Site icon আলাপী মন

মা

মা
-বিভূতি ভূষণ বিশ্বাস

 

 

বুঝলে বিপিনের মা এবার নিজের চেহারার দিকে একটু খেয়াল দাও দিন দিন যা মোটা হয়ে চলেছ যদি এক বার বিছানায় পড়ো বিপিন তো দূরের কথা দশ জনেও তোমাকে নাড়াতে পারবে নাl তাও বা যদি বিপিনের বাবা বেঁচে থাকতো।

দুই বান্ধবী রান্না ঘরে বসে গল্প গুজব হাঁসি ঠাট্টা করছে । হঠাৎ হৈ হট্টগোলে দুজনের গল্প থেমে গেলো । মনে হচ্ছে যেন দাঙ্গা বেঁধে গেছে লোক জন ছুটা ছুটি করছে কেউ কারোর কথা শোনার সময় পর্যন্ত নেই ।

ছুটছে তো ছুটছে কারো হাতে ব্যাগ কারো হাতে গরু,ছাগল,মুরগী যে যা পারছে নিয়ে ছুটছে । ছেলে মেয়ে বৌ বাচ্চা সবাই ছুটছে । গ্রামের কেউ আর ছুটতে বাকি নেই । আরে এতো রবিন পাগল টিয়া পাখির খাঁচা নিয়ে ছুটছে । সবাই ঠিকই বলে “টিয়া পাগলা” টিয়া পাখী ছাড়া ও আর কিছুই বোঝে না ।

ঐ তো বিপিন হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে । —— কি হলো বাবা বিপিন ? মা এখন কিছু বলার সময় নেই সব কিছু গোছ গাছ করে নাও । এই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে । সে কি বাবা এই বুড়ো বয়সে কোথায় যাবো ? কেন হিন্দুস্থান। এই দেশ আর আমাদের নেই এটা পূর্ব পাকিস্থান হয়ে গেছে । মোড়ল মহাশয়ের আদেশ “যত শীঘ্র সম্ভব গ্রামের সবাইকে হিন্দুস্থানে যেতে হবে”। কিন্তু বাবা আমি যাবো কি করে? কেনো সবাই যে ভাবে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে । মা,যানবাহন বলতে পালকি আমরা কোথায় পাবো। ও সব তো জমিদারদের জন্য। তা ছাড়া আমাদের অতো সামর্থ আছে নাকি !

আচ্ছা বাবা সংসারের জিনিসপত্রের কি হবে ?—- মা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও ! তোমার ধবলির গলা থেকে চিরতরের মত দড়ি খুলে দিলাম বাচ্চাকে (বাছুর) নিয়ে ধবলি স্বাধীন ভাবে বাঁচবে। ওকে হিন্দুস্থানে নেবার ক্ষমতা আমার নেই । মা,– তাড়াতাড়ি মুরগির খাঁচার দরজাটা খুলে সবাইকে মুক্ত করে দাও। সব ছাগলের গলা থেকে দড়িগুলো আমি খুলে দিচ্ছি। হে আমার প্রিয় জীব জড়ো সবাই ভালো থেকো। আমি আর মা চল্লাম হিন্দুস্থান।

চলো মা ———আচ্ছা চল বাবা —– রাস্তা দিয়ে হাঁটার জো নেই কাতারে কাতারে লোকজন হেঁটে চলেছে গন্তব্য একটাই হিন্দুস্থান । সবার হাতে কিছু না কিছু আছে । রিম ঝিম করে বৃষ্টি তার উপর কাঁচা রাস্তায় এক হাঁটু কাঁদা । মা ভালো হাঁটতে পারে না প্রায় সবার পেছনে আমরা।

হঠাৎ মা চেঁচিয়ে বললো খোকা ঐ দেখ মনে হচ্ছে রবিনের টিয়া পাখী ফেলে দিয়ে চলে গেছে বেচারী খাঁচার মধ্যে ছট্ ফট করছে ওকে ছেড়ে দে। দরজাটা খুলে দিতেই ফুরুত করে উড়ে পালালো। মনে হলো ও যেন স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। খোলা আকাশে প্রাণ ভরে উড়তে লাগলো।
হালদার পাড়ায় ঢুকতেই কান্নার শব্দ। মা কান্নার শব্দ অনুসরণ করে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন আমিও পিছনে পিছনে ঢুকলাম । একি রে বাবা এতো তপন হালদারের মা। বিছানায় শুয়েই থাকে বাঁ দিকটা সম্পূর্ণ পড়ে গেছে। পাশেই হাতের কাছে জল,মুড়ি কিছু ফল রাখা আছে । বুঝতে অসুবিধা হলো না সবাই ওনাকে ফেলে রেখে চলে গেছে । মা কাঁদতে কাঁদতে ওনার কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন । কিছু একটা বলতে চাইছে বলতে পারছে না। মুখটা তো বেঁকে গেছে । কোনো রকমে মাকে ধরে নিয়ে ওখান থেকে আবার হাঁটা শুরু করলাম ।

যত এগিয়ে চলছি ততই দেখছি রাস্তার দুধারে সব সাংসারিক জিনিসপত্র পরে আছে । কারোর ব্যাগ,বাসন পত্র,আরো কত কি ! রাত হয়ে এসেছে মা আর চলতে পারছে না । সামনেই একটা খোলা মাঠ সবাই ওখানে বিশ্রাম নিচ্ছে । আমরাও ওখানে ভিড়ে গেলাম কিছু চেনা,কিছু অচেনা মুখের ভিড়ে বিশ্রাম নিতে শুরু করলাম।

ভোর হতে না হতেই মাঠ প্রায় ফাঁকা যে যার মত উঠে চলে গেছে। মাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মায়ের পা দুটো ফুলতে শুরু করেছে মা আর হাঁটতে পারছে না মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে মায়ের কষ্ট হচ্ছে। কোনো মতে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে এলো সামনে পিছনে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।

সামনে একটি বটবৃক্ষের গাছের তলায় আমরা আশ্রয় নিলাম রাত কাটাবার জন্য সঙ্গী সাথী বলতে ভোলা কুকুরটা এখনো আমাদের সাথে আছে। মা যে ওকে ভীষণ ভালোবাসে । ভোর হতেই মাকে উঠিয়ে দিলাম। একি মা তোমার গায়ে তো জ্বর। পা দুটো প্রচণ্ড ফুলে গেছে।

বাবা আমি আর যেতে পারবো না আমাকে রেখে তুই চলে যা। আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে কোনো এক 15 August তোর ঘরে ছেলে রূপে জন্ম নেবো তুই যা চলে যা। তা হয় না মা। তোমাকে ছেড়ে কি করে যাই! দুই এক জন লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছে না দেখার ভান করে। সাহায্য চাইলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের খানা খন্দের জল আর জঙ্গলের ফল মূল দিয়ে দুই তিন দিন চললো।

এক দিন ভোরে মার কপালে হাত দিয়ে দেখি,কপাল বরফ হয়ে গেছে। হাত পা শক্ত নাড়ানো যাচ্ছে না। সত্যি মা আমাকে ছেড়ে হিন্দুস্থান চলে গেলো। মাকে টেনে নাড়াতে না পেরে কিছু ডাল পালা দিয়ে ঢেকে দিলাম। আর ভোলাকে বললাম চল ভোলা আমরা যাই । আমি হাঁটা শুরু করলাম ভোলা আমার পিছনে পিছনে হাঁটা শুরু করলো। কিছু দূর আসার পর ভোলা এক দৌড়ে মার কাছে চলে গেলো। অনেক ডাকলাম ও শুধু তাকিয়ে রইল এলো না।

সন্ধ্যা হবো হবো একটি গ্রামে এসে পড়লাম সবাই অচেনা । জিঞ্জাসা করলাম এটা কোথায় ? এক জন বললো এটা ভারতবর্ষ মানে হিন্দুস্থান। স্বাধীন ভারত বুঝলে ভাই। মনটা আমার ব্যাথায় ভরে গেলো।

অনেক দিন পর আবার পূর্ব পাকিস্থানে গিয়ে মার দেহাবশেষ খোঁজ করে ছিলাম কিছুই পাইনি।খুঁজতে খুঁজতে একটি মানুষের মাথার খুলি আর একটি কুকুরের মাথার খুলি পেয়ে ছিলাম। মা আর ভাই মনে করে নিয়ে এসে সৎকার করেছি।

Exit mobile version