প্রতিদান
-রেহানা দেবনাথ
জুঁই কালীঘাটের চত্বরে ঘুরে বেড়ায় পুজো দেবার জন্য নয়,খদ্দের ধরতে। প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল সে এই দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়েছে। কাল সে মন্দিরে প্রদীপবাবুকে দেখেছে নতুন বউ নিয়ে পুজো দিতে এসেছিল। জুঁই এর একটু কষ্ট হলেও তা সহ্য করে নিলো। প্রায় চার বছর ধরে প্রদীপ জুঁইকে বিয়ে করার জন্য চেষ্টা চালায় কিন্তু জুঁই রাজী হয় না।কারণ তার বিশ্বাস ভালোবাসা দুটোই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।মাত্র ১৬ বছর বয়সে জুঁই অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে হয়ে গরীব রঞ্জনকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। নদীর ধারে একটা হোটেলে তারা ওঠে। কিন্তু রাতে ফুলশয্যা হয় অন্য একজনের সাথে জোর করে,তার কাকুতি মিনতি সব ব্যর্থ করে লোকটি তার শরীর,মন পিষে দেয়। লোকটির কাছে জানতে পারে পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে রঞ্জন। লজ্জায় ঘৃণায় তার নিজেকে শেষ করে দেবার ইচ্ছে হলো কিন্তু পারলো না। বন্দিনী হয়ে রইল একমাসের মত। সবসময় কান্না ছাড়া আর কোনো কিছুই তার করার ছিল না। কেউ তাকে উদ্ধারের জন্যও এলো না। রাতে সেই লোকটিও অন্য আরো পুরুষ ঢুকিয়ে দিত তার ঘরে।তার উপর যত অত্যাচার হয়েছে ততই রঞ্জন ও পুরুষদের উপর ওর ঘৃণা জন্মেছে। তারপর হাত বদল হতে হতে সে এখন কালীঘাটে এসে পড়েছে বছর পাঁচেক আগে। সেই সময় প্রদীপবাবু একদিন ওই পল্লীতে আসে আর জুঁই এর সঙ্গে থাকে। তারপর থেকেই প্রদীপবাবু ওকে ভালোবেসে ফেলে, বিয়ে করতে চায়। জুঁই রাজি হতে পারেনি কারণ পুরুষ জাতির উপর থেকে তার বিশ্বাস উঠে গেছে!পুরুষের ভালোবাসা মানে নারীদেহ ভোগ করা এটাই সে মনে করে আর প্রতিটি পুরুষের মধ্যে সে রঞ্জন ও হোটেলের সেই লোকগুলোর প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। যারা তার ফুলের মত শরীরটায় কামনার থাবা বসিয়েছিল। তার জন্যই প্রদীপবাবুর প্রস্তাবে সে রাজি হতে পারেনি। জুঁই বুঝেছিল প্রদীপবাবু ভালো লোক কিন্তু সে তার এই জীবনের সঙ্গে ওকে আর জড়াতে চায় নি।
জুঁই ডায়মন্ড হারবারের একটি নামী হোটেলের লনে দাঁড়িয়ে রাতে শান্ত নদীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিল। সে এখানে আসতে রাজি হচ্ছিল না পুরানো পার্টি তাই বাধ্য হয়েছে। পার্টি মদ খেয়ে ঘুমাচ্ছে তাই সে এতরাত্রে বাইরে। হঠাৎ তার কানে একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ এলো পাশের রুম থেকে। সে কান খাড়া করে শুনতে লাগলো দরজার কাছে গিয়ে। ধস্তাধস্তির আওয়াজ হচ্ছে আর মেয়েটি বলছে দয়া করে আমায় ছেড়ে দাও! তোমার পায়ে পড়ছি। জুঁই আগেপিছে কিছু না ভেবে দরজায় দড়াম দড়াম করে মারতে থাকে। তারপর দরজাটা খুলে যায় একটি মধ্য বয়স্ক লোক মুখ বার করে কিছু বলার আগেই সে হুড়মুড়িয়ে রুমের ভিতর ঢুকে যায় সেখানে দেখে একটি অল্পবয়সী মেয়ে বিবস্ত্র অবস্থায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে আর কাঁদছে। জুঁইকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে দিদি আমাকে বাঁচাও। জুঁই মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে আর পাঁচ বছর আগের জুঁইকে দেখতে পায়।লোকটি তখন আমতা আমতা করে বলে কে আপনি? এই হোটেলে পুলিশের উৎপাত নেই!বেশি করে টাকা দিয়েছিলাম। জুঁই গর্জে ওঠে চুপ করো। একটা ছোট্ট মেয়ের উপর অত্যাচার করছো, আবার কথা বলছো।এখান থেকে এখুনি বের হও না হলে লকাপে ঢুকিয়ে দেব।লোকটি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে, কি ভাবলো তারপর জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তখন জুঁই মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর জামাকাপড় পরিয়ে দেয়। এরপর মেয়েটিকে শান্ত করে তার পরিচয় ও কিভাবে এখানে এলো তা জানতে চায়। মেয়েটি জানায় তার নাম সুমিতা দাস,বাবা নেই,দাদা রঞ্জন দাস,মা শশীবালা দাস,গ্রাম নন্দনপুর,দক্ষিণ ২৪পরগনা। জুঁই চমকে ওঠে এটাতো তাদের গ্রামের ঠিকানা। সুমিতা তাহলে বিশ্বাসঘাতক রঞ্জনের বোন!সুমিতা বলতে থাকে চার বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় দাদার হাত দুটো বাদ হয়ে যায়। দাদার এক বন্ধু কাজ দেবার নাম করে আজ তাকে এই হোটেলে রেখে যায়। তারপর রাত্রি হলে,,,,বলতে বলতে সুমিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। জুঁই কি করবে,কি বলবে বুঝতে পারে না।যার দাদা ওকে এই নরকে ঠেলে দিয়েছে তাকে কি বাঁচাবে,নাকি টেনে নিয়ে যাবে ওই নরকে! আর সে রঞ্জনকে এনে তার বোনের অবস্থা দেখাবে। হঠাৎ জুঁই নড়ে ওঠে! এ কি সব ভাবছে,সুমিতা আর রঞ্জন আলাদা মানুষ। আর ও যে হাত দিয়ে আমাকে এই জীবনে ঠেলে দিয়েছিল সেই হাত দুটোই নেই। ওর কিছুটা শাস্তি হয়তো পেয়ে গেছে। সুমিতার তো কোনো দোষ নেই। পরেরদিন জুঁই বোরখা পরে সুমিতাকে নিয়ে নিজের গ্রামে ফেরে। গ্রামের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখে চারপাশটা কত বদলে গেছে,অনেকগুলো মাটির বাড়ীর জায়গায় ইঁটের বাড়ি উঠেছে। ওদের বাড়ির সামনে আসতেই বুকটা কেঁপে উঠলো। ঘরগুলো ভেঙেচুরে গেছে,লতাপাতা,আগাছা ভর্তি হয়ে গেছে। জুঁই কাঁপা গলায় সুমিতাকে জিগ্যেস করে এই বাড়িটার অবস্থা এমন কেন? সুমিতা জানায় যে বছর পাঁচেক আগে এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে নিঁখোজ হয়ে যায়। সেই শোকে কাকু মারা যায়। তার বছর খানেকের মধ্যে কাকিমা মারা যায়।সেই থেকেই জায়গাটা পড়ে আছে। জুঁই কঁকিয়ে ওঠে, দুচোখে জলের ধারা নামতে থাকে।নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না, দৌড়ে গিয়ে বাড়িটার ভাঙা দেওয়াল জড়িয়ে ধরে মা,,,,বাবা,,,,বলে কাঁদতে থাকে। প্রথমে সুমিতা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না, ধাতস্থ হয়ে জুঁইএর কাছে গিয়ে বলে তুমিই জুঁই দিদি! জুঁই কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ে। সুমিতা জুঁইকে ধরে বলে তুমি কোথায় হারিয়ে গেছিলে? জুঁই চোখের জল মুছে সুমিতাকে নিয়ে ওদের বাড়ি পৌঁছে দেয়। সুমিতার হাতে একটা টাকার ব্যাগ দেয় বলে যে সংসার চালানোর খরচ মাঝে মাঝে পাঠিয়ে দেবে আর ও যেন পড়াশোনা শেষ করে। তারপর ওর চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে।সুমিতা জোর করে ঘরের ভিতরে আসার জন্য কিন্তু জুঁই ঢোকেনি। এই ঘরের বউ হবার জন্য সে ঘর ছেড়েছিল এখন কি করে সে এই ঘরে ঢুকবে। জুঁই বিদায় নেবার সময় শুধু বলে গেল তোমার দাদা জানে আমার হারিয়ে যাবার কারণ। বলে জুঁই চোখের জল মুছতে মুছতে ধীরে ধীরে সুমিতার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল!
ধন্যবাদ সবাইকে