মাঙ্গলিক

মাঙ্গলিক

-অমল দাস 

 

 

পুত্রের বিয়ে উপলক্ষ্যে বিনয় সেন নিজে পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে পাত্রী দেখে ছিলেন। পাত্রী পছন্দ হতেই সেইমতো কন্যার পিতার নির্মল ঘোষের সঙ্গে আলাপ সম্পূর্ণ করে মহারম্ভরে বিয়ের আয়োজন করলেন।

   বিয়ের দিন সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হলেও ফুলশয্যার সন্ধ্যাকালে প্রচণ্ড বৃষ্টি  নেমে বসে। সে বৃষ্টি যেন থামবার নয়। কেউ কেউ  প্রকৃতির এই বিদ্রোহকে অশনি সঙ্কেত ভেবে বসেন। এরা কি ভাবে বুঝবে জানি না! টইটম্বুর আষাঢ়ে বৃষ্টিই তো হবে, আকাশ থেকে ফুল তো আর ঝরে পড়বে না!

  সন্ধ্যা আটটার সময় বৃষ্টি ক্ষান্ত হল। আরও একঘণ্টা বৃষ্টি হলে আশা করি গ্রামের সমস্ত কাঁচা বাড়ী ধুয়ে যেত। বৃষ্টি থামলে আত্মীয় সমাগম হতে থাকে। তবে যে পরিমাণ নিমন্ত্রিত তার সিংহভাগই আসেনি। আসবেই বা কি ভাবে? গ্রাম্য পথ বৃষ্টি হলেই একরাশ কাদায় পূর্ণ হয়ে উঠে। আর এর সাথেই গ্রাম্য পরিবেশের বিকশিত চিত্রও ফুটে ওঠে।

    আগন্তুকদের আপ্যায়ন সম্পূর্ণ হলে বাড়ীর মশকরার উপযুক্ত বয়স জ্যেষ্ঠারা নিয়ম ফিরিস্তি সম্পূর্ণ করে বর-বধূকে রজনীগন্ধায় সাজানো ঘরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। তার সঙ্গে মাঝ রাত্রিতে উলু ও শঙ্খ ধ্বনিরা ছড়িয়ে পড়ে। এমন মনে হতে লাগল যেন কোন রাজ পরিবারে মধ্যরাতে যুবরাজের রাজ্যাভিষেক ঘটতে চলেছে।

    খাটের একপাশে বালিশ রেখে তার উপর ভর দিয়ে পাত্র সমীরণ পাত্রী অনন্যার কাছে প্রশ্ন করে বসে- “তোমার আগে কারও সঙ্গে প্রেম সম্পর্ক হয়েছে?”  কী ধরনের মানসিকতার উদ্ভব ঘটিয়ে এই প্রশ্ন করে বসে তা অনন্যা আশা করি বুঝতেই পারেনি। সমীরণের মাথার ভিতরে প্রবেশ করে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে দুষ্ট কোষগুলিকে ভালো করে উপলব্ধি করতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে সংকোচ না রেখে সে বলে ফেলল- “হ্যাঁ, এর আগে আমার সঙ্গে একজনার সম্পর্ক হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সে অন্যের সঙ্গে সংসার বেঁধেছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন! তার সঙ্গে কোন রকম সম্পর্ক আমার আজ আর নেই”।

    এ কথা শোনা মাত্রই সমীরণের সমস্ত শরীর বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। তার মনের শীসমহল প্রবল ভূকম্পনের ধ্বংসের মত চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এক আকাঙ্খিত ঝড়ে। সমীরণ তখনই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে। অনন্যা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। শুধু স্বামীর অপেক্ষায় একা ঘরে বসে থাকে ।

   কিছুক্ষণ পর বাইরে শোরগোল শোনা গেলে অনন্যা ঘর থেকে বাইরে বেরতেই দেখে সমীরণ বারান্দার মেঝেতে পড়ে আছে। কেউ কেউ হাতে পায়ে ঘসে দিচ্ছে , কেউ মাথায় জল দিয়ে সেবা করছে। সেন বাবু একটা এ্যাম্বুলেন্স ডাকছেন ফোন করে। হঠাৎ দেখা যায় সমীরণের মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে, যা দেখে আর বুঝতে বাকি ছিল না যে, সে বিষাক্ত কিছু খেয়েছে। এই অবস্থা দেখে সেন পত্নী বিপাশা দেবী কান্নায় ভেঙে পড়ে, অনন্যার হাত ধরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় – “কি করেছো তুমি আমার ছেলের সাথে, ও যে প্রথম রাতেই মরতে চলছে? না কি কিছু খাইয়ে দিয়েছ ? তোমার বিয়েতে মত না থাকলে আগেই বলতে পারতে! আমার ছেলেকেই শেষ করতে বসেছো? এই অলুক্ষনে কাণ্ডটা তুমি কেন ঘটালে?”

    অনন্যা এর বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে, আর সে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে যাচ্ছে। খুশির দিনে সারা পরিবার জুড়ে এক কান্নার রোল পড়ে গেছে। পুত্রের এই দশায় পিতা আবেগী হয়ে বলেই বসল – “আমারই  ভুল আমি জেনে শুনে এই বিয়ে করিয়েছি, ভগবানের বিরুদ্ধে গেলে এই হয়, তুমি আমায় ক্ষমা কর বিপাশা, তোমার কাছে আমি গোপন রেখেছিলাম ও মেয়ে যে মাঙ্গলিক”।

     এতক্ষণ তো অনন্যাকে নিয়ে কানাঘুসো চলছিলই এবার সেই জ্বলন্ত আগুনে যেন ঘি ঢালা হল। সকলেই একটা ব্যঙ্গদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আর যে যা পারছে সমানেই খারাপ বক্তব্য করে ফেলছে। অনন্যা তবু নীরব বোধ শূন্য, সংসার করার আগেই তার ঘর ভেঙ্গে চুরমার, তার চতুর্দিক এখন বেদনার আঘাতে হাহাকার। সব কিছু যেন নিমেষে অন্ধকারে ঢেকে গেল। মায়ের সেই আশঙ্কার কথাও যেন সত্যি হয়ে গেল! মা বিমলা দেবী চিন্তায় পড়েছিলেন –“তোকে নিয়ে অনেক বিপদ মা , তুই যে মাঙ্গলিক”।

    এ্যাম্বুলেন্স আসতেই সকলে সমীরণকে ধরে গাড়িতে তোলে অনন্যাও গিয়ে গাড়ীতে উঠে পড়ে। এতে সকলেই অবাক ওকে নামতে বলা হল কিন্তু ও অনড়। হয়তো চূপ থেকে সবাইকে বলতে চাইল সংসার নাইবা হোল একদিনও কিন্তু ও আমার স্বামী তাই ওর ভালোমন্দটা আমাকেও তো বুঝতে হবে। সেনবাবু আর দেরি না করে গাড়ী ছাড়তে বলেন। সঙ্গে আরও দু’এক জন নিকট  আত্মীয়।

  রাতভর চিকিৎসার পর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসক জানান ঠিক সময়ে এনেছিলেন এখন আর ভয় নেই আপনার পুত্র বিপদ মুক্ত। এই কথায় উপস্থিত সকলের চোখে মুখেই এক খুশির আবরণ ধরা পড়েছে। সেন বাবু বাড়ীতেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে বিপাশা যেন চিন্তা না করে সমীরণ ভালো আছে।

   অনন্যা ধীর পায়ে সমীরণের পাশে গিয়ে বসে সমীরণের দিকে চেয়ে থাকে, সমীরণের মাথায় হাত বোলাতেই সে তাকিয়ে পড়ে। অনন্যার সীমিত প্রশ্ন-“ তুমি কেন…. ?”

আধো আধো সুরে সমীরণ- “কারো সাথে তোমার সম্পর্ক…… আমি মেনে নিতে পারিনি…”।

এরপর আর কোন কথা নেই। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অনন্যা উঠে আসে। শ্বশুর সেনবাবু একটি চেয়ারে বসে আছেন, অনন্যা তার সামনে হাত জোর করে বসে পড়ে। রাতের এত হুলুস্থলুসের পর এই প্রথম অনন্যার গলা থেকে ঝেড়ে কথা বেরিয়ে আসে-“ আপনি আমার শ্বশুর সংসার এক দিনও না হলেও সেটাই সত্যি, আমি মাঙ্গলিক জেনেও আপনি আমাকে আপনার পুত্রবধূ করেছেন এতে আমি আমার পরিবার কৃতজ্ঞ। কিন্তু আপনি জেনে শুনে কেন সকলের কাছে তা লুকিয়েছেন? এই একটি কারণেই সারারাত কত অপমান আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। মাঙ্গলিক পাত্রী আপনার পুত্রের জন্য অমঙ্গল হতে পারে জেনেও আপনি আমায় এনেছেন সেটা আপনার উদারতা হিসাবে দেখবো? না কি আপনার ওই মানসিক রোগগ্রস্থ পুত্রের জন্য পাত্রীর যোগান ছিল না সেই কারণেই আমি? জানি না আপনি কি ভেবেছেন! আপনার পুত্রের এই ঘটনায় সেই দায়ী এতে আমার মাঙ্গলিক হওয়ার কোন দোষ নেই। আপনার সন্তান এখন বিপদ মুক্ত, প্রাণ যাওয়ার এই মুহূর্তে আর কোন ভয় নেই। আমার অলক্ষুণে প্রভাব থেকে ওকে মুক্তি দিলাম , আমাকেও মুক্তি দিন- আমি চললাম”।

   সেন বাবুর হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে তিনি বৌমার হাত ধরে বলে ওঠেন- “না মা না তুমি যেওনা আমাদের ক্ষমা কর…”। এই বলতে বলতেই তিনি শক্ত করে অনন্যার হাত ধরে অনুনয় বিনয় করতে থাকেন।

  অনন্যা  সেনবাবুর হাত ছাড়িয়ে বলে ওঠে-  “না তা হয়না মাঙ্গলিক জীবন নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে রাজী , পঙ্গু স্বামীতেও রাজী কিন্তু মানসিক রোগীর সাথে জীবন কাটানো… অসম্ভব… দুঃস্বপ্নের মত”। এই বলেই সে আর এক মুহূর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বধূ বেসেই নিজের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

    সেন বাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি লজ্জিত তাঁর মুখে কোন কথা নেই । উপস্থিত অন্য সদস্যরাও চুপ, যাঁরা রাতে এত কথা শুনিয়েছেন তাঁরাও যেন অনন্যার এই আচরণে নির্বোধ। অনন্যা হয় তো কি শিক্ষা দিয়ে গেল তারই উত্তর খুঁজে চলেছে নিজ নিজ মনে।

=সমাপ্ত=

Loading

Leave A Comment