যেখানে দেখিবে ছাই (পর্ব-৩ /শেষ)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
গভীর বিষণ্ণতায় থাকার দারুণ রাত্রে ভালো ঘুম হয়ে না তিস্তার। আদৌ কি তার দাদা কোনো দিন ফিরে আসবে? আদৌ কি আর কোনো দিন নিজের দাদার মুখে ‘রুমির’ মধুর ডাক শুনতে পাবে? রাখী ও ভাইফোঁটার পর্ব কি বিষাদের গভীর সাগরে ডুবেই কেটে যাবে তিস্তার? চোখের জল সে ফেলে না। এখনও নিজের মাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে সে। যদি তিস্তা চোখের জল ফেলে তাহলে তার মায়ের মনোবল তো আরও পড়ে যাবে। সারা রাত প্রায় জেগেই কাটালো তিস্তা। তাই ভোরের দিকে চোখ লেগে গিয়েছিল। ঠিক সে সময় তার মোবাইল বেজে উঠল। ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে। মোবাইলের দিকে দেখলো সে। দেখেই অবাক। অদ্ভুত এক তৃপ্তি পেলো সে। এক এমন তৃপ্তি যেটা বর্ণনা করা সম্ভব না। ফোন তুলল সে – ‘হ্যালো!’
‘অনেক জরুরি কথা আছে আপনার সাথে। আমি বারোটা নাগাদ পৌঁছাবো। আপনি কি বাস স্ট্যান্ডে আসতে পারবেন? ‘ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘পারবো, পারবো আমি। আপনি ছিলেন কোথায়? বহুবার আপনার ফোন ট্রাই করলাম।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে অচিরেই তিস্তার গলা ভারী হয়ে এলো।
‘সব বলবো আপনাকে। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করুন।’
সেই থেকে আর ঘুম হলো না তিস্তার। অধীর আগ্রহে বসে থাকলো বেলা বারোটা বাজার অপেক্ষায়। তাহলে দীনবন্ধু বাবু ঠিক কথাই বলেছিলেন। মৃত্যুঞ্জয় যে কাজের দায়িত্ব নেয়, সেটা শেষ না করা পর্যন্ত সে শান্তি পায়ে না।
বাড়িতে কাউকে জানায়নি তিস্তা। বাস স্ট্যান্ড বাড়ি থেকে একটু দূর, তার এগারোটা বাজার সাথে-সাথেই তিস্তা বেরিয়ে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় কোথায় গিয়েছিল, জানে না তিস্তা। কী খবর সে নিয়ে এসেছে, সেটাও জানে না সে। ক্রমে তার হৃদয় স্পন্দন বেড়ে চলেছে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ সে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছালো। বেশ কিছু বাস সেখানে প্রবেশ করলো, বেশ কিছু বাস বেরিয়ে গেলো নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এক কোণাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো তিস্তা। খানিক পর শিলিগুড়ি থেকে একটা বাস ঢুকলো সেখানে। পিঠে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে সেই বাস থেকে নামলো মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে পেলো তিস্তা। মরুভূমির লোকেরা জলের দিকে যেমন ছুটে যায়, ঠিক তেমনই ছুটলো তিস্তা মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। যেন মনে হলো বহু বছর পথ হারানো পথিক অবশেষে নিজের পথ খুঁজে পেলো।
‘কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনি, কিছু না জানিয়ে? এই কিছু দিন কী অবস্থা হয়েছে আমার, সেটা জানেন না আপনি।’ একরাশ অভিমানের স্বরে তিস্তা বললো।
‘সব বলবো আপনাকে, কিন্তু সময় আসলে। এখন হাতে সময় খুব কম।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘সময় কম মানে? আমার দাদাকে খুঁজে পাওয়া গেছে?’
তিস্তার এই প্রশ্নে অল্প বিষণ্ণতা চলে এলো মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে। সেটা লক্ষ করলো তিস্তা।
‘কী হয়েছে, মৃত্যুঞ্জয়? আপনি চুপ কেন? জবাব দিন আমার প্রশ্নের।’
‘আপনি চলুন আমার সাথে। নিজের চোখেই সব দেখে নেবেন।’ কথা শেষ করে এগিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়। পেছন পেছন তিস্তা।
হেঁটে যাওয়ার মতো সময় নেই। বাস স্ট্যান্ডে কিছু ভাড়ার ট্যাক্সি ছিলো, যেগুলো টুরিস্টদের ঘুরতে নিয়ে যায়। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলো মৃত্যুঞ্জয়। যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি চালককে যে ঠিকানাটা সে বলল, সেটা শুনে চমকে উঠল তিস্তা। ঠিকানাটা তাদের শাড়ির দোকানের ।
‘দোকানে যাবেন কেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করলো তিস্তা।
‘আগে ট্যাক্সিতে বসুন।’
মৃত্যুঞ্জয় প্রায় ধাক্কা দিয়ে তিস্তাকে ট্যাক্সিতে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসলো।
‘একটু তাড়াতাড়ি যাবেন মশাই। সময় খুব কম।’
‘ব্যাপারটা কী, মৃত্যুঞ্জয়? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
খানিক চুপ থেকে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো মৃত্যুঞ্জয়, তার পর বলল – ‘আমি কোলকাতা গিয়েছিলাম। এই কেসের গোপন রহস্য ভেদ করতে আমাকে সেখানে যেতেই হতো। শুরুতে সেই দোকানে গেলাম যেখান থেকে সুপ্রিয় কসমেটিক্স কিনতো।অনেক গোপন তথ্য সেখান থেকে উদ্ধার হলো। যখন কলকাতা গেলাম, তখন আরও একটা তথ্য জানবার ইচ্ছে হলো। তাই রওনা দিলাম বেলঘোরিয়ার উদ্দেশ্যে। সব তথ্য সংগ্রহ করার পর কোলকাতা থেকেই এখানকার থানায় ফোন করলাম। অনিচ্ছা সত্বেও থানার বড়বাবুকে নিজের পরিচয় দিতে হলো। যদি পরিচয় না দিতাম, তাহলে হয়তো কাজ হতো না।’
‘থানার বড় বাবু তো সুপ্রিয়র দোকান সার্চ করেছে। নীলকন্ঠদাকে আবার থানায় নিয়ে গিয়েছিল।’ তিস্তা বলল।
‘জানি। সেটা আমার ফোন করার আগে। কাল রাতে বড় বাবুর সাথে আমার কথা হয়েছে। এতক্ষণে হয়তো পুলিশ নিজের কাজ সেরে নিয়েছে।’
মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল বেজে উঠল। তিস্তা শুধু মৃত্যুঞ্জয়ের কথাগুলোই শুনতে পেলো।
‘ হ্যাঁ বড়বাবু, বলুন ….কী পেলেন? ওঃ .. তাহলে পেলেন তো …. ঠিক আছে .. আপনি এগোন , আমিও আসছি।’ ফোন রেখে দিলো মৃত্যুঞ্জয়।
তিস্তার কাছে এখনও কিছুই পরিস্কার না। কী হচ্ছে এবং কী হতে চলেছে, কিছুই তার মাথায় আসছে না। এতো কিছু জানার তার দরকার নেই। তার শুধু প্রয়োজন নিজের দাদাকে নিয়ে। মৃত্যুঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলো – ‘আমার দাদা কোথায়, মৃত্যুঞ্জয়? তার কোনো সন্ধান পেলে?’
মৃত্যুঞ্জয় আড়চোখে তাকালো তিস্তার দিকে। বলল – ‘মনে আছে আপনার, সে দিন আপনার বাড়ি গিয়ে সুপ্রিয়র ঘর থেকে কিছু নেলপোলিশ ও কিছু লিপিস্টিক আমি নিয়েছিলাম? ‘
‘মনে আছে।’
‘ ওই নেলপোলিশ ও লিপিস্টিক আমি সাজগোজ করার জন্য নিশ্চই নিইনি। তার পেছনে কারণ ছিলো। যে কারণটা একটু পরেই আপনি জানতে পারবেন। ওই কারণের জন্যই আপনার দাদা নিরুদ্দেশ।’
দোকান চলে এলো। এক দিক দিয়ে তাদের ট্যাক্সি ও অন্য দিক দিয়ে পুলিশের গাড়ি এক সাথে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। গ্রাহকের খুব একটা ভিড় দোকানে ছিলো না । দু-একটা গ্রাহক ছিলো ঠিকই, তাদের বিক্রম শাড়ি দেখতে ব্যস্ত ছিলো। এক দিক দিয়ে পুলিশের দল ও অন্য দিক দিয়ে তিস্তা এবং মৃত্যুঞ্জয়কে ঢুকতে দেখে সুধাকর এবং সুধাময় ঘোষাল চমকে গেলেন। সুধাময় বাবুর গলা থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে গেলো – ‘আপনারা!’
সুধাময় বাবুর কথার জবাব কেউ দিলো না।
মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গেলো বিক্রম পালিতের দিকে। তাকে বলল – ‘বিক্রম বাবু, আপনার বন্ধ ঘরের রহস্য ভেদ হয়ে গিয়েছে।’
বিক্রম পালিত চমকে উঠল – ‘মানে?’
‘মানে আপনি জানেন না বুঝি? ঠিক আছে, মানে আপনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে থানায়।’
‘থ – থ – থানায় কেন? আ – আমি কী করেছি?’
‘কসমেটিক্সের ব্যাবসা তো সুপ্রিয় করতো। আপনার সেই বন্ধ ঘরে প্রায় কুড়িটা নেলপলিশের শিশি পাওয়া গেছে।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘তাতে কী হয়েছে? বাড়িতে নেলপোলিশ রাখা কী অন্যায়?’ এবার সুধাময় বাবু বললেন, গলার স্বর ঈষৎ উচ্চ।
‘না, একেবারেই অন্যায় না, যদি সেই নেলপোলিশ সামান্য নেলপোলিশ হয়। একটা নেলপোলিশের শিশির দাম যদি হাজার-হাজার টাকা হয়, তাহলে সেটা ভাবতে বাধ্য করে।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘নেলপোলিশের শিশির দাম হাজার-হাজার টাকা!’ বিস্ময়ে কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো তিস্তার।
‘হ্যাঁ তিস্তা।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘এক-একটা নেলপোলিশের দাম প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি হাজার টাকা। এতো দামী নেলপোলিশের ব্যবসা আপনার দাদা করতো, সাথে বিক্রম পালিত। এইগুলা আদৌ নেলপোলিশ নয়, তিস্তা।’
‘তাহলে কী?’
‘এ গুলো ড্রাগস্।’
‘ড্রাগস্!’ তিস্তার সাথে অনেকেই চমকে উঠলেন।
‘হ্যাঁ। নেলপোলিশের শিশির পরীক্ষণ করানো হয়েছে। নেলপোলিশের শিশির ভেতর যে জিনিসটা পাওয়া গেছে, সেটাকে বলা হয়ে “লিক্যুইড হেরোইন”।
মৃত্যুঞ্জয়ের কথা শুনে প্রত্যেকে থ।
‘তিস্তা, আপনার দাদা আপনার জামাইবাবুর সাথে মিলে ড্রাগসের ধান্দা করতো। আপনার দাদার কী হয়েছে, সেটা এবার বিক্রম বাবুই ভালো বলতে পারবেন। বিক্রম বাবু, আপনার বাড়ি থেকে যা পাওয়া গেছে সেটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কলকাতার যেখান থেকে আপনারা হেরোইন কিনতেন সেখানে অলরেডি নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্ট রেড মেরেছে। আপনার ও সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই, বাঁচবার আর কোনো উপায় নেই। এবার বলুন, সুপ্রিয় তো আপনার পার্টনার ছিলো, তাকে খুন করলেন কেন?’
তিস্তার ও সুধাকর বাবুর আর কোনো সন্দেহ রইল না যে সুপ্রিয় আর এই দুনিয়াতে নেই । হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তিস্তা ।
মূর্তির ন্যায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিক্রম পালিত। পুলিশের কিছু সিপাহী তাকে অ্যারেস্ট করতে যাবে , ঠিক সে সময় সুধাময় বাবু বলে উঠলেন – ‘দাঁড়ান। যদি খুনের কারণে অ্যারেস্ট করা হয়, তাহলে আমাকে করুন। সুপ্রিয়র হত্যা আমি করেছি।’
সবাই থানাতে একত্র হয়েছে। দুটো পাশাপাশি চেয়ারে বসে বিক্রম ও সুধাময় ঘোষাল। তাদের দুজনকে ঘিরে আছে থানার বড় বাবু, মৃত্যুঞ্জয়, সুধাকর ঘোষাল এবং তিস্তা। সুধাময় বাবু বলছেন- ‘মানুষের জীবনে শুধু একটা জিনিসের প্রয়োজন, সেটা হলো টাকা। যার কাছে টাকা নেই, তার সমাজে কোনো মান-সম্মান নেই। মান-সম্মান ছিলো না বিক্রমের। আমার নিজের ভাই বিক্রমকে কোনো দিন সম্মান দিতে পারেনি। আমার মেয়ে নাকি বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়েছে। আমি নিজের বড় মেয়ের বিরুদ্ধে কোনো দিন যাইনি। তাই বিক্রমকে বিয়ে করার তার সিদ্ধান্তটা অগত্যা আমাকে মানতেই হলো। আমার লক্ষ্য ছিলো বিক্রমকে তার সম্মান পাওয়ার যোগ্য করার। আর সম্মান মানুষে একটি জিনিসে পায়, টাকায়।’
কথা শেষ করে থামলেন সুধাময় ঘোষাল। অল্প জল পান করে পুনরায় বলতে শুরু করলেন – ‘সে রাতে সুপ্রিয় কারুর সাথে ফোনে কথা বলছিলো। আমি তাদের কথা আড়াল থেকে শুনেনি। ড্রাগসের ব্যাপারে কথা হচ্ছিলো তাদের। আচমকা আমাকে দেখে সুপ্রিয় ভয় আঁতকে ওঠে। ঠিক তখনই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেললো। আমি সুপ্রিয়কে বললাম যে আমি টাকা ইনভেস্ট করবো। শর্ত এটাই যে এই ব্যবসাতে বিক্রমকেও নিতে হবে। কোলকাতার মার্কেটের সাথে সুপ্রিয়র ভালো পরিচয় ছিলো। সে ওখানে থেকে মাল নিয়ে আসতো, এখানে বিক্রি করার দায়িত্ব ছিলো বিক্রমের। মাঝে মাঝে বিক্রমকেও যেতে হতো কলকাতা। বেশ সুন্দর চলছিলো সব কিছু। বিক্রমের ভালো অর্থ রোজগার হচ্ছিলো। স্বচ্ছন্দে চলছিলো আমার মেয়ের সংসার। এক দিন হঠাৎ সুপ্রিয় বলল সে নাকি এ ধান্দা করবে না আর। এবার নাকি সে সাধু পুরুষ হয়ে থাকবে। আমি তাকে বোঝালাম যে সে যদি না করে, না করুক। কোলকাতার মার্কেটের সাথে ভালো পরিচয় করিয়ে দিক বিক্রমের। কিন্তু সেটাও সে করালো না। কোলকাতায় গিয়ে সে বলে এলো যে তার আর মাল চাই না। যা পেমেন্ট বাকি ছিলো, সব দিয়ে এলো। আমি আর বিক্রম মিলে কোলকাতার মার্কেটের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বাধা সৃষ্টি করলো সুপ্রিয়। অগত্যা তাকে পথ থেকে সরানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।’
‘শালা বেইমান …. তুই ভাই না শত্রু আমার? ‘সুধাময়ের দিকে তেড়ে গেলেন সুধাকর ঘোষাল। থানার বড় বাবু, তিস্তা ও মৃত্যুঞ্জয় মিলে তাকে আটকালো।’
‘কুপথে তো অনেকেই যায়, কিন্তু নিজের ভুল বুঝে যে সুপথে আসতে চায় , তাকে আসতে দেওয়া উচিত । আপনি তাকে সুপথে আসতে দেননি, সুধাময় বাবু। এর শাস্তি তো আপনাকে পেতে হবেই। সুপ্রিয়র লাশ কোথায় লুকিয়েছেন, সেটা বলবেন কী?’ কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় তিস্তা ও সুধাকর ঘোষালের দিকে তাকালো। দুজনেরই চোখ দিয়ে বয়ে চলেছে অফুরন্ত অশ্রু ধারা।
সকাল প্রায় দশটা বাজে। নিজের ঘরে ব্যাগ প্যাক করে ব্যস্ত মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ পেছন থেকে তিস্তার কন্ঠস্বর শুনতে পেলো সে।
‘কোথাও যাচ্ছেন?’
পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘যেতে হবে।’
‘কোথায়?’
‘দেখি কোথায় যাই।’
‘মানে? কতো দিনের জন্য যাবেন?’
‘ফিরে আসবো কিনা সন্দেহ আছে।’
চমকে উঠল তিস্তা।
তিস্তার দিকে এগিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘তিস্তা, আমার পরিচয় যত গোপন থাক, ততোই ভালো। আমার অতীত খুব একটা ভালো না। আমি এখানে নিজের পরিচয় লুকিয়েই ছিলাম। এখানে যখন অনেকে আমার আসল পরিচয় জেনে গেছে, তখন আর এখানে থাকা চলবে না আমার। দুঃখ শুধু এটাই রয়ে গেলো যে আপনার দাদাকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না।’
‘আপনি যেটা করলেন সেটা কিছু কম নয়। খারাপ লাগছে আমার। আমার জন্য আপনাকে নিজের ঠাঁই ছাড়তে হলো। একটা প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞেস করি?’
‘অবশ্যই।’
‘কলকাতা গিয়ে আপনি কী এমন তথ্য পেলেন যার ভিত্তিতে এটা বুঝলেন যে বিক্রম পালিত দোষী?’
অল্প হাসলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘জানতে চান? খুব একটা কঠিন ছিলো না। সুপ্রিয় কলকাতায় যেখান থেকে কসমেটিক্স কিনতো সেখানে গেলাম। ঠিকানাটা নীলকন্ঠ দিয়েছিল। সেখান থেকে যখন খুব বেশি তথ্য পাওয়া গেলো না তখন এক কর্মচারীকে আড়ালে কিছু টাকা দিয়ে গোপন তথ্য জানবার চেষ্টা করলাম। যেখান থেকে সুপ্রিয় লিক্যুইড হেরোইন কিনতো সেখানকার ঠিকানা পেলাম। সেই কর্মচারী নাকি সুপ্রিয়কে এই ধান্দার প্রলোভন দিয়েছিল। যাই হোক, কলকাতার নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্টকে খবর দিয়ে সেখানে গেলাম। যেখান থেকে জানতে পারলাম যে সুপ্রিয়র সাথে মাঝে মাঝে এক অন্য লোকও আসতো সেখানে। কে সে? সুপ্রিয় যে একলা কোলকাতা যেতো না সেটা সুপ্রিয়র ঘরে সে দিন জানতে পেরেছিলাম। ডাস্টবিন থেকে একটা ট্রেনের টিকিটের টুকরো পাই আমি। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শেয়ালদা, দার্জিলিং মেল। টিকিটে দুটো বার্থ রিসার্ভ করার উল্লেখ ছিলো। তাই বলা হয়ে ম্যাডাম, কোনো জিনিসকে তুচ্ছ ভাবতে নেই।” যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।” যাই হোক, সেই ঠিকানা থেকে যারা, যারা ড্রাগ কিনতো তাদের ভিডিও করে রাখতো এক জন নিজের মোবাইলে। সেখান থেকে সুপ্রিয় ও বিক্রমের ভিডিও পেলাম। বেলঘোরিয়া, বিক্রমের পৈতৃক বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম যে তার বাবারা তিন ভাই। দু’ভাই এখনও বেলঘোরিয়াতেই থাকে। সুদের ব্যবসা ছিলো তাদের। এক দিন বিক্রমের বাবা বেশ কিছু টাকার হেরফের করে সেখান থেকে স্বপরিবারে উধাও হয়ে যায়। কিছু জিনিস শুরুতেই মনে খটকা দিয়েছিল আমায়। প্রথম তো বিক্রমের সাথে দেখা করার কথাতে সুধাময় বাবুর বাধা দেওয়া, এবং দ্বিতীয় বিক্রমের দরকার থেকে বেশি আপ্যায়ন করা।’
কথা শেষ করে থামলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘তার মানে সে দিন দাদা আর নীলকন্ঠদার মধ্যে কি ড্রাগ নিয়েই ঝামেলা হয়েছিল?’
‘একদম ঠিক। নীলকন্ঠ জানতে পারে যে তাদের কসমেটিক্সের সাথে ড্রাগও আনা হচ্ছে। পুলিশকে খবর দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার ধমকি দেয় সে। তাই এতো আপসেট থাকতো আপনার দাদা। ‘
মৃত্যুঞ্জয়ের বেরোবার সময় চলে এলো। তিস্তা তাকে ছাড়তে গেলো বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত। ইচ্ছে করলো, মানা করুক মৃত্যুঞ্জয়কে যেতে। কিন্তু যে যেতে চায়, তাকে কেউ আটকাতে পেরেছে?
‘যেখানেই থাকুন, যোগাযোগ রাখবার অনুরোধ রইল।’ বিষাদে ভরা মুখে তিস্তা বলল।
জবাবে শুধু অল্প হাসলো মৃত্যুঞ্জয়।
বাস ছেড়ে দিলো । যতক্ষণ বাসকে দেখা যায়, দেখতে থাকলো তিস্তা ।
=সমাপ্ত=