তফাৎ
-চিন্ময় মহান্তী
শতচ্ছিন্ন নোংরা গেঞ্জি পরিহিত ছেলেটা পরিত্যক্ত বোতল কুড়োচ্ছিল রেল লাইনে। ধীরে ধীরে ভর্তি হচ্ছিল বস্তাটা। হ্যাঁ অবশেষে ভর্তি হলো। তারপর সেটাকে পিঠে ঝুলিয়ে ছেলেটা হাঁটা দিল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
আজ দুদিন হলো রোদের তাপ বেড়েছে , সাথে গরমও। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ছেলেটা আশ্রয় নিল চৌ রাস্তার মোড়ে , বড় বটগাছটার তলায়। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠলো বছর কয়েক আগের দিনগুলো , মা তখনও জীবিত ছিল। স্কুলের বন্ধুদের সাথে স্কুল থেকে ফিরে আসার পথে কতই না দোলনা দোলনা খেলেছে এই বটের ঝুরি ধরে। মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখে জল এলো ছেলেটার। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসতে লাগলো। একটু জল খাওয়ার জন্য সে এগিয়ে গেল সামনের টিউবওয়েলটার দিকে। জল খেয়ে গলাটা ভিজতেই ছেলেটার সম্বিত এলো। সে বস্তাটা পিঠে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল সামনের বাজারের দিকে।বস্তার বোতলগুলো মন্ডলের ভাঙা চুরোর গাদায় ঢেলে দিয়ে কয়েকটা পয়সা নিয়ে এসে সৎমায়ের হাতে দিলে আজ কোনো ঝাঁঝালো টিপ্পনী শুনতে হবে না , অন্ততঃ শান্তিতে দুটো ভাত খেতে পারবে ; এই চিন্তা করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল ছেলেটা।
সামনের দিক থেকে প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন বাজাতে বাজাতে একজন আইসক্রিম বিক্রেতা আসছিল। তাকে দেখে ছেলেটা বলল , ‘ ও আইসক্রিম কাকু একটা সাদা বরফ দাও না , খেতে খেতে যাবো। ‘ আইসক্রিম কাকু বলল , ‘ কেন বাবা একটা আইসক্রিমই নাও না। ‘ ছেলেটা বলল , ‘ না কাকু ! আইসক্রিম কেনার পয়সা নেই যে আমার কাছে। ‘ ছেলেটার ঘর্মাক্ত শীর্ণ মুখটা দেখে আইসক্রিম কাকুর মনে দয়া হলো। সে মনে মনে ভাবলো , ‘ আমার ঘরেও তো এই ছেলেটার বয়সী ছেলে আছে। এ তো আমার ছেলেরই মতো। ‘ বাক্সটি খুলে একটা আইসক্রিম ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল , ” নাও বাবা। পয়সা লাগবে না। ” ছেলেটা আইসক্রিম খেতে শুরু করল। আইসক্রিম কাকু ঢপ করে আওয়াজ করে বাক্সটা বন্ধ করে ছেলেটার মুখের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল , ” বাবা এই বয়সে তোমার তো ইস্কুলে যাওয়ার কথা। এসব কেন করছো ? ”
” মা মারা যাওয়ার পর সৎমা এসে আমার ইস্কুল ছাড়িয়ে দিয়ে বলেছে ,’ লেখাপড়া শিখে কি হবে তার থেকে এখন থেকে দুটো পয়সা সংসারে দিতে পারলে কাজে লাগবে , ” বাবা যে আমার থেকে তাকেই বেশি ভালবাসে- কাকু, আসছি কাকু , দেরি হলে পিঠে লাঠি পড়বে ;” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই ছেলেটা হাঁটতে শুরু করলো। আইসক্রিম কাকু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো , তারপর প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে গেল।
হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটা এসে পৌঁছালো বাজারে । সঞ্জীব সরকারের কাপড়ের দোকানটা পেরোলেই মন্ডলের আড়ৎ । কাপড় দোকানটার সামনে এসেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল। দোকানটাকে নতুন করে সাজিয়েছে সঞ্জীব । গোটা কয়েক পুতুল এনে নতুন পোশাক পরিয়ে দাঁড় করে রেখেছে দোকানের সামনে। ছেলেটা অবাক হয়ে ভাবলো এতোগুলো মানুষ নতুন পোশাক পরে এখানে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন ? কৌতূহল নিয়ে ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে দেখল , মানুষ নয় ঠিক মানুষের মতো দেখতে পুতুল। সে সেগুলি দেখে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলল , ” তোদের কি ভাগ্য বল ,তোরা পুতুল হয়েও দামী দামী নতুন নতুন পোশাক পরে আছিস। আর আমি দেখ মানুষ হয়েও এতো হতভাগা যে একটা গেঞ্জি জুটেছে সেটাও ছেঁড়া ফাটা। ” ছেলেটা যে পুতুলগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তা এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি সঞ্জীব। হঠাৎ ছেলেটাকে দেখে সে দোকানের ভেতর থেকে চিৎকার করে বলল , ”এই ছেলে সর ওখান থেকে । নোংরা হাত দিয়ে ফেলিস নি তো। ” ছেলেটা খানিকটা আপরাধীর ঢঙে বলে , ” না না। ” তারপর হাঁটা দিল মন্ডলের আড়তের দিকে। যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল , ” ভগবান তোমার এই সৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কতো তফাৎ , কেউ কিছু না পেলে আমাকে খেতে দেয় না , কেউ তার ত্রিসীমানা থেকে তাড়িয়ে দেয় আবার কেউ আদর করে তার সামর্থ অনুযায়ী খাওয়ায়। ”
ছেলেটা এসে পৌঁছাল মন্ডলের আড়তে। তাকে দেখে বিধান মন্ডল বলল , ” যা বাবা মালগুলো গাদায় ঢেলে দিয়ে তোর কাকিমার কাছে যা ,দেখ আজ আবার তোর জন্য কি খাবার বানিয়ে রেখেছে কে জানে। ” ছেলেটা বস্তা ফেলে ছুটে মন্ডল কাকুর ঘরে ঢুকে ডাক দিল , ” কাকিমা ও কাকিমা। ” নিঃসন্তান মন্ডল কাকিমা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল , ” আহারে বাছার মুখটা খিদেয় একেবারে চুপসে গেছে। দাঁড়া আমি খাবার নিয়ে আসি। ” কাকিমা চটপট রান্না ঘরের দিকে দৌঁড়াল । ছেলেটা মনে মনে ভাবল , ” মন্ডল কাকিমা আর আমার সৎ মায়ের মধ্যে কতো তফাৎ। দুজনেই তো মহিলা। কেউ দেবী অন্নপূর্ণা আর কেউ ….।” ছেলেটার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই কাকিমা ফিরে এসে বলল , ” দেখিতো বাবা হা কর , খাইয়ে দি। ” ছেলেটা খেতে খেতে কাকিমার মুখের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকল যেন সাক্ষ্যাত দেবী মাকে দেখছে।