Site icon আলাপী মন

ইন্দুর অষ্টমী

ইন্দুর অষ্টমী
-পারমিতা চ্যাটার্জী

আজ এতদিন পর ইন্দুর মনে হল তার এবারের দূর্গাপুজাটা সার্থক হল। বিয়ে হয়েছে দু’বছর। স্বামী মলয় এমনিতে ভালোই, কিন্তু তার উদাসীনতা ইন্দুকে খুব কষ্ট দিত। মাইনে পেয়ে পুরো টাকাটা মা বাবার হাতে তুলে দিত।তাকে বলেছিল প্রথম রাতেই যে যা প্রয়োজন মায়ের কাছে বলতে। ইন্দু অবাক হয়েছিল এই কথা শুনে কিন্তু কোন প্রতিবাদ করেনি।
তার এই নিশ্চুপ মনোভাবে মলয় বরং আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল, তোমার কিছু বলার নেই?ইন্দু নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বলেছিল,’ প্রথম রাতেই দেওয়া নেওয়ায় কথা বলে আমি রাতটা নষ্ট করতে চাই না।’
ও, বলে মলয় চুপ করে গিয়েছিল। তারপর রাতটা ভালোই কেটেছিল।
কিন্তু প্রতিদিন সংসারের নানারকম কাজে শাশুড়ির মন্তব্যে সে অস্থির হয়ে উঠত। তার কোন কাজেই শাশুড়ি খুশি হতে পারেন না।
সে মাসে একবার কি দুবার বাপেরবড়ি যেতে চাইলেও শাশুড়ি নানারকম ছলে তাকে আটকে দিতেন। কিন্তু তাঁর নিজের মেয়ে প্রত্যেক শনি রবি নিয়ম করে বাপেরবড়ি আসত। তখন সারাদিনের পরিশ্রমে সে ক্লান্ত হয়ে পরতো, রাতে তার তপ্ত চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। তার নির্লিপ্ত স্বামী বলে কেঁদে কোন কিছুর সমাধান হয় না।
অভিমানে ইন্দু কেন উত্তর দেয়না।
প্রথম পুজোয় তার ননদ প্রায় পুরো পুজোটাই বাপেরবড়ি কাটায়, ইন্দু একদিনের জন্য বাপেরবড়ি যাওয়ায় বা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পায়না।এমন কি বোনাসের টাকা মলয় তার মায়ের হাতেই তুলে দেয়।ইন্দুর ভাগ্যে জোটে একটা সাধারণ মানের তাঁতের শাড়ি। তার ননদকে দেওয়া হয় কাঞ্জিভরম, শাশুড়ি নিজেও কেনেন দামী তসর। তখন থেকেই ওর মনে একটা প্রতিবাদের ঝড় উঠতে থাকে। তার বাপেরবড়ি থেকে ইন্দু এবং সবার জন্যেই তার বাবা মা নিয়ে আসে অত্যন্ত দামী সব শাড়ি নিয়ে, তার দাদা দিদিারাও দিয়ে যায় তাদের ভালো ভালো শাড়ি। সে কাউকে কিছু দিতে পারেনা, হীনমন্যতায় ভোগে।
দ্বিতীয় পুজোর অষ্টমীর সকালে ইন্দুর মা তাকে বিশেষ ভাবে আসতে বলে দেন। ওইদিন তার বাপেরবড়িতে বরাবর করুণাময়ীর কালি মন্দির থেকে ভোগ আনা হয়। অনেকেই আসেন ওই দিন ওর বাপেরবড়ি। ইন্দু সেদিন সকালবেলা বেশ জোরের সাথে সবার সামনে এসে বলে আজ আমি যাব। শাশুড়ি হুঙ্কার ছাড়েন, যাবো মানে? যাবো বললেই হল নাকি? জানোনা তোমার দিদিভাই পুজোর কটাদিন এখানে থাকে। তাছাড়া জামাই আছে, কত কাজ, আর তুমি বলছ যাবো!
ইন্দু আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকালো ।শাশুড়ি বললেন ওদিকে তাকিয়ে কোন লাভ হবেনা ও মায়ের বাধ্য ছেলে, মায়ের কথার অবাধ্য হতে ও শেখেনি।
ইন্দু হঠাৎ বলে উঠল, আমি তো আপনাদের আলোচনার সময় শুনেছিলাম জামাইবাবুর মা নাকি এবার একটা দিনের জন্য অন্তত বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। তাঁদের আত্মীয়স্বজন আসবে, দিদিভাইয়ের জেদের জন্যে উনি মায়ের কথা রাখতে পারেননি। আপনিও তার সাথে তাল দিয়ে বললেন, পুজোর সময় মেয়ে বাপেরবড়ি আসবে এটাই স্বভাবিক; তোমার মা এমন অন্যায় আব্দার করেন কি করে?
তাই আমিও ভাবছিলাম, জামাইবাবু কি করে মায়ের অবাধ্য হয়ে বউ নিয়ে চলে এলেন। উনিও তো তাহলে মায়ের খুব অবাধ্য!
আপনার ছেলে না যাক, আমি এবার যাবোই।
মলয় এতক্ষণ চুপ করে কাগজ পড়ছিল। সে কাগজটা হঠাৎ টেবিলের ওপর রেখে বলে উঠল, ‘সাবাশ ইন্দু,আমি এতদিন এই দিনটার অপেক্ষা করছিলাম কবে তুমি নিজের প্রতিবাদ নিজেই করবে। এতদিনে তুমি আমার মনের মতো কাজ করেছ। নাও তৈরী হয়ে নাও আমিই যাবো তোমাকে নিয়ে, সব অন্যায় সহ্য করে নেওয়া কোন কাজের কথা নয়। আর নিজের প্রতিবাদটা নিজেকেই করতে হয়, তোমার হয়ে আমি করলে আমার অবর্তমানে তোমার অপমান বাড়তো বই কম তো না।আর দেরী নয় চল।’
ইন্দু অবাক হয়ে তাকালো স্বামীর দিকে।অবাক হলেন তার বাবা, মা, দিদি, সবাই। শুধু জামাইবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন,’আমিও তোমাকে সাধুবাদ জানাই ইন্দু।আর মলয় তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল। এতদিন ভাবতাম তুমি আমার মতোই একজন মেরুদণ্ডহীন। কিন্তু আজ তুমি প্রমাণ করলে তোমার মধ্যে লুকিয়ে আছে আর একটা তুমি– যে প্রতিবাদ চায়।’
একটু পরে মলয়ের পছন্দ মতো সেজেগুজে ইন্দু মলয়ের হাত ধরে বেড়িয়ে গেল। শাশুড়ি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, তিনি হেরে গেলেন।আজ তারই আত্মজর কাছেে। জামাই বলল, ‘মা অধিকারবোধ দেখিয়ে জেতা যায়না, ভালোবাসা দিয়ে জিতে নিতে হয়। আপনি বা আপনার মেয়ে সেটা শেখেনই নি।’ মলয়ের গাড়ি নিউমার্কেটের দিকে ছুটছিল।
ইন্দু বলল,এদিকে কেন?
বাহ্ খালি হাতে যাবে নাকি? আজ তুমি প্রাণভরে কেনাকাটা কর। শুধু তোমার শাড়িটা আমি কিনব আমার পছন্দ মতো।
ইন্দু মুখ নীচু করে বলল– তুমি কিন্তু বেশ দুষ্টু আছো।
তাই বুঝি?
তাহলে আজ রাতে দুষ্টুমিটা কিন্তু একটু বেশি হবে বলে দিলাম।
-ইন্দু মলয়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল, তোমার যা ইচ্ছে। আমার পুজোর আনন্দ আজ তুমি সার্থক করলে। দূর্গা মায়ের এই বিশাল ঘরে অনেক দূর্গারা নীরবে কেঁদে চলে। আজ অন্তত একজন দূর্গা চোখের জল মুছে হেসে উঠেছে, সে হচ্ছে আমি।।

Exit mobile version