একটি অসহায় মেয়ের কাহিনী

একটি অসহায় মেয়ের কাহিনী
-রেহানা দেবনাথ

 

 

প্রতিদিন ট্রেনে একটি দশ বছরের মেয়ে ওঠে ভিক্ষা চাইতে তার সঙ্গে বছর সাতেকের একটি মেয়ে। সবার থেকে টাকা চায় কখনো বলে আমার ক্ষিদে পেয়েছে পাঁচ টাকা দেবে আবার কখনো বলে আজ আমার বোনের কিছু খাওয়া হয়নি খেতে দেবে! কেউ কেউ কিছু টাকা দেয়,কেউ আবার দূর ছাই করে,কেউ বলে আবার বাড়িতে চল থাকবি কাজ করবি খেতে দেব। মেয়েটা সেখানে দাঁড়ায় না বোনের হাত ধরে চলে যায়,কোনো কথা না বলে। তখন সবাই হাসাহাসি করে। কেউ বলে ওদের ওটাই স্বভাব হাত পেতে চেয়ে খাবে,কাজ করবে কেন! প্রতিদিন এইসব শুনতে শুনতে ওর সহ্য হয়ে গিয়েছিল। কিইবা তার করার আছে চোখের জল ফেলা ছাড়া! হঠাৎ একদিন তার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল! সেদিন ও একাই ভিক্ষে করতে ট্রেনে উঠেছিল। সে উঠেই বলতে লাগলো আজ আমাকে একটু বেশি টাকা দেবে গো দিদিরা আমি আর আমার বোন দুদিন ধরে খাইনি,বোনের শরীর খারাপ ওকে ডাক্তার দেখাবো।তখন নিত্য যাত্রীদের কেউ কেউ বললো ওই জন্যই দুদিন দেখতে পায়নি। কেউ বললো নতুন বাহানা শিখেছে! ও শুধু চোখের জল ফেলে আর হাত বাড়িয়ে পয়সা নেয়। এমন সময় একজন বলে ওঠে এদেরকে টাকা দিবেন না,এসব এদের ব্যবসা। যতসব ছোটলোকের বাচ্চা! মা দেখো ঘরে শুয়ে আরাম করছে আর এদেরকে টাকা চাইতে পাঠিয়ে দেয়। তখন মেয়েটি জোরে চেঁচিয়ে রুখে দাঁড়ায়,আমাকে যত খুশি গালাগালি দাও কিন্তু খবরদার আমার মায়ের নামে একটাও কথা বলবে না। তোমরা ভালো দামী দামী জামা কাপড় পরে আছো তাই ভদ্রলোক! ঠিক বলেছ আমার মা ঘরে শুয়ে আছে তবে আরামের জন্য নয়, অসুখের জন্য! ডাক্তার বলেছে মাথায় রক্ত জমে আছে অপারেশন করতে অনেক টাকা লাগবে।আমাদের এই অবস্থা তোমাদের মতো শিক্ষিত ভদ্র মানুষদের জন্য।আমার বাবা একজন বড়লোক ,তার অনেক টাকা।আমার মায়ের উপর অত্যাচার করতো আমি মেয়ে হয়েছি বলে! তিন বছর পর আমার বোন হলে তাকে মেরে ফেলতে চায়,মা বাধা দেয় তাই মাকে মেরেধরে বার করে দিয়েছে। মা আমাদের নিয়ে চলে আসে মামার বাড়ি কিন্তু সেখান থেকেও কিছুদিন পর বার করে দেয়।মামাদের সংসার আছে তাদের ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে তার খরচ,বাড়ি,গাড়ির লোন অনেক খরচ তাই বোনকে কেউ দেখতে পারবে না তখন মা আমাদের নিয়ে অনেক দূরে চলে আসে। এখানে একটি ডাক্তারের বাড়িতে থাকা খাওয়ার কাজ পায় ,বাড়ির সব কাজ করতে হবে বিনিময়ে থাকতে ও দুবেলা খেতে দেবে তাতেই মা রাজি হয় আমাদের মুখ চেয়ে। পাঁচ বছর ভালো চলছিল। আমরা পাশের সরকারি স্কুলে পড়তাম,মা সারাদিন কাজ করতো,সুখেই কাটছিল আমাদের জীবন। যেদিন থেকে ডাক্তার আন্টির ভাই বিদেশ থেকে এসেছে সেদিন থেকে দেখতাম মা কেমন ভয়ে ভয়ে থাকতো। একদিন দেখলাম স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছি ঘরের দরজা বন্ধ ভিতর থেকে গোঙানির আওয়াজ আসছিল, জোরে দরজায় মেরে মা মা করে ডাক দিতেই দরজা খুলে গেল মা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো আর তখন দেখলাম ওই আঙ্কেল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি মাােক জিজ্ঞাসা করেছিলাম,’ কি হয়েছে মা?’ কিছু বলেনি শুধু কাঁদছিলো আর আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। সেই দিন সন্ধ্যায় ডাক্তার আন্টি মাকে বকছিলো,তাড়িয়ে দেবে বলছিল। দুদিন পর হঠাৎ সকালে মাকে বাগানের মধ্যে পাওয়া যায় শাড়ি ছেঁড়া মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ডাক্তার আঙ্কেল ও আন্টি মিলে মাকে ঘরে নিয়ে এসে কাপড় বদলে মাথায় ব্যান্ডেজ করে চিকিৎসা করে। মায়ের জ্ঞান ফিরলেও শরীর নাড়াচাড়া করতে পারছিল না তখন হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। সেদিন থেকে ওই আন্টির ভাইকেও আর দেখা যাচ্ছিল না।কয়েকদিন পর হাসপাতাল থেকে মাকে ফিরিয়ে এনে একটি বস্তির ছোট ঘরে আমাদের ও মাকে রেখে যায় আর বলে যায় যে আমরা তোদের মায়ের জন্য আর খরচ করতে পারবো না,নিজেদের ব্যবস্থা নিজের করে নে। সেদিন আমি ছোটো থেকে বড় হয়ে গেলাম ভাবতে লাগলাম কিভাবে মার চিকিৎসা করবো আর দুমুঠো খাবার জোগাড় করবো। মা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে আর চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি চায়ের দোকানে,হোটেলে বাসন মেজে ধুয়ে খাবার জোগাড় করতে থাকি। একদিন হোটেল বন্ধ ছিল হোটেলের মালিক টাকা দেবার নাম করে সেখানে ডাকে তারপর জোর করে আমার শরীর নিয়ে খেলতে থাকে সে যন্ত্রণার সময় মায়ের কষ্টও অনুভব করি, তারপর কিছু টাকা দিয়ে ছেড়ে দেয় বলে যে কাউকে যদি বলে দিই তাহলে বস্তি থেকে বার করে দেবে আর রোজ রাতে যদি আসি তাহলে টাকা দেবে। অনেক ব্যাথা নিয়ে ঘরে ফিরে আসি এসে দেখি বোনটা খুব কাঁদছে তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলে যে পাশের পাড়ার ক্লাবের কয়েকজন ছেলে তাকে ক্লাবে ঢুকিয়ে চকলেট,চিপস খেতে দেয় আর তার সঙ্গে কি করেছে ,পেচ্ছাব করতে গেলে জ্বালা করছে।সেদিন আমি মা আর বোনকে জড়িয়ে কেঁদেছিলাম, এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। তারপর থেকেই বোনকে কাছ ছাড়া করি না সঙ্গে করেই সারাদিন ট্রেনে ভিক্ষে করি । এখানে ভীড়ের মধ্যে ভয় লাগে না, জানি এতে গালাগালি খাবো, মনে কষ্ট হবে কিন্তু অসভ্য মানুষদের হাত থেকে রেহাই পাবো। এবার তোমরা বলো এতে আমাদের কি দোষ?আমার মায়ের ভুল কোথায়? আমরা মেয়ে হয়ে জন্মেছি এতে আমাদের দোষ কোথায়? জোরে জোরে সে প্রশ্নের বাণ যাত্রীদের উদ্যেশে ছুঁড়ে দেয়। সবাই নিশ্চুপ শ্রোতা!শেষ স্টেশন এলে মেয়েটি নেমে যায় আর প্লাটফর্মে দাঁড়ানো মানুষদের থেকে অভ্যাস মতো পয়সা চাইতে চাইতে চলে যায়।

Loading

Leave A Comment