মানব বোমা

মানব বোমা
-বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

 

উগ্রপন্থী কার্যকলাপে সাহায্য করার জন্য আজ দুদিন হলো আমি লকাপে বন্দী আছি।  নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। তবে এখনো আমার গায় হাত তোলেনি। তার কারণ আমার মোবাইল, যেটা ওরা বাজেয়াপ্ত করে ঘেঁটে ঘুঁটে দেখেছে কিছু্ই নেই আছে শুধু কবিতা,গল্প,আর নিজের তোলা পশু, পাখি, কীট পতঙ্গের ছবি । হয়তো তার জন্যই গায় হাত তোলেনি। আজ বিকালে আমার স্ত্রী একটা চিঠি থানার বড় বাবুকে দিয়েছে। চিঠিটি আজই আমার নামে এসেছে। আর পাঠিয়েছে সেই কল্পনা। হ্যাঁ ও আমাদের পাড়ার ভাড়াটিয়া। প্রায় এক বছর ধরে আছে। ও আমার ভালো বন্ধু ফোনে প্রায়ই কথা হয় লেখালেখি নিয়ে। ও আমার লেখার খূবই ভক্ত। চিঠিটি বড় বাবু পড়ে আমাকে পড়তে দিয়ে বললেন। কাল রবিবার হলি চাইল্ডের ম্যডাম আর সেই BSF জাওয়ান আসছে ওনাদের জবানই আপনাকে মুক্ত করতে পারবে ।

কল্পনার লেখা চিঠি আমাকে —–
প্রিয় বিভূতি বাবু ।
এটাকে চিঠি না বলে আমার জীবন কাহিনী বলতে পারেন । আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম । আমার মা লক্ষ্মী পূজা করতেন আর আমাদের ইস্কুলে “জন গণ মন” গান গাওয়া হতো এই দুটি কথাই মনে আছে। একদিন ইস্কুল থেকে ফেরার পথে রতন কাকার সঙ্গে দেখা। উনি বললেন আমার বাবা’ মা অসুস্থ আমাকে ওখানে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ওনার গাড়িতে উঠে চললাম বাবা মাকে দেখতে। গাড়ির ভিতরে দুই তিন জন লোক ছিল তাদের লম্বা লম্বা দাড়ি। চোখগুলো দেখলে ভয় ভয় করে। একটি ফাঁকা যায়গাতে এসে গাড়ি দাঁড়াল। আশে পাশের অনেক লোকজনের ভিড়। ভিতরে গিয়ে দেখি চার পাঁচজনের দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে । ওরা মৃত দেহ দেখিয়ে বলল এটা তোমার বাবা এটা তোমার মা ওটা দাদা । তোমাকে ছাড়া সবাইকে ভারতের সেনাবাহিনী গুলী করে মেরে ফেলেছে।আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। তখন একটা দাড়িওয়ালা লোক এসে বলল তুমি আমার কাছে থেকে পড়াশুনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে ।

প্লেনে করে কোথায় যে নিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। বিরাট বড়ো ইস্কুলের মতো। আমার মতো অনেক ছেলে মেয়ে আছে। ছোট থেকে বড় সব রকম। দু একদিন বসে বসে ঘুরে ঘুরেই কাটালাম। তার পর থেকে ক্লাস শুরু হলো। লম্বা লম্বা দাড়িওয়ালা লোকগুলো এসে ক্লাস নিত। ক্লাসের শুরুতেই বলতো তোমাদের সব আত্মীয় স্বজনদের ভারতীয় সেনারা গুলি করে মেরেছে। তার চরম প্রতিশোধ নিতে হবে। তোমরা তৈরি। সবাই তারস্বরে বলতো হ্যাঁ আমরা তৈরি প্রতিশোধ নেবার জন্য । তার পর শুরু হতো ক্লাস । পড়া শুনার সাথেসাথে প্রাকটিক্যাল করতে হতো, সাঁতার কটা, জাম্প দিয়ে দেয়াল পার হওয়া বছর দুই পর থেকে ড্রাইভিং শেখা , বন্ধুক চালানো ইত্যদি । শেষের বছর আমাকে ট্রেনিং দেওয়া হলো মানব বোমার। ট্রেনিং শেষে আমাকে পাঠানো হলো ভারতে “অপারেশন পেগনেন্ট” সফল করার জন্য। ভারতীয় সেনাবহিনীর উপর আক্রমণ করতে হবে। তাই আজ গর্ভবতী মহিলা সেজে চললাম ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে। পরের জন্মে আমি ভারতবর্ষে জন্মাতে চাই। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।
ইতি আপনার বন্ধু কল্পনা ।

পরের দিন BSF জাওয়ান ও হলি চাইল্ডের ম্যডাম এসে হাজির । আমদের তিনজনকে একটা ঘরে নিয়ে বসালো । ম্যডামকে ঘটনার বিবরণ দিতে বললেন —–
উনি বললেন গুটি কয় ছাত্র ছাত্রী আর আমি আটকে পড়েছিলাম হঠাৎ বাস হরতাল হয়ে যাবার জন্যে। তাই সেনাবাহিনীর গাড়ি যাচ্ছ দেখে সাহায্য চেয়ে ওদের গাড়িতে উঠে পড়ি । বাগমোড়ে আসতেই এক গর্ভবতী মহিলা সাহায্য চাইল হসপিটালে যাবার জন্য। মহিলা গাড়িতে উঠতেই আমি যায়গা ছেড়ে দিলাম বসার জন্য। ওর পাশেই দুজন বাচ্ছা এক ছিঁটে বসে ছিল। একজন আপন মনে গুণ গুণ করে গান করছে “জন গণ মন অধিনায়কও জয়ও হে” অন্য বাচ্চাটি মহিলাকে বলছে আন্টি কাল আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মী পূজা তুমি প্রসাদ খেতে এসো। মহিলাটি যেন শক্ত কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। আমি ভাবলাম ওর বোধ হয় সময় হয়ে গেছে। ড্রাইভারকে জোড়ে গাড়ি চালাতে বললাম। হঠাৎ মহিলাটি চিৎকার করে বলল এটা তো আমার দেশ এটা তো আমার দেশ বলেই দরজা খুলে নিচে ঝাঁপ দিলো। বিকট শব্দে আমাদের গাড়িটি কেঁপে উঠল। কিছুদূর গিয়ে গাড়িটি থেমে গেলো। আমরা অল্প বিস্তর অনেকেই আঘাত পেয়েছি। ঘটনাস্থলে এসে দেখি মহিলা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

সমস্ত কথাগুলি রেকর্ড করা হলো এবং সাদা কাগজে লিখে আমরা তিনজনে সই করলাম। কাল কোর্টে উঠবে কেস। আজ সোমবার দুপুর একটায় রায় বেরোল আমি বেকসুর খালাস পেলাম।

Loading

Leave A Comment