পুনর্মিলন
-বিভূতি ভূষন বিশ্বাস
খুবই স্পষ্ট মনে আছে বাবার কাঁধে চড়ে ইস্কুলে যেতাম । পথে যেতে যেতে কত লোকে কত কথা বলতো বাবাকে । সব আর মনে নেই শুধু মনে আছে ওরা বলতো ওই লম্বু পাগল … ওই লম্বু পাগল … বলেই দৌড়ে পালিয়ে যেতো । মাঝে মধ্যে ঢিলও ছুঁড়তো । বাবা অবশ্য কিছুই বলতো না । কিন্তু ওদের এই ব্যবহারে আমার খুব কষ্ট হতো । ইস্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাবা আমার দু গালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত । কিছুদিন পর বাবা হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল । বাবার উপস্থিতি আর কোন দিন দেখতে পাইনি । মাকে অনেক বার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করেছি । কিন্তু তেমন কোন সদুত্তর পাইনি । মা শুধু কান্না করতেন আর বলতেন বাবা দেশান্তরী হয়ে গেছেন । বড় হবার পর বাবার স্মৃতি প্রায় ভুলেই গেছি বলা চলে ।
রেলে চাকরি পাবার পর অজপাড়াগাঁয়ের গ্রাম ছেড়ে চলে যেত হলো নাগপুর ষ্টেশনে । ওখানেই যে প্রথম পোষ্টিং । বেশ কিছুদিন পরে জানতে পারলাম দুলালদা রেলে চাকরি করে না । দিনরাত প্লাটফর্মেই থাকে । আর রেলের বড় বাবুদের ফাইফরমাশ খাটে । দুলালদা দেখতে বেশ লম্বা । মাথা ভরা ঝাঁকড়া সাদা চুল । বয়স মনে হয় ৬৫/৭০ হবে । যে কোন কাজ বললেই ওনার না নেই । রেলের কাজ এত সুন্দর করেন মনেই হয়না যে উনি রেলর কর্মীই নন ।
ভ্রমণ করা আমার খুবই ভালো লাগে । মাঝে মধ্যে এক দুদিন ছুটি পেলে আশেপাশের ছোট ছোট জায়গাগুলি দেখতে বেরিয়ে পড়ি দুলালদা কে সঙ্গে নিয়ে । দুলালদাও আমার সঙ্গে বেশ মিশে গেছে । কবে থেকে যে দুলালদা আমার রেল কোয়াটারে থাকতে শুরু করেছেন মনেই করতে পারছিনা না । অবশ্য রান্নার কাজটা দুলালদা দক্ষ হাতে করে আমাকে রান্না ঘরের ধারে ঘেষতেই দেন না ।
এক বার বাড়ি থেকে খবর এলো বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । দুলালদাকে অনেক করে বললাম কিছুতেই আমার সঙ্গে যেতে রাজি না হওয়ায় অগত্যা আমি একা চলে গেলাম । বোনের বিয়ে দিয়ে । ফাঁকা ঘরে মাকে কি করে রেখে আসি । তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম নাগপুরে । ষ্টেশনে নামতেই বড় বাবু বলল বিশ্বাস ভয় নেই অমিতাভ রান্না বান্না করে রেখেছে ।
মা জিজ্ঞাসা করলেন অমিতাভ কে ? আমি বললাম আমার ঘরে একজন বয়স্ক লোক থাকেন উনার আসল নাম কেউ জানে না । আমি দুলালদা বলে ডাকি । বড় বাবু অমিতাভ বলে ডাকে । আবার কেউ কেউ লম্বু বলেও ডাকে । উনি কিন্তু সবার ডাকেই সাড়া দেন । কথা বলতে বলতে মা আর আমি রেল কোয়াটারে পৌঁছে গেলাম । কলিং বেল টিপতেই দুলালদা বেরিয়ে এল । মা উনাকে দেখে চমেক উঠল । মুহূর্তের মধ্যে মা কেঁদে ফেলল আর বলল খোকা এই তোর বাবা । মুহূর্তের জন্য আমি যেন হারিয়ে গেলাম আর আমার দু চোখ দিয়ে যেন পুষ্প বৃষ্টি ঝরতে লাগলো ।