ভালবাসার শেকড়
চিন্ময় মহান্তী
১
বিকেল হলেই সাজতে বসে ফুলকি । টান টান করে চুল আঁচড়ে চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায় । বার কয়েক আয়নায় তাকিয়ে দেখে নেয় নিজেকে । ওঘর থেকে হাঁক দেয় তারই সখী ফুলি , ‘ কি লো হইছে । ‘ ফুলকি কপালে টিপ লাগাতে লাগাতে বলে , ‘ হ যাই । ‘ তারপর দুজনে বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় রাস্তার বড় লাইটটার নিচে ।
রাত বাড়তে থাকে , বাড়তে থাকে বাবুদের আনাগোনা । ফুলকির এসব আর ভালো লাগে না । সে বেণীর চুলগুলো নাড়তে নাড়তে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পাড়ায় ঢোকার মুখে রাস্তার দিকে । পরপর তিন তিনটে বাবুর ধকল সয়ে ফুলি বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় ফুলকির কাছে , বিড়বিড় করে বলে , ‘ টাকা দিয়েছে বলে মানুষ বলে ভাবে না , হায়নাগুলো । ‘ ফুলির কথা কানে যায় না ফুলকির । কোনো উত্তর না পেয়ে ফুলি ঝাঁঝিয়ে বলে , ‘ ইনি আবার পিরিতে মজেছেন । ধুর ! আমাদের আবার এসব ।’ বিরক্ত হয়ে চলে যায় ফুলি চার নম্বর বাবুর সাথে । ফুলকি তখনও দাঁড়িয়ে থাকে । অপেক্ষা করতে করতে ফোনটা বার করে গোপন মানিব্যাগ থেকে । তারপর একটা নম্বর ডায়াল করে । ওপ্রান্ত থেকে শোনা যায় , ‘ যাচ্ছি গো যাচ্ছি । জ্যামে আটকে পড়েছি । ‘ ওর মুখ থেকে ‘ গো ‘ ডাকটা শুনতে বেশ ভালো লাগে ফুলকির । ফোনটা কেটে যায় কিন্তু তার কানে ভ্রমরের গুনগুন আওয়াজের মতো ঘনঘন বেজে যায় , ‘ যাচ্ছি গো যাচ্ছি । ‘
২
ফুলকির আজ ভীষন মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা । যখন বাবু তার কাছে আসতো সেজেগুজে দামী পারফিউম মেখে । সে মুখটা গুঁজে দিত বাবুর বুকে । তারপর কাজলের তলে রাত-ভোর এঁকে যেত হাজার স্বপ্ন । সেই স্বপ্নগুলোর শেকড় মাটি খুঁজে পায় একদিন , ফুলকির সিঁথি ভরে ওঠে সিঁদুরে । টেবিলের উপর রাখা আয়নাটা তুলে নেয় ফুলকি , নিজের বিবর্ন মুখটা দেখে আঁতকে ওঠে । বাবুর জন্য মনটা কেমন করে ওঠে । সে চলে গেলে বাবু কি করে একা থাকবে – এই চিন্তা এসে গ্রাস করে ফুলকির দৃষ্টি । ধীরে ধীরে দৃষ্টি ঝাপসা হয় । কয়েক ফোঁটা চোখের জল টপটপ করে পড়ে বালিশের বুকে ।
বাবু ঘরে ঢুকে দেখে ফুলকি কাঁদছে । কাছে গিয়ে পরম আদরে চোখের জল মুছিয়ে বলে , ‘ তুমি ভালো হয়ে যাবে ফুলকি । ‘ ফুলকি জানে যে রোগ এসে ধরেছে তাকে তা থেকে মুক্তি একমাত্র মৃত্যু , তবুও বাবুর কথায় মাথা নেড়ে জানান দেয় এখনো ভালো হয়ে বাবুর সাথে দীর্ঘজীবন অতিবাহিত করার আশা রয়েছে তার বুকে । দু’ হাত বাড়িয়ে বাবুর মুখটা কাছে টেনে নেয় ফুলকি , তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে , ‘ বাবু , পরজনমেও যেন এই ভাবে কাছে পাই তোমায় ! তুমি থাকবে তো ? ‘ কথাটা শুনে ফুলকির ডান হাতের কব্জিটা চেপে ধরে বাবু । চারটি চোখের জল জানিয়ে দেয় ভালবাসার শেকড় মাটির ভেতরের জল খুঁজে পেয়েছে ।