বিনয় অবিনয়
-চিন্ময় মহান্তী
সেদিন শহরে কাজ সারতে সারতে দুপুর দুটো বেজে গেল । বাড়ি ফিরতে গেলে বাসে প্রায় দু’ ঘন্টা লাগবে । অগত্যা মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নেওয়াই বাঞ্ছনীয় চিন্তা করে ঢুকে পড়লাম ফুটপাথের একটি অনামী হোটেলে ।
হাত ধুয়ে যথারীতি চেয়ার দখল করে বসে ভাতের প্লেট আসার অপেক্ষা করছি , এক ভদ্রলোক এসে আমার ঠিক বিপরীত মুখী চেয়ারটা দখল করে বসলেন । সার্ভ বয় ততক্ষনে আমার প্লেটটি দিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো , ” স্যার মাছ দেবো না মাংস ? ” মাংসটা আমি খাবার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি টিভিতে মাংস নিয়ে ভাগাড় কান্ডের খবর দেখার পর থেকেই । মনে মনে স্থির করেছি এবার থেকে মাংস না মেনুতে মাছ রাখবো , তাই আর বিশেষ ভাবিত না হয়েই স্ট্রেটকাট বললাম , ” ভাই মাছই নিয়ে এসো । ” আমার অর্ডার পাওয়ার পরই ছেলেটি চলে গেল । ক্ষনিক পরেই ফিরে এলো একটা বড় ট্রের উপর প্লেটে হরেক মাছ সাজিয়ে , কি মাছ নেই তাতে গলদা-শোল-পাবদা ইত্যাদি আরো কি সব মাছ । ট্রেনে- বাসে হকারেরা যেরকম অনর্গল হরেক মালের দাম আউড়ে যায় সেও সেরূপ মাছের দাম আউড়াতে লাগলো । আমি তাকে থামিয়ে বললাম , ” ভাই সব চাইতে কম দাম কোন মাছের ? ” সে বিনীত ভাবেই উত্তর দিল , ” স্যার কাটাপোনা , পনের টাকা । ” আমি তাকে বললাম , ” তাহলে ওরই এক পিস দাও । ” ছেলেটি যথারীতি আমাকে মাছটা দিয়ে চলে গেল ।
আমার বিপরীতে বসে থাকা ভদ্রলোক এতক্ষণ আমাদের কথা বার্তা শুনছিলেন । তিনি এমনভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন যে তা দেখে আমার মনে হচ্ছিল, তিনি যেন অন্য গ্রহের কোনো জীব দেখছেন । ভদ্রলোকটির ভাতের প্লেট আসতে আমি তার দৃষ্টি থেকে নিষ্কৃতি পেলাম । সার্ভ বয় তাকে জিজ্ঞেস করলো , ” স্যার আপনাকে কি মাছ দেবো না মাংস ? ” ভদ্রলোক তারদিকে তাকিয়ে বললেন , ” সব চাইতে ভালো মাছ যেটা আছে নিয়ে আয় । ” ছেলেটি ফিরে যেতেই আমি ভদ্রলোকটির মুখের প্রতি চাইলাম , সাজ পোশাক ঠিকই আছে একেবারে সাহেবি ঢঙ , যা গায়ের রংটাই একটু কালো ; ওটা ফর্সা হলেই গোরা সাহেবদেরকেও বোধহয় উনি হার মানিয়ে দিতেন ।
ভদ্রলোক পকেট থেকে সেলফোন বার করে অপরপ্রান্তের কারও কথাতে সায় দিয়ে শুধু ‘ হুঁ-হুঁ ‘ বলে যাচ্ছিলেন । ছেলেটি অভ্যাস মতো মাছের প্লেট ভর্তি ট্রে নিয়ে হাজির হলো । ভদ্রলোক কথা বলতে বলতেই আঙ্গুল দিয়ে ট্রের প্রতি নির্দেশ করতেই ছেলেটি একটি গলদার প্লেট তার সামনে রাখলো । তিনি ফোনে হঠাৎ বলে উঠলেন , ” কি বললে ? আজ নিরামিষ , বার পালন করছো ।” কথার ধরন ধারনে মনে হলো হয়তো তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন । ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোকটি বললেন , ” এই এটা নিয়ে যা , আজ নিরামিষ । ” ছেলেটি চুপচাপ মাছের প্লেটটা ট্রেতে তুলে নিয়ে গেল ।
ভদ্রলোকটি ফোনে এপ্রান্ত থেকে যা বলছিলেন সবই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম । ইচ্ছা না থাকলেও যেহেতু আমি তার বিপরীতের চেয়ারে তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই শুনতে হচ্ছিল । তার ফোনে বলা , ” কি বললে ? আজ নিরামিষ , বার পালন করছো ” কথাটি শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম । মনে মনে ভাবলাম – ওনার স্ত্রী কি ফোনেও গন্ধ পান স্বামী কি খাচ্ছে , কি খাচ্ছে না ! উনি তো একবারও মাছ খাওয়ার গল্প বলেন নি, শুধু ‘ হুঁ ‘ দিয়ে যাচ্ছিলেন । ব্যাপারটা অচিরেই আমার কাছে জলের মতো হয়ে গেল যখন তিনি ‘ রাখছি ‘ বলে ফোনটা টেবিলে নামালেন । আমি লক্ষ্য করলাম ফোনের স্ক্রিনে কোনো আলো নেই । কারো সাথে কথা বলার পর ফোন রাখলে ফোনের স্ক্রিন লাইট কিছুক্ষন জ্বলে থাকে সাথে সাথেই নিভে যায় না । বুঝলাম পুরোটাই ভাঁড়ামি , আমার কাটাপোনা খাওয়াকে কিঞ্চিৎ হেয় করার জন্যই হয়তো ভদ্রলোকটির এরূপ উদ্দ্যোগ । কিন্তু ভেবে পেলাম না এতে উনি কি সুখ লাভ করলেন । যেহেতু তার আক্রমণ পরোক্ষে তাই আমি নীরব রইলাম । মনের মধ্যে একটি বিনয়ের ভাব এনে মনে মনে বললাম , ” এতে ওনার কোনো দোষ নেই , ওনার স্বভাবের দোষ । ”
প্লেটের ভাত শেষ হতেই ভদ্রলোকটি সার্ভ বয়কে ডেকে বললেন , ” ভাত নিয়ে আয় । ” ছেলেটি ভাত নিয়ে এসে তার প্লেটে যেই দু’ হাতা দিয়েছে অমনি তিনি চিৎকার করে উঠলেন , ” এক হাতা বললাম আর তুই দু’হাতা দিয়ে দিলি , বাড়তি একহাতা কে খাবে ? ” তিনি কখন বলেছিলেন তিনিই জানেন । ছেলেটি কাচুমাচু করে বিনয়ের সঙ্গে বলল , ” ভুল হয়েছে স্যার , একহাতা সরিয়ে রেখে দিন , দাম দিতে হবে না । ” আমি ততক্ষণে উঠে হাত ধুচ্ছি , না হলে হয়তো আমাকে সাক্ষী হতে হতো । আমাকে পাশ কাটিয়ে হোটেলের মালিক তখন ভদ্রলোকটির কাছে পৌঁছে গেছেন । তিনি ছেলেটিকে জোর ধমক দিয়ে বললেন , ” কানে কি কম শুনছিস ? ” ছেলেটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ততক্ষণে মালিক ফিরে এসেছেন ক্যাশে । আমি খাবারের দাম মিটিয়ে একবার ভদ্রলোকটির প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম , প্লেট পরিষ্কার । আঠারো- উনিশ বছর বয়সী সার্ভ বয় ছেলেটির চোখে আমার চোখ পড়ে গেল , সেও হয়তো ওটাই লক্ষ্য করছিল