উমার পিতৃগৃহ গমন
-অমল দাস
আজ সকালে উমার সপরিবার বাবার বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় চলছে । সবে মাত্র ফুলিয়ার তাঁতের শাড়িটা কুঁচি দিয়ে কোমরে গুঁজে আঁচলটা কাঁধে ফেলেছে , ঠিক সেই সময় ফিরিঙ্গী ছুটতে ছুটতে এসে সামনে ঝুঁকে হাঁপাতে লাগলো। উমা এই অবস্থা দেখে জানতে চাইল ফিরু কি হয়েছে, এতো হাঁপাচ্ছিস যে ?
-মা সর্বনাশ হয়ে গেছে , তাড়াতাড়ি চলুন।
-আরে কি হয়েছে? সেটা তো বলবি আগে! আর কোথায় যাব, কেন যাব?
-মা কাতুকে (কার্ত্তিক) পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
-পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে! কেন? কি করেছে?
-মা , কাতু ময়ূর নিয়ে কলেজ ফেরত মেয়েদের সামনে রোমিও সেজে ইস্টাইল দিচ্ছিল।
-ও কি কারও শ্লীলতাহানি করেছে?
-না না মা! ওসব কিছু না! কাতু সুদর্শন পুরুষ তার উপর সে আইবুড়ো। আবার দেবসেনাপতি, প্রোফাইলটা কত মজবুত! মেয়েরা কল্পনাতেই লাট্টু খাবে। তারপর তো সশরীরে তাদের সামনে। কাতুকে দেখে মেয়েদের মধ্যে একটা উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল। তাদের কি উল্লাস!
-তাহলে পুলিশে তুলে নিলো কেন ?
-“বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনে” তুলে নিয়ে গেছে মা, ময়ূর ছিল না সঙ্গে তাই…। ওটা ওদের জাতীয় পশু।
উমা কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বলল- এই ব্যাপার! এতে অতো ভয় পাওয়ার কি ? এরা তো মানুষ সংরক্ষণ করতেই ব্যর্থ, পশু সংরক্ষণ করে কি করে? যে দেশে নর-সংহার করে মানুষ ক্ষমতায় বসে থাকে, পশু হত্যা করে ব্যবসা করে, কৃষ্ণ হরিণ শিকার করে বছরের পর বছর দিব্য কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কিছু হয় না! আর ও তো জ্যান্ত পাখি নিয়ে গেল। ওসব চিন্তা করে লাভ নেই! ও ঘরে সরস্বতী আছে ওকে নিয়ে থানায় যা, শান্ত মেয়ে বুদ্ধি আছে পুলিশের সাথে ভালো কথা বলতে পারবে। আমাকে আর বিরক্ত করিস না তৈরী হতে দে অনেক বেলা হয়ে গেল! প্রথম কথা গুলি জোড়ে বললেও শেষে মৃদু স্বরেই একটা উষ্মা প্রকাশ পেল -এদিকে পার্লারের মেয়েটা এখনো এলো না! ভ্রূ’টা, চুলের ডগাটা ঠিক করব ভাবলাম..!
কথাগুলি ফিরিঙ্গীর কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি -আচ্ছা মা আমি শীঘ্রই যাচ্ছি। এই বলে ফিরিঙ্গী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল।
সরস্বতী সেই সময় ঠাণ্ডা এসি ঘরে বুকের নিচে বালিশ রেখে পায়ের উপর পা দিয়ে কলম দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ডুবে আছে। পাশে মোবাইলে ফেসবুক খোলা , সেখানে পোষ্ট স্ট্যাটাসও দেখছে- কত লাইক, কত কমেন্ট । ফিরিঙ্গী ঘরে ঢুকেই দেখল সারা ঘরে কাগজের মণ্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । সে একটা একটা করে কুড়িয়ে ডাস্টবিনে রেখে ঘর সাফ করতে লাগলো , আর বললো সরু (সরস্বতী) প্রেমপত্র অনেক লিখেছো এবার থামো ঘর নোংরা হয়ে গেল যে।
সরস্বতী ঘুরে তাকিয়ে শান্ত সুরে বললো – এমন গুরজালি কথা আমাকে বলো না ফিরুদা ! আমি ওসব প্রেমপত্র-টত্র লিখি না আমার ভালো লাগে না। আর ফিরুদা তোমাকে কতবার বলেছি আমাকে সরু বলবে না, এটা ডায়েট কন্ট্রোল জিরো ফিগার। যা মগজে ঢোকে না তা নিয়ে কেন পরিহাস কর।
-ওসব কি আমার মগজে আসে সরু! তোমরা সকলে মিলে ফিরিঙ্গীরে ফিরু বানাইলে তাই আমিও সরস্বতী দিয়ে সরু করে দিলাম ভালোবেসে।
তারপর একটু থেমে আবার জানতে চাইলো -আচ্ছা বলো তো সারাদিন তাহলে কি লেখো এইসব কাগজে? ফেসবুকের দেওয়ালে!
-ওটা ফেসবুক ওয়াল বলে দেওয়াল নয়।
-ঐ হল তোমাদের ওয়াল আর আমাদের দেওয়াল তো একই। কি লেখো সেটা বলো!
-আমি যে কি লিখি তা তো তোমরা কি কেউ পড়েও দেখো? লেখার জগতে শিক্ষার জগতে একটা নাম হয়েছে আমার সেটাও কি জানো?
ফিরু উত্তর দিল- আচ্ছা ঠিকাছে রাগ করোনা! আজকের কাজটা করো, তারপর আমি পড়বো জানবো।
সরস্বতী একটু হতাশ হয়ে বলল -তুমি পড়বে আমি কাজ করলে? সেটা না বললেই নয় । কি কাজ আছে বলো পারলে করে দেবো।
-কাতুকে থানায় নিয়ে গেলো ওকে ছাড়িয়ে আনতে হবে চলো। একটু উদ্বিগ্ন সুরেই বললো।
– সেটা আমি পারবো না , ওখানে কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। আর আমি নেতা নেত্রীদের মত থানায় ঢুকে তাণ্ডব নৃত্য করতে পারবো না। তারচেয়ে বরং তুমি লক্ষ্মীর কাছে যাও! ওর থেকে টাকা নিয়ে থানায় যাও, দেখবে ছেড়ে দিয়েছে।
ফিরু এবার বিরক্ত সুরে -আবার লক্ষ্মীর কাছে যেতে বলছো ! ও বড় কৃপণ! অসহায় মানুষের জন্য ওর হাত খোলে না। তাও যাই দেখি কি হয়। এই বলে ফিরিঙ্গী লক্ষ্মীর ঘরের দিকে ছুটতে লাগলো।
এদিকে গণেশ বারান্দায় বসে পেট সামনে রেখে সকাল সকাল লাড্ডুর থালিতে ডুবে আছে । ফিরিঙ্গীকে ছুটতে দেখে গণেশ জিজ্ঞাস করলো এ ফিরুদা ছুটছো কেন? গাঁজার ধোঁয়ায় আগুন লাগে নি তো? কোন সমস্যা? আমি আসব?
-না ক্ষ্যান্ত দাও গণশা তোমার আর দরকার নেই। তুমি ভুঁড়ি নিয়ে ছুটতে পারবেনা , তারচেয়ে ভালো গ্যাঁট হয়ে বসে লাড্ডু খাও।
এ কথায় গণশা রাগ করে একটা লাড্ডু সজোরে ফিরুর পিঠে ছুঁড়ে মারল। জোরেই লেগেছে “উঁই মা” বলে কাতরাতে কাতরাতে ছুটল। কাঁদো কাঁদো সুরে বলল -ফিরে এসে দেখাচ্ছি মজা।
লাড্ডু পিঠে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। গণেশের অভুক্ত মূষিক এসে স্বাদে আহ্লাদে তা চেটে পুটে খেয়ে নিল। এমনিতে তো পায়না খেতে! এভাবেই যদি জোটে তার।
লক্ষ্মীর ঘরের দরজা খোলা। এদিকে লকার সিন্দুক সবই খোলা। টেবিলের কম্পিউটারে একাউন্টসে্র সফটওয়্যার খোলা রয়েছে দেখে মনে হল সমস্ত আর্থিক হিসাব-নিকেশের কাজ চলছে। কিন্তু যে কাজ করে সেই লক্ষ্মীর উপস্থিতিই নেই ঘরে! তবে গেলো কোথায়? শুরু হোল খোঁজ। এদিক সেদিক করে খোঁজ পাওয়া গেল না। ওদিকে থানায় যেতে দেরি হলে কাতুকে আদালতে নিয়ে যাবে, তার আগেই রফাদফা করতে হবে সেই চিন্তা মাথায়। হঠাৎ লক্ষ্মীর পেঁচাটি ফিরুর গায়ে এসে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গেল।
মাটি থেকে তুলে ফিরু তার গায়ের ধুলো ঝেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাস করলো – তুমি এখানে কি করছো ?
-আজ্ঞে কোষাগার পাহারা দিচ্ছি।
ফিরু অবাক হয়ে জানতে চাইল -দিনের বেলায় কোষাগার পাহারা ? তুমি তো চোখেই দেখে না।
-ঐ হল, অন্ধের দিন রাত, আর কি হবে!
– লক্ষ্মী কোথায় ?
সে অসহায় হয়ে বলল- আমি তো জানি না! এখানে থাকলে দিনের বেলায় অনুভব করি। তবে মাঝে মাঝে পুকুর পারের দিকে যায় ওদিকেই দেখো আর আমাকে একটু নিরাপদ স্থানে বসিয়ে যাও।
লক্ষ্মী তখন সুসজ্জিত কলা গাছ বেষ্টিত পুকুর ধারে সবুজ ঘাসের উপর আঁচল ছড়িয়ে বসে বসে হোয়াট্স আপে বন্ধুর পাঠানো ভিডিও ক্লিপ দেখছে আর একা একা হাসছে।
ফিরু গিয়ে পিছনে দাঁড়ালো, কিন্তু সে খেয়ালই করেনি। সে কানে হেড ফোন লাগিয়ে হেসেই যাচ্ছে আর মোবাইল স্ক্রিনে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
ফিরু লক্ষ্মীর মাথায় নাড়া দিয়ে বলল – কিছু টাকা লাগবে মেয়ে?
লক্ষ্মী রাগে গদগদ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল কি অসভ্যতামি ? মাথায় মারতে নেই জানো না ।
ফিরু অবাক হয়ে বলল -যা বাবা মারলাম কই? মোবাইল সমুদ্রে ডুবে আছো , আমাকে দেখনি! তাই মাথায় নাড়া দিলাম, হাতে-টাতে নাড়া দিলে কিনা হুলুস্থুল কাণ্ড হয়ে যায়!শরীরে হাত দিয়েছো কেন বলে?
লক্ষ্মী নাকের ডগা থেকে রাগ নামিয়ে ঠোঁটে রেখে বলল- ঠিক আছে! কি হয়েছে বলো কি দরকার? আমি কিন্তু নেশা-ভাঙের জন্য টাকা দিতে পারবো না আগেই বলে দি।
-না তা দিতে হবে না, সে ভোলেনাথ, আমরা নন্দী ফিরিঙ্গী ঠিক জোগাড় করে নিই।
-তাহলে কিসের জন্য টাকা লাগবে? বাজার-হাট তো হবে না! আমরা সবাই মামার বাড়ি যাচ্ছি আজ!
-কাতুকে পুলিশে ধরেছে তাকে ছাড়াতে হবে তাই! উত্তর দিলো ফিরু।
-কেন? কি হয়েছে? আর টাকা দিয়ে ছাড়ানো মানে তো ঘুষ! সেটা তো অন্যায়।
-ও এটা অন্যায় বুঝি? আর টাকা পয়সা ধন সম্পত্তির লোভে সবাই লক্ষ্মীর পূজো করে যখন ভেট চড়ায় সেটা ঘুষ নয় বুঝি ? সেটা অন্যায় নয়?
লক্ষ্মী বুঝলো এবার অন্য সুর উঠবে! তাই সে ফিরুকে থামিয়ে বললো ঠিক আছে! ঠিক আছে! সিন্দুক থেকে হাজার টাকা নিয়ে যাও, বেশি নেবে না কিন্তু!
ফিরু হতাশা প্রকাশ করে বললো -হাজারে হবে না! ওদের খেতে খেতে পেট বড় হয়ে গেছে, চক্ষুতে দিব্যদৃষ্টি আছে! কার কত কি আছে সব বোঝে, জানে। এই বলে সে ছুটে কোষাগারে এসে দশ হাজারের একটা বান্ডিল নিয়ে ছুটলো। যেতে যেতে বললো -যদি কমে রফা হয় বাকি ফেরত দিয়ে দেবো!
লক্ষ্মী তা শুনলো কিনা বোঝা গেল না , নারায়ানের ভিডিও কল এলো সে তাতেই মজে গেল সবুজ পুকুর ধারে দোলায় চড়ে। এদিকে কোষাগারে কেউ নেই যদিও চুরির ভয় নেই। এখানে কোন চোর ঢুকবে না। তবুও সাইবার ক্রাইমের যা উৎপাত, তাতে বাতাসের মাধ্যমেই কম্পিউটার হ্যাক করে একাউন্ট সাফ করে দিতে পারে গুণধরেরা।
উমার বাপের বাড়ি থেকে ব্রাহ্মণ এসেছে , উমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে । সে এসেই উমার তাঁতের শাড়ি দেখে জানতে চাইল- মা তুমি বালুচুরি–জামদানী-বেনারসী সব ছেড়ে সাধারণ তাঁতের শাড়ি পড়ে রাস্তায় বেরবে?
-ব্রাহ্মণ খুড়ো এই একটা দামী প্রশ্ন করেছো! শাড়ি যে পরবো আমাকে দেখার কেউ কি আছে ?
-সে কি কথা মা! তোমার আগমন নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর জুড়ে কতো উন্মাদনা! কত জৌলুস, কত আনন্দ! আর তুমি বল কিনা …….
কথা শেষ না হতেই উমা বলে ওঠে- আমাকে বা আমার পরিবারকে কেউ কি দেখতে আসে? সবাই তো প্যান্ডেল দেখতে আসে! কোথায় কোন প্যান্ডেল ভালো! কোথায় আলোকসজ্জা ভালো সেই সবই। আর একদল আসে সুন্দরী মেয়েদের ফ্রেম বন্দী করতে! আর সুন্দরীরা বেরোয় নানা রকম সাজ সজ্জা করে ফ্যাশান দেখাতে। কেউ কেউ সেলফিতে মজে থাকে! কেউ কেউ ঠেলাঠেলিতে মজা নিতে থাকে! এই সবের মধ্যে আমি কোথায়? আমাকে কে দেখে ভালো করে বলতো খুড়ো?
-তা ঠিকই বলেছ মা! কিন্তু তারপরেও তোমার আগমন নিয়েই তো উৎসব মুখর বাঙালীর সারাবছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। চারিদিকে আনন্দ উৎসব, জনসমাগম, প্রকৃতির এক সাজ সাজ নতুন রূপ ফুটে ওঠে ঐ এক শরতে। কত কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে তোমার আপ্যায়নের জন্য খরচ করা হয় তা তো অস্বীকার করার নয়!
– সত্যি কি আপ্যায়ন? না কি প্রতিহিংসার অহংকারের প্রতিযোগিতায় মাতে সবাই আমাকে নিয়ে? কে বড়ো মণ্ডপ সাজালো! কে প্রতিমা বড়ো বানাল, কে আলোক সজ্জায় রাঙাল কে কত কোটি খরচ করলো সেই নিয়েই তরজা। যেখানে সাবেকি পূজো সেখানে লোক সমাগম নেই, যেখানে বিশাল যাগযজ্ঞ সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই থাকেনা।
-কিন্তু সবই তো তোমাকে ঘিরে তোমাকে নিয়েই!
-আমি এসব চাই কিনা! কেউ কি আমায় জিজ্ঞাস করে? কত সাধারণ মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়! কই সব উদ্যোক্তারা মিলে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় চালু করতে পারে তো সমস্ত সুবিধা দিয়ে ? তা তো করেনা ! অথচ চিকিৎসার গাফিলতি হলে ভাঙচুরে মত্ত হয়ে ওঠে। আসলে এরা গঠনে নেই ধ্বংসে আছে।
– থাক মা ওসব কথা। তুমি ওদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো বেলা অনেক হল। আর বিলম্ব করে লাভ নেই। ওখানে গিয়ে কে কি খাবে তার একটা সম্ভাব্য তালিকা বলো, আমি লিখে নি! সেসব তো আবার মাকেই জোগাড় করে তোমাদের অর্পণ করতে হবে !
– বিশেষ কিছু তালিকা নেই ! তবে ফলগুলি কারো বাড়ির গাছ থেকে আনতে পারলে ভালো হয়! কারণ মোমের প্রলেপ–রঙ-কেমিক্যাল জড়ানো ফল দিও না, গেলো বার খুব অসুস্থ হয়েছি ফিরে এসে। ও হ্যাঁ ! জলটাও আর নদীর জল দিও না! সে জলের যা অবস্থা , তা গলায় যাবে না! তার চাইতে কারো বাড়ির সাবমার্শালের জল ধরে নিও প্রতিদিন।
ততক্ষণে কার্ত্তিক আর ফিরিঙ্গী এসে হাজির। মা পুরোহিতের সাথে কথা বলছে দেখে বলে ওঠে– সেকি তোমরা এখনো বেরোও নি? মাল বহনকারী ট্রেনের মত এতো ধীর গতিতে চললে কি করে হবে! অনেক বেলা হয়ে গেল তো! এর পর চড়া রোদে যেতে হবে! তাতে তোমার, তোমার দুই কন্যার ত্বক খারাপ হওয়ার ভয় আছে।
উমা রেগে লাল হয়ে এগিয়ে গেল- তবে রে দেখাচ্ছি মজা! আমরা লেট? এতক্ষণ ঢেই ঢেই করে কোথায় নেচে বেরাচ্ছিলি? সকাল সকাল থানা পুলিশ ঘুরে আমাকেই চোখ।
এদিকে লক্ষ্মী সরস্বতী দুজনেই তৈরি হয়ে হাজির। সরস্বতী দ্রুত মায়ের হাত ধরে বলল- ছেড়ে দাও মা, আজকের মত এই শুভদিনে গায়ে হাত দিও না ওর, তাহলে মামা বাড়ি গিয়ে সেখান রমণীদের লাল গাল দেখাবে কি করে?
লক্ষ্মী কোনরকম উৎসাহ না দেখিয়েই বললো- দশ হাজার নিয়ে গেছে দশই ফেরত চাই কোনো কথা শুনবো না ।
সাড়ে সাত হাজার ফেরত দিয়ে ফিরু বল- এই ফিরেছে ।
কার্ত্তিক বলল- আর পাঁচশো কই? গিলে নিলে? ওখানে তো দুই হাজার লাগলো!
ফিরিঙ্গী মাথা নিচু করে বললো- সকাল সকাল এতো পরিশ্রম করলাম তার পারিশ্রমিকও তো আছে! তাছাড়া ট্রাভেলিং বিল? গাড়ি নিয়ে গেলাম এলাম পেট্রলের যা দাম! এই বলে একটু মৌন থেকে দেখলো পিছনে গণেশ রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আছে। সে আর কোন কথা না বলে আস্তে আস্তে বাহিরের দিকে চলে গেলো। দূর থেকে একবার বলে গেলো- আপনারা বেরিয়ে পড়ুন মা, পথে আমি অসুরকে তৈরি হতে বলছি।
এদিকে পাঁচ সাতদিনের জামা কাপড় প্রসাধনীর সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে তাদের বেরোতে বেরতে আরো এক ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল। অসুর তখনও এসে পৌছায় নি। উমা চিন্তা করতে লাগলো পাগলা যদি না আসে তাহলেই হলো। গেল বারও অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিতে হয়েছে।
মায়ের চিন্তা দেখে গণশা বলে ওঠে- তুমি চিন্তা করোনা মা! চলো ও পেচু মাতালকে রাস্তায় তুলে নেবো, এখন চলো।
রাজপথের পাশেই একটি ধাবায় বসে আছে অসুর। তাকে দেখে কার্ত্তিক বলে ওঠে- ব্যাটাকে বেঁধে নিয়ে আসবো? ঐ দেখো এখানে বসে হাওয়া খাচ্ছে।
উমা কার্ত্তিককে থামিয়ে বললো- দাঁড়া আমি গিয়ে দেখি কি মতলব ওর।
উমা কাছে যেতেই অসুর বলে ওঠে- কোনো লাভ হবে না! আমি নেই তোমাদের নাটকে!
অসুরের মুখ দিয়ে তখন দেশী মদের গন্ধ বের হতে লাগলো।
উমা বললো- এই সকালেই তুমি মদ খেয়ে মাতলামি শুরু করলে, আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি চলো, আমার সাথেই চলো।
-না আমি যাবো না।
-কিন্তু কেন? কি হয়েছে?
-আমি যাব কেন বলো? ওখানে তুমি তোমার ছেলে মেয়েদের জয় জয়কার আমার কি?
-তোমার কি মানে? তোমাকে তার জন্য বেতন দেওয়া হয়, ভালো ভালো খাবার দেওয়া হয়।
-ছাই দেওয়া হয়। সমস্ত খাবারই তো তোমারদের উৎসর্গ করা হয়। বেচারা অসুর বুকে ত্রিশূল নিয়ে দিনের পর দিন যন্ত্রণা সয় তার দিকে কারো নজর নেই। উল্টে গালাগালি ফ্রী। আর বেতন! তাও সামান্য। ঐ বেতনে দিন মজুরের আজকাল চলে না দেবী, চলে না…। আমি যাব না.. অন্য কেউ দেখে নাও!
-ঠিক আছে রাগ করোনা! এবার চলো, তোমার বেতন বাড়িয়ে দেবো আর খাবার আমরা যা পাবো তোমাকেও দেবো।
মাতাল অসুর এবার মাথা দুবার নাড়িয়ে বলল- দেবো বললে হবেনা আমি আগে বেছে নেবো! তারপর তোমরা। আর বেতন কৃষি মূল্যের মত বাড়ালে চলবে না! দু’ দুটো পে কমিশনের মত বাড়িয়ে দিতে হবে।
মাতালের ব্যবহারে উমা নিরুপায় হয়ে বললো – খাবার না হয় মেনে নিলাম কিন্তু বেতন এতো চেয়ো না।
অসুর কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে নেশার ঘোরে কথা জড়িয়ে বললো- অতই লাগবে দক্ষিণার ভাগও দিতে হবে! আর হ্যাঁ আমার বুকে পা দেওয়া চলবে না! এতে আমার বুকের খাঁচায় ব্যথা হয় খুব। ত্রিশূল উপরে থাকবে শরীর বিদ্ধ করবে না! আর মহিষের মাথা কাঁটা যাবে না, এটা হিংস্রতার বার্তা দেয়, শিশু মনে এফেক্ট পড়ে। রক্তারক্তি একটা বিশ্রী ব্যাপার।এই গরু মহিষ কাটা নিয়ে অনেক কাণ্ড হয়ে গেলো দেশে! অস্ত্র সস্ত্র ত্যাগ করে শান্তির বার্তা দাও দেবী… শান্তির বার্তা দাও…। এই বলতে বলতে সে ধাবার খাটিয়ায় লুটিয়ে পড়লো।
উমা ভাবলো এতো মহা বিপদ! অসুর না গেলে তো পূজো সম্পূর্ণ হবে না, কিন্তু এটাকে সঙ্গে নিই কীভাবে। সে উদাস হয়ে গাড়ির দিকে তাকালো কার্তিক গণেশ যেন মায়ের ইশারা বুঝে গেল! ঝপাং করে গাড়ি থেকে নেমে অসুরকে চ্যাংদোলা করে গাড়ির ডিকিতে তুলে নিয়ে চলতে লাগলো। পথের দু’ ধারে তখন সাদা কাশফুল আগমনীর আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ফুর ফুর করে উড়ছে। সেই সময় আকাশবাণী হলো সাবধানে যেও , পারলে সেতু এড়িয়ে অন্য পথে যেও, ওগুলির কোনো ভরসা নেই! যখন তখন ভেঙে পড়তে পারে। ফিরেও তো আসতে হবে!