অমল দাস
১
শ্রেয়সী খাটের উপর উপুড় হয়ে বুকে একটি বালিশ দিয়ে একাগ্র চিত্তে ডাইরি লিখছে। পাশের টেবিলে বসে মেয়ে তিস্তা পড়াশুনা করছে । ও এবছর ‘ক্লাস এইটে’ পড়ছে। তিস্তা পড়াশুনায় যেমন মেধাবী তেমনই ‘মোবাইল’ বা ‘কম্পুটার অপারেটিং’-এও খুবই ‘এক্সপার্ট’ । তবে পড়াশুনা জলাঞ্জলি দিয়ে কখনই সে ‘ইলেক্ট্রনিক্স আইটেম’ এ হারিয়ে যায় না। শ্রেয়সীর এই বাড়ি দ্বিতল । উপরের রুম থেকে টিভিতে খেলা চলার হালকা শব্দ সিঁড়ি বেয়ে দেয়ালের কান ঘেঁষে নিচে নেমে আসতে থাকলো। তার সাথে মাঝে মাঝে যুক্ত হয় এক পুরুষের উত্তেজিত কণ্ঠ। সে আর কেউ না শ্রেয়সীর একমাত্র স্বামী অজিতেশ। বাড়িতে ঐ তিনটিই প্রাণী। টিভির ঐ আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। এই বাড়িতে যে কেউ বসত করে তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।
নিস্তব্ধতা ভেঙে আবহকে চমকে দিয়ে হঠাৎ শ্রেয়সীর ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা তুলতেই ওপ্রান্ত থেকে একটা মিষ্টি ছোট্ট সুর ভেসে আসে।
- হ্যালো আন্টি ?
- হ্যাঁ বল!
- আমি সৌমী , তিস্তাকে একটু দিন না!
- তুমি কেমন আছো সোনা ?
- হ্যাঁ আন্টি ভালো, তুমি ভালো আছো?
- হ্যাঁ আছি, এই নাও তিস্তার সাথে কথা বল।
শ্রেয়সী ফোনটা বাড়িয়ে তিস্তাকে বলল- এই নে সৌমী ফোন করেছে কি বলছে শোন।
তিস্তা ফোন নিয়ে – হ্যালো বল!
- তুই স্কুলের প্রোজেক্ট করেছিস?
- হ্যাঁ করছি এখন । তুই ?
স্কুলের বিষয়, প্রজেক্ট আর দুই বান্ধবী নিজেদের কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেছে । অন্যদিকে শ্রেয়সী তার ডাইরি লিখতে মন দিয়েছে। তিস্তার যখন এক বছর বয়স সেই সময় থেকেই শ্রেয়সী নিয়মিত লেখালেখি করে। কখন গল্প কখন কবিতা কখন বা বাস্তব জীবন। তবে শ্রেয়সী কোথাও কখন কোন ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ করে নি। বর্তমানে ফেসবুকের এতো জনপ্রিয়তা এতো লেখক লেখিকা সেখানেও সে কোন লেখা দেয়নি কখনও। সে অন্যের লেখা পড়ে , শত শত তরুণ প্রবীণ প্রজন্মকে দেখে তবুও সে সাহস করে কোন লেখাই পোস্ট করে নি। তার মধ্যে একটা লজ্জা বোধ কাজ করে, সে ভাবে তার লেখার বিশেষ মান নেই কেবল মনের ইচ্ছাই ফুটে ওঠে। কিন্তু সে থেমে নেই লিখছে অজস্র লিখছে প্রতিনিয়ত। তার বহু ডাইরি এই কয়েক বছরে জমা হয়ে গেছে । তিস্তা মায়ের লেখা দেখে তবে এখনো সে ছোট কাব্য ব্যাপার তার আসে না । তবে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে যে তার মা ভালো লেখে এবং সবার চাইতে ভালো মা তার।
একবার স্কুল ম্যাগাজিনে মাতা পিতাদের লেখা দিতে আহ্বান করা হয়েছিল স্কুলের তরফ থেকে , তিস্তা মাকে বললে মা রাজী হয়নি। কিন্তু সে চুপিসারে ডাইরির পাতা ছিঁড়ে স্কুলে জমা দিয়েছিল। শ্রেয়সী জানতেও পারেনি। স্কুলের অনুষ্ঠানে ম্যাগাজিন প্রকাশ পেল এবং প্রিন্সিপ্যালের মুখে শ্রেয়সীর কবিতা প্রশংসিত হলো। সে যেন হঠাৎ আকাশ থেকে পড়ল । সে এই আকস্মিকতায় অবাক ও আবেগ তাড়িত হয়ে চোখ ছলছল করে উঠল। তিস্তা পাশে বসেই মাকে অনুসরণ করছিল। সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে- মা তুমি রাগ করনা!আমিই লুকিয়ে তোমার একটা লেখা স্কুলে জমা করেছিলাম। বন্ধু বান্ধবীর মা বাবা লেখা দিয়েছে আমার কেউ না দিলে খারাপ লাগবে না…. ? তাই আমি দিইয়েছিলাম।
শ্রেয়সী কিছুই বলল না শুধু আঁচলে চোখ মুছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথার উপর ঠোঁটের চুম্বনে স্নেহের আশিস রাখল।
২
সৌমীর সাথে কথা বলে ফোনটা টেবিলে রেখে মায়ের দিকে ঘুরে হঠাৎ তিস্তা প্রশ্ন করে বসে মা! ও মা! তুমি আর বাপি একসাথে থাকো না কেন?
এই প্রশ্ন তিস্তার মনে আজ নয় কয়েক দিন আগেই উদয় হয়েছিল, সৌমীর জন্মদিনে। সেদিন ওদের বাড়িতে রাতে থেকে গিয়েছিল তিস্তা। দুই বান্ধবী একসাথেই শুয়ে ছিল। তিস্তা সৌমীকে জানতে চায় – এই তোর মা আজ আমার জন্য তোর সাথে ঘুমোতে পারলো না তাই না রে?
-কেন ? আমি তো একাই থাকি। মা আর পাপা ঐ রুমে থাকে। তুই আর আন্টি একসাথে থাকিস? সৌমীর কৌতূহলী প্রশ্ন।
ছোট্ট তিস্তা আর উত্তর দেয়নি সেদিন। তবে তার মনের কোণে একটা প্রশ্ন জেগেই ছিল। সৌমী ফোন করতেই মনে পড়ে গেল এবং শ্রেয়সীকে প্রশ্ন করে বসলো।
মা , মেয়ের এই অনাবশ্যকীয় প্রশ্নে একটু আশ্চর্য ও অবাকই হয়েছিল। তারপর নিজেকে সংযত ও ধীর করে জানতে চাইল- এ প্রশ্ন কি তোমার ? না কেউ জানতে চেয়েছে তোমার কাছে?
তিস্তা কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে আবার পড়ার টেবিলে ঘুরে গেল। শ্রেয়সী মেয়ের এই প্রশ্নের গুরুত্ব বুঝেছিল । সে বিছানা থেকে নেমে তিস্তার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো – তুমি এখন অনেক ছোট মা, বড় হও সব জানবে সব বুঝবে। তবে আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি তাই তোমার সাথেই থাকি রাতে।
৩
শ্রেয়সী মেয়েকে খুবই ভালোবাসে, মেয়েই ওর জীবন। এই মেয়ের জন্যেই ছোট্ট থেকে তার কত লড়াই, নিজের সাথে পরিবারের সাথে, স্বামীর সাথে। শ্রেয়সী খুবই সুন্দরী ফর্সা আর ঘন কেশের অধিকারিণী। অজিতেশের সাথে বিয়ের পর যখন এই বাড়িতে পা রেখেছিল তখন তার রূপে আত্মীয় পরিজন সকলেই পঞ্চমুখ।
শাশুড়িও খুব গর্ব করতেন, ভালোবাসতেন পুত্রবধূকে । আর এই ভালোবাসায় খামতি হতো না যদি সে শাশুড়ির মত করে চলত। শ্বশুর তো ছিল না , শুধু স্বামী আর শাশুড়ি। শ্রেয়সী প্রেগনেন্ট, খুব খুশীর ঝড় বইছিল পরিবারে। এই খুশীও বজায় থাকত যদি সে শাশুড়ির কথা মত ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে সম্মত হত। শাশুড়ি মিনতী দেবী চেয়েছিলেন একটা পুত্র সন্তান আসুক ঘরে যে বংশের প্রদীপ জ্বলবে।
এই প্রদীপ যে কোথায় জ্বলে , তার কত কিরণ কত আঁধার দূর করে তা আজও আবিষ্কার করা গেল না, কেবল স্বৈরী মনোবাঞ্ছার গল্প কথা হয়ে রয়ে গেল ।
শ্রেয়সী এর প্রতিবাদ করেছিল, সে চুপ থাকেনি। চুপ ছিল কেবল অজিতেশ, সে মায়ের অনৈতিক চাহিদার বিরুদ্ধে রা-শব্দ করেনি।আর সেই দিন থেকেই শ্রেয়সী অজিতেশের উপর অভিমানী। যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে ছাড়া কমে নি। মিনতী দেবীর বিরুদ্ধে গিয়েই অদৃষ্টের ইচ্ছায় সে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিল। তার সাথেই শুরু হল জীবন সংগ্রামের দুর্দিন।
তিস্তা মায়ের কাছেই লালিত হতে লাগলো। ঠাকুমা কখনই তাকে কোলে তুলে নেয়নি, খাইয়ে দেয়নি, ঘুম পাড়িয়েও দেখেনি। অথচ ঠাকুমাদের কাছে নাতনিরা কতই সোহাগের কতই আদরের। অজিতেশ অফিস থেকে ফিরে যদি কখন নিজের সন্তানকে কোলে তুলেছে স্নেহের পরশ দিয়েছে অমনি শাশুড়ি কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছোট্ট শিশুকে বিছানায় শুইয়ে দিত। মেয়ে কান্না শুরু করলে হুঙ্কার বাণী আসতে লাগলো- এই যে রাজরানী বাচ্চাটি কান্না করে থামাও এর জ্বালায় আজকাল বাড়িতেও থাকা দায় দেখছি ।
এমন বহুদিন গেছে শ্রেয়সী রান্না ফেলে মেয়ের কান্না থামাতে ছুটে এসেছে। বাড়িতে মানুষ থেকেও যেন নেই! ওদিকে রান্না খারাপ হয়েছে তার জন্য কটূক্তির গঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছে ,- ‘বলি রান্না করতে করতে কি ঘুমিয়ে পড়ো বাছা? তা একবারে আগুনে পড়লেই তো জ্বালা মিটে যায়’।
শ্রেয়সী কখনই ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙেনি সে চোখের জল ফেলেছে, একা একা বালিশে মুখ চেপে কান্না করেছে , শান্ত নীরব থেকেছে মেয়েকে বুকে আগলে রেখে।
তিস্তা যখন একবছর বয়স শ্রেয়সী অজিতেশ একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেলেও মিনতী দেবীর না না কুসংস্কারাচ্ছন্ন ফরমানে আলাদা রেখেছে , বাধ্য করেছে। অজিতেশ প্রতিবাদহীন সব ক্ষেত্রেই চুপ থেকেছে, মায়ের আজ্ঞাবহ হয়ে রয়েছে। সে ভুলেই গেছে তার একটি স্ত্রী আছে , তার প্রতি কর্তব্য আছে । একটি মেয়ে আছে , তার প্রতি দায়বদ্ধতা আছে , স্নেহ আছে , ভালোবাসা আছে। না ! মাকে অমান্য করা কোন পুত্রেরই উচিত নয়। তাই বলে ন্যায় অন্যায় বোধ কি স্থান পায়না ? মায়ের প্রতি আনুগত্য আছে , আর যার বা যাদের উপেক্ষা করে তার জীবন সরল পথে গতি নেওয়া সম্ভব নয়, সেই স্ত্রী মেয়ের উপর তার উদাসীন নিরুত্তাপ নিশ্চুপ মনভাবও তো সুখকর নয়! এই সকল ঔদাসীন্য ভাব, আত্মিক আকর্ষণ্ , অনুভূতির দুর্বল ভিত এক কালো ঘন অভিমানী মেঘের জটলা শ্রেয়সীর মনাকাশে বিস্তৃতি লাভ করেছিল যা ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাওয়া মেঘমুক্ত হওয়ার কোন ইচ্ছা বা অভিপ্রায় নেই ছিল না, আজও হয়নি। আর এই অভিমানী ক্ষোভ অতি সযত্নে অভিশপ্ত অহল্যার পাষাণের মত দৃঢ় হয়ে উঠেছে।
বছর তিন আগে শাশুড়ি মিনতী দেবী ইহলোক ত্যাগ করেন । পরবর্তী কালে শ্রেয়সী অজিতেশের মধ্যে বাক্যালাপের সম্পর্ক বাড়লেও শারীরিক সম্পর্ক আত্মিক টান আর দৃঢ় হোল না। অজিতেশ ইচ্ছা প্রকাশ করলেও শ্রেয়সী তাকে আশাহত করে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। দুজনের অন্তরে বিরহ, অভিমানের একটা চাপা স্রোত প্রাবাহিত হলেও প্রাত্যহিক জীবনে সরাসরি কোন পারিবারিক ঝগড়া বা অশান্তি নেই। অজিতেশ শ্রেয়সীকে যে অবহেলা করে তাও নয়। অন্যদিকে তিস্তাকেও যে ভালোবাসে তাও প্রকাশ পায় । সে মেয়ের কোন চাহিদাই অপূর্ণ রাখে না। শুধু আন্তরিক স্নেহের বসে কন্যাকে জড়িয়ে ধরতে দেখা গেল না আজও।
৪
তিস্তার প্রশ্ন শুনে শ্রেয়সী তার স্মৃতির পাতায় ডুবে গিয়েছিল। ডাইরি খোলা পেন তার উপর পড়ে আছে । দু এক ফোঁটা অভিমানী অশ্রু ঝরে পড়েছিল তাতে। একটা ফোন আসাতে তিস্তা যখন ঘুরে মাকে ফোন দিতে গেল, সেই সময় শ্রেয়সী বিছানায় শরীর এলিয়ে কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে। তিস্তা মায়ের শরীরে হাত দিয়ে ঠেলে ডাকতে গেলে দেখে মা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আছে। সে ভীত হয়ে মা মা করে ডাকতে লাগল, কিন্তু মায়ের সাড়া দেওয়ার মত কোন ক্ষমতাই নেই।
তিস্তার আশঙ্কা অনুভূত হয়েছিল , সে ফোনের ইন-কামিং কলটা কেটে দ্রুত ১০২ এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে ফোন করে। একটা বোতল থেকে জল নিয়ে সে মায়ের নাকে মুখে ছিটিয়ে দেয় তাতেও কিছু না হওয়াতে পায়ের পাতা ডলতে শুরু করে।
বাবার সাথে বিশেষ আন্তরিকতা না থাকায় সে ভুলেই গেছে বাবা বাড়িতে আছে। শ্রেয়সীর হালকা জ্ঞান ফিরলে সে কোন মতে হাত উঁচিয়ে ঈশারা করে সম্ভবত যার অর্থ দাঁড়ায় উপরে যাও বাবা কে ডাকো।
তিস্তা একছুটে উপরে গেল , তখন অজিতেশ খেলা দেখতে ব্যস্ত। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তিস্তার শান্ত সুর- বাপি! বাপি!
-হ্যাঁ ! বল?
– মা অসুস্থ!
– কি হয়েছে?
-শুয়ে আছে।
-তুমি যাও। আমি আসছি!
আসছি বলে অজিতেশ ফের খেলায় মগ্ন হয়ে গেল, মেয়ের কথার গুরুত্বই বুঝলো না, হয়তো মেয়েও গুরুত্ব বোঝাতে পারলো না। এর মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স এসে দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ে। তিস্তা ‘লকার’ থেকে টাকা আর মায়ের ‘ডেবিট কার্ড’টি নিয়ে একটি ‘পার্সে’ ভরে বাইরে গিয়ে ওদের ডেকে মাকে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালের দিকে চলে যায়।
৫
খেলার বিরতির সময় অজিতেশের মেয়ের কথা মনে পড়লো। সে নিচে নেমে এলো কিন্তু কেউ নেই কোথাও, এদিক ওদিক দেখে বাইরে গিয়েও দেখলো , না আশেপাশে নেই। ফোন করতে গেল কিন্তু শ্রেয়সীর ফোন তিস্তার পড়ার টেবিলে বেজে উঠলো। অজিতেশের মুখমণ্ডলে বিরক্তির আভাস ধরা পড়লো। সে ভাবলো হয়তো রাগ করে বাপের বাড়ি গেছে । শ্রেয়সী মাঝে মাঝে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি যায় । কাছেই বাড়ি, রাতেও যাতায়াতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। অজিতেশ আর শ্বশুর বাড়ি ফোন করলো না , রাতের খাবার নিয়ে দোতালায় চলে গেল।
সকালে বাড়ির সামনে রাস্তার উল্টো দিকে চায়ের দোকান থেকে একটা চা বলে সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিতে লাগে অজিতেশ।
দোকানদার মাধব জানতে চায়- দাদা বাড়িতে কার কি হয়েছে ? রাতে এ্যাম্বুলেন্স এলো যে!
ঠিক তখনই অজিতেশের টনক নড়ে। সে কোন উত্তর না দিয়ে চা সিগারেট ফেলে ছুটে ঘরে আসে শ্রেয়সীর ডায়াল কল লিস্ট থেকে ফোন করে জানতে পারে কোন হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স গিয়েছিল।
৬
তিস্তা মায়ের পাশেই বসে ছিল । সারা রাত ঐ ফুটফুটে মেয়েটি মায়ের পাশেই মাকে আগলে ধরে বসে ছিল , একটুও ঘুমোয়নি। ডাক্তার নার্সরাও ওকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারেনি। ডাক্তার চিকিৎসা করেছে আর সে বারবার তাদের কাছে করুণ সুরে প্রশ্ন করেছে- আমার মায়ের কিছু হয়নি তো ? আমার মা ভালো হয়ে যাবে তো? আমার মা কখন বাড়ি যেতে পারবে ?
ছোট্ট তিস্তার এই উৎকণ্ঠা দেখে ডাক্তারও আবেগ তাড়িত হয়ে ওঠে এবং একটু বেশিই যত্ন নিয়ে তাদের যথাসাধ্য মত চিকিৎসা করে।
সকাল থেকেই শ্রেয়সী একটু সুস্থ। রাতে হঠাৎ পুরনো স্মৃতির তাজা যন্ত্রণায় প্রেসার বেড়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে আকস্মাৎ বুকের ব্যথা শুরু হয়েই এই বিপত্তিটা ঘটে গিয়েছিল।
ডাক্তার তো সকালে বলেই গেল- ভগবান নয় থ্যাঙ্কস আপনার এই মেয়েকে । ঐ টুকু মেয়ে যে সময় মত উপস্থিত বুদ্ধিতে এ্যাম্বুলেন্স ডেকে আপনাকে এখানে এনেছিল তাই…………… ( একটু থেমে গিয়ে) । নয় তো অন্যকিছু হয়ে যেতে পারতো।
শ্রেয়সীর চোখে জল ছলছল করছে। এদিক ওদিক চেয়ে দেখল কিন্তু না পরিজনের কেউ নেই মেয়ে ছাড়া। কেউ কি আসেনি? তার অন্তরের প্রশ্নরা যে একটা মানুষকেই খোঁজে , যে মানুষটার ভালোবাসার তার অধরা রয়ে গেল। বৈবাহিক জীবন পূর্ণ হয়েও অপূর্ণ রয়ে গেল। না সে নেই, হয়তো বা সে বাইরে! নয় কি আসে নি ? না না ভাবনা তাকে জড়িয়ে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে । তিস্তা মায়ের চোখের জল মুছতে মুছতে সকরুণ কণ্ঠে – ও মা ! তোমার কিছু হইনি তো?
তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো ?
শ্রেয়সী আর নিজেকে সামলাতে পারলো না সমস্ত রাগ অনুরাগ দু চোখ দিয়ে ঝরঝর করে ঝরতে লাগলো। সে মেয়েকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো। হাত দিয়ে মাথায় স্নেহের পরশ দিতে দিতে মৃদু স্বরে বলতে লাগলো- তুমিই আমার সব মা। তোমাকে একা ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। আমি তোমার জন্য বেঁচে আছি ! তোমার জন্যই বাঁচবো! আমাকে তোমার জন্যই……
ইতিমধ্যে অজিতেশ বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই দৃশ্যে সেও আবেগ প্রবণ। সে আত্ম গ্লানির অনুশোচনার ভুগছে। অনুতাপের সমস্ত রঙরেখা চোখে মুখে দৃঢ় হয়ে উঠেছে। ক্ষমা প্রার্থী হতে চাইছে কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছে না। শ্রেয়সী অজিতেশ কে দেখে চোখের জল মুছে অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে অপলক চেয়ে থাকে ক্ষোভে , অভিমানী হয়ে। মেয়ে বাবাকে দেখেই কেমন যেন ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলে ওঠে- বাপি তুমি এখন এসেছো? তুমি মোটেও ভালো না! তুমি চলে যাও, আমি আর মা তোমার কাছে আর যাবো না!
শ্রেয়সী কোন কথা বলল না হয়তো বা পারলো না। মেয়েকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে । তার চোখের কোণ থেকে নিঃশব্দে নোনা জল বইতে লাগলো গাল বেয়ে….।