তখন অনেক রাত

তখন অনেক রাত
-পার্থসারথি

 

বদ্যিপাড়ার যেদিকটায় ঝোপঝাড় ওইদিকে থাকে তিনুমাসি-একাই থাকে সে ,তিনকুলে তার কেউ নেই।রাত তখন দেড়টা-দুটো তিনু মাসির দরজায় আঘাত-ঠক,ঠক,ঠক-ঠক———?
তিনু মাসির এমনেই রাতে ঘুম আসে না।

যদিবা চোখ একটু লেগেছিল তাও গেল চুলোই ওই ঠক্-ঠক্ আওয়াজের দৌলতে।কে-কে-এতো রাতে ?কে দরজায় ধাক্কা দেয়?
গলা চড়িয়ে বলে উঠলো তিনু মাসি।
মাসি ,আমি ঘ্যানা শিগ্গির দরজাটা খোলো।
কেন কি হয়েছে রে?
বলছি-বলছি,আগে দরজাটা খোোলোতো।
তিনু মাসি দরজা খুলে দিতেই ঘ্যানা ঢুকে পড়লো হন্তদন্ত হয়ে ,বললো-মাসি দরজাটা বন্ধকরো তাড়াতাড়ি।
কেন?
আঃ কথা বারিওনা যা বলছি তা শোনো।
তিনুমাসি ঘ্যানার কথা মতো দরজাটা লাগিয়ে দিলো।
এবার বলতো ঘ্যানা কি হয়েছে?
বলবো-বলবো সব বলবো;আগে একগ্লাস জল দাও দেখি?গলাটা শুকিয়ে একে বারে কাঠ হয়ে গেছে।
তিনু মাসি কলসী থেকে জল গড়িয়ে ঘ্যানার হাতে দিলো।জলটা এক নিশ্বাসে ঢক্ ঢকিয়ে খেয়ে ঘ্যানা বললো,আঃ,এতক্ষণে জীবনটা এলো মাসি তুমি কোনো জন্মে আমার মাই ছিলে।
এবার বলতো ঘ্যানা এতরাতে তুই এখানে কেন এলি?।
পুলিশ!
পুলিশ!কেন কি-কি হ-হয়েছে?তিনুমাসির গলা একটা অজানা ভয় যেন চেপে ধরলো।
ঘ্যানা বললো,পুলিশে আমাকে তাড়া করেছে।সেই স্টেশান মোড় থেকে ছুটতে ছুটতে আসছি।আর একটু হলেই ধরা পড়ে গিয়েছিলুম আর কি।
কেন পুলিশ তোকে তাড়া করলো কেন?তুই কি করেছিস্?
জাননা সেদিন সাহেবরা আমাদের মালবোঝাই গাড়ি বাজারে ঢুকতে দেয়নি।সেই নিয়ে প্রথমে বচসা পরে হাতাহাতি–শেষে-বোমবাজি।ওরা আমাদের চন্দনের গায়ে বোম মেরেছে-সে এখন হাসপাতালে ভর্ত্তি।উল্টে শালা আমাদের নামেই থানায় ডাইরি করেছে?
ও মা সেকি !ওরা মেরে আবার ওরাই ডাইরী করেছে?পুলিশ ডাইরী নিলো কেন?
নেবেনা?ওরা যে শালা জনার্দন ওঝার লোক গোটা দুনিয়াটা শালারা যেন কিনে রেখেছে?
ওরা কিন্তু খুব ভয়ঙ্কর ঘ্যানা?সাবধানে চলাফেরা করিস্।এইতো সেদিন বাউরী রণাটা আর বাড়ি ফিরলোনা একদম বেপাত্তা।
হবেনা রণা যে সাহেবের বাউরী পাড়া ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিলো।
হঠাৎ দরজায় আবার শব্দ-ঠক্-ঠক্-ঠক্—–তিনুমাসি ঘ্যানাকে বললো ঘ্যানা তুই মাচানের উপর লুকিয়ে পর ,মনে হচ্ছে পুলিশ।
কি হলো দরজা খোলো,না খুললে দরজা লাথি মেরে ভেঙে ফেলবো,বাইরে কারা যেন চিৎকার করে উঠলো।

তিনু মাসি ঘুম-জড়ানো গলা নকল করে বললো ,কে ?এতরাতে?এখানে ?
পুলিশ!-উত্তর এলো বাইরে থেকে।ততক্ষণে অবশ্য ঘ্যানা লুকিয়ে পড়েছে মাচানের উপরে।
পুলিশ?তা এখানে কেন?
দরজাটা খুলবে,না ভেঙে ফেলবো।
তার দরকার হবে না।খুলছি ,খুলছি।এই বলে তিনুমাসি দরজাটা খুলে দিলো;দরজা খোলার সাথে সাথেএকদল পুলিশ ও সাহেব ঘরের মধ্যে হুরমুরিয়ে ঢুকে পড়লো।
সাহেব লাল চোখে তিনুমাসিকে বললো,ঘ্যানা কোথা?
তিনূ মাসি মুখে কাপড় চাপা দিলো কারণ সাহেবের মুখ থেকে ভক্ ভকিয়ে মদের গন্ধ বেরুচ্ছিলো।
কিহলো ?ঘ্যানা কোথা?সাহেব ঝাঁঝালো গলায় চিৎকার করে উঠলো।
চিৎকার করবি না সাহেব!এটা ভদ্রলোকের পাড়া।
ওঃ ভদ্দর পাড়া!কি আমার সতিলক্ষীরে!
থানার বড়বাবু নিরঞ্জন সমাদ্দার সাহেবকে
থামিয়ে তিনুমাসিকে বললো-আপনিতো ঘ্যানার দূরসম্পর্কীয়া মাসি ,কি?
হ্যাঁ,তাতে কি হয়েছে?
কিছু হয়নি,ঘ্যানা ছুটতে ছুটতে এদিকেই এসেছে।
তাই আমাদের সন্দেহ হলো সে হয়তো এখানে-মানে আপনার বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে!হাজার হোক মাসি তো?
ভদ্রভাবে কথা বলো অফিসার ?আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আজ তোমার বয়সেরই হতো।
সাহেব হঠাৎ ফোড়ং কাটলো-স্যার এশালা বিধবা বুড়ি এযুগের মাতঙ্গিনী।-কথাটা শুনে দলের অন্য কনস্টেবলেরা হো -হো -হা -হা -হি -হি-করে হেসে উঠলো।
আঃ কি হচ্ছে কি?চুপ!সবাই আবার চুপ।যেন একটা আলপিন পড়লেও শোনা যাবে।
বড়বাবু এবার কনস্টেবলদের ঘরটা সার্চ করার নির্দেশ দিলেন।
তিনু মাসি বললো ,এটা কি?বলা নেই, কওয়া নেই আমার বাড়ি সার্চ?তার আগে তোমার সাথের ওই গুণ্ডাটাকে গ্রেফ্তার করা উচিত অফিসার?
আপনি কিন্তু আপনার ঔকাৎ ভুলে যাচ্ছেন তিনুদেবী?পুলিশের কাজে বাধা দিয়ে আইন হাতে নেবেন না।
আইন!হাঃ-হাঃ-হাঃ,যারা আইনের দোহাইদিয়ে মুঠো মুঠো টাকা আত্মসাৎ করে,তাদের মুখে আর যাইহোক আইনের কথা মানায়না।
কি মানায় আর না মানায় ,একটু পড়ে টের পাবেন।-বলে বড়বাবু এক কনস্টেবলের কাছে জানতে চাইলেন-কি কোনো ক্লু পেলে সমীর?
না স্যার।
মাচানের উপরে কি আছে তিনুদেবী?বড়বাবু জানতে চাইলেন
তিনুমাসি বললো ,ওখানে কিচ্ছুনেই।বড়বাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন-
বেশ!তাহলে চলো হে সব,মনে হচ্ছে মালটা এখানে আসেনি।
বড়বাবুর কথাটা শেষ হতে না হতেই মাচানের উপর রিঙটোনের আওয়াজ ভেসে এলো।
একটা কনস্টেবল চেঁচিয়ে উঠলো -স্যার মোবাইল!মাচানের উপর!
ঘ্যানা ওর মোবাইলের সুইচ অফ্ করতে ভূলে গিয়েছিলো।আর ওটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়ালো।
বড়বাবু মাচানের উপরটা সার্চ করার নির্দেশ দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে দুজন কনস্টেবল্ মাচানের উপর চেপে ঘ্যানাকে নামিয়ে নিয়ে এলো।
বড়বাবু ঘ্যানার উদ্দ্যেশ্যে বললেন-এবার বাছাধন !চলো থানায় বেশ করে ধোলাই দিয়ে,বেছে বেছে জাঁদরেল ধারা দিয়ে তোমাকে কোর্টে চালান করবো।তবেই আমার নাম নিরঞ্জন সমাদ্দার।এই কে আছো? ব্যাটাকে গাড়িতে তোলো।
তিনুমাসি প্রথমটায় বাধা দেবার চেষ্টা করলে -সাহেব তার পেটে একগুঁতো মারলো,তিনু মাসি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
ঘ্যানা নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না চিৎকার করে উঠলো-সা—-হে—-ব!হাত দুটো নেহাৎই আমার বাঁধা তানাহলে মাসির পেটে গুঁতো মারার ফল তুই হাড়ে হাড়ে টের পেতিস্।
ততক্ষণে তিনুমাসি কোনোরকমে উঠে বসেছে।
বড়বাবু বললেন ,আঃসাহেব আইন হাতে নিও না।ফলাখারপ হবে।
তিনুমাসি সাহেবকে বললো-সাহেব তুই কাজটা ভাল করলিনা।এরজন্য তোকে ভুগতে হবে।
বড়বাবু কনস্টেবলদের বললেন-এই দাঁড়িয়ে দেখছো কি?গাড়িতে তোলো ব্যাটাকে।থানায় নিয়ে গিয়ে ব্যাটার দপ্ দপানি আমি আজই ঠাণ্ডা করে দিচ্ছি।
ঘ্যানাকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে থাকা পুলিশ ভ্যানে তুলে-ভ্যানটা সোজা উত্তর মুখে বেরিয়ে গেল।
তিনুমাসি ওদের উদ্দ্যেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলো-তোদের দিন এবার ফুরিয়ে এসেছে রে পশুরদল!সবাই জেগে উঠছে -এবার তোদের বিনাশ হবে -বিনাশ হবেই হবে।

তিনুমাসিও শক্ত মায়ের বাছা।অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করা তার অভিধানে নেই।কোনো রকমে উঠে দরজায় শেকল দিয়ে পাটি পাটি করে রওনা দিলো বাউরী-পাড়ার দিকে।মঞ্জা বাউরীর ভাঙা দেওয়ালের কাছে এসে ডাক দিলো,-ম–ন—-জজাএই-ম–ন–জা।
মঞ্জা মনে হয় জেগেই ছিলো বললো,ক্যা ক্যা গ-এত রাইতে?—–

আমি ,আমিরে তোদের তিনুমাসি।
ওহ!মাসি?তাই বুলো,তা ঘরবাগে আস কেনে মাসি?
বিপদ হয়েছে রে মঞ্জা।
তা আবার কি বিইপদ হ্যল গ?
কিছুক্ষণ আগে সাহেব পুলিশ নিয়ে এসে ঘ্যানাকে ধরে নিয়ে গেলো।
আমার পেটেও ঘুসি মেরেছে ওই হারাম- জাদাটা।

উঃ শালা সাহেবের খুইব বার ব্যাড়েইছে।উর ববস্থাট আমাদেরক্যাই ক্যরতে হ্যবে।

শোন কালই আমরা সকলে সকাল ৯টার সময় থানা ঘেরাও করবো।
তুই সনাতন,ফকির,রণার ভাই গনা ,জগদীশ এদের সবাইকে জানিয়ে দিস্।

হ্যাঁ-হ্যাঁ সিট তুমাকে চিন্তা ক্যরতে হ্যবে না আমরা সব্বাই তৈয়ার থাইকব,ঘ্যানা আমাদের মাবাপ ব্যটটে।উর জ্যন্যে জান বাজী রাইখব গো মাসি -জান বাজী রাইখব।

তিনুমাসি আবার মনে করিয়ে দিলো,মনে রাখিস্ কাল সকাল ৯টা?
হ্যাঁ-হ্যাঁ ত্যুমি নিচ্তিন্তি ঘ্যর ষাও।

থানায় বড়বাবুর রুমে জনার্দ্দন ওঝা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,ঘ্যানার পিঠে লাল দাগ গুলো কিসের ববড়বাবু?এতো মার মেরে ছেন এখনো পর্যন্ত বেহুঁশ-যদি কিছু হয়ে যায় আপনার চাকরিটা তো থাকবে না-ই,সেই সঙ্গে মিডিয়ার দৌলতে গোটা ব্যাপারটা আর ছড়াতে বাকি থাকবে?যতসব গর্দভকান্তের দল।

বড়বাবু মাথা নিচু করে বললো,সরি স্যার্!

আর সরি স্যার যা গোবর গোলার তাতো গুলে
ফেলেছেন।
এবার সাহেবের দিকে আঙুল তুলে জনার্দনবাবু সরোষে বললো,নিজেকে তুই কি মনে করিস্ সাহেব?তোর ওই গুণ্ডা গর্দ্দি দল মেনে নেবে?যদি কিছু দূর্ঘটনা ঘটে যায় তার জন্য দায়ী থাকবি তুই আর ওই তিনদিনের বড়বাবু।

সাহেব জনার্দনের পা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো ,আমাকে বাঁচাও জনুদা এবারের মতো মাপ করে দাও।

এইভাবে একটার পর একটা ভূল !দলের কাছে আমার ভাবমূর্ত্তির কথাটা একবার ভাবলি না?নেক্সট্ ইলেকশনে দল আমাকে টিকিট দেবে ভেবেছিস্?

হঠাৎ একজন কনস্টেবল দৌড়ে এসে বড়বাবুকে বললো,স্যার-স্যার প্রায় শ-পাঁচেক লোক হাতে লাঠি ,ঝাঁটা,কুড়াল নিয়ে থানা ঘেরাও করতে এগিয়ে আসছে এইমাত্র বিবির পুকুরের পাড়ে দেখে এলাম!

জনার্দন ওঝার চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো,বড়বাবুকে সে বললো-এখন কি করে সামলাবে অফিসার?

বড়বাবু নিরঞ্জন সমাদ্দার বললেন,জনার্দ্দন বাবু আপনি পেছনের গেট দিয়ে বেড়িয়ে যান।সাহেবকেও সঙ্গে নিয়ে যান।
জনার্দ্দন ওঝা যাবার আগে আবার বড়বাবুকে মনে করিয়ে দিলো-দেখবেন দ্বিতীয় ভূল যেন আর নাহয়?

না না সে আপনার চিন্তা নাই ,আমি ব্যাপারটা ঠিক ট্র্যাকেল করে নেবো।নফরগঞ্জে আসার পর থেকে অনেক এক্সপিরিয়েন্স হয়েছে -তাছাড়া অনেক গুলো প্রোবলেমইতো সল্ভ করলাম।

তাই নাকি!বেশ আসছি ,কি ঘটে না ঘটে পরে ফোনে——–!সাহেব! চল আমরা বেড়িয়ে যাই।জনার্দ্দন ওঝা সাহেবকে নিয়ে থানার পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।ওদের গাড়িটা বাজারের মোড় ক্রস করতে না করতেই মিছিলের মুখে পড়লো।বাইরে থেকে ওদেরকে দেখা যাচ্ছিল না;কারণ গাড়ির গেটের কাচগুলো কালো।গাড়ির ভেতর থেকে জনার্দ্দন ওঝা লক্ষ্য করলো মিছিলের পুরোভাগে রয়েছে বিরোধী শিবিরের নেতা সাকিল ও ভীম নস্কর এবং সঙ্গে সেই সবার পরিচিত তিনুমাসি ও বাউরী পাড়ার লোকজন ।তিনুমাসি আজই সকালে সাকিলদের আঞ্চলিক অফিসে গিয়ে সব খোলসা করে বলে এসেছিলো।
জনার্দ্দন ওঝা সাহেবের উদ্দ্যেশ্যে বললো,সাহেব জল যে অনেক দূর গড়িয়েছে রে—-।বড়বাবুকে একবার কল করতো।

এই যে করি—–,
বলে সাহেব ওর মোবাইল থেকে বড়বাবুকে ফোন করলো।
ফোনে বড়বাবুর গলা-হ্যালো !কে?

সাহেব বললো -ধরুন জনার্দ্দন দা কথা বলবেন—–,
বলে ফোনটা জনার্দ্দন ওঝার হাতে ধরিয়ে দিলো।
হ্যাঁ!বড়বাবু আমি সভাপতি সাহেব বলছি।আমি যা বলছি তা মন দিয়ে শুনুন।লোকজন অনেক -আপনি এখনই ডি-এস-পি কে ফোন করে কিছু এডিশনাল্ ফোর্সের ব্যবস্থা করুন।নইলে সামাল দিতে পারবেন না।ক্যুইক্ এখনই—-
বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বার করে নিয়ে যাওয়ার ইশারা করলো জনার্দ্দন ওঝা।
গাড়িটা চোখের নিমেষে বেরিয়ে গেল।
এদিকে থানার বড়বাবু জনার্দ্দন ওঝার কথা মতো ডি-এস-পি সাহেবের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে এডিশনাল ফোর্সের ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন।মোটামুটি আধঘন্টার মধ্যে ফোর্স পৌঁছে যাবে।

মিছিল বাজার ছাড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডের মুখে।”থানার বড়বাবু মুর্দাাবাদ।”—“সাহেবকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।”–
“জনার্দ্দন ওঝা তুমি নিপাৎ যাও।”—“ঘ্যানাকে অবিলম্বে ছেড়ে দিতে হবে।”ইত্যাদি ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে মিছিলটা একসময় থানার গেটে গিয়ে পৌঁছালো।ভিতর থেকে গেট বন্ধ।

সবার আগে তিনু মাসি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো-কই রে কাপুরুষের দল কোথায় লুকালি সাহস থাকেতো বেরিয়ে আয় ।মিছিলের অন্য লোকজনও খুব হম্বিতম্বি করতে লাগলো।

কেউ কেউ ইটপাটকেল ছূঁড়তেও দ্বিধা করলো না।পরিস্থিতি যখন খুব জটিল বলে মনে হলো বড়বাবুর ,তখন হ্যান্ডমাইকের মাধ্যমে ঘোষণা করলেন-
আপনারা কেউ কিন্তু আইন নিজের হাতে নেবেন না।ঢিল ছূঁড়ে থানার জানলার একটা কাচ যদি ভাঙে তাহলে সরকারী সম্পত্তি নষ্টের দায়ে সবাইকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হবো।

মিছিলের সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠলো-সব নষ্ট করে ফেলবো দেখি আমাদের গ্রেফতার কর।

তারা থানার গেট টপকানোর চেষ্টা করতে লাগলো এবং রীতিমতো ইটপাটকেল ছূঁড়তে লাগলো।
সাকিল ও ভীম নস্কর সকলকে শান্ত হতে বললো এবং বড়বাবুর পারমিশন বলে তিনুমাসি ,সনাতন,গনা,জগদীশ ও মঞ্জাকে নিয়ে থানার ভেতরে ঢুকলো।অবশিষ্ট লোকজন বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো।
এদিকে এডিশনাল ফোর্সনিয়ে একটা পুলিশভ্যান থানার গেটে এসে হাজির হলো।

বড়বাবুর পার্সোনাল্ রুমে ওরা সবাই ঢুকলো এবং অফিসিয়াল এটিকেট্ যথাসম্ভব বজায় রেখে সবার আগে সাকিল বড়বাবুকে বললো -কোন অপরাধে ঘ্যানা ওরফে ঘনশ্যাম দাশগুপ্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে?জানতে পারিকি?
বড়বাবু তাচ্ছিল্যের সুরে বললো-আপনি কে?
ভীম নস্কর গলা চড়িয়ে বলে উঠলো,চেনেন না মনে হচ্ছে?খুব বাড়াবাড়ি করছেন আপনি।
সাকিল ভীমের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললো,কতটা মাল খাইয়েছে ওই জনার্দ্দন ওঝা?

হোয়াট্!আপনার সাহসতো কম নয় ?থানায় ঢুকে থানারই বড়বাবুর aginstএ আনঅফিসিয়াল এলিগেশন্?

সাহসের এখনই দেখলেন কি?এরচেয়েও বেশী সাহস দেখাতে পারি।

তাইনাকি?কিন্তু এটা থানা -কথাটা ভূলে যাবেন না।বড়বাবু বললো।

ভীম নস্কর ও তিনুমাসি একযোগে বলে উঠলো-এডিশনাল ফোর্স কেন ?লাঠিচার্জ করবেন নাকি?
তা আপনারা যদি অশান্তি করেন তখন তাই করতে হবে,বড়বাবু জানালো।

বাইরে যারা ছিলো তাদের মধ্যে অনেকেই পুলিশ ব্যারিকেড্ ভেঙে থানার ভেতরে ঢুকতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে তাদের একপ্রস্থ খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেলে বড়বাবু বললেন,ভীমবাবু আপনার লোকেদের শান্ত হতে বলুন;নইলে পরিণাম কিন্তু খুব ভয়ঙ্কর হবে?

ভীমনস্কর বাইরের সকলকে শান্ত হতে বললে তারা তার কথামতো ভেতরে ঢোকা থেকে বিরত হলো।
হঠাৎ তিনুমাসি বড়বাবুকে বললো,ঘ্যানাকে কোর্টে চালান করা হয়নি কেন এখনো?
সে কৈফিয়ৎ আপনাকে দিতে আমি বাধ্য নই।

সাকিল রাগে ফেটে পড়লো–কি ভেবেছেন কি আপনি?খাঁকি পোশাকটা গায়ে আছে বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করবেন?
আমরা চাই ইমিডিয়েট আপনি ঘ্যানাকে কোর্টে প্রডিউস্ করুন।
নইলে—-

নইলে! কি করবেন কি?
আমরা মানবাধিকার কমিশনের দারস্থ হবো!ভীমনস্কর জানালেন।

তা যাননা যেখানে যাবেন। এখানে কেন এতো উপদ্রব?আমাদের করণীয় যা -তা করার পরই ঘ্যানাকে কোর্টে প্রডিউস্ করা হবে।
ভীমনস্কর বলে বসলো,এটা কি আপনার বাপের জমিদারী?যে যখন যা খুশি তাই করবেন।সাকিল !ডি-এস-পিকে ফোনে ধরোতো দেখি?

সাকিল ডি-এস-পিকে ফোনে সমস্ত ব্যাপারটা ইন ডিটেল্ জানালো।
ডি-এস-পিও আশ্বাস দিলো তাদের।অতএব আজকের থানা ঘেরাও-এর উদ্দ্যেশ্য সফল।তারা আবার সদলবলে মিছিল করে বড়বাবুর কুৎসা-মেশানো স্লোগান দিতে দিতে ফিরে এলো আঞ্চলিক অফিসে।
সাময়িক একটা আলোচনা সভার কাজ সাঙ্গ করে সেদিনকার মতো সকলেই বিদায় নিলো।

গাজনের মেলা ছিলো সেদিন ।সাহেব তার নিজের মোটরবাইকে করে বাড়ি ফিরছিলো। পীরস্থানের কাছে আসতেই কারা যেন তার পথ আটকে দাঁড়ালো।সকলের মুখ কাল কাপড়ে মোড়া।তাদের মধ্যে একজন বললো ,কোথায় যাবিরে শালা?আজ তোর হিসাবটা চুকিয়ে দিতেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি এখানে।

সাহেব মোটর বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলো কিন্তু পেছন থেকে আচমকা তার মাথায় পড়লো রডের বারি—-আঃ !আঃ——আঃ করতে করতে—-

মাটিতে ছিটকে পড়লো সাহেব।সঙ্গে সঙ্গে মুখোশ ধারীর দল এলোপাথাড়ি রডের বারিতে সাহেবকে আধমরা করে -ফেলে রেখে পালালো সেখান থেকে।সাহেব গোঙাতে লাগলো,গায়ের জামাটা রক্তে ভিজে গেছে।
বেশকিছুক্ষণ কেটে গেলো এমনি ভাবেই।
হঠাৎ দৃরে একটা গাড়ির লাইটের ছটা দেখা
গেলো ।গাড়িটা কাছে আসতেই দেখা গেল-ওটা একটা লরি ,ড্রাইভার লরি’র আলোতে দেখতে পেল সাহেবকে।
লরি থেকে নেমে সাহেবকে কোলে করে লরিতে তুললো।সোজা হাসপাতালের দিকে ছুটে চললো লরিটা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে—

রাত তখন প্রায় দুটো হবে–সাহেবকে স্যালাইন দিতে না দিতেই হার্টফেল করলো।অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণই যার একমাত্র কারণ।
সাহেবের মোবাইলের কললিস্ট থেকে জনার্দন ওঝার ফোনে হাসপাতাল থেকে ঘটনাটা জানানো হলো।ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই জনার্দন ওঝা ,বড়বাবু নিরঞ্জন সমাদ্দার ও দলীয় কিছু হোমরাচোমরা গোছের যুবক এসে হাজির হলো হাসপাতাল চত্বরে।
ব্যস আর যায় কোথা–শুরু হয়ে গেল সাবেকী চাল অর্থাৎ যেমনটা হয় আরকি? ভাঙচুর,ডাক্তার নার্সদের মারধর,শ্লীলতাহানি ইত্যাদি ইত্যাদি।হাসপাতাল চত্বর একেবারে রণক্ষেত্র হয়ে উঠলো।
যাইহোক নিয়মমাফিক পুলিশি হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রনে এলে–হাসপাতালের ইতিকর্তব্যানুসারে লাস পাঠানো হলো পোস্টমর্টেমের জন্য।সেখানেও দলীয় হোমরা-চোমরাদের দাপাদাপি—শেষমেষ লাশ তুলে দেওয়া হোলো দলীয়সদস্যবৃন্দের হাতে।

পরের দিন সকাল হতে না হতেই সারা নফরগঞ্জ হয়ে উঠলো যেন কুরুক্ষেত্র।বোমাবাজি,মিছিল ,বিরোধীদের ঘরে আগুন ,গ্রেফতার–নফরগঞ্জ শুনশান—বিরোধী দলের একটা লোক নেই –কেউ মারখেয়ে হাসপাতালে ,তো কেউ জেলে,কেউবা আবার প্রাণের ভয়ে গ্রাম ছেড়েছে।

দিনরাত পুলিশি টহল -১৪৪ধারা জারি—–

দুপুর বারোটা নাগাদ বড়বাবু জনার্দন ওঝা কে জানালো-স্যার!কেস্ কিচাইন্!

কি হয়েছে বড়বাবু?অ্যাঁ আরে বলছেন কি ?এতো কাস্টোডিয়াল ডেথ্?
স্যার,আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। প্লিজ্ আপনি একবার থানায় আসুন।

ঠিক আছে আপনি ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করুন আমি এস পি সাহেবের বাঙলো থেকে একটা আলোচনা সেরেই আপনার ওখানে পৌঁছুবো—খেয়াল রাখবেন কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়?
ঠিক আছে স্যার।

এদিকে তিনুমাসি ও বাউরীপাড়ার বেশ কয়েকজন ফেরার।সারা বাউরী পাড়াটা যেন শ্মশানে পরিণত হয়েছে।বাউরী পাড়াতে পুলিশ পিকেট্ বসানো হয়েছে।বাইরে থেকে অচেনা লোক এলাকায় এলেই থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে জেরা করা হচ্ছে।বড়বাবু সেই নিয়েই ঘন্টাতিনেক হলো খুব ব্যস্ত।

হঠাৎ জনার্দন ওঝার ফোন–বড়বাবু ওটাকে বস্তায় ভরে সোজা চলে আসুন ডিহির জঙ্গলে ওখানেই ওটার শেষকৃত্য হবে।

বড়বাবু একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো-বাঁচালেন স্যার!

পরেরদিন প্রতিটি খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে যে ক্যাপশন্ টা নফরগঞ্জ এলাকার মানুষ কে ভাবিয়ে তুলছিল তাহলো—“আসামী ঘনশ্যাম দাশগুপ্ত ফেরার।”
বাউরীপাড়ার ফেরারী আসামীদের খোঁজ চালাচ্ছে পুলিশ।জনার্দন ওঝা সেই খবর জানতেই ফোনে বড়বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো,কি বড়বাবু আসামীদের খোঁজ মিললো?
বড়বাবু উলটে জানতে চাইলো,স্যার ওদের খোঁজকি আদৌ মিলবে?
জনার্দন ওঝা ফোনটা কেটে দিলো।ঘড়িতে তখন রাত ১-৩০মিনিট।
——–সমাপ্ত———

Loading

One thought on “তখন অনেক রাত

Leave A Comment