মাহাত্মের ফুল
-মহেশ্বর মাজি
মদনপুরের শিব-মাহাত্ম আজ আর কারো অজানা নয়।
মাটির তিন হাত ভেতরে শিবলিঙ্গ।
শোনা যায় কাশিপুরের রাজা নিজে নাকি এখানে স্বয়ং একবার এসেছিলেন। রাণীকে ব্যাধিমুক্ত করতে।
রাণী যখন সুস্থ হন। তারপর রাজার সাথে পাল্কি চড়ে এসেছিলেন একবার পুজো দিতে।
আশেপাশের সমস্ত গ্রামবাসীদেরকে পুরো দিন ভোজন করিয়েছিলেন।
মন্দির সংস্করণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার আগে শোনা যায়,এখানে কোন স্থায়ী মন্দির ছিল না। শুধুমাত্র শিবরাত্রির সময় গ্রামবাসীরা মিলে কয়েকদিনের জন্য বাঁশ,খড় দিয়ে একটা চালার মত করে দিতেন।
আসলে মন্দির করার ইচ্ছে থাকলেও,উপায় ছিল না। তখন একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে সারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াভয় আকার ধারণ করেছিল।
মানুষ ঠিকমতো দুবেলা খেতে পাচ্ছিল না। মন্দির নির্মাণের ব্যয় জোটায় কী করে?
শেষে,মহাদেব স্বয়ং নির্মাণকারীকেই ডাক দিলেন।
কাশিপুরের রাজা, বাবার কৃপালাভের আশায় উপস্থিত হয়েছিলেন।
সে প্রায় কয়েকশো বছর আগের কথা। তারপর থেকে আজ অব্দি আর মন্দিরটির জীর্ণ সংস্করণ করা হয়নি। দূর থেকে তাকিয়ে দেখলে,এখন আর মন্দির বলে একদম মনে হয় না।একটা টিলার আকার ধারণ করেছে। চারপাশে অশ্বত্থ আর বটের শক্ত শিকড় মন্দিরের দেওয়াল ভেদ করে জালের মত ছড়িয়ে পড়েছে।
বর্ষাকালে জল পড়ে।
শোনা যায় ওখানে নাগ,নাগিনীও বাস করে।
অনেকের চোখেে পড়েছে। তাই কেউ আর একা মন্দিরে যাওয়ার সাহস দেখান না।
গ্রামে আজো কোন গাভীর বাছুর হলে, প্রথম দোয়া দুধ এক বাটি শিব মন্দিরের ভাঙা চত্ত্বরে নামিয়ে দিয়ে আসেন।
সকালে সেই এঁটো দুধের বাটির অল্প দুধ গাভীর মাথায় ছোঁয়ানো হয়।
সেই গাভীর দুধ কেউ কোনদিন নজর দিয়ে খাারাপ করতে পারে না।
বিজন এ গ্রামেরই ছেলে। এখন মুম্বাই-এ একটি বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ম্যানেজার। ইচ্ছে ছিল,বিয়েটা হোটেলে করার, কিন্তু বাড়ির সকলের তাতে ঘোর আপত্তি দেখা দিল।
তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরে উড়ে আসতে হল নিজের গ্রামে।
সানিয়া বাংলা বলতে ঠিকঠাক পারে না। তবে বুঝতে পারে।সবটাই নিজের আগ্রহে শিখেছে।বিজন তো পরিস্কার বলে দিয়েছিল,কোন দরকার নেই। বাংলা ভাষাটা আজকাল আমিই ঠিকমত বলতে পারি না।
কথা ছিল অষ্টমঙ্গলাটা চুকে যেতেই ফ্লাইট ধরবে। জিদ ধরলো সানিয়া নিজেই। আর দিন কয়েক পরই নাকি শিবরাত্রি। খুব ধুমধাম সহকারে বাবা ভোলেনাথের পুজো হয়। দুদিন বাউল,একদিন অষ্টম প্রহর গুনকীর্তন তাছাড়া অনেকেই ডন্ডিও দেন।
সানিয়াকে বিজন সব বোঝাতে পারলেও ওই “ডন্ডি” নামক শব্দটির ঠিক সরলীকরণটা বোঝাতে পারল না। সানিয়া জিদ ধরে বসে থাকল। ওটা যে কী জিনিস নিজের চোখে না দেখে কিছুতেই যাবে না।
দরকার হলে হানিমুনের ট্রিপ থেকে কয়েকটা হলি ডে মাইনাশ করবে।
বিজনও আজ দশ বছর পর নিজের জন্মভূমিটা একবার ঘুরে, ফিরে দেখার সুযোগ পেল।সানিয়াকে সাথে নিয়ে পরিচয় করাতে লাগল এক,একটা জিনিসের সাথে।
পুকুর,ডোবা,ইস্কুল,ধানক্ষেত,জোড়।
সবশেষে এল সেই পুরনো শিব মন্দিরের চত্ত্বরে।
সানিয়া বলে উঠল,ফেন্টাসটিক।ইয়ে খুসবু কিস চিজ কী?
বিজনও বুঝতে পারল না। সত্যি সত্যিই অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধে চারিপাশ ম ম করছে।বিজন এদিক,ওদিক খুঁজে দেখল, তবু কিছু বুঝতে পারল না।
সানিয়া চোখের সামনে অনেকগুলো প্রস্ফূটিত ধুতরা ফুল দেখে বলে উঠল,ও দেখো।
বিজন হো,হো করে হেসে ওঠল,আর ইউ ম্যাড?..ওগুলো ধুতরো ফুল।কোন গন্ধ থাকে না।
সানিয়া না দেখে মানবে না। একটা তুলে এনে নাকের কাছে ধরে বলল, প্রুফ ইট।
বিজন নিজের নাককেই বিশ্বাস করতে পারল না।
এটা কী করে সম্ভব? হতেই পারে না। তাহলে কী সে ছোটবেলায় ভুল শিখে এসেছিল?..না,এখন ধুতরো ফুলে গন্ধ হয়?..হয়ত সে জানে না।
তাই একটা ফুল পকেটে ভরে বাড়ি ফিরে এল।
সন্ধ্যেবেলায় সবার সামনেই বলতে লাগল,আচ্ছা মা,তুমি যে আমায় বলতে ধুতরো ফুলে কোন গন্ধ থাকে না। সেটা কী ভুল?
ওর মা সানিয়ার মাথায় তেল বুলিয়ে বলে উঠলেন,ধুর বোকা। সেটা ভুল হতে কেন যাবে?সবাই তো জানে ওই ফুলে গন্ধ থাকে না।
সানিয়া বলে উঠল,না মামিজী এই কথাটি রঙ্গ্ আছে। আমি অর্ আপনার সন মিলকে দেখে এলাম।
তার মা হেসে বলে উঠলেন,কী দেখে এলি পাগলী?..আর তুইও ধন্য বিজন!..বউমাকে বুঝিয়ে বলবি কোথায়? উল্টে তুই ওকে ভুল শিক্ষা দিচ্ছিস?
বিজন পকেট থেকে ধুতরো ফুলটা বের করে শুকে দেখল। গন্ধ নেই, সানিয়াও পেল না।
দুজনই অবাক। তবে কী ফুলটার গন্ধটা এতক্ষণে শেষ হয়ে গেল?
সবাই এ নিয়ে হাসিহাসি করলেও, বিজন আর সানিয়া কিছুতেই হাসতে পারল না। এতটা ভ্রম তাদের কী করে হতে পারে?
এ নিয়ে রাতে দুজনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হল।
তারপর দিন আবার মন্দির চত্ত্বরে তারা গেল। গন্ধটা পেল না। তারা আবার অবাক হল।
এই প্রথম আনমোনা হয়ে বাবা ভোলানাথের উদ্দ্যেশে দুজনেই প্রণাম করল।
তারা বাড়ি ফিরে এল।
এসেই সবাই প্রায় একসাথে বলে উঠল,হ্যাঁরে বিজন এত সুন্দর গন্ধ কোথা থেকে কিনেছিস বাবা?..আমাদের দুটো দিয়ে যাস বাবা ।
তোর দাদু হাঁপানির রুগী।দ্যাখ কেমন আজ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন?..ওই গন্ধ পেয়ে।
কোথাও মনে হচ্ছে কোন যন্ত্রণা নেই, শুধু শান্তি,অপার শান্তি। আমরা কখন থেকে শিশিটা খুঁজে ফিরছি, পেলাম না।
তার মা আগ্রহ সহকারে বলে উঠলেন,কই দ্যাখা বাবা একবার । কেমন জিনিসটা দেখি তো।সারা পাড়া এসেছিল,দেখতে। কোথাও পেলাম না।
বিজন কোন গন্ধ পেল না। সানিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, সেও পায়নি।
বিজন দেখল তার প্যান্টের পকেটে ধুতরো ফুলটা আজো সেই একই রকম আছে। অল্পও শুকায়নি, সানিয়াও অবাক।
গন্ধটা কী তাহলে…।না তো কই?
ফুলটা বিজন বাইরে ছুঁড়ে দিল ।
মাঝ রাতে হঠাৎ বিজনের ঘুমটা ভেঙে গেল। সানিয়ার চোখেও ঘুম নেই।বলে উঠল,বাবা ভোলেনাথ কুছ তো চাহতে হ্যায়?
বিজন বলল,ঈশ্বরে বিশ্বাস আমি সেরকম না করলেও। এত লোকের যে বিশ্বাস তাকে ভেঙে লাভ নেই।
শিব মন্দিরটা সংস্কার করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।
সানিয়া বলল,আমার ভী ইরাদা আছে। এমনভাবে বানাতে হবে, যেন বিলকুল স্বর্গ মনে হয়।
বিজন বলল,কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার!
সানিয়া বলল,এখন স্লিপিং টাইম। কাল সকালে ভাবা যাবে।
বিজন মোবাইলের আওয়াজ পেয়ে ভাবল,হয়ত অ্যালার্মটা অফ করা হয়নি।ঘুম জড়ানো চোখেই হাতে মোবাইলটা নিয়ে কাটতে যাবে। এমন সময় চমকে উঠল।মি. লিলি য়ান-এর ফোন। কোম্পানীর সি.ই.ও।
ফোন ধরে বিজন জানতে পারল। তাদের কোম্পানী কিছু ফান্ড ডোনেট করতে চায়।ইন্ডিয়াতে কোথায়, কোথায় ডোনেট করতে হবে তার একটা সামগ্রিক লিষ্ট যেন খুব শীঘ্রই তৈরি করা হয়। অনাথ আশ্রম,স্কুল,কলেজ,হাসপাতাল এমন কী মন্দির বা মসজিদ প্রকল্পেও দান করা চলবে।
সানিয়া খুশি হয়ে বলে উঠল,আমি জানতাম। কুছু একঠো হবে জরুর।
বিজনের বিশ্বাস এবার কানায়,কানায় ভরে উঠল। ঈশ্বর যদি চান,অনেক কিছুই করিয়ে নিতে পারেন।
না হলে বিজনের কী সাধ্যি ছিল। গ্রামের এতবড় শিব মন্দিরটাকে এতবড় তীর্থস্থল করে দেয়?সে তো নিমিত্ত মাত্র।টাকা দিয়েছেন,তাদের কোম্পানীর মালিক।
সে শুধু মার্বেল চালান করেছে,বসিয়েছে গ্ৰামের মিস্ত্রি,নিজের পরিশ্রমে। ভোজনশালা বানালে কী হবে। সে তো দানের জিনিসে চলছে। সে শুধু একটা মন্দিরের ট্রাস্ট মন্ডল গঠন করে কয়েক কোটি টাকা গচ্ছিত রেখে দিল। যাতে মন্দিরের সংস্কারে বাঁধা না পড়ে।
আজকাল বিদেশের মাটি থেকে সেও আর আসতে সময় পায় না।
এক বছরের মধ্যে সেও প্রোমোশন পেয়ে আমেরিকায় চলে যায়।
আজো তারা শিবরাত্রির দিনটা মনে রাখে।সানিয়া ওইদিন উপোস করে বাবার পুজো দেয়।
গ্রামের শিব মন্দির থেকে যে ধুতরো গাছটা এনে লাগিয়ে ছিল। তার ফুলগুলো আজো সেই রকম সুগন্ধ ছড়ায়।
তবে সেটা তারা দুজনই পায়। এমন কী তাদের ছেলে শংকরও না।
সমাপ্ত
গল্প বেশ সুন্দর হয়েছে