এক বাবার প্রতীক্ষা

এক বাবার প্রতীক্ষা

-মৌসুমী সাহা মহালানাবীশ

অনিমেষ বাবু ফোনটা হাতে তুলতেই——
তুমি আবার ফোন করবে রিঙ্কুকে,,,?
এইতো সকালবেলায় দেখলাম কতক্ষন বাপ-মেয়েতে গল্প করলে, সবেতো ছয়মাস হয়েছে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে তাতেই যদি এতো অস্থিরতা তবে বাকি দিন গুলো কাটাবে কি করে,,?

তুমি এতো কথা বলো কেনো,,,? আমি কি তোমার রিঙ্কুকে ফোন করছি নাকি! যখনই ফোন ধরবো তোমার সেই একই কথা——

অনিমেষ বাবু তাড়াতাড়ি করে তার মোবাইল স্ক্রিনে ওঠা মেয়ের নাম্বারটা ডিলিট করে দিলো।

দ্যাখো তোমায় একটা কথা বলি,ত্রিশ বছর হতে যাচ্ছে আমি তোমার সঙ্গে সংসার করছি এটুকু যদি না বুঝি তবে তোমাকে আর চিনলাম কি! আমাকে ওসব বোঝাতে এসোনা।

অনিমেষ বাবু রাগ করে টেবিল থেকে উঠে গেল।

মিনিট দশেক পর বেলা বেডরুমে গিয়ে টেবিলের ওপর ফেলে আসা ফোনটা দিয়ে বললেন, নাও কল করে মেয়ের সাথে কথা বলে নাও।তোমায় বকাঝকা করেছি জানলে শেষে রিঙ্কুও আমার ওপর রাগ করবে।
অনিমেষ বাবু ফোনটা নিয়ে বিছানার ওপারেই রেখে দিলেন—-

এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে চলেছে,পাখিদের বাসায় ফেরার তাগিদে নীল গগনের বুকে ডানা মেলে ভেসে বেড়ানো এদিক থেকে ওদিকে,পশ্চিমে সূর্যাস্ত,আষাঢ়ের আকাশে রক্তিম আভা,যারা মাঠে ফুটবল খেলছিল তারাও খেলা গুটিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে।দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে যেন অনিমেষ বাবু সবকিছুই এতক্ষণে লক্ষ্য করছিলেন।বুঝলেন এ জগৎ সংসারে সবকিছুই নিয়মে বাঁধা।
এমন সময় বেলা অনিমেষ বাবুর হাতটা ধরে পাশে বসতেই অনিমেষ বাবু বলে উঠলেন–তুমি ঠিকই বলেছো বেলা,মেয়ে তো সবে মাত্র শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে।ওর কতো দায়িত্ব,কর্তব্য,কতো সম্পর্কের বাঁধন। আমিই বারে বারে ভুল করি।আসলে আজ বিকেলেই তো মামনির আসার কথা ছিল। কিন্তু সকালেই বললো রজত অফিস ছুটি পায়নি আর এমনিতেও গতকাল রাতে ওর ননদ রিয়া এসেছে তাই আসতে পারবে না।জানো তো ওর প্রিয় ইলিশ মাছ,পনির সবই নিয়ে এসে ছিলাম। তুমিও তাড়াতাড়ি করে ওর প্রিয় খাবার গুলো রান্না করলে কিন্তু কি জানো কোনো খাবার আমার গলা দিয়ে নামতো না তাই খাইনি।

আচ্ছা এইরকম করলে কি করে হবে বলতো! রিঙ্কু আমাদের একমাত্র সন্তান। ছোট্ট থেকেই ওর সব আবদার তোমাকে ঘিরেই। তুমি ভালো থাকলে মেয়েটাও ভালো থাকে। সব জেনে বুঝে তুমি এমন করলে ও কি করে মন দিয়ে ওর ঘর-সংসার করবে বলো। কোথায় তুমি ওকে সাহায্য করবে তা না করে….

আসলে এটাই হয়তো আমার বেশি দূর্বলতা যে মামনি আমার একমাত্র সন্তান—
এভাবে বলছো কেনো,,,?

বেলা একবার তুমি ফোন করে বলোনা দেখোনা কাল আসে কিনা তোমার মেয়ে!!
বলবে বেলা,,,?
এতো ঘনঘন কি করে আসতে বলি বলো,ওতো গত মাসেই এসে ঘুরে গেল। সবে বিয়ে হয়েছে এতো ঘনঘন বাপের বাড়ি আসাটাও যে ঠিক দেখায় না। তারপর শাশুড়ি, শ্বশুর,ননদ,ওর বড়ো জা সবাই কি ভাববে বলতো!!

হ্যাঁ তাইতো,আমার মামনির তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে।এটাতো ওর বাপের বাড়ি। আমার সেই ছোট্ট মেয়েটা যে কখন এতো বড়ো হয়ে গেলো…
মনে হয় যেন এই দুদিন আগেই তোমার সেই পূজা দেবার লাল পেরে শাড়িটা পরে ,গামছা মাথায় পেঁচিয়ে চুল বানিয়ে বলতো ”বাবা দ্যাখো তো আমায় নতুন বউ লাগছে কিনা,,,?”
অফিস থেকে ফিরলেই আমার সাইকেলের আওয়াজ পেয়ে হই হই করে ছুটে এসে ছোটো ছোটো হাতে গেট ধরে নাড়াতে নাড়াতে বলতো তাড়াতাড়ি দরজা খোলো বাবা এসেছে,কোনো খেলনা ভেঙে গেলেই–”মা রাখো তো বাবা ঠিক করে দেবে” হাত দুটোকে ওপরে তুলে দিয়ে বলতো”আমার বাবা সুপারম্যান” , খিলখিলিয়ে সেকি হাসি,মনে আছে বেলা!
মামনি একদম ওষুধ খেতে চাইতো না,একবার সে কি জ্বর হলো ওর কিছুতেই কমছিলনা আর জোর করে তুমি, আমি আর মা মিলে চেপে ধরে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে ওর ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল তাই দেখে ওকে বুকে নিয়ে আমি খুব কেঁদে ছিলাম,সেদিন নিজের উপর যা রাগ হয়েছিল তাতো তুমি জানো,আমার ছুটির দিনে ইচ্ছে করে ওকে যখনই বলতাম আমি অফিস যাই ও শুনে কেমন করতো বলো,রাস্তায় বেড়ালেই বেলুন নেওয়ার জন্য ছিল ওর কতো বায়না,তোমার আমার ঝগড়া হলে বার বার চিৎকার করে বলতো “তোমরা ঝগড়া-ঝগড়ি করবে না আমার কষ্ট হচ্ছে”,পড়তে বসালে উল্টে আমাকেই পড়িয়ে দিতো,তুমি বোকলেই আমাকে কেমন নালিশ করতো,তুমি যখনই ঘরে আবৃত্তি করতে কেমন করে আমাকে থামিয়ে দিতো বলো! আর যখন গল্প টাইপ করতে আমাকে বলতো মাকে একদম ডিস্টার্ব করবে না,ও কতো তাড়াতাড়ি সব বুঝে যেতো বলো!

মন খারাপ করোনা। এটাই সংসারের নিয়ম। তুমিতো শিক্ষা দিয়ে ছিলে,ভালো করে সংসার করতে।শ্বশুর বাড়ি গিয়ে কোনো ত্রুটি যেন কেউ দেখাতে না পারে—-এই ভাবেই তো মেয়েকে মানুষ করে ছিলে। তবে আজ ওকে তোমার কথা গুলো রাখতে দেবে না,,,? আর এমনিতেও ছয় দিন পর বাড়িতে রথের উৎসব। তখন তো আসবেই,যত পারো মেয়েকে সামনে বসিয়ে আদর করে নিও।এখন এই ছয়টা দিন ধৈর্য ধরতো বাপু!!
হ্যাঁ তা ঠিকই বলেছো তুমি—

অনিমেষ বাবু চোখ থেকে চশমা খুলে বিছানায় রেখে ওয়াশ রুমে গিয়ে ট্যাপকলটা ছেড়ে দিয়ে অঝোরে কেঁদে নিলেন কিছুক্ষণ।পাছে যাতে কেউ কান্নার আওয়াজ না পায়।গুনগুন করে ভারি গলায় বলতে থাকলেন—
বেলা তুমি আমায় ছয় দিন অপেক্ষা করতে বলছো আমি যে ছয় মিনিটও মামনিকে ছেড়ে থাকতে পারছিনা।জীবনের বাকি দিনগুলো ওকে ছেড়ে থাকার কথা যে ভাবতেই পারিনা।কেনো যে এমনটা হয়,এতো বড় ত্যাগ কেনো সব মেয়ের বাবাকেই করতে হয়,,,?
তুমি বুঝবে না বেলা,,,,! তুমি বুঝবে না,,,!

Loading

Leave A Comment