সন্ন্যাসী তান্ত্রিক ও ভূত
-সৌমেন সরকার
প্রায় বছরখানেক পর নিতাই পণ্ডিতের সাথে দেখা হল।
সবার আগে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার।নিতাইদের পদবি কিন্তু পণ্ডিত নয়,ওরা অধিকারী।আসলে ওর বাবা নিমাই বাবু মহারাজ ব্যক্তি বলে সবাই পণ্ডিত উপাধি দিয়েছে। তাই আমিও নিতাই পণ্ডিত বলে ডাকি।
এবার ওর আমাদের বাড়ীতে আসার কারণটা সম্পূর্ণ আলাদা যা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এসেই খাটের ওপর থপাস করে বসে পড়ে কোন ভূমিকা না করে বলল-“আমার ছোট মাসিকে চিনিস তো?”
আমি বললাম-“হ্যাঁ,ওই শুভররত্নপুর না জাঙ্গিপুর কোথায় যেন বাড়ী। নাম তো টুয়া। কেন কি হয়েছে ওর?”
-“সি ইজ পোজেজড্।”
শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ হবার জোগাড়! ওর কথার অর্থ হল এই যে,ওর টুয়া মাসিকে কোন এক প্রেতাত্মা নিজের বশে করে নিয়েছে। ওর পরবর্তী খবরটা শুনে আমি তড়াক করে ওর পাশে খাটের ওপর বসে পড়লাম। ওর মাসির ঘাড় থেকে ভূত নামাতে স্বয়ং সন্ন্যাসী তান্ত্রিক আসছেন!
আমি বললাম-“এই দাঁড়া দাঁড়া। তোর বাবা বলেছিল সেই জিনের ঘটনার পর থেকে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক নাকি বেপাত্তা হয়েগিয়েছিলেন। তাহলে ভদ্রলোক এখন হঠাৎ করে উদয়,হলেন কি করে?”
-“তা ছাই আমিও জানিনা। পরে শুনে নেব।”
আরও ভালো খবর পেলাম এই যে তিনি অম্বিকাপুরে জমি কিনে পাকাপাকি ভাবে ওখানেই বাস করছেন।ওদেশে আর যাবেননা। নিতাই বলল-
“মাসির ঘাড় থেকে ভূত হোক আর পেত্নী-শাঁকচুন্নী যাই হোক না কেন কান ধরে নামাবেন সন্ন্যাসী তান্ত্রিক।আমাদের সবারই ইচ্ছা আমাদের সাথে তুইও চল ওখানে।”
শুধু লেখক বা ওর বন্ধু বলে নয়,নিমাই বাবুর মতে আমার মন অতি পবিত্র,ঈর্ষা-বিদ্বেষহীন। তাই আমি থাকলে নাকি খুব ভাল হয়।
এসব কথা আমার মাথার প্রায় ওপর দিয়েই বেরিয়ে গেল। কি সব যাতা বলছে নিতাই! কোন কিছু অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে শুধুমাত্র অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মত্ত হয়ে তখনই হ্যাঁ বলে দিলাম। আমার পরিবার কখনও আমার কোন কাজে বাঁধা দান করেনা। পরদিন সকালেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
মিনিট তিরিশ মত লাগল যেতে। যখন পৌঁছলাম তখন সকাল দশটার বেশী বেজে গেছে। সময়টা পূজোর কিছু পর,সম্ভবতঃ কার্ত্তিক মাস। তাই শীত তখনও পড়েনি।নিতাই সকলের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিল।তারপর নিমাই বাবু যখন জানালেন যে আমার মধ্যে শুভ শক্তিকণা বর্তমান তখন সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ওর মামাবাড়িতে দুই মামা,দুই মামী,এক ভাই,এক দিদি,দিদিমা-দাদু আর ছোট মাসি আছে।সন্ন্যাসী তান্ত্রিক তখনও এসে পৌঁছাননি। শুনলাম ছোট মামা তাকে আনতে অম্বিকাপুরে গেছেন। নিমাই বাবু অবশ্য কাল বিকালেই চলে এসেছেন। তখন আমি টুয়া মাসিকে একটু দেখতে চাইলাম। নিমাই বাবু বারণ করে বললেন-
“আগে স্নান করে গঙ্গাজল ছিটিয়ে পবিত্র হয়ে এস।তারপর আমি মন্ত্র পাঠ করে তোমার গাত্রবন্ধন করে দেব। সাথে বাড়ীর সবার। তখন যেও দেখা করতে। আর দুষ্টু আত্মা সবসময় ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজবে।কিন্তু আমি কখনই তা হতে দিতে পারিনা। খুড়ো না আসা পর্যন্ত সবার দায়িত্ব আমার ওপর।”
সবটা না বুঝলেও খানিকটা পেরেছি এমন ভাব করে স্নানে গেলাম যদিও আমার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা কি সব হচ্ছে এখানে। স্নান সেরে এসে দেখি নিতাই আর পরিবারের সবাই স্নান সেরে এক্কেবারে রেডি।
ওদের তিনতলা বিরাট সাবেকি আমলের বাড়ী।একতলার উঃ পূঃ দিকের একটা ঘর খুললেন নিমাই বাবু। জানালেন কাল তিনি টুয়া মাসিকে মন্ত্র পড়ে বন্ধন করিয়ে ওই ঘরে আটকে বেঁধে রেখে গেছেন। একটা বিরাট যান্তব ক্যঁ-অ্যা-অ্যা-চ শব্দ করে দরজাটা খুলতে বুকের ভিতরটা কেন জানিনা নিজের অজান্তেই ধড়াস্ করে উঠল! খুট্ করে একটা শব্দে ঘরের সি.এল জ্বলে উঠল। দেখি একটা বড় খাটের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে খাটের একপাশে কারুকাজ করা অংশে হেলান দিয়ে বসে আছে টুয়া মাসি। দুটো হাত আর দুটো পা টেনে খাটের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে টেনে বাঁধা রয়েছে যাতে কোন অঘটন ঘটাতে না পারে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। যদি সত্যিই টুয়া মাসি পোজেজড্ হয় তবে এসব করে কি কোন ফল হবে! মাথাটা সামনের দিকে বুকের ওপর ঝুকে পড়া।আর মাথার বন্ধনহীন এলোমেলো চুলের রাশি সামনের দিকে খাট পর্যন্ত ঝুলছে। তাই মুখ দেখা সম্ভব হয়নি তখন। তবে মাঝে মাঝেই একটা মরা পঁচা ভ্যাপসা গন্ধ পাচ্ছিলাম। আর একটা মৃদু গোঙানির মত আওয়াজ। গন্ধের উৎস না বুঝতে পারলেও গোঙানি যে টুয়া মাসির গলা থেকেই বেরোচ্ছে তা আমি নিশ্চিত।
মুখটা তখন দেখা সম্ভব হয়নি। মিনিট পাঁচেক পরে তার মুখের গোঙানি হুঙ্কারের রূপান্তরিত হয়ে উঠল। দেখে ভয়ে বুকের সব সাহস নিমেষে যেন শুকিয়ে গেল আমার। ধীরে ধীরে মুখটা তুলল মাসি। সে মুখ কোন মানবীর নয়,কেন নরকের কীট যেন। ঠোঁট ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। গলগল করে রক্ত ঝরছে। অবাক হয়ে দেখি জিভ দিয়ে সেই রক্ত চেটে চেটে খাচ্ছে টুয়া মাসি।চোখের তলায় কালীর মত গভীর অমাবস্যার চিহ্ন। পুরো মুখটা দুমড়ে মুচড়ে কুঁকড়ে গিয়েছে। হঠাৎ টুয়া মাসি তীব্র হুঙ্কার ছেড়ে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল-
“শয়তান! নরকের কীট! যাব না,আমি কিছুতেই যাবনা।মরবি,তোরা সব্বাই মরবি।যতই ঝাড়ফুঁক করিস না কেন আমাকে তাড়াতে পারবি না। আমি তোর মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবই। হা হা হা…”
সে কি অমানুষিক বিকট আওয়াজ! এর আগে আমি কখনও কোনদিন মনুষ্য কণ্ঠে এমন আওয়াজ শুনিনি।শুনলে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। হাতে চাপ পড়তে তাকিয়ে দেখি নিতাই জোরে আমার হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। ওর মুখ মৃত মানুষের মত অসম্ভব ফ্যাকাশে!
ওদিকে নিমাই বাবু অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করেছেন। মন্ত্র পাঠ করতে করতে পকেট থেকে একটা রুদ্রাক্ষমালা হাতে পেঁচিয়ে পরে নিলেন এবং তা মুঠো করে ধরে দুর্বোধ্য ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে দরজায় তিনবার বদ্ধ মুষ্ঠি দিয়ে আঘাত করলেন,তবে কিছু সময় অন্তর। প্রথমবার আঘাত করার পর মাসির মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা দিল। টুয়া মাসি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। দ্বিতীয় বার আঘাত করতেই চার হাত পা দিয়ে দেহটাকে যথা সম্ভব কুঁকড়ে চক্রাসনের ভঙ্গিতে নিজেকে তুলে ধরতে লাগল। বুকটাকে যতটা সম্ভব খাট থেকে শূন্যের দিকে তুলতে লাগল। আর তৃতীয়বার আঘাত করতেই দেহটা হঠাৎ নিষ্পন্দ হয়ে খাটের ওপর হাত পা ছড়িয়ে লুটিয়ে পড়ে গেল। তবে শেষবার করাঘাত করার সময় অকথ্য ভাষায় নিমাই বাবুকে আবার গালিগালাজ দিতে শুনলাম-
“শালা বেভুষ্যে আত্মা,আমাকে ভয় দেখানো! এবার বোঝ মজা! সন্ন্যাসী তান্ত্রিককে আসতে দে,তোর সব রস মিটিয়ে দেবে দেখিস। তুই ছাড়বিনা তোর ঘাড় ছাড়বে। শয়তান আত্মা নরকের কীট কোথাকার!”
আত্মাটা আসলে কার সেটা বোঝা কিন্তু সম্ভব হল না।সন্ন্যাসী তান্ত্রিক না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।টুয়া মাসি বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। খারাপ লাগলেও সেদিকে যাওয়ার সাহস কারো হল না। নিমাই বাবাজীর নির্দেশ মত সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।তিনিও তারের ঘরের ছিটকিনি তুলে তালা লাগিয়ে ঘর বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন। দুপুরবেলা নামমাত্র খাওয়াদাওয়া হল সবার। ঠিক বেলা তিনটে নাগাদ ছোটমামা সন্ন্যাসী তান্ত্রিককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ী ঢুকলেন।বাড়ীতে ঢুকলেন বললে ভুল হবে। কারণ ঢোকার সময় গেটের মুখে হঠাৎই তিনি কি একটা ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাড়ীর ভিটের সীমানা অর্থাৎ প্রবেশদ্বার থেকে চার আঙুল দূরে বাম পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল তুলে সেটাকে আড়াল করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাম হাতের তেলো বুকের কাছে উত্থিত ভঙ্গিতে ঠেকানো আর ডান হাত মুঠো করে বুড়ো আঙুল খুলে ওপর দিকে রেখে তেলোর ওপর বসানো।
মিনিট দশেক মত এভাবেই কোন ভাবলেশহীন হয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন বহু প্রশংসিত সন্ন্যাসী তান্ত্রিক। সেই সুযোগে আমি তাঁর আপাদমস্তক সম্পূর্ণ ভাবে নিরীক্ষা করে নিলাম।
দেখলাম নিমাই বাবু ভুল কিছু বলেননি তার সম্পর্কে।উচ্চতা ছয় ফুটের বেশী ছাড়া কম হবেনা।ফর্সা;সুদর্শন,সুদৃঢ় ও সুগঠিত শরীর। প্রায় ষাটের কাছে বয়স তা কেউ বিশ্বাস করবে না। এই বয়সেও দারুণ পেশল চেহারা। বড় বড় চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে কিন্তু জটাধারী নন। গোঁফ-দাঁড়ির জঙ্গল থাকলেও তা নিয়মিতভাবে ছাঁটা। পরনে কালো আলখাল্লা পোশাক।কোমরে ওড়নার মত কাপড় টেনে জড়িয়ে শক্ত করে বাঁধা। কপাল ঘিরে একটা কালো কাপড়ের টুকরো জড়িয়ে বাঁধা। গলায় ও দুহাতের কব্জিতে রুদ্রাক্ষের মালা। কাঁধে কালো রঙের একটা বড় ঝোলা।
এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর দেখি বাম হাত উল্টো করে ধরে হাতের বুড়ো আঙুলটা বুকের নীচে যেখানে কড়া নামে ওখানে ঠেকালেন। ডান হাত ওপরে তুলে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নাক ও চোখের সংযোগস্থলে মৃদু চাপ দিলেন। বাকি আঙুলগুলো শূন্যে প্রসারিত। ডান পায়ের পাতা বাম পায়ের গোড়ালির কিছুটা ওপরের অংশে ঠেকিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে কিসব মন্ত্র পাঠ করতে লাগলের যার এক বর্ণও কেউ বুঝতে পারলাম না। মিনিট খানেক পর হঠাৎ মৃদু কাঁপুনি দিয়ে দু-পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। হাত পা ততক্ষণে ছেড়ে স্বাভাবিক করে নিয়েছেন। ছোটমামা হাত বাড়িয়ে ধরার আগে তিনি অবশ্য নিজেকে সামলে নিলেন। ডান হাত তুলে তাকে বারণ করলেন। তারপর বললেন-
“সর্বনাশ ছোটবাবু! এ যে সাক্ষাৎ শয়তানীতে ধরেছে তোমার বোনকে! নিমাই বুদ্ধি করে ভিটে বাড়ী আর সকলের গাত্রবন্ধন করে দিয়েছে বলে রক্ষে। নাহলে ভীষণরকম ভয়ঙ্কর কিছু একটা সাংঘাতিক বিপদ ঘটতে পারত।”
তারপর আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটু মৃদু হেসে বললেন-“একে এনে ভালোই করেছিস নিমাই।এ যে সাক্ষাৎ শুভ শক্তিরূপ কণিকা। এ সঙ্গে থাকলে ওই শয়তানী তেমন কেন বড় বিপদ ঘটাতে পারবে না।”
আমি তো অবাক। তখন সন্ন্যাসী তান্ত্রিক আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন-
“ভয় পাবে না তো খোকাবাবু? নাম কি তোমার?”
-“সৌম্য,মানে সৌম্যজিৎ সরকার। আর আমি ভয় পেলে কি এখানে আসতাম নাকি!”
-“চল তবে,আমরা ভিতরে যাই। দেখি কতটা কি করতে পারি।”
উনি বাড়ীতে এসে সবার আগে ছোট মামার গাত্রবন্ধন করে দিলেন। তারপর সকলের আত্মশুদ্ধি করলেন।তারপর যাওয়া হল টুয়া মাসির ঘরে। বাড়ীর মহিলাদের ওঘরে যেতে বারণ করলেন তিনি। তাছাড়া যারা সাহসী পুরুষ কেবল তাদেরকেই সঙ্গে যেতে বললেন।আমি,নিতাই,ছোটমামার ছেলে বছর পনেরো ষোলোর সায়ন,দুই মামা,আর নিমাই বাবু ছাড়া কেউই সাহস করে ঘরে ঢুকতে পারল না। অবশ্য অনেকেই টুয়া মাসির ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। যদি কোন প্রয়োজন হয় তাহলে সাহায্য করবেন তাই। তিনি আরও পরিষ্কার করে বললেন যে- “টুয়ার ঘাড়ে চেপে থাকা শয়তানী প্রেতাত্মা রোশের মুখে বাড়ীর অন্য কোন মহিলার ক্ষতি করতে পারে। তাই সকলে যেন চুল খুলে বসবেন না। ভাল করে চুল বেঁধে মাথায় ঘোমটা টেনে বসবে।”
নিমাই বাবু বললেন- “আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা।ওঘরের ভিতর প্রবেশের পূর্বে তা বলা দরকার। যদি ভয় লাগে বা ভয়ের কোন ঘটনা ঘটে তবে যেন কেউ পালানোর চেষ্টা করবে না। ওখানেই চোখ-মুখ বুজে বসে পড়বে। ভূত নামানো বা ঝাড়ানোর সময় ঘরের গণ্ডীর বাইরে বের হওয়া মানেই মহাবিপদ! সাক্ষাৎ মৃত্যু!”
-“ঘরের গণ্ডী মানে? কোথাও তো কোন…”
আমরা প্রশ্ন করে উঠলাম একসাথে। উত্তরে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক শুধু মৃদু হেসে বললেন-“ভুতরে চল,দেখ কি করি। সবই বুঝতে পারবে।”
দুরুদুরু বক্ষে সকলে প্রবেশ করলাম। নিতাই বেশ জোরের সঙ্গেই আমার বাম হাত চেপে ধরেছে। সায়নের বয়স আমাদের থেকে অনেক কম হলেও সাহস যে আমাদের থেকে অনেক বেশী তা বলতে কোন লজ্জা নেই। বাপকা ব্যাটা আর কি। সে একাই বাবার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে নিমাই বাবু আর সন্ন্যাসী তান্ত্রিককে সাহায্য করছে। বড় মামাবাবু কিন্তু বেশ ভীতু। ঘরে ঢুকেই সন্ন্যাসী তান্ত্রিক চৌকাঠের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এবার দুহাত মুঠো করে কেবলমাত্র তর্জনী খুলে তর্জনী দুটিকে কপালের দুপাশে সেনসেটিভ্ জায়গা দুটিতে চাপ দিলেন। আর একপাশে দাঁড়ালেন ঠিক বাড়ীতে ঢোকার মুখে যেমন ভঙ্গীতে ছিলেন। মুখে কিসব দুর্বোধ্য ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। মন্ত্র পাঠের উচ্চারণ যত তীব্র হচ্ছে ততই টুয়া মাসির দাপাদাপি,গালিগালাজ,হুঙ্কার বাড়তে লাগল। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক বললেন-
“এবার কুমকুম আর হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে একটা পাত্রে রেখে তাতে কিছুটা সরষে আর লঙ্কার গুঁড়ো মেশাও। তারপর বাড়ীর কর্তাকে ডাকো।”
দাদু ভয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে প্রবেশ করলেন।টুয়া মাসি তাকেও গালিগালাজ করে হাসতে লাগল। দাদু তো ভয়ে সিঁধিয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক বললেন-
“ভয় নেই আপনার। ও আবদ্ধ হয়ে আছে।চেঁচামেচি,গালিগালাজ ছাড়া ওর কোন ক্ষমতাই নেই।”
এবার দাদুর হাতে মিশ্রনের পাত্র দিয়ে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক তাকে বললেন- “ঘরের গণ্ডী কাটব এবার। আপনি এই মিশ্রণ দিয়ে খাটের চারিদিকে একটা গণ্ডী কাটুন। আমি মন্ত্র বলতে বলতে আপনাকে স্পর্শ করে থাকব। এটা বাড়ীর কর্তাকেই করতে হবে।”
দাদু গণ্ডী কাটছেন আর তাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করছে টুয়া মাসি অকথ্য ভাষায়। এমন সময় দেখি সন্ন্যাসী তান্ত্রিক তার ঝোলা থেকে একমুঠো লাল কিসের একটা গুঁড়ো নিয়ে চোখ বুজে কপালে ধরে মন্ত্র বলে ছুঁড়ে দিলেন মাসির দিকে। ভীষণ একটা আর্তনাদ করে মাসি নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়ল খাটে।তান্ত্রিক বললেন- “মন্ত্রপূত সিঁদুর ছুঁড়ে কিছুক্ষণের জন্য ওকে অজ্ঞান করে রেখেছি। এর মধ্যেই আমাদেরকে সব কাজ সেরে ফেলতে হবে। নিমাই,তুই এবার পাত্রের বাকি অংশ দিয়ে ঘরের ভিতর একটা গণ্ডী কেটে ফেল।ওর মধ্যে ঘরের সবাই থাকবে। কোন মতে ওর বাইরে যাবে না।”
নিমাই বাবু তাই করলেন। তান্ত্রিকের কপালের লাল তিলকটা এবার যেন আরও বেশী জ্বলজ্বল করে উঠল।ভয়ঙ্কর কোন দুর্যোগের ইঙ্গিত পেলাম বলে বুকটা হঠাৎ ধড়াস্ করে উঠল। গণ্ডী কাটা শেষ হলে ঝোলা থেকে একটা আসন বার করে খাটের চারিপাশ জুড়ে টানা প্রথম গণ্ডীর মধ্যে আসন পেতে বসলেন তিনি।
এবার নিমাই বাবু বাদে বাকী সবাই আমরা প্রথম গণ্ডীর বাইরে কিন্তু দ্বিতীয় গণ্ডীর ভিতরে রইলাম। তিনি টুয়া মাসির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
সন্ন্যাসী তান্ত্রিক প্রথম বৃত্তের মধ্যে প্রথমে গোল করে বালি ছড়িয়ে তার ওপর বেলকাঠ সাজিয়ে,ছোট যজ্ঞের বেদী তৈরী করলেন। তাতে আগুন ধরিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে ঘি ঢালতে লাগলেন তিনি। যজ্ঞের সামনে সেই আগের হলুদ ও সিঁদুর মেশান গুঁড়ো দিয়ে একটা চতুর্ভুজ আঁকলেন। তার আগে তার সাথে আরও একটু সিঁদুর মিশিয়ে নিয়েছেন। তারপর চতুর্ভূজের মধ্য একটা তারা চিহ্ন আঁকলেন। ঝোলা থেকে একটা মাটির পুতুল বার করে তারার মাঝখানে শুইয়ে রাখলেন। পুতুলটি একটা নারী মূর্তির। মূর্তিটাকে ঘিরে একটা জবা ফুলের ছোট মালা রাখলেন ঠিক বেড়া দেওয়ার মত। মন্ত্র পাঠ করতে করতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন মূর্তিতে। একটা ছোট বেতের লাঠি ঝোলা থেকে বার করে ওটার গায়ে মৃদু আঘাত করতেই টুয়া মাসি চেঁচিয়ে উঠল। তান্ত্রিক চেঁচিয়ে উঠল-“বল কে তুই? কেন এসেছিস ওর দেহে?কি চাস? কি করেই বা এলি? সব সবকিছু শুনব।আমাকে সব বলবি।”
ওদিকে বাজখাঁই কণ্ঠে উত্তর এল-“ভাগ শালা! তুই কিছুই করতে পারবি না। আমি ছাড়ব না,ছাড়ব না ওকে। আর কিছুই বলব না। ভাগ ভাগ শালা এখান থেকে।”
একথা বলেই ‘ওয়াক্ থু’ করে এক খাবলা থুতু সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের দিকে ছুঁড়ে দিল। ততক্ষণে গতিক সুবিধার নয় বুঝতে পেরে আগে থেকেই একটা সরা হাতের কাছে রেখেছিলেন। ওটাকেই সামনে এনে বর্মের মত ব্যবহার করলেন। ফলে থুতু গিয়ে পড়ল তাতে। দেখলাম থুতু নয়,জমাঁট বাঁধা একতাল টাটকা রক্ত।এবার টুয়া মাসিকে দেখলাম ভাল করে। আশ্চর্যরকম সুন্দরী তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনকার অবস্থা খুবই শোচনীয়। চোখের নীচে ও ওপরে কালো কালির মত গাঢ় প্রলেপ পড়েছে। ঠোঁট ও সারা মুখ আশ্চর্যরকম ফ্যাকাশে ও গ্রীষ্মের খরার মত ফুটিফাটা হয়ে গেছে।সেই ফুটিফাটা স্থানগুলো থেকে খানিকটা রক্ত ও মাঝে মাঝে কসও ঝরছে। তখন সন্ন্যাসী তান্ত্রিক একটা কাজ করলেন যা আমাদের সবাইকে অবাক করে দিল। গর্জে উঠলেন-“দাঁড়া মাগী! এবার তোর পিণ্ডি চটকাচ্ছি!”
এই বলে সেই রক্তমাখা সরার ওপর যজ্ঞ থেকে কিছু জ্বলন্ত কাঠ তুলে রাখলেন। কর্পূর দিলেন আর মন্ত্র বলতে বলতে ঘি ঢালতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর ঝোলা থেকে একটা মস্ত বড় সূঁচ বার করে মন্ত্র পাঠ করতে করতেই পুতুলটার পেটে ফুঁটিয়ে দিতে শুরু করলেন।ওদিকে টুয়া মাসি তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল।বলল-“ওরে আর মারিস না,আর মারিস না। বলছি বলছি,আমি সব খুলে বলছি।”
-“বল শিগগির। নইলে এই পুতুলটা যজ্ঞের আগুনে ফেলে…”
-“আমি সব বলছি তো…করবেন না আমার এতবড় ক্ষতি। আমি চলে যাব কথা দিচ্ছি।
আমি প্রমীলা সেন,বাড়ী মাঝের গ্রাম। এই সুন্দরী মেয়েটা কোলকাতার আর.জি.কর হাসপাতালে কোন রুগীকে দেখতে গিয়েছিল হয়তো। আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিলাম। ও সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল আর স্ট্রেচারে করে আমার লাশ নামানো হচ্ছিল। আমার চোখ খোলা ছিল। চোখে চোখ পড়ল,ব্যাস্,ওকে বশে আনতে আমায় কোন বেগ পেতে হয়নি। একে ও কোন তাবিজ-মাদুলি ব্যবহার করত না। তার ওপর শনিবার অমাবস্যা ছিল।”
-“প্রথমে তো কেউ কিছুই বুঝতে পারেনি। তবে ধরল কি করতে তোকে?”
নিমাই বাবুর দিকে তাকিয়ে টুয়া মাসি;না টুয়া মাসি নয় প্রমীলা সেনের প্রেতাত্মা বলল- “ওই হারামজাদার জন্য ধরা পড়ে গেলাম। ভাবলাম সারা জীবন ওর ঘাড়ে বসে সুখে খাব। কিন্তু এই মেয়েটা নিরামিষ খেত,তা আমি জানতাম না। মেয়েটা আর ওই হারামজাদা একসাথে খাওয়াদাওয়া করত এখানে এলে। একদিন ওই হারামজাদা এলে আমি অন্যদের মাংসের পাত্র থেকে মাংস তুলে খেতে শুরু করতেই শালা ধরে ফেলল। কি সাহস আর বুদ্ধি ওর। প্রথমে কাউকে কিছু বুঝতেই দেয়নি। কারণ, মাংস খাওয়াটা ও শুধু একলাই দেখেছিল। সময় বুঝে আমি কিছু করার আগে সকলের দেহ বন্ধ করে দিল আর আমাকে বন্দী করে এখানে আটকে রাখল।”
-“বেশ করেছে। এবার পালা এর দেহ ছেড়ে।”
-“খেঁপেছিস নাকি শালা হতচ্ছাড়া তান্ত্রিকের বাচ্ছা!আমি পাগল নাকি যে এত সুন্দর শরীর ছেড়ে যাব!”
-“আমি জানতাম এমন কিছু একটা বলবি। আগে তো বললি চলে যাবি। তা যাবি যখন বলেছিস তখন চলে তোকে যেতেই হবে। আমার হাত থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না। তুই যাবিনা তোর বাপ যাবে শালী শয়তানী!”
এই বলে সরাতে জ্বলন্ত বেলকাঠের ওপর লঙ্কা আর সরষে ছড়িয়ে দিয়ে মন্ত্র পাঠ করতে করতে তাতে ঘি ঢালতে লাগলেন। পুতুলের গায়ে সূঁচটা পুরো ফুটিয়ে পুতুলটাকে যজ্ঞের আগুনের কাছে আনতেই প্রেতাত্মা আবার পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করে দিল। সাথে সাথে বেত দিয়ে একবার সরাতে আঘাত করছেন,আবার কখনও পুতুলে।
শেষে হার স্বীকার করল প্রমীলা সেনের শয়তানী প্রেতাত্মা। ওকে দিয়ে তিনসত্যি কাটিয়ে নিলেন তান্ত্রিক।তিনি বললেন-“তুই যে সত্যি সত্যি চলে যাবি তার কি প্রমাণ রেখে যাবি?”
-“ওই দূরের নিমগাছের মোটা ডাল ভেঙে দিয়ে যাব।”
-“আর শরীর ছেড়েছিস তার কি প্রমাণ রাখবি? জুতো নিবি? নাকি কলসী?”
-“কলসী দাও!”
-“যা,তোর আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে দেব।”
আমরা সবাই চক্ষু ছানাবড়া করে দেখলাম টুয়া মাসি অবলীলাক্রমে এককলসী জল দাঁতে করে নিয়ে উঠোনের এককোণ থেকে অন্য কোণে বয়ে নিয়ে গিয়ে কলসী সমেত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সেকেন্ড দশেক পর নিতাই এর মামা বাড়ী থেকে কিছুটা দূরে রেল লাইনের পাশের নিমগাছটার একটা প্রকাণ্ড মোটা ডাল মটমট করে ভেঙে পড়ল। অথচ কোথায় কোন ঝড়তুফান নেই। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক বললেন-
“ব্যাস্ আর কোন ভয়ের কারণ নেই। আমি মন্ত্রপূত কবচ করে দিয়ে যাব, বাম হাতে ধারন করতে হবে। আর গৃহবন্ধন করে দিয়ে যাব চিরদিনের জন্য। কারণ এদের দিয়ে কোনই ভরসা নেই। তবে আর কোনদিন কেউই কোনরকম ক্ষতি করতে পারবে না।”
সকলে ততক্ষণে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে সেবা শুশ্রূষা শুরু করে দিয়েছে। গ্রামের পরাশর ডাক্তারকেও খবর দিয়ে এল সায়ন। পরে জেনে অবাক হলাম যে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক কোনো দক্ষিণা গ্রহণ করেন না। নিঃস্বার্থভাবে এইসব অপদেবতাদের বিরুদ্ধে এইভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যান। আমার মন তার প্রতি শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায় ভরে উঠল। নিমাই বাবুকে ডেকে বললেন-
“চল্ নিমাই। তোর সাথে প্রয়োজন আছে।রাস্তায় যেতে যেতে কথা হবে।”