ফিরে পেতে চাই

ফিরে পেতে চাই
-চিন্ময় মহান্তী

 

প্রিয় বন্ধু প্রসেনজিৎ ,
প্রিয় বললে হয়তো অনেকটাই কম বলা হবে তাই প্রিয় শব্দের সঙ্গে সু যোগ করে বলি সুপ্রিয় বন্ধু। আমি যখন ডায়রি খুলে তোর আর আমার ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মৃতির চিলেকোঠা হতে তুলে লিখতে শুরু করলাম তখন অনেক রাত্রি , বাইরে নিম্নচাপের বৃষ্টি অনবরত টিপটিপ করে ঝরে সবে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে অবিরাম অনর্গল। আমি বসে রয়েছি বেলকনিতে। আমার সামনের মোমবাতির শিখাটা হালকা বাতাসে বারে বারে দুলে উঠছে। আমি লিখে চলেছি সুপ্রিয় বন্ধু তোর সাথে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিকথা।
আচ্ছা প্রসেনজিৎ , তোর কি মনে পড়ে সেই -সেই—– দিনগুলোর কথা! আমার কিন্তু ভীষণ মনে পড়ে —জানিস , বয়সের মধ্যাহ্নে এসে মনের কোনে উঁকি দেয় –স্কুল থেকে বাড়ি না ফিরে সোজা সিনেমা হলে ঢুঁ মারা ,
তারপর বাড়ি ফিরে একটা মিথ্যের জন্য হাজার মিথ্যে বলার দিন। বকুনি ছিল – তাহলেও মন্দ ছিল না । নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা ছিল না। এটা নেই ওটা নেই -এই আনতে হবে সেই আনতে হবে , এটা ছিল না। সর্বোপরি কোনো দায়িত্বই ছিল না। শুধু একটাই দায়িত্ব ছিল দুজন একসাথে খেলা -ঘোরা আর ঘোরা। যখন দিন শেষে রাত্রি নামতো তখন বিষন্নতা এসে জড়িয়ে ধরতো আমায়। সকাল হওয়ার অপেক্ষায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম টেরও পেতাম না। যদিও কোনো মানুষই তার ঘুম আরম্ভের সঠিক সময় টের পায় না। সকাল হলেই শুরু হয়ে যেতো নিত্যদিনের রুটিন।
জানিস বন্ধু, আমার অাবাসনের পিছন দিকটায় একটা বড় পুকুর আছে। একবার ছিপ বানিয়েছিলাম মাছ ধরবো বলে তারপর একদিন গিয়েওছিলাম মাছ ধরতে কিন্তু ফিরে এসেছিলাম একটা মাছও না ধরে। তোর মনে এখন যে প্রশ্নটা জাগবে সেটার নিরসন আমি করি বন্ধু, পুকুরের পাড়ে বসে আমার মন কেবলই উদাসী হয়়েছে, বারবার সেই ছোটোবেলায় পাশাপাশি দুজনে বসে ছিপ ফেলার দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ; ছিপের চুঁঁইটা দেখতে পাইনি। তারপর আর ওপথ মাড়াই নি কোনো দিন।
স্কুলের পর দুজনের পথ দুটো যেদিন আলাদা হয়ে গেল সেদিন আমার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো। তুই ভর্তি হলি আলাদা কলেজে আর আমিও আলাদা। আমি ভাবলাম বুঝি আমাদের সম্পর্কে ইতি পড়ল। কিন্তু না , কলেজ থেকে ফিরে প্রথম সন্ধ্যায় যেদিন তুই আমার বাড়ি এলি সেদিন বুকটা আনন্দে ভরে গেল। তারপর সেটা হয়ে গেল প্রাত্যহিক। প্রতি সন্ধ্যায় তোর সঙ্গে দু’দন্ড কথা বলে মিটিয়ে নিতাম মনের খিদে। জানিস বন্ধু, আজও আমার আবাসনে প্রতি সন্ধ্যায় দু’চারজন প্রাত্যহিকীর সাথে গল্পে মেতে উঠি কিন্তু সেদিনটা খুঁজে পাই না ; কোথায় যেন একটা প্রাণের অভাব রয়ে যায় , কই সেদিন তো তোর আর আমার মধ্যে এমনটা ছিলনা বন্ধু।
বয়স বাড়তে লাগলো, বেকারত্ব এসে আমাকে গ্রাস করতে শুরু করলো। একটা কাজের খোঁজে চলে এলাম কোলকাতায়। কাজও জুটলো একটা কোম্পানীতে। কাজের মাঝে ডুবিয়ে দিলাম নিজেকে। কাজ শেষে যখন প্রতি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম তখন বারবার মনে পড়তে লাগলো তোর মুখ। তুই তখন গ্রামের স্কুলে কর্মব্যস্ত। বাঁধনটা কেমন যেন ঢিলে হতে শুরু করল। আমি থাকতে পারলাম না কোলকাতায় , গ্রামে ফিরে গেলাম। চারিদিকে কর্মব্যস্ত মানুষ আর আমি বেকার হয়ে ঘুরতে লাগলাম। তুইও তোর সময় মতো স্কুলে ব্যস্ত । আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখলাম। শুরু করলাম ব্যাবসা । একটা ছোটো দোকান খুলে বসলাম। শুভাকাঙ্খীরা প্রায়ই বলতে লাগলেন , ” তোর এসব মানায় না। একটা সরকারী চাকরির চেষ্টা কর। ” আমার তখন মনে হতো তাদের কে বলে দি , ” সরকারী চাকরি কি হাতের মোয়া ! ” কিন্তু পারতাম না। তুই যখন স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি আসতিস তখন সেসব ভুলে যেতাম এক নিমেষে। তারপর অনেক রাত অব্দি চলতো দুজনের খোশ গল্প।
একদিন ঈশ্বর সহায় হলেন , আমার একটা চাকরি জুটে গেল। আমি তল্পি তল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। বন্ধুত্বের রংটা ক্রমে ফ্যাকাশে হতে শুরু করলো। তুই রয়ে গেলি গ্রামে। তারপর বাকিটা একটা বিরাট শূন্যস্থান।
জানিস বন্ধু , আজ তোর ফোন পেয়ে আমার মনটা বর্ষায় ময়ূরের মতো আনন্দে নেচে উঠলো। বারবার ইচ্ছে করছে তোকে কাছে পেতে , তোকে পাশে পেতে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে তোর পাশে বসে এক থালায় ভাত খেতে। ছোটোবেলার দিনগুলো ফিরে পেতে। পড়ার মাঝে ফাঁকি দিতে। ক্লাস কেটে সিনেমা দেখতে। আর প্রতিদিন বাড়িতে জয়পন্ডা নদীর ব্রীজ উদ্বোধনের অনুষ্ঠান দেখে ফিরতে দেরি হওয়ার মিথ্যে অজুহাত দিয়ে সিনেমা দেখার গল্প গোপন করতে। ফিরে পেতে চাই বন্ধু -ফিরে পেতে চাই সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে। কিন্তু সামনে আজ দাঁড়িয়ে চাহিদার বীভৎস নখর থাবা , যে মধ্যেখানে এঁকে দিয়েছে- সীমারেখা।

Loading

One thought on “ফিরে পেতে চাই

Leave A Comment