সান্ধ্য বৃষ্টি
-অমল দাস
একটা তীব্র ঝড়ের পর মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । অহনা দোতলার বারন্দায় একটি চেয়ারে বসে আছে। হাওয়ার ঝাপটায় সে ভিজে প্রায় সিক্ত হয়ে উঠেছে । যদিও সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে তো আজ নিজের শরীরকে বৃষ্টির হাতে সমর্পিত করে দিয়েছে। বৃষ্টির আদুরে ছোঁয়ায় এক অশরীরী স্পর্শের অনুভূতিতে মগ্ন হয়ে উঠছে। তার অন্তরের আত্মা যেন এই সন্ধ্যায় “ ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা……”-র সুরে মেতে উঠেছে।
এই ভাবের ঘোরে স্মৃতির চাদর উন্মুখ করে ধীরে ধীরে হারিয়ে চলেছে তার নস্টালজিক শৈশব কালে। এই বৃষ্টিতেই বিনা বাধায় সে কত ভিজেছে ! বৃষ্টিতে ভিজেই কত আম কুড়িয়ে এনেছে, কত গাছে চড়ে সে আম চুরিও করেছে। বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছে। সারাদিন খেলায় মত্ত ছিল, গাছে উঠতেও সে ছেলেদের পিছনে ফেলেছিল। রাস্তায় গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতেও যথেষ্ট পটু ছিল। আর এই সকল গুণের জন্যেই অহনা পাড়ায় দস্যি মেয়ে হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিল।
এখনও তার ইচ্ছা হয় এই কংক্রিটের দেওয়াল ফেলে ছুটে বাইরে চলে যেতে। রাস্তায় কোন গাড়ির গতি ধরে তুফান বেগে নিজের শক্তিকে যাচাই করতে । তার ইচ্ছে হয় কোন আমাবাগানে গিয়ে গাছে উঠে আম পাড়তে। এখনও ইচ্ছে হয় বৃষ্টিতে ভিজতে, কাদা মাটিতে নাচতে বা শৈশবের সেই নারী সুলভ খেলাগুলি আবার খেলতে শিশুদের সাথে ওদেরই মতন করে। তার ভাবনার গহ্বরে উৎফুল্লতার বা উদ্দীপনার বিন্দুমাত্র অভাব নেই সান্ধ্যঘন মুহূর্তে।
কিন্তু তার সেই ইচ্ছা শক্তিকে আজ সিন্দুকে বন্দী করা ছাড়া কোন উপায় নেই। ঠিক যেমন উপায় নেই সমুদ্রের সমস্ত জলকে একটি পাত্রে সঞ্চয় করার। যেমন উপায় নেই সমস্ত আকাশকে মেঘমুক্ত করার। কারন অহনা আর সেই শৈশবে নেই , আর সেই দস্যি মেয়েও নেই । অহনার এই পরিবর্তনে অতি পরিচিতরাও অবাক হয়ে যান। অহনা এক শান্ত স্বভাবের দক্ষ গৃহিণী হয়ে উঠছে, তার স্বামী আছে সন্তান আছে। শাশুড়ি বিমলাদেবী যথেষ্ট ভালো মানুষ ছিলেন, নিজের মেয়ের মত স্নেহ করতেন। গত দু বছর আগেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। সেই থেকেই কেমন যেন একা হয়ে উঠেছে অহনা। স্বামী অনিরুদ্ধর ব্যস্ত জীবন এক দূরত্ব তৈরি করেছে, অফিস-বাড়ির রোজনামচায় আত্মিক আত্মীয়তা দুর্বল হয়ে উঠেছে , ঠিক যেন বৃষ্টির জল পেয়ে উঁই পোকার বাসার মতন ধীরে ধীরে ধুয়ে যাচ্ছে। বছর সাতেকের কন্যা চৈতালি পড়াশুনায় বেশ ভালো। তাকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা, পড়াতে নিয়ে যাওয়া, স্বামীর যত্ন নেওয়া এই সবের মধ্যে যেন অহনা তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে, হারিয়ে ফেলেছে তার সব স্বপ্ন, হারিয়েছে তার রূপলাবণ্য, যা ঔজ্বল্য হারিয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যের মত স্তিমিত হয়ে চলেছে মিথ্যে ব্যস্ততার অন্তরালে।
কলেজে পড়ার সময় অহনা রাজ্যের সমস্ত কলেজ দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম স্থান লাভ করেছিল। সকলকে খুশির খবর দেবে, এমন সময় বাড়ি পৌঁছতেই অহনার সব আশা-আকাঙ্ক্ষায় অকাল বাজ পড়ে যায় । বাড়িতে তখন পাত্র পক্ষ বসে কন্যা দেখার জন্য। আর সেই দর্শনেই যেন মোক্ষ লাভ করে আজ অহনা সরকারি কর্মী অনিরুদ্ধ চৌধুরীর স্ত্রী। অহনার তরফ থেকে বাবা মাকে বোঝানোর শত চেষ্টা বিফল হয়। কারণ এই বাজারে সরকারি চাকরির পাত্র মেলাও তো দুষ্কর। এই সকল পাত্র ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য হয় কন্যার বাবার কাছে । সেই অলিখিত ঈশ্বরীয় আদেশ লঙ্ঘনের অহেতুক সাহস কেনই বা দেখাবেন তারা। আর যেখানে পাত্রপক্ষ অহনাকে পছন্দ করেছে সেখানে তো তাদের আর না করা যায় না। অভুক্ত কি সাধা ভাত ফেলে দিতে পারে?
অনিরুদ্ধ অহনার থেকে বয়সে পনেরো বছরের বড়, যা অহনা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না, তবু তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়, জীবন পথে যত দিন আছো বোঝা কাঁধে নিয়েই চলতে হবে। এইসব কর্মকাণ্ড ঠিক তখন হয়, যখন তার মননে শয়নে স্বপনে বসে আছে ভুলতে না পারা তার সিদ্ধ পুরুষটি । কলেজেই আলাপ প্রদ্যুতের সঙ্গে , বেশ ভালো ছেলে , পড়াশুনায়ও বেশ। দুজন দুজনার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। একে অপরকে না দেখে একটা দিন ভালো করে কাটাতে পারেনি। ওরা পরস্পরের আরাধ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কেউ কাউকে বলে উঠতে পারেনি “আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্নে ভাসি”। অথচ আত্মিক সংযোগ ছিল দূরদূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। অহনার জীবনে হঠাৎ কালো ঘন মেঘ নিয়ে দাপিয়ে আসা কালবৈশাখীর প্রলয়ে তুচ্ছ পাতার মত সব উড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
ভালোই হয়েছে কেউ কাউকে কথা দেয়নি , না হলে ওই দুর্দিনে অহনা কাকে বেছে নিত ? পরিবার, প্রদ্যুত না কি নতুন আগন্তুককে ? তাকে তো সম্পর্ক সঙ্কটে পড়তে হত ! কিন্তু তাই বলে প্রদ্যুতকে কি মুছে ফেলা যাবে, না কি ওকে নিয়ে দেখা রাত জাগা স্বপ্ন গুলো তারাদের সাথে আকাশে মিলিয়ে যাবে ? প্রদ্যুত সেই পুরুষ যে অহনার মনে ফাগুনের উষ্ণ দীপ জ্বেলেছিল ,যে অহনা কে বয়ে চলা বাতাস ছুঁয়ে প্রকৃতির সুরে গাইতে শিখিয়েছিল। তারা কোন এক বৃষ্টি দিনে একে অপরের হাত ধরে কলেজ ক্যাম্পাসে আমগাছের তলে আশ্রয় নিয়ে গভীর ভাবে ভিজে ছিল অন্তরে বাহিরে। ডুবে গিয়েছিল একে অন্যের দৃষ্টি সমুদ্রে। আজ এই সান্ধ্য বৃষ্টির পরশে প্রদ্যুত সদ্য অঙ্কুরোদগম সবুজের মত গভীর ভাবে জেগে উঠেছে অহনার হৃদয়ের অলিন্দে।
কয়েক দিন আগেই প্রদ্যুতের সাথে ফেসবুকে আলাপ হয় অহনার । তারপর ফোনে কথাবার্তা । একবার দেখাও করেছিল চৈতালির স্কুলের বাইরে। সে কোন এক ব্যাঙ্কে চাকরি করছে , এখনও বিয়ে করেনি, মেয়ে দেখছে পরিবার থেকে। কিন্তু পছন্দ বা ইচ্ছা … ? হয়ত অন্তরে যে মন্দির আছে সেখানে অন্য কেউ দখলদারী নিয়ে আছে আজও। প্রদ্যুত না বললেও তা অহনার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, সেই হৃদ মন্দিরে এখনো অহনা নামে শঙ্খ ধ্বনি বাজে।
অহনার হাত ধরা মাত্র এক অজানা উন্মাদনার চোরা স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে একে অপরের আপাদমস্তক । শিহরণ জেগে উঠে রক্তের কানায় কানায় । চোখে চোখ রেখে প্রদ্যুত জানতে চেয়েছিল –“ অহনা আগামীটা কি আমাদের হতে পারে না ”?
এই ছোট্ট একটি প্রশ্ন দিয়েই প্রদ্যুত তার সমস্ত আবেগ, দীর্ঘদিন জমে থাকা যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। সে এখনো অহনাকে আশা করে, এখনো সে অহনার সমস্ত দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। হয়তো সেই অভিলাষেই এই বিশাল জনসমুদ্রে তার তরীতে সে একা। কিন্তু অহনা ! অহনা কি চায়…..! না অহনা কোন উত্তর দিতে পারেনি সেদিন। সে নির্বাক পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে, চতুর্দিক যেন অন্ধকার স্তব্ধ হয়ে আসে। মাথা নত করে কোন ভাবনায় সে হারিয়ে গিয়েছিল একমাত্র সেই জানে। সে হয়ত প্রদ্যুতের বন্ধুত্ব গভীর ভাবে কামনা করেছিল তার বদলে যাওয়া জীবনে। প্রদ্যুতের সাথে সে হয়তো একমত হতে পারেনি বা অন্য কিছু। সে মাথা তুলে সজল চোখে তার পানে একটি বার চেয়ে নিঃশব্দে চলে আসে। ফেলে আসে সেই নীরবতায় হাজারো প্রশ্নের উত্তর যা অহনার মুখমণ্ডলে খুঁজে পেয়েছিল প্রদ্যুত।
“আজ প্রদ্যুতের বিয়ে এখানে বৃষ্টি হচ্ছে ওখানেও কি হচ্ছে…? আমার প্রতিটি রক্ত কণায় ছড়িয়ে পড়েছে আজ, আমায় কি ও মনে করছে এই শুভ দিনে…! ওকি সেদিন রাগ করেছিল ? তারপর তো বিশেষ কথা বলেনি শুধু বিয়ের খবরটাই দিয়েছিল। আমি তো ভালবেসেছিলাম, এখনো আমার স্বপ্নে আসে , কিন্তু আমি তো প্রতারক নই! সেটা তো ওর বোঝা উচিৎ ছিল…! সেদিনও আমি পরিবারের সাথে প্রতারণা করতে পারিনি যেদিন আমার ইচ্ছাকে বলি দেওয়া হয়েছিল, এখনো বা আমি স্বামী সন্তানের সাথে প্রতারণা করি কীভাবে..? অনিরুদ্ধকে আমি যথেষ্ট অবহেলা করেছি শুরুর দিনগুলিতে। কিন্তু কখন রা- শব্দটি করেনি আমার বিরুদ্ধে, বরং অধিক প্রেম নিবেদনের চেষ্টা করেছে, অধিক যত্নও সে নিয়েছে। অনিরুদ্ধ যথেষ্ট শান্ত এবং ভদ্র স্বভাবের মানুষ। বয়স ছাড়া তো ওর প্রতি আমার আর কোন অভাব নেই অভিযোগ নেই। মানুষটা তো আমায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। তাকে আমি কি করে দুঃখী করি…..!, কীভাবে ছোট্ট ফুলের মত মেয়ের জীবন অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দি…..! না সেটা সম্ভব নয়…এই অসম্ভব প্রদ্যুতও বোঝার চেষ্টা করেনি সে তার মতই ভেবেছে যা আমি ভাবিনি! আমি আমার বর্তমানেই থাকি। প্রদ্যুত তুমি ভালো থেকো…..! পারলে আমায় মুছে দিও…..”। দোতলার বারান্দায় নিজ মনে এই ভাবনাতেই সে মগ্ন ছিল।
বৃষ্টি কিছুটা থেমেছে, অফিস থেকে ফেরার পথে অনিরুদ্ধ ছোট্ট চৈতালিকে শিক্ষকের বাড়ি থেকে নিয়ে ফেরে। দরজায় দাঁড়িয়ে চৈতালির শিশু কণ্ঠে চীৎকার- “মা তাড়াতাড়ি দরজা খোলো বাপি আমি ভিজে যাচ্ছি……তাড়াতাড়ি……..”।
ওই শিশু কণ্ঠ দোতলায় অহনার কানে গিয়ে পৌঁছল না। সে দখিণা বাতাসে বৃষ্টির পরশে প্রকৃতির কোলে আত্মনিমগ্ন হয়ে বসে আছে নিরালায়। বিদ্যুতের ঝলকে অস্পষ্ট অনুজ্জ্বল মুখচ্ছবিটা ধরা পড়ছে বারবার। অনিরুদ্ধ কলিং বেল বাজাতেই অহনার সম্বিৎ ফেরে, সে নিচে এসে দরজা খুলে দিতে অনিরুদ্ধ চৈতালি ঘরে প্রবেশ করে, দুজনেই ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। অহনাকে অগোছালো আলুথালু দেখে অনিরুদ্ধর প্রশ্ন– তোমার এ অবস্থা কেন ?কি হয়েছে ? অহনা ঠোঁট চেপে একটা ঈষৎ হাসি দিল কোন উত্তর দিল না, যা উত্তর দিতে চাইল তা হয়তো সে পেল তাই অনিরুদ্ধও আর কিছু না বলে নিজের ভিজে পোশাক বদলাতে লাগে।
কিন্তু কৌতূহলী চৈতালি! মাকে অর্ধ সিক্ত দেখেই জানার ইচ্ছা- ও মা আমাদের বাড়িতে জল পড়ছে ? তুমি ভিজে গেলে কেন ? আমরা তো জলে ভি..জে..ছি! নিচু হয়ে অহনা মেয়ের গালে একটি চুমু দিয়ে বলল- আমার সোনা মা তার বাপি ভিজে আসবে তো তাই আমিও একটু ভিজে নিলাম ।
– তা…ই হয় না কি..? চৈতালির অবিশ্বাসী প্রশ্ন।
এ কথা অনিরুদ্ধর কানে পৌঁছাতেই হাত মুঠো করে মুখের কাছে নিয়ে একটা ব্যর্থ কাশির চেষ্টা করল । অহনা অনিরুদ্ধর চোখাচুখিতে দুজনের মুখমণ্ডলেই মুচকি হাসি ধরা দিল।