Site icon আলাপী মন

মতলবী মন

মতলবী মন

-অমল দাস

 দীর্ঘ টানা পোড়েনের পর অবশেষে সমাধান হল। হ্যাঁ প্রফেসর নীলৎপল চ্যাটার্জী আর শিক্ষিকা অনুসুয়া রায় চ্যাটার্জীর ছ’মাস পূর্বে ফাইল করা দু’বছরের  বিবাহিত জীবনের ডিভোর্স কেসটি আজ ব্যাঙ্কশাল কোর্টে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদের স্বীকৃতিতে সিলমোহর পড়লো।

 দু’বছর আগেই নীলৎপল ও অনুসুয়া শুভ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। বৈবাহিক সম্পর্ক প্রথম দিকে বোঝাপড়ার পাল্লা সমান্তরালে থাকলেও মাস খানেকের মধ্যেই দুজনার মতানৈক্য তিল থেকে তাল, সামান্য জল থেকে খাল আর ধোঁয়া থেকে আগুন হয়ে উঠতে লাগলো। ধীরে ধীরে তাল বড় হল, খাল সমুদ্র দেখলো আর আগুন জ্বলে ছাই হল, যে কারণে সম্পর্কের মাঝে বিনি সুতোর বাঁধনে বিচ্ছেদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এলো। আসলে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস থেকে শুরু হয় লড়াইটা , যা বেপরোয়া মনোভাবে পর্যবসিত হয়। প্রফেসর হওয়ার দৌলতে প্রতিদিন শতশত উঠতি তরুণীর সম্মুখীন হতে হয় নীলৎপলকে, তাই এক অনুসুয়া গেলেও জ্যৈষ্ঠের আম কাঁঠালের মত অন্য অনুসুয়া জীবনে আসতে সময় লাগবে না, এমনই তার ভাবনা। ঠিক অনুসুয়াও ভাবে নীলৎপলের সঙ্গে না থাকলে তার জীবনের গতি পথে কোন হিমালয় এসে দাঁড়াবে না। কারণ সে চাকরী করে, ভালো টাকাই বেতন পায়। শক্ত হাতে হাল ধরে বয়ে চলা সমাজ নদীতে নৌকা সে একাই টেনে নিতে পারবে।সুতরাং তাকে কারো মুখাপেক্ষী হয়ে দিন কাটাতে হবে না।

   বর্তমান সমাজের এই একটা ব্যাধি, যেখানে যত বেশি প্রতিষ্ঠিত উচ্চবিত্ত পরিবার, সেখানেই তত বেশি বিচ্ছেদে সম্পর্কের ফাটল ঘটনা দেখা যায়। ঠিক যেমন ধূ ধূ মাঠের মাঝে দু’চারটি তালগাছ দাঁড়িয়ে থাকে যা সামান্য মেঘের বজ্রপাতেই শেষ হয়ে যায়। সমাজ শিক্ষিত হচ্ছে ঠিকই তা অন্তরে নয় , অবিচ্ছেদ্য ত্বকের আকারেও নয় !  যা হচ্ছে সেটা পোশাকি, চাইলেই চোখ বন্ধ করে খুলে রাখা যায়। কারণ ধীরে ধীরে মানবিক বন্ধন, সততা, বিশ্বাস, সংস্কার, আত্মীয়তা দৃঢ়তা আমাদের কাছে মূল্যহীন তুচ্ছ হয়ে উঠছে। আমরা ‘আমিতে’ সীমাবদ্ধ। অন্যকে নিয়ে চলতে দ্বিধা, পারস্পরিক সমঝোতায় গভীর অনীহা আমাদের।

        কলেজে পড়ার সময় অনুসুয়া ও শঙ্খদীপের আলাপ। ক্রমশঃ তা মন বিনিময়ে মাধ্যমে একে অপরের হৃদয়ের নীল আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে দাঁড়ায়। কলেজ শেষে বি.এড কোর্সে ভর্তি হয় অনুসুয়া এবং শঙ্খদীপ আর্থিক দুর্বলতার কারণে সে পথে না গিয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়। তাদের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এই কয়েক বছরে। বি.এড পড়তে পড়তেই অনুসুয়া প্রবল আগ্রহে কোর্ট ম্যারেজের ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু শঙ্খদীপ তাকে বোঝায় অন্তত একজন চাকরী পেলেই বিয়ে করে নেবে, যাতে তাদের পরিবার এই সম্পর্ক না মেনে নিলেও তাদের সংসার জীবনে কোন অসুবিধা না হয়। আসলে বাবা মা ছোট থেকে সন্তান লালন পালনে তাদের দাবী পূরণে বিশেষ অনীহা না দেখালেও, যখন  বিয়ের মাধ্যমে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে পা দেওয়া হবে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানের ইচ্ছাকে রাস্তা তৈরির কংক্রিট পাথরের মত তপ্ত পিচে ফেলে রোলার দিয়ে পিষে দেওয়া হয়। আর এই ভীতিই শঙ্খদীপের মনের মধ্যে তপ্ত মধ্যাহ্ন সুর্য্যের মত উদয় হয়ে ছিল।

     বি.এড পাশের একবছরের মাথায় অনুসুয়া শিক্ষিকার চাকরী পায়।শঙ্খদীপ তখন বেকার…..! শুরু শুরুতে সম্পর্ক ঠিক থাকলেও ধীরে ধীরে কর্ম ব্যস্ততার  অজুহাত দেখিয়ে অনুসুয়া একটা দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করে। বাঁধন সম্পূর্ণ ছিন্ন না হলেও তৃষ্ণার্ত পথিকের সামনে মরীচিকা তুলে ধরা হয়েছিল। অবশেষে শঙ্খদীপের সে ভ্রম ভাঙে।

একদিন অনুসুয়া বলেই বসে –“ বাবা-মা কিছুতেই মেনে নিচ্ছে না এই সম্পর্ক। তোমাকে বিয়ে করলে বাবা আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছে ! কি করব ? বুঝতে পারছি না , তুমি একটা উপায় বল…”।

কথাগুলি শোনা মাত্র শঙ্খদীপের শরীরের সমস্ত রক্ত যেন বিষাক্ত হয়ে শিরার মধ্যে দিয়ে যন্ত্রণা দিতে দিতে হৃদয়ে আঘাত করছিল বারবার। চোখ সেই যন্ত্রণায় ছলছল হয়ে উঠেছিল। এই বক্তব্য সত্য কিনা জানার কোন উপায় ছিল না শঙ্খদীপের কাছে, সে শুধু বিশ্বাস করেছিল মন-মন্দিরের আরাধ্য দেবীকে।

সেই প্রত্যয় নিয়েই সে বলেছিল – ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে তাকেও আমি ভালবাসবো’ ।

শঙ্খদীপের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা আহ্লাদ আবেগ প্রেম সমস্ত কিছু অনুসুয়ার করুণ আর্তির কাছে হার মেনে নিয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় । সে একটি বারও অনুসুয়াকে অবিশ্বাস করেনি, একটি বারও তার বাবার কাছে জানতে চায়নি। আসলে কোন দাবী নিয়ে সে যাবে, কোন অধিকারে সে অনুসুয়াকে ছিনিয়ে আনবে, সে তো কর্মহীন বেকার, তার হাতে কে-ই বা কন্যা সম্প্রদান করবে। অতএব শঙ্খদীপের মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর তো কোন উপায় ছিল না। শুধু ছিল বিচ্ছেদ বেদনাপূর্ণ অশ্রু মিশ্রিত চোখে অনুসুয়ার পানে পলকহীন ভাবে চেয়ে থাকা। জল থেকে তুলে ডাঙায় মাছ ছেড়ে দিলে যে ছটফটানি দেখা যায় ঠিক তেমনটাই অবস্থা ছিল শঙ্খদীপের। অনুসুয়া তার সেই বিদীর্ণ হৃদয়টাকে অনুভব করেছিল কিনা সেই হয়তো বলতে পারে……।

      কথায় বলে একজন সফল পুরুষের পিছনে একজন নারীর যথেষ্ট ভূমিকা থাকে। সেই নারীর ভূমিকা কি অনুসুয়া পালন করতে পারতো না? সে কি পারতো না শঙ্খদীপের হাত ধরতে, সাহস যোগাতে, বিশ্বাস জাগাতে? অনুসুয়ার সঙ্গ পেলে হয়তো শঙ্খদীপের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হত, সে বেকারত্বের জ্বালা মুছে যেকোনো পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারতো বিনা সঙ্কোচে। আসলে অনুসুয়ার মত নারীদের বোঝা উচিৎ যে শঙ্খদীপের মত শিক্ষিত শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন পুরুষরা সরকারী চাকরীর আশায় নিজেকে তৈরি করতে থাকে একটা সময় পর্যন্ত, কিন্তু তা না পেলে বেকার জীবন বেছে নেয় না, কিছুনা  কিছু অবশ্যই করে, ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে অন্তত থাকে না।

    এ সমাজে বেকার মহিলাদের তো সংসার ধর্মে অসুবিধা হয় না বললেই চলে। কিন্তু শিক্ষিত বেকার যুবকদের সেই ভাগ্য নেই, চাইলেও হয় না, অথচ সংসারী হওয়ার ইচ্ছা সুপ্ত হৃদয়ের কোঠরে।

    গভীর ভাবে দেখলে বোঝা যায় যে দশ জন চাকুরীজীবী পুরুষের অন্তত নয় জনের স্ত্রী কোন পেশায় যুক্ত নয়। অন্যদিকে দশ জন চাকুরীজীবী মহিলাদের অন্তত ন’জনের স্বামী তাদের থেকে উচ্চপদে কর্মরত, অর্থাৎ বেকার স্বামী কারও নেই। বর্তমান সমাজ যে ভাবে যন্ত্র নির্ভর হয়ে উঠছে তাতে কর্ম পরিসর সঙ্কুচিত হচ্ছে প্রসারিত হচ্ছে না। মহিলারা পুরুষের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে সমান তালে যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে আমাদের নারী সমাজের ভিত মজবুত হচ্ছে, আর্থিক শ্রী বৃদ্ধি ঘটছে ঠিকই তার সাথে মননশীলতা, সহযোগিতা সাথে নিয়ে এগিয়ে চলার প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা যদি বৃদ্ধি পায় তা সমাজের পক্ষে মঙ্গল। সফল পুরুষ যেভাবে এতদিন নির্দ্বিধায় বেকার মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে চলে আসছে তেমনি যদি সার্বিক ভাবে চাকুরীজীবী মহিলারা শিক্ষিত বেকার যুবকদের জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধা না করে, তবে বেড়ে চলা বেকারত্বের সামাজিক অবক্ষয়ের উপর একটা ভারসাম্য তৈরি হতে পারে। পুরুষ বেকারত্ব পরিবারের পক্ষে তো বটেই সামাজের পক্ষেও ক্ষতিকারক।

    যাইহোক, বিবাহ বিচ্ছেদের এই ঝড়ো আবহাওয়ার দিনে আজ সকাল থেকেই প্রবল ভাবে শঙ্খদীপ উদয় হচ্ছে বারবার অনুসুয়ার মনে। সে কেমন আছে? কি করছে? বিয়ে করেছে কি না? করে নি নিশ্চয়ই করলে তো জানতাম…! বড্ড জানতে ইচ্ছা হচ্ছে আজ!  এমনই ভাবনায় সে মগ্ন। শঙ্খদীপের মোবাইল নম্বরটাও নেই, হয়তো পুরনো ডাইরির কোন পাতায় আছে। তাই সে তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছে। খনি থেকে সম্পদ বার করে তবেই নিস্তার হবে। ডায়রির পাতায় বদ্ধ প্রথম প্রেম নিবেদনের গোলাপটি আজও নিজ স্থানে বসে আছে। কলেজের সেই দিনগুলিতে আজ মন যেন হারিয়ে যেতে চাইছে বার বার। তার মন ব্যকুল চঞ্চল। অবশেষে একটি নম্বর পেল সে । কিন্তু মনে প্রশ্ন অনেক- সেকি এই নম্বর এখনো ব্যবহার করছে? সে কি আদৌ কথা বলবে? কারণ আমি তো সেদিন মিথ্যেই বলেছিলাম শঙ্খদীপ কি সেটা বোঝে নি নিশ্চয়ই বুঝেছে। এভাবে এত দিন পর কি ফোন করা ঠিক হবে? কিন্তু মন তো কিছুতেই মানছে না, অনুসুয়া বাঁধন ছিঁড়ে ডানা মেলে আজ শঙ্খদীপের দেশে যেতে চাইছে হাওয়ায় ভেসে। না সাহসটা দেখাই যা হয় হবে, আমি তো জানি ও নিশ্চয়ই আমার সাথে কথা বলবে..!

 এই ভেবে সে ফোনটা করেই ফেলল…

ও প্রান্ত থেকে শঙ্খদীপ  ফোন তুলে -“হ্যালো!”

– হ্যালো ! আমি বলছি !

কণ্ঠ শুনেই শঙ্খদীপের শরীরে এক অপ্রত্যাশিত শিহরন উদ্বেলিত হয়। যেন মেরু প্রদেশের শৈত্যের বাতাস ছুঁয়ে গেল তার সমস্ত শরীর। বুকের বাম দিকটা যেন আরও বেশি দপ্‌দপ্‌ করতে লাগলো। রক্তের সঞ্চালনও তীব্র হয়ে উঠেছে নিমেষে। সে সহজেই চিনে গিয়েছিল তার আত্মিক আত্মীয়ের স্বর -“ আজ এতদিন পর আমাকে জানতে ইচ্ছা হল ? মৃত না জীবিত সেটাই কি জানতে চাইছো?

অনুসুয়া চুপ !

কোন সাড়া না পেয়ে আবার প্রশ্ন- কেমন আছো তুমি?”

শঙ্খদীপের কথা শুনে অনুসুয়ার চোখে জল চলে আসে সে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে। দু বছরের অধিক সময় পর শুধু হ্যালো! বলাতেই সে অনুসুয়াকে চিনে নিয়েছিল। এখনো তাকে মুছে ফেলতে পারেনি, তা শঙ্খদীপের কণ্ঠ স্বরেই সহজেই বোঝা গেলো।

অনুসুয়া নিজেকে সামলে উত্তর দিল-“ ভালো! তুমি কেমন আছো ?

এক বিরহ মিশ্রিত সুরে সে বলল-“ তোমার জায়গায় আমি একই আছি! শুধু আমার জায়গায় একটু পরিবর্তন হয়েছে”।

সে কি বলতে চাইল বা বলল তা অনুসুয়ার বুঝতে অসুবিধা হল না। শুধু বলল “ তোমাকে একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ! আমি এখানেই আছি কাল কি তুমি আসবে”?

শঙ্খদীপ প্রবল ভাবে চায় একটি বার অনুসুয়াকে সামনে থেকে দেখি সে কেমন আছে,  বিয়ের পর রাঙা টিপ- শাঁখা -শাড়িতে কেমন দেখতে হয়েছে? কিন্তু সে চুপ, নির্বাক আজ কোন উত্তরই যেন জানা নেই তার। কোন উত্তর সে খোঁজারও চেষ্টা করেনি।

উল্টো দিকে অনুসুয়ার কণ্ঠ- হ্যালো ! তুমি শুনছো ? হ্যালো….. সাড়া দাও,  কথা বল…।

Exit mobile version