নিয়তি

নিয়তি
-মৌসুমী সাহা মহালানাবীশ

 

 

খোকন!
বের হচ্ছিস বাবা?
একটু সময় দিতে পারবি ? দুটো কথা আছে—-
উফফ মা—
সেই পেছনে ডাকলে,তাড়াতাড়ি বলো দেরি হচ্ছে—
একটু বিষ এনে দিতে পারবি বাবা!
ভালো করে ঘুমোতাম—–
তোর বাবা থাকাকালীন হাসি মুখে বলতাম, আমার খোকন সোনার টুকরো, চাঁদটাও আমাকে এনে দিতে পারে।আজ কি পারবি না বাবা!
একটু বিষ এনে দিতে_____!!

উফফ তোমার বকবকানি গুলো এবার থামাও। আবার শুরু করলে। দেখো মা তোমার ভাঙ্গা রেকর্ড আর বাজিও না। অনিতা বলে শুধু এখনও তোমাকে দুটো খেতে দিচ্ছে।সারাটা দিন কি করো ?
হরির মালা না জপে ওর হাতে হাতে তো একটু কাজ করতে পারো। তাহলে তো আর এতো অশান্তি হয় না।আর ওতো ঠিকই বলেছে,বৃদ্ধাশ্রম কি খারাপ জায়গা নাকি——-
নাকি তুমি একাই ওখানে থাকবে!
তোমার মতো কতো মানুষ ওখানে থাকে।তোমার ওখানে মন বসবে,অনেক বান্ধবী জুটে যাবে তোমার।আর এমনিতেও তো এতো বড়ো ঘর তোমার এখন লাগে না,যখন বাবা ছিল সে আলাদা কথা কিন্তু এখন——
নারে খোকন,ঘরের লোভী নই আমি!
যখন বিয়ে হয়েছিল এই ঘরে বসে তোর বাবা বলেছিল–হাজার কষ্ট এলেও আমরা হাসি মুখে লড়াই করবো কিন্তু সুলেখা তবু এই ঘর ছেড়ে কোনোদিনও যেওনা,জানি জীবনের নিয়মে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে সেটা পরের কথা,,,,,,,,!
থাক মা তোমার ওই প্যানপ্যানানি কথা অনেক বার শুনেছি। ছাড়ো! থাকো বাবার কথা নিয়ে আমি চললাম।
খোকন দাঁড়া—–
আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছি তুই কখন নিয়ে যাবি বাবা ?
কোথায় ?
কেন বাবা বৃদ্ধাশ্রমে——-
ও শেষমেশ তুমি রাজি হলে!
ছেলের কথায় সুলেখা আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি, সবকিছু যেন ঝাপসা হতে লাগছে।সত্যি খোকন আজ মানুষ হয়েছে।অনেক বড়ো হয়েছে।কাঁদতে কাঁদতে সুলেখা উত্তর দিলো———-
সন্তানের জন্য এতো বছর যখন নিজের স্বপ্ন, অস্তিত্ব সব ত্যাগ করতে পেরেছি, বাবা তখন এটাও পারব।
তাহলে চলো, অফিসে যাবার পথেই কাজটা সেরে নিই।এমনিতেই ওনাদের সাথে আমার কালই সব কথা হয়ে গিয়েছিল, খুব একটা অসুবিধা হবে না তোমার।জাস্ট কিছু নিয়ম আছে আরকি,,,,,,,,ওকে, এগুলো আমিই দেখে নেবো।
এখনি যাবি বাবা———
হ্যাঁ কেনো——
দাঁড়া হাওয়াই চটির ফিতেটা বড্ড পুরোনো বার বার খুলে যায়,একটু সুতো দিয়ে বেঁধে নিই।
যা করার তাড়াতাড়ি করো।
পাশের ঘর থেকে বৌমাকে একবার ডাকবি বাবা চলেই তো যাচ্ছি!!
একবার মা লক্ষ্মীর মুখটা শেষ বারের মতো দেখে যাই,,,,,,,,,,,,,,,
অনিতা একবার এসোনা প্লিজ—-
কিছুক্ষণ পরে অনিতা——
কি হয়েছে ডাকছো কেনো—–?
তাড়াতাড়ি বলো,কথা বলছিলাম নিশা লাইনে আছে।
বৌমা আসলে আমি ডেকেছি!
আপনার আবার কি হলো——-?
তেমন কিছু না মা।আমি চলে যাচ্ছি। খোকন আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে কাজে যাবে। তুমি খেয়ে নিও মা আর হ্যাঁ কাতলা মাছটা ভাজার সময় একটু তেল ছিটে ছিল হাতে ,তাই সামলাতে না পেরে মাছটা কড়া ভাজা হয়ে গেছে খোকাবাবুকে ওটা দিওনা। আমি ওর জন্য চাকা চাকা বেগুন ভেজে রেখেছি,যেমনটা ও ভালো খায়। ওকে ওটাই দিও। তুমি এবার যাও মা,খুব ভালো থেকো, সুখে শান্তিতে থেকো।

একটা ব্যাগ হবে মা! নাহলে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট দিতে পারো, আসলে আমার ব্যাগটা বড্ড পুরোনো তো মা, আর চেনটাও ছেঁড়া।
দাঁড়ান দেখছি——–
কিছুক্ষণের মধ্যে অনিতা একটা ব্যাগ নিয়ে এসে উপস্থিত।
দাঁড়ান আপনার ব্যাগটা দিন দেখি। না বৌমা তেমন কিছু নেইকো।
আপনার কি দিতে অসুবিধা আছে?
না না মা,কিসের অসুবিধা!! নাও তুমি।
অনিতা ব্যাগের ভেতর থেকে সব গোছানো জিনিসগুলো নামেতেই বলে উঠলো, কি এসব আজেবাজে জিনিস নিয়েছেন। আপনার ছেলের মান সম্মান নষ্ট করবেন নাকি?
বাবার ছবি নাহয় ঠিক আছে,তবে আপনার নাতির ছবি নিতে গেলেন কেন? আর আমাকে কি একবারও জিজ্ঞেস করেছেন নেওয়ার আগে? এইসব বাটি, ঝিনুক,থালা, টাওয়েল।আপনি কি পাগল নাকি?
না মা তুমি ভুল বুঝেছো। সুলেখা জলভরা চোখে ঝিনুক বাটিতে হাত বুলাতে বুলাতে কাঁপা স্বরে বলে উঠলো, আমার খোকনের ছোটো বেলার ঝিনুক বাটি মা।জানো! খোকন একদম খেতে চাইতো না, আমি আর আমার শাশুড়ি মা চেপে ধরে খাওয়াতাম।আর এই টাওয়েলে আজও আমার খোকনের গায়ের গন্ধ পাই, আ আ হা! সেই ছোট্ট খোকন আমার।
জানো বৌমা! এই থালাতে আমার খোকন প্রথম কাঁপা কাঁপা হাতে ভাত খেয়েছিল। সেকি খাওয়ার ভঙ্গি, চারিদিকে ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলেছিলো আর সামান্য ভাত ওই কচি হাতে মুখে তুলেছিলো। তাই দেখে আমি আর আমার শাশুড়ি মা খুব হেসে ছিলাম। তবে আজ কেনো আবার খুব হাসি পাচ্ছে জানি না! অনেক স্বপ্ন ছিল,মা বলতো তুই যেমনটা করে আমার যত্ন করিস তোর খোকনের বউও তোকে তেমন ,,,,,,,,,,,
সবকিছুই নিয়তির লেখা খন্ডাবে কার সাধ্য!!!!
সত্যিই বৌমা আজ মায়ের কথা গুলো বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে।
সুলেখা অশ্রুভরা নয়নে বললে—–আসছি মা!
তোমার সংসার পরিপূর্ণ থাকুক। খোকাবাবুকে দেখে রেখো। একটা কথা বলি মা,যখন বাপের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে এই বাড়িতে এলাম বুকটা যেমন ফেটেছিলো আজ ছেলের বাড়ি ছেড়ে,,,,,
আর বলতে পারলোনা সুলেখা কথা গুলো যেন বুকের হাহাকারে চোখের প্লাবনতায় ভেসে গেল।
চল খোকন,গাড়িতে উঠতেই পাশের ক্লাবে রক্ত দান শিবির হতে ভেসে আসছে—
“আমার দিন ফুরালো ব্যাকুলও বাদলো সাঁঝে …আমার দিন ফুরালো…”
কাঁদতে কাঁদতে খোকাবাবু দৌড়ে এসে,,,,ঠাম্মি কোথায় যাচ্ছো? আমাকে নেবেনা ?
দালাও নুতুন জামা পলে আসি।
না খোকাবাবু—–
আজ তোমাকে নিতে পারবোনা সোনা।আমি অনেক বড়ো হয়েছিতো তাই একাই যেতে হবে।তুমি বড্ড ছোট খোকাবাবু। তুমি পড়াশোনা করে মস্ত বড়ো হও। মানুষের মতন মানুষ হও। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তোমার যেন ওখানে কোনোদিনও না যেতে হয়। তুমি ভালো থেকো।
দালাও ঠাম্মি  “আমি যখন বলো হবো,তখন আমাল মাও অনেক বলো হবে তখন আমিও আমাল মাকে ওখানে পাঠাবো”——-

Loading

2 thoughts on “নিয়তি

Leave A Comment