Site icon আলাপী মন

সেই বাসটা

সেই বাসটা

– অনিন্দ্য ভুক্ত

বাসটাকে ভালো করে চোখে পড়েনি সুকুমারের। অথচ এই রুটে তার ভালোই যাতায়াত।কাজেকম্মে কলকাতায় আসতে হলে , বলতে গেলে প্রায় ফি হপ্তাতেই যেটা করতে হয়, রাতটা অশোকের বাড়ি কাটিয়ে যায়। কাজের বড়ো সুবিধা হয় তাতে। অনেক রাত অবধি কলকাতার কাজগুলো সারতে পারে। তারপর টুক করে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঢুকে পড়ে অশোকের বাড়ীতে। আগে থেকে বলাই থাকে। তাই অশোকের বৌ রান্না করে, বিছানা পেতে রাখে। খেয়েদেয়ে, দুই বন্ধুতে খানিকক্ষণ আড্ডা মেরে একবার. মশারির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলেই হলো।

সমস্যাটা হয় সকালে, বাড়ী ফেরার সময়। সেকেন্ড হুগলী ব্রীজ থেকে যে রাস্তাটা সিধে নেমে এসে সাঁতরাগাছি স্টেশনে ঢুকেছে, কোণা এক্সপ্রেস হয়ে , সেই রাস্তাতেই বাসটা ধরতে হয় ওকে। আগে এই সময়টায় বেশ কিছু বাস ছিল। এখন তার বেশীর ভাগই হয় বন্ধ, নৈলে রোজ চলে না, এমনকি কবে চলবে আর কবে নয়, তার কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। সরকার বাসভাড়া বাড়াচ্ছে না বলে বাস মালিকেরা বাস তুলে নিচ্ছে। মধ্যিখান থেকে ভোগান্তিটা পোহাতে হচ্ছে প্যাসেঞ্জারদের। ঠিক যেন সেই ,রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, সেই গল্প।

বাসের সময় অসময় বলে কিছু নেই বলে নিজে হাতে বাড়তি সময় নিয়ে বেড়িয়েছিল সুকুমার। কাল বাবাকে ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে মেজকাকার সঙ্গে দেশের বাড়ীতে পাঠিয়ে কাজ সারতে শুরু করেছিল। অশোকের বাড়ী ঢুকতে যথারীতি রাত এগারোটা। কথা আছে আজ সকালে বাবা চন্ডীতলা চলে আসবে, সেখান থেকে দু’জনে একসঙ্গে বাড়ী ফিরবে। বাবাকে টাইম দেওয়া আছে আটটা। সরাসরি বাস পেলে এখান থেকে চন্ডীতলা আধ ঘন্টার রাস্তা।সেটা পাবে না ধরে নিয়েই ছ’টার সময় স্ট্যান্ডে হাজির হয়ে গিয়েছিল।

তারপর থেকে হা-পিত্যেশ।ঝাড়া আধঘন্টা অপেক্ষার পরও যখন কোন বাস এলো না, তখন আর ওয়েট করার ভরসা পেল না। এখান থেকে শলপ মিনিট পনেরো। সেখানে কিছু না পেলে পদব্রজে কোণা চৌমাথা। মানে আরো প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। সেখান থেকে বাসে চন্ডীতলা আধঘন্টা। অতঃপর শলপ যাবার প্রথম যে বাসটা আসবে সেটাতেই উঠবে ঠিক করে নিয়েই হাতটা তুলেছিল,বাসটাও ঠিক তার পায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়,যে বাসের ও এখন সওয়ারী।

বাসটা যাবে জঙ্গীপাড়া। শলপ থেকে বাঁদিকে ঘুরে যায়। শলপে নামবে ভেবেই বাসটায় উঠেছিল সুকুমার। বাসে উঠে কি মনে হলো, কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞাসা করলো,’চন্ডীতলা যাবে?’ ওকে অবাক করে অম্লান বদনে ঘাড় নেড়ে দিলো কন্ডাক্টর,’যাবে।’

জঙ্গীপাড়া যাবার বিকল্প রাস্তা আছে একটা চন্ডীতলা দিয়ে। মনে একটা চোরা আশা নিয়েই তাই প্রশ্নটা করেছিল। তার যে এমন উত্তর পাবে ভাবেনি সুকুমার। উত্তর শুনে হাতে যেন চাঁদ পেল। তাড়াতাড়ি একটা জানলার ধার দখল করে বসে পড়ল।

তাড়াহুড়ো করার অবশ্য বিশেষ দরকার ছিল না। গোটা বাসটা প্রায় ফাঁকা। সাকুল্যে পাঁচ-ছ’ জন হবে যাত্রী।সবাই এক একটা জানলার ধার দখল করে বসে পড়েছে। ব্যতিক্রম বলতে একজন। ভদ্রলোক কন্ডাক্টরের পাশে বসে জমিয়ে আড্ডা মারছেন।

এখন শ্রাবণের শেষ। কাল রাত্রে প্রায় সারারাত ঝেঁপে বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস তাই বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা,মনোরম। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলেও এখনো রোদ ওঠেনি। আচমকাই একটা মেজাজ এসে গেল সুকুমারের। জমিদারী মেজাজ। যেন নিজের গাড়ী বের করে সকালে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে….”।
আচমকা হেঁড়ে গলায় সাত সকালে জ্যোৎস্না রাতের গান শুনে চমকে সবাই তার দিকে তাকালো। সুকুমার তখন চোখ বুঁজে গানের ভেলায় প্রমোদ ভ্রমণ করছে। গান শেষ হতে চোখ খুলে সুকুমার দেখলো তার পাশে স্বয়ং কন্ডাক্টর সাহেব বসে আছেন। “বাহ্ দাদা ভারী মিষ্টি গলা তো আপনার। কোথায় থাকা হয় তাহলে দাদার?”

“চাঁপাডাঙ্গা”। একটু গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল সুকুমার। বাড়ীতে একটু গলা খুললেই বৌ বলে, “ওই শুরু হলো ষাঁড়ের বাজনা;কানের পোকা সামলাও এবার।” সেই গান শুনে কেউ উঠে এসে অভিনন্দন জানালে একটা কেউকেটা ভাব আপনিই চলে আসে।

কন্ডাক্টর অবশ্য সুকুমারের গাম্ভীর্যকে বিশেষ পাত্তা দিল না। উল্টে খোসগল্প জুড়ে দিল তার সঙ্গে। লোকটা গপ্পোবাজ, বোঝাই যাচ্ছে। সুকুমারের জমিদারী মেজাজ যাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিলো বেরিয়ে ফিরে সে বাড়ির বৈঠকখানায় আড্ডা জুড়েছে। আড্ডা মারতে মারতেই সে জেনে নিল ভায়া চন্ডীতলা জঙ্গীপাড়া যাবার বাস এই একটিই। দিনে দু’টো ট্রিপ। সকাল সাড়ে ছ’টায় একবার, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় একবার।

গল্প করতে করতেই বাস চন্ডীতলায় হাজির। স্টপেজ টপকে ঠিক যেখানে প্রয়োজন সুকুমারের, সেখানেই তাকে নামিয়ে দিল। বাস থেকে নেমে কৃতজ্ঞতাবশত কন্ডাক্টরের দিকে হাত নাড়তে গিয়ে সুকুমারের মনে হল তাকে নামিয়ে দিয়ে বাসটা যেন অনাবশ্যক দ্রুত গতিতে চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল। কেমন যেন একটা খটকা লাগলো। তারপরই মনে পড়লো, এই রে বাসের ভাড়াটাই তো দেওয়া হয়নি! কিন্তু তার না হয় ভুল হলো, কন্ডাক্টর সাহেবও তো একবারও ভাড়া চাইলেন না! ভাবতে ভাবতেই মনে হলো,আচ্ছা বাসটা কি মাঝে কোথাও থেমেছিল? লোকজন কি কিছু ওঠানামা করেছিল?

সুকুমারের ভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। তবে পুরো জট পাকানোর আগেই একটা নীল রঙের মারুতি ভ্যান হর্ণ দিয়ে ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। বাবা চলে এসেছে, বিনয়ের ভ্যান গাড়ীতে। দেশ থেকে ফেরার সময় বিনয়ের এই ঝরঝরে গাড়িটাই প্রতিবার ভাড়া করা চাই বাবার।

বন্ধু হলেও অশোকের সঙ্গে একটা আত্মীয়তাও আছে সুকুমারের। আত্মীয়তা অবশ্য পোস্ট- ম্যারিটাল, মানে বিয়ের পর গড়ে উঠেছে। দুই বন্ধুতে দুই বোনকে বিয়ে করেছিলো। মীনা অশোকের বৌ, ঝুমা সুকুমারের। ছেলে মেয়ে বৌকে নিয়েও তাই মাঝে মাঝেই অশোকের বাড়ী যায় সুকুমার। আর ফেরার সময় এখন প্রতিবারই এক ঝামেলা। বাসের টাইম ধরে বাসস্ট্যান্ডে এসেও বেশির ভাগ দিনই বাস মেলে না। দূরপাল্লার বাস সব, কোনদিন যে কোনটা বসে যাচ্ছে।

যাক এবারে অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সুকুমার। বাস নিয়ে ঝামেলাটা মিটলো। ছোটো রুটে চলে এই বাসটা। রেগুলার পাওয়া যাবে। একবার চন্ডীতলা পর্যন্ত চলে আসতে পারলে বাসের ভাবনাটা আর থাকবে না।

বাড়ী ফিরেই তাই বাসের গল্পটা ঝুমাকে করেছিল। এই রুটটা আসলে ঝুমারই আবিষ্কার। নৈলে বৌ-বোঁচকা নিয়ে আগে তারকেশ্বর পর্যন্ত ট্রেনেই ফিরতো। তাতে সময়টা লেগে যেত বেশী। আর ঝুমাকে গল্প বলতেই সে বায়না ধরেছিল,”চলো একবার ঘুরে আসি, অনেকদিন যাইনি।”

রাজী হয়ে গেল সুকুমার। রবি-সোম দু’ দিন মেয়ের টিউশন পড়তে যাওয়া থাকে না। রবিবারের ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাই বেরিয়ে পড়েছিল।
আজ মঙ্গলবার । বিকেলে মেয়ের টিউশন আছে। তাছাড়া সকালে ফিরতে পারলে দোকানটাও বন্ধ যায় না। ভোরবেলা থেকে বৌকে তাড়া মেরে বেরোতে বেরোতে ছ’টা। তা হোক, মনে মনে হিসেব করে নিয়েছে অশোক, সাড়ে ছ’টার জঙ্গীপাড়া ধরে চন্ডীতলা, সেখান থেকে হয় কোনো এক্সপ্রেস, না পেলে ছাব্বিশ নম্বর ধরে চাঁপাডাঙ্গা।

কিন্তু কোথায় সেই বাস? ঘড়ির কাঁটা ছ’টা বত্রিশ পেরোতেই উদ্বিগ্ন হতে শুরু করলো সুকুমার। এক্ষুনি ছোট ছেলে বায়না ধরলো বলে। ও বাসে যেতে চায় না। গত কয়েক বার বাসের গন্ডগোল হয়েছিল বলে এবারে আরো বেঁকে বসেছিল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এনেছে। ছ’টা পঁয়ত্রিশ হতেই ঝুমা কনুইয়ের গুঁতো মারলো,”কই গো?”

সুকুমারের মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।স্পষ্ট মনে পড়ছিলো সেদিন বাসটা কোথাও দাঁড়ায়নি, কোথাও কোনো প্যাসেঞ্জার ওঠানামা করেনি, কন্ডাক্টর কারো টিকিট কাটেনি। শুধু সুকুমারকে চরম বিপদ থেকে উদ্ধার করে, গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে রকেটের গতিতে চোখের সামনে থেকে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল।

Exit mobile version