গল্প

রেশমি চুড়ি

রেশমি চুড়ি
-অমিতাভ সরকার

শিয়ালদহ থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেন এ বহরমপুর ফিরছিলাম দুপুরের দিকে। এই সময়টায় একটু বসার জায়গা মোটামুটি পাওয়া যায়। যাইহোক কম্পার্টমেন্ট একটু ফাঁকা ছিল। আমি জানালার দিকে বসে ছিলাম।একটু বাদে একজন বয়স্ক লোক এসে আমার পাসে বসলেন। কিছুক্ষণ ট্রেন ছাড়ার পর ,একটা দুটো কথা হতে, তিনি শুরু করলেন, দেখুন ভাই কি অবস্থা দেশের, কোথাও একটু সুস্থ ভাবে যাওয়ার উপায় নাই, সর্বত্র হুড়োহুড়ি, অশান্তি, ধৈর্য, সহ্য, কিছুই নাই। এসব করে নিজের ক্ষতি, নিজেদের ক্ষতি, আমরা কাউকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি, সেটা তো সবটাই ঈশ্বরের প্রতি করি। প্রতিটি মানুষের ভেতরে ঈশ্বর বিরাজমান।কারো প্রতি অন্যায় করা মানে ঈশ্বরের প্রতি অন্যায় করা। আমি একটু সোজা হয়ে বসলাম, ভাবলাম ভদ্রলোক অন্য জগতের মানুষ। মুগ্ধ হলাম তার কথা শুনে।
আমি অন্য ভাবনায় চলে গেলাম।  জানালার দিকে মুখ করে একজনের টেবিলে খোলা ডাইরি পড়ে ছিল দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের দিনলিপি, কিছু কিছু জায়গায় কিছু খণ্ড চিত্র লিপিবদ্ধ ছিল। যেহেতু খোলা ডাইরি, অনিচ্ছাকৃতভাবেই পাতা উল্টিয়ে পড়তে লাগলাম ,দৈনিক যাতায়াতের পথের ইতিবৃত্ত। তিনি একজন মহিলা আধিকারীক। একটি এনজিওতে কাজ করেন।
তিনি এক জায়গায় লিখছেন, তিনি একটি গ্রামে
তাদের একটি ইউনিট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বাস ষ্ট্যান্ড থেকে অন্তত তিন চার কিলোমিটার হাঁটা পথে। কোন গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা নাই।
তাদের স্থানীয় অধস্তন কর্মচারি তাকে এগিয়ে নিতে এসেছেন। সেই ইউনিটে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যেতে যেতে দেখতে পেলেন । এক বৃদ্ধা একটা আধ ভাঙ্গা চালা ঘরের নিচে হরেক রকম কাচের চুড়ি নিয়ে বসে আছেন বিক্রির জন্য। বৃদ্ধা তাকে দেখে, ডেকে বলতে শুরু করলেন, মা
তোমার হাতে কোন চুড়ি নাই, তোমার হাত খালি দেখতে ভালো লাগছে না, তুমি কটা চুড়ি পড়ো, মেয়ে মানুষ ভালো লাগবে। এবরো খেবরো রাস্তা এমনিতে আসতে পরিশ্রম হয়েছে তারপর ইউনিটে পৌঁছে কাজ করে ফিরতে কম করে ঘন্টা তিনেক লাগবে। তিনি এখন সময় নষ্ট করতে চাইছেন না। বৃদ্ধাকে বললেন আমি চুুুুড়ি পরি না। ঠিক আছে আমি কাজ থেকে ফিরে আসি ফেরার পথে দেখা যাবে। এই বলে এগিয়ে গেলেন।
এগোতে এগোতে সঙ্গী কর্মচারী বলতে শুরু করলো দিদি, বুড়ির ভাগ্য খারাপ এক ছেলে রেখে তার স্বামী মারা যায়, জমি বাড়ি সব ছিল। তার পরিবারের ভাসুর দেওরা বেশির ভাগ জমি ও বাড়ির অংশ দখল নিয়ে নেয় । একমাত্র ছেলে দারুণ পড়াশোনায় ভালো ছিল ,প্রতিবার ক্লাসে প্রথম হত । সেই ছেলেকে পড়াতে গিয়ে যেটুকু জমি ছিল বিক্রি করতে হয়েছে। ছেলে প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় স্থান করে সরকারি খরচে বিদেশে চলে যায়। সেখানে ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করতে থাকে এবং এক বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করে। স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে বসবাস শুরু করে সেখানে।প্রথম দিকে মাঝে মাঝে খোঁজখবর নিতো কিছু খরচ খরচা পাঠাতো।এখন ছেলে আর খোঁজ খবর নেয় নাখ খরচখরচা কিছুই পাঠায় না। শোনা যায় তার স্ত্রী এদেশে, গন্ডগ্রামে আসতে রাজি নয় অথচ এই ছেলের জন্য সেই যুবতী অবস্থায় বৃদ্ধা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি, সারা জীবন ছেলের জন্য জীবন পাত করেছে, সবার কাছে খারাপ হয়েছে, কত কথা শুনেছে, কত গঞ্জনা বলার নাই দিদি। কি শোনালে তুমি! এখনো ঈদের দিন খাবার নিয়ে বসে থাকে, যদি ছেলে আসে।

ভাবতে থাকলাম কি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে মানুষ।
জ্ঞানের ভাণ্ডার বিকশিত না হয়ে শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে।
বিবেক, মমত্ববোধ সবকিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের মাঝে ঈশ্বর, কেউ শ্রদ্ধা দিতে রাজি নয়। এতো শিক্ষা নয়, এতো অবনতি, ধ্বংসের পথে এগুনো। জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়া।
দিদি ফেরার পথে দেখতে পেলেন বৃদ্ধা বসে আছেন তখন। সোজা তার কাছে গেলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এখনো বসে আছেন? হ্যাঁ মা, তোমার জন্য বসে আছি। তুমি ফেরার পথে চুড়ি নেবে বলে ছিলে কিনা? আমি খেতে যায়নি তুমি আসবে বলে। আমি বাড়ি গেলে তুমি আমাকে পাবে না তাই। দিদি কোন কথা না বলে তার দুটো হাত এগিয়ে দিলেন। বুড়ি সুন্দর করে চার চার আট জোড়া চুড়ি দিদির হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।
দিদি তার পার্স থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে, বৃদ্ধার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, আমার মা নাই, তুমি আমার মা ,মেয়ের এই সামান্যটুকু স্নেহ ও শ্রদ্ধা হিসেবে রাখ। বুড়ির চোখের দুই কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। দিদি, ভালো থেকো বলে, এগিয়ে গেল। সঙ্গী কর্মচারী ও অবাক হলো এসব দেখে।
আমি ডাইরি পড়তে পড়তে ভাবতে থাকলাম, ঈশ্বর অর্থাৎ মানবিকতা এখনো আছে এবং থাকবে। ভারতের মাটি অনেক উর্বর। পাশের ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বহরমপুর
আসতে তখন দেরি আছে।

Loading

One Comment

Leave A Comment

You cannot copy content of this page