Site icon আলাপী মন

বেগুনের গুণ

বেগুনের গুণ
– অনিন্দ্য ভুক্ত

 

 

সুজাতা হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই রমাপদ ধপ করে বসে পড়েছেন। তাও কিনা পোকা বেগুনের কারণে! একদিন বাজার করতে এসে সুজাতার যা চোখে পড়ে গেল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই, নিত্য বাজারে অভ্যস্ত মানুষটাকে তার জন্য বসে পড়তে হলো! রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন সুজাতা। কি কুক্ষণেই না ইচ্ছে হয়েছিল আজ একসঙ্গে বাজার করতে আসার। একসঙ্গে আসবেন বলে ট্রাঙ্ক খুলে পাটভাঙ্গা ধুতি পাঞ্জাবী বের করে ছিলেন, আর তাই পরেই কিনা..এই প্যাচপ্যাচে জলকাদার মধ্যে! এই পোকাধরা বেগুনের ঝাঁকির সামনে! রোজ বাজার থেকে ফেরার পর পাঞ্জাবীর পেছন দিকটায় কাদার ছিঁটে কোত্থেকে আসে, সে রহস্য সুজাতার কাছে আস্তে আস্তে পরিস্কার হচ্ছিল। যত পরিস্কার হচ্ছিল, তত ক্রোধ বাড়ছিলো তার। বাড়তে বাড়তে… দুই পাটি দাঁত তাঁর সশব্দে কড়মড় করে উঠলো।
চমকে উঠে পাল্লা হেলিয়ে ফেলল নিবারণ। রমাপদর সযত্নে বাছাই করা বেগুনগুলো গড়িয়ে পড়ে মিশে গেল ঝাঁকির বেগুনের মধ্যে। দু’হাত দিয়ে সেই পতন আটকাতে গিয়ে উবু হয়ে বসা রমাপদ কাত হয়ে উল্টে গেলেন কাদার মধ্যে।
তুলে ধরবেন কি, বিস্মিত সুজাতা হতভম্বের মতো যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনই রইলেন,আর তার প্রৌঢ় স্বামী পাটভাঙা ধুতি -পাঞ্জাবী পরে বাজারের কাদার মধ্যে লুটোপাটি খেতে লাগলেন।

অন্যদিনের চেয়ে দৃশ্যটা আজ একটু অন্যরকম হলো। অন্যদিন বাইরে বেরোলে রমাপদ যান আগে আগে।টান টান শরীর,দৃপ্ত পদক্ষেপ। পেছন পেছন সুজাতা। একটু শ্লথগতি। হাঁটার ভঙ্গীতে একটু থপথপে ভাব। এই নিয়ে প্রতিবারই অনুযোগ করেন সুজাতা, ‘কি সবসময় ঘোড়ার মতো লাফাও?’ স্ত্রীর মনোগত ইচ্ছা রমাপদ জানেন। তাই গতি মন্থর করেন। চেষ্টা করেন পায়ে পা মিলিয়ে চলতে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই ফিরে আসে অভ্যাস, স্মৃতি যায় বিস্মরণে। আবার সামনে রমাপদ, পিছনে সুজাতা। সুজাতার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। অগ্ৰগামী রমাপদর চোখে পড়ে না সে দৃশ্য। আজ পরিস্থিতি একেবারে বিপরীত। সামনে সুজাতা হাঁটছেন দৃপ্ত দ্রুত পদক্ষেপে। পিছনে, বেশ কয়েক কদম তফাতে রমাপদ হাঁটছেন, যেন কোনোক্রমে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শরীরটাকে। ঝুলে গেছে চোয়াল,চোখ রক্তশূন্য, চিবুক বক্ষলগ্ন হয়ে ঝুলে পড়ে আছে। চারপাশে এখনও লোকজন আছে, মাথার ওপর ক্যাটক্যাট করছে সূর্য, সাহস তাই ধরে রাখতে পারছেন রমাপদ। টেনে হিঁচড়ে হলেও শরীর তাই এগোচ্ছে। এরই মধ্যে অবশ্য দু’বার ভেবে ফেলেছেন, বাড়ী ফিরে কি হবে, কি হতে পারে। দু’বারই তলপেট মোচড় দিয়ে উঠেছে। নির্বিবাদে বাড়ী পর্যন্ত ফেরার জন্য তাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে অশুভ চিন্তা ভাবনা মন থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে চালাতেই পা চালাচ্ছেন। কবিদের তিনি দু’চক্ষে দেখতে না পেলেও এখন বারবার কবিকেই স্মরণ করছেন। ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’। তবে কবি তো আর ভগবান নন, তাই শেষ পর্যন্ত ভক্তের ভরসা হলেন না তিনি। দূরপাল্লার দৌড়ের ক্ষেত্রে যেমন শেষ বাঁকে এসে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়,রমাপদর হলোও তাই। সুজাতার পেছন পেছনই হাঁটছিলেন তিনি, বাড়ীর সামনে এসে সূজাতা যখন সদর দরজার তালা খুলছেন, ধুতিতে পা জড়িয়ে তিনি পড়ে গেলেন।
ধরণী দ্বিধা হও– এটুকু উচ্চারণেরও সময় হলো না রমাপদর। সুজাতার দরজা তখন খোলা হয়ে গিয়েছিল। শব্দ পাওয়া মাত্র তিনি বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়ালেন। ব্যাপারটা বুঝতে তাঁর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। বিপদের কিছু নয় বুঝতে পেরে তিনি এগিয়ে এলেন। তারপর রমাপদকে কিছু বুঝতে না দিয়ে, সামান্য নীচু হয়ে খপ করে চেপে ধরলেন তাঁর পাঞ্জাবীর করার। হিড়হিড় করে টানতে শুরু করলেন প্রৌঢ় স্বামীকে। তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে এনে ডাষ্টবিনে ময়লা ফেলার ভঙ্গীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সোফার উপর। টানা- হ্যাঁচড়ায় ততক্ষণে পাঞ্জাবী ছিঁড়ে গেছে রমাপদর, ধুতি খুলে যাবার উপক্রম।
এতো দ্রুত সব ঘটনাগুলো ঘটে গেল রমাপদ থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। সুজাতার এই মুর্তির সঙ্গে, পঁচিশ বছর ঘর করার পরও তাঁর কখনো পরিচয় হয়নি। নিজেকে সামলে সুমলে সোফার উপর যখন উঠে বসলেন, ভেতর থেকে তখনো সুজাতার চাপা গর্জন ভেসে আসছে।এটা অবশ্য রমাপদর চেনা অস্ত্র। চাপা গর্জন আর দাঁত কিড়মিড়। বর্তমানে যদিও রমাপদর কোনো অস্ত্র নেই, তথাপি যৌবনে ছিল, পিলে চমকে দেওয়া হুঙ্কার। তখন খুব কার্যকর মনে হতো এই অস্ত্রকে, এখন খুব ভোঁতা মনে হয়। স্বল্প পাল্লার ঝগড়ায় তিনি জিতলেও দূর পাল্লায় সুজাতার অস্ত্র দু’টি যে অনেক বেশী কার্যকর তা স্বীকার করতে অন্তত রমাপদর কোনো দ্বিধা নেই।
খানিকক্ষণ থম মেরে সোফায় বসে থাকার পর রমাপদ উঠে পড়লেন ভয়ঙ্কর হতাশ লাগছে, বিষণ্ণও। সেকেণ্ড রাউন্ড চা’টাও যে আর পাওয়া যাবে না, বেশ বুঝতে পারছিলেন। এখনও গেলে দ্বিজেনের ঘরে সবাইকে পাওয়া যাবে। দ্বিজেনের বউয়ের কৃপা হলে হয়তো বা এক কাপ চা’ও। উঠে পড়ে বাইরে পা বাড়াতে যাবেন, চাপা হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে ঘরে ঢুকে এলেন সুজাতা, ‘ তা যাবে না, এই পোশাকে না গেলে বন্ধুদের কাছে বউয়ের পিণ্ডি চটকানো যাবে কি করে!’
মনে হচ্ছিল ঝট করে পিছন ফিরে একটা সজোরে পাঞ্চ, মুখের জিওগ্রাফিটাই পাল্টে দেবেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন রমাপদ। এই শর্ট-র্টার্ম মিস্ট্রিগুলোর পিছনে ছুটতে গিয়েই লং-র্টার্মে আজ তাঁর এই হাল। রমাপদ তাই পিছনে ফিরলেন, হাত চালালেন না। বদলে সুড়সুড় করে ঢুকে গেলেন বাথরুমে।
বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরে বেরিয়ে পড়লেন। লুঙ্গিটা ইচ্ছে করে পড়লেন। লুঙ্গি পড়ে বাইরে বেরোনো সুজাতা পচ্ছন্দ করেন না। তবে বাইরে বেরিয়ে এবারেও গতি বাড়লো না। যে তেজে লুঙ্গি পড়েছেন, বাইরে বেরিয়ে সেই তেজ কেমন নেতিয়ে পড়লো। রমাপদ মাথা তুলে হাঁটতে পারছিলেন না। সুজাতার হাতে নেংটি ইঁদুরের মতো ঝুলতে ঝুলতে গৃহপ্রবেশের দৃশ্যটা আশেপাশে কে দেখেছে কে জানে!
তবে কিছুদূর এগোনোর পরেও যখন কোথাও কোনো আওয়াজ উঠলো না, খানিক স্বস্তি ফিরে এলো রমাপদর মনে। তাহলে বোধহয় এ যাত্রায় পার পাওয়া গেছে।কারো চোখে পড়েনি। ভাবনাটা মাথায় আসায় স্বস্তির সঙ্গে গতিও ফিরে এসেছিল পায়ে।
কিন্তু রমাপদর অঙ্কে গোলমাল ছিল সেটা বোঝা গেল দ্বিজেনের ঘরে ঢুকতেই। প্রাত্যহিক বৈঠকীতে কেউ কাউকে অভ্যর্থনা জানায় না। আজ সবাই হৈ হৈ করে উঠলো রমাপদ ঘরে ঢুকতেই। মুখ ফের আষাঢ়ের কালো মেঘে ভরে উঠলো। রমাপদ গিয়ে ঘরের এক কোণে বসে পড়লেন। বসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আজ চা’ও এসে গেল। অন্যদিন বাড়ীর কাজের মেয়েটি চা দিয়ে যায়,আজ দ্বিজেনের বউ নিজে এলো। চা নিতে গিয়ে রমাপদ দেখলেন দ্বিজেনের বউয়ের মুখে মুচকি ফিচেল হাসি।
টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট করতে নেমে যে লোকটার হাত হঠাৎ আটকে যায়, গ্যালারির ব্যারাকিং হজম করতে করতে সে ভেতরে ভেতরে ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে, তারপর একসময় ঝেড়ে চালিয়ে দেয়। হয় ছক্কা,নয় ফক্কা। রমাপদর অবস্থা সেই দিকেই এগোচ্ছিল। আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করলেন বিশ্বনাথ।
বিশ্বনাথ ঘোষ রমাপদর নিকটতম প্রতীবেশী। রমাপদর প্রথম থেকেই সন্দেহ হছিল খবরটা ঠেকের দোরগোড়া পর্যন্ত টেনে এনেছে বিশ্বনাথই। তাছাড়া পোকা বেগুন কেনার আইডিয়াটা বিশ্বনাথেরই মস্তিষ্ক প্রসূত। দিন কয়েক আগে বাজারে দুজনের দেখা, রমাপদ তখন একটা বেগুন হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন,
-‘কি রমাদা কি দেখছেন অত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে?’
ঘাড় ঘুরিয়ে বিশ্বনাথকে দেখে রমাপদ বলেছিলেন,
-‘আরে ভাই বলো কেন, একটা পোকা দেখলে সে বেগুন আর ঘরে ঢুকবে না’।
– ‘বলেন কি দাদা, পোকাই তো বেগুনের গুণ।,’
এবার রমাপদ পর্যন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন,’মানে?’;
-‘আরে রমাদা, বেগুনে পোকা মানে কি বলুন তো, জমিতে পেষ্টিসাইড পড়েনি। পোকা আর ক’টা দাদা, কেটে ফেলে দেবেন। ইন এক্সচেঞ্জ কি পাচ্ছেন ভাবুন।’

সেদিন আর বেগুন কেনা হয়নি। বিশ্বনাথের কথায় যুক্তি আছে। আবার উল্টোদিকে আছে সুজাতার ভ্রুকুটি। দোটানায় পড়ে সেদিন আর বেগুনই কেনেন নি। আজ সুজাতাকে সঙ্গে পেয়ে ভেবেছিলেন এক্সপিরিয়েন্সটা হাতে নাতে হয়ে যাবে। তারপর তো এই কীর্তি।

ঠেকে এসে বিশ্বানাথকে দেখার পর থেকেই তাই পারদ চড়িয়ে। অথচ বিশ্বনাথ মুখ এমন গম্ভীর করে বসে ছিল যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু ঠেকে এসে কাঁহাতকই বা আর এমন ভেটকি মাছের মতো মুখ করে বসে থাকা যায়? বিশেষ করে চারদিকে যখন এমন হাসি-ঠাট্টার ফোয়ারা চলছে। শেষ পর্যন্ত সে বলেই ফেলল,
– ‘যাই বলুন দাদা, বৌদির রাগটা কিন্তু রুগি বেগুনের জন্য নয়।’
– কথাটা কানে ঢুকতে যেটুকু সময় লাগলো,রক্তটা চড়াৎ করে মাথায় উঠতে সেটুকু সময় লাগলো না। দাঁতে দাঁত চেপে, হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন রমাপদ। ঠিক ততটা দ্রুততায় উঠেছিলেন, ততটা দ্রুততার সঙ্গেই আবার নিজেকে সামলেও নিলেন। তারপর মাথা নিচু করে, মন্থর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন বাইরে, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
বাড়ী ফিরে অন্যদিন আগে একটু পাখার তলায় বসেন, তারপর বাথরুম যান। আজ সোজা গিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। শাওয়ারের প্যাঁচটা ডানদিকে পুরো ঘুরিয়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রক্তটা মাথা থেকে নেমে এলো। স্নান করে বেরিয়ে এসে রমাপদ দেখলেন সুজাতা পাজামা-পাঞ্জাবী হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। এমনটা তো হয়না! কোনোদিন কপাল ভালো থাকলে পাট করা জামা কাপড় বিছানার উপর পান। অবাক হলেও আজ তার চুপ করে থাকার দিন। স্ত্রীর হাত থেকে নিঃশব্দে পরিধেয়গুলি নিলেন। নিঃশব্দেই তৈরী হয়ে নিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলেন। মাথা নীচু করে চুপচাপ খেয়ে নিয়ে রমাপদ গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
ঘুম আসছিল না। ঘুমোবার জন্য তো শোননি। চোখ বুজে কেবল ভেবে যাচ্ছিলেন। নির্দিষ্ট কোনো ভাবনা নয়। নির্দিষ্ট কিছু ভাবার মতো মনের অবস্থাও তো নয়। হঠাৎই কপালে একটা ভিজে ভিজে নরম স্পর্শ অনুভব করলেন রমাপদ। কিসের স্পর্শ, বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয। কিন্তু ইতিপূর্বে এমন ঘটনা কবে ঘটেছে স্মরণে আসছিলো না তাঁর। যেটুকু আসছিলো সেটাকে পূর্ব জন্মের স্মৃতি বলেই মনে হচ্ছিল। রমাপদর শরীর শক্ত কাঠের মতো হয়ে গেল।
সুজাতা এরকমই কিছু প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করেছিলেন। তাই পরের কাজটাও ভেবে রেখেছিলেন। সিঙ্গল খাট, স্বামীকে একটু টেনে নিয়ে পাশেই শুয়ে পড়লেন। তারপর ধীরে ধীরে স্বামীর চুলে বিলি কাটতে শুরু করলেন। রমাপদর চোখ খুললো না। খানিকক্ষণ বিলি কাটার পর গলায় আদুরে সুর এনে সুজাতা বললেন,
– ‘বেগুনগুলো জানো, দারুণ টেস্টি। বিশ্বনাথদা ঠিকই বলেছেন। কোনো কেমিক্যাল নেই তো।’
ফটাস করে দু’চোখের পাতা খুলে গেল রমাপদর। বিষ্ফোরিত হয়ে উঠলো দৃষ্টি। সেদিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন সুজাতা।

Exit mobile version