অমৃতের বিষ পান (পর্ব – ১)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
অমল হালদারের নিমন্ত্রণটা অমান্য করতে পারলো না মৃত্যুঞ্জয়। কোলকাতা তার জীবনের অতীত, এক এমন অতীত যার ছায়া সে নিজের বর্তমান জীবনে পড়তে দিতে চায় না। নর্থ বেঙ্গলে থাকা কালিন এক রহস্যের সমাধান করার জন্য তাকে কোলকাতা যেতে হয়। কিন্তু সেটাও অনিচ্ছা সত্বেও। এক বার আরও তাকে যেতে হবে কোলকাতা। অমলবাবুর অনুরোধ সে অমান্য করবে কী করে?
মৃত্যুঞ্জয় যখন সি.আই.ডি.তে কাজ করতো, অমল হালদার ছিলেন তার সিনিয়ার। বয়স জ্যেষ্ঠ অমল হালদারকে মৃত্যুঞ্জয় নিজের গুরু বলে মানতো। অমল বাবু চাকরী থেকে অবসর পেয়েছেন প্রায় দু’বছর হলো। থাকেন কোলকাতাতেই, নিজের বাড়িতে। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে অরূপ হালদার পুলিশেই কাজ করে। দমদম থানার বড়বাবু সে এখন। মেয়ে অর্পিতা হালদার পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর এক প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করে। তারই বিয়ের উপলক্ষ্যে মৃত্যুঞ্জয়কে কোলকাতা আসার নিমন্ত্রণ করলেন অমল হালদার।
আজকের দিনে মৃত্যুঞ্জয়ের গোপন ঠিকানার বিষয় যারা জানে, তাদের মধ্যে এক জন অমলবাবু। নর্থ বেঙ্গল ছাড়ার পর মৃত্যুঞ্জয় যে বাঁকুড়াতে আছে, সেটা তিনি বেশ ভালো করেই জানতেন। মৃত্যুঞ্জয়ের চাকরী ছাড়ার পর তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন তিনি। মৃত্যুঞ্জয় বহু বার পরিবর্তন করেছে নিজের মোবাইল নম্বর। কিন্তু প্রতিবারই নিজের নতুন নম্বর অমলবাবুকে দিয়েছে। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অনেকেই জানে যে অমলবাবুর যোগাযোগ আছে মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। অনেকে অমল বাবুর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের নম্বরও চেয়েছে। কিন্তু নম্বর দেননি অমল হালদার। বিশ্বাস রক্ষা করতে তিনি খুব ভালোই জানেন।
অমলবাবুর ডাকে কোলকাতা এলো মৃত্যুঞ্জয়। বিয়ের অনুষ্ঠান, অমলবাবুর লেক টাউনের দু’তোলা বড়ো বাড়িতে আত্মীয়ের প্রাচুর্য। অমল হালদার প্রত্যেককে মৃত্যুঞ্জয়ের পরিচয় দিলেন নিজের এক বন্ধুর ছেলে বলে। মৃত্যুঞ্জয়ের আসল পরিচয় যদি কেউ জানতো, সে হলো অমলবাবুর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এবং নিমন্ত্রিত কিছু পুলিশ অফিসার।
বিয়ের দিন সকালে অরূপ কাজে বেরিয়ে গেলো। ছুটি তো সে নিয়েছিল, কিন্তু থানা থেকে ফোন আসাতে তাকে চলে যেতে হলো। শুরুতে একটু গজগজ করলেন ঠিকই অমলবাবু, কিন্তু তিনি জানেন পুলিশের চাকরীর কোনো বাঁধা ধরা সময় হয়ে না। বিকেলে ফিরে এলো অরূপ। বরযাত্রী আসতে এখনও প্রায় দু’ঘন্টা দেরী। ইতিমধ্যেই থানায় যাবার কারণটা মৃত্যুঞ্জয়কে বলল অরূপ। বরযাত্রীর আপ্যায়নের সরঞ্জাম করতে, করতে অরূপ মৃত্যুঞ্জয়কে বলল- ‘আজ সকালে দমদমের এক হোস্টেলে একটা ছেলের খুন হয়েছে।‘
‘হোস্টেলে খুন?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘না, ঠিক হোস্টেলে না। রাস্তায়।’
‘ রাস্তায়? কেউ প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো না?’
‘ না, এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আসলে ঘটনাটা ঘটেছে ভোর পাঁচটা নাগাদ। রাস্তা সুনসান ছিল সে সময়। কেউ তাকে ফোন করে হোস্টেলের বাইরে ডাকে।’ ‘
‘কার নম্বর পাওয়া গেলো ফোন চেক করে?’
‘আননোন নম্বর। সুইচ অফ। নম্বর ট্রেস করতে দেওয়া হয়েছে। কাল রিপোর্ট আসবে।’
‘কী দিয়ে খুন করা হয়েছে?’
‘ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে। সম্ভবত চাকু। কিন্তু সেটা পাওয়া যায়নি।’
‘লেগে পড়ো, অরূপ। মনে হয়ে এই কেসটা তুমি এ্যস সুন এ্যস পসিবল সলভ করে নেবে।’
বিয়ে চলাকালীন বহু বার অরূপের ফোন বেজে উঠল। বেশ চিন্তাগ্রস্ত ছিলো অরূপের মুখমন্ডল। সে সশরীরে তো বিয়ের অনুষ্ঠানে, কিন্তু মনটা যেন অন্যত্র। মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলো কেসের চাপটা হয়তো বাড়ছে। অরূপের কাছে এসে সে জিজ্ঞেস করলো- ‘কী হলো, অরূপ? বেশ চিন্তায় আছো মনে হচ্ছে?’
‘কল ট্রেসিং এর রিপোর্ট এসেছে, মৃত্যুঞ্জয়দা। ওই নম্বরটা অমৃতের নামেই নেওয়া।’ অরূপ বলল।
‘কোন নম্বরটা?’
‘যে নম্বর দিয়ে লাস্ট কল এসেছিল।’
‘অমৃতটা কে?’
‘যে খুন হয়েছে, তার নাম অমৃত। অমৃত সামন্ত।’
‘কলটা কোথা থেকে করা হয়েছিল জানা গেলো?’
‘হুম। দমদম থেকে। ভোর চারটে বেজে পঞ্চাশ মিনিটে। বাড়ির লোককে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা থানায় এসে বসে আছে।’ অরূপ বলল।
হাতে কোনো কেস পেলে রাতের ঘুম শেষ হয়ে যায়, সেটা জানে মৃত্যুঞ্জয়। তার সাথেও এমনই হতো। অরূপ দমদম থানার বড়বাবু। হয়তো অনেক রহস্যের সমাধান সে করেছে। কিন্তু এখন সে নার্ভাস কেন? কারণটা জানতে পারলো মৃত্যুঞ্জয় পরের দিন। অর্পিতার বিদায়ের পরে অরূপ মৃত্যুঞ্জয়কে বলল- ‘যার সামনে এতো বড় এক আই.পি.এস. অফিসার থাকবে, সে তো একটু হলেও নার্ভাস হবে। খুব বড় কমপ্লিকেটেড কেস আমি আজ পর্যন্ত হ্যান্ডেল করিনি। জানি না এই কেসটা কতোটা কমপ্লিকেটেড হবে।’
‘আমি আর আই.পি.এস. নয়, অরূপ। ভুল করছো তুমি। আমাকে দেখে নার্ভাস হবার কিছুই নেই।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘সত্যি বলতে এই প্রথম পুরোপুরি কোনো কেস আমার হাতে এলো। এর আগে কোনো থানার ইনচার্জ আমি ছিলাম না। কিছু দিন হলো দমদম থানার ইনচার্জ হয়ে আমি এসেছি। মৃত্যুঞ্জয়দা, একটা রিকোয়েস্ট করবো?’
‘কী?’
‘ক্যান উ হেল্প মি টু সোল্ভ দিস কেস? তোমার সান্নিধ্যে কিছু শেখার এর থেকে বড় সুযোগ আর কী কোনো দিন পাবো?’
পর্ব – ২
‘আমি অফিসিয়ালি তো তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না, অরূপ। কিন্তু আনঅফিসিয়ালি তোমার সাথে আছি।’ অরূপের কাজে বেরোবার আগে মৃত্যুঞ্জয় তাকে বলল।
সারা দিন মৃত্যুঞ্জয় বাড়িতেই থাকলো। অধিকাংশ সময় সে কাটালো অমলবাবুর সাথে। কিছু পুরোনো কথা যে উঠল সেটা বলাই বাহুল্য।
অমলবাবু বললেন- ‘মৃত্যুঞ্জয়, তখন তোমার মাথার ঠিক ছিলো না। প্রভার চলে যাওয়া তোমায় ভেঙ্গে দিয়েছিল। তখন তুমি যা করতে যাচ্ছিলে, তাতে তোমাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যেতো। ডিপার্টমেন্টে তোমার প্রয়োজন ছিল।’
‘প্রবলেম তো সেখানেই, স্যার। আপনারা শুধু ডিপার্টমেন্টের বিষয় ভেবে গেলেন। ডিপার্টমেন্টের এক অফিসারের মনে কী ঝড় চলছে সেটা আপনারা বুঝলেন না। আমার স্ত্রী ও তার গর্ভে থাকা ছ’মাসের সন্তানকে যারা মেরেছে, তারা পলিটিক্যাল লিডারের ডান হাত ছিলো। তাই আমি যদি তাদের প্রাণের শত্রু হয়ে যেতাম, তাহলে আমার জীবিত থাকায় প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যেতো। ডিপার্টমেন্ট চাইতো আমি অনবরত ডিপার্টমেন্টের হয়ে জটিল থেকে জটিল রহস্যের সমাধান করে যাই। তার জন্য আমার জীবিত থাকার প্রয়োজন ছিলো। স্যার, আজকের দিনে আমার এটা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না, যে ডিপার্টমেন্ট আমার সাথে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করেছে। আমার আজও রাতে ঘুম হয়ে না, স্যার। ততো দিন রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবো না, যতো দিন না আমি নিজের স্ত্রী ও সন্তানের খুনিদের শাস্তি না দিই।’
মৃত্যুঞ্জয়ের কথাগুলো চুপচাপ শুনলেন অমল হালদার।
‘তাই আমিও চাকরী ছাড়তে বাধ্য হলাম স্যার। যদি ডিপার্টমেন্ট আমার প্রতি স্বার্থপর হয়, তাহলে আমিও তার প্রতি স্বার্থপরই হবো।’
‘গ্লানি আমারও আছে, মৃত্যুঞ্জয়। প্রভা আমার মেয়ের মতো ছিল। তার অসময় চলে যাওয়া আমায় কতোটা আঘাত দিয়েছে সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু তুমি সে সময় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলে। সে সময় তোমাকে সামলানো দরকার ছিলো। যদি স্বার্থপরের কথা বলো, সেটা শুধু ডিপার্টমেন্ট নয়, স্বার্থপর আমিও। আমি প্রভার মতো মেয়েকে হারিয়েছিলাম, মৃত্যুঞ্জয়ের মতো ছেলে হারানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।’ দু’চোখ ছলছল করে উঠল অমলবাবুর।
রাত দশটার পর বাড়ি ফিরলো অরূপ। ডিনার শেষ করে ছাদে গিয়ে কথা হলো মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে তার। সিগারেটের ডিবে থেকে মৃত্যুঞ্জয়কে একটা সিগারটে দিয়ে একটা নিজে ধারালো সে। একটা টান দিয়ে বলল- ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে এসেছে।’
‘কী বেরোলো তাতে?’
‘সেটাই, যা আন্দাজ করেছিলাম। ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে গলার নলী কাটা হয়েছে।’
‘ফোন লিস্ট চেক করা হয়েছে?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ। শেষ কলটা দমদম থেকেই এসেছিল। নম্বরটা অমৃতের নামেই নেওয়া। বাকি কল হিস্ট্রি যা বেরলো তাতে বেশিরভাগ তার বন্ধুবান্ধবের নম্বর। পায়রাডাঙ্গাতে অমৃতের বাড়ি। বেশিরভাগ কল সেখানেই করা হয়েছে। কিছু কল করা হয়েছে কোলকাতায়। নিজের রুমমেটকে আর যেখানে টিউশন পড়াতো সেখানে।’
‘টিউশন পড়াতো অমৃত?’
‘হ্যাঁ, হাত খরচার জন্য। তার রুমমেট রাহুলের থেকে আমরা জানাতে পেরেছি। অমৃত কোলকাতায় থেকে ব্যাংক, রেল ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতো। খরচা বাবদ কিছু টাকা তার বাবা পাঠাতো, বাকি টাকা সে টিউশন করে রোজগার করতো।’
সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো – ‘রাহুল কী করে?’
‘একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী করে সে। অফিস সল্টলেকে।’
‘হোস্টেলের রুম থেকে কী, কী জিনিস পাওয়া গেলো অমৃতের?’
‘বিশেষ কিছুই না। কিছু জামাকাপড় আর বইপত্র।’
সিগারট ফেলে দিয়ে খানিক চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলো মৃত্যুঞ্জয়। তারপর জিজ্ঞেস করলো – ‘অমৃতের বাবা কী করেন?’
‘পায়রাডাঙ্গাতে তাঁর মুদির দোকান আছে।’ অরূপ জবাব দিলো।
‘অমৃতের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে কি না খোঁজ নিয়েছ?’
‘আছে একটা। তার ওয়ালেট থেকে এ.টি.এম. পাওয়া গেছে। কিন্তু তার ব্যাগ সার্চ করে কোনো ব্যাংকের পাসবুক পাওয়া যায়নি।’
‘খোঁজ নিয়ে দেখো। কোন ব্যাংকের কোন ব্রাঞ্চে তার অ্যাকাউন্ট, আর সেই অ্যাকাউন্টে এই মুহূর্তে কতো ব্যালেন্স আছে।’
‘ঠিক আছে, মৃত্যুঞ্জয়দা।’
‘অমৃতের কোলকাতায় পরিচিতির কেউ আছে কী?’
‘এখন পর্যন্ত তো কাউকে পাওয়া যায়নি।’
‘তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কোলকাতায় কে আছে?’
মাথা নেড়ে ‘না’ বলল অরূপ – ‘কেউ না।’
‘দিনে কটা টিউশনি করতো সে?’
‘এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলতে গেলে, দুটো। রোজ সন্ধ্যা ছ’টায় বেরোতো, রাত দশটায় ফিরতো।’ অরূপ বলল।
‘তার মানে এই দুটো টিউশনি থেকে রোজগার বেশ ভালোই হতো তার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন কোলকাতায় তার বিশেষ পরিচিতি কেউ ছিলো না, তখন তাকে এই টিউশন গুলো কে ধরিয়ে দিয়েছিল?’
মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নে চুপ থাকলো অরূপ। নিরুত্তর সে।
‘এই প্রশ্নের উত্তর সেখানে গিয়েই পাওয়া যাবে, যেখানে অমৃত টিউশন পড়াতো। অরূপ তুমি এক কাজ করো, আগামী কাল তুমি অমৃতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ডিটেল্স বার করো। আমি বরং তার টিউশন বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নি। তার টিউশন বাড়ির ঠিকানা দাও।’
বাঘাযতীনের এক বহুতল অট্টালিকা। তারই আট তলায় 712/B নম্বর ফ্ল্যাটে থাকে মিতালী গাঙ্গুলী। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, সুগঠিত সুন্দর চেহারা এবং উপস্থিত বুদ্ধি রাখে খুব বেশি। কলিং বেল টিপতে পরিচারিকা দরজা খুলল।
‘ম্যাডাম আছেন?’ পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘আপনি?’ জবাব দেওয়ার বদলে পরিচারিকা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো।
‘ম্যাডামকে বলুন পুলিশের লোক এসেছে।’
পুলিশের নাম শুনে পরিচারিকার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।
‘কে এসেছে রে?’ ইতিমধ্যেই মিতালী ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিছু সেকেন্ড মৃত্যুঞ্জয়কে অবাক দৃষ্টিতে দেখার পর জিজ্ঞেস করলো – ‘আপনি?’
‘হ্যাঁ আমি। আমি এ সি পি মৃত্যুঞ্জয় মজুমদার, সি.আই.ডি.।’
‘সি.আই. ডি.! সি.আই.ডি. হঠাৎ আমার বাড়িতে কেন জানতে পারি?’
‘নিশ্চই জানতে পারেন ম্যাডাম। আসলে আমাদের কাছে সময়ের খুব অভাব। তাই ফালতু ঘুরে বেড়ানো আমাদের পোষায় না। যেখানে যাই, কাজেই যাই।’
পরিচারিকাকে চা করতে বলে মৃত্যুঞ্জয়কে হল ঘরের সোফাতে বসতে দিলো মিতালী। হল ঘরটা ভালো করে এক বার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো মৃত্যুঞ্জয়। বেশ সুন্দর সাজানো ঘর। দামী সোফাসেট, মাটিতে দামী কার্পেট, দেয়ালে ঝুলছে বেশ সুন্দর কিছু ওয়েল পেন্টিং। তাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের কারণে ঘরটা বেশ ঠান্ডা। ঘর সাজাবার জন্য প্লাস্টার অফ প্যারিসের বেশ কিছু মূর্তি এবং কিছু শোপিস দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়।
মৃত্যুঞ্জয়ের সামনের সোফাতে বসে মিতালী বলল – ‘বলুন, আজ হঠাৎ সি.আই.ডি. আমার ফ্ল্যাটে আসার প্রয়োজন বোধ করলো কেন?’
‘আপনি অমৃত সামন্তকে কী ভাবে চেনেন?’
অমৃতের নাম শুনে মুখটা ঈষৎ শুকিয়ে গেলো মিতালীর।
‘আমার মেয়ে রিয়াকে টিউশন পড়াতো অমৃত, প্রায় এক বছর ধরে। খুব ভালো পড়াতো সে। সত্যি বলতে এখন চিন্তায় পড়ে গেলাম। রিয়ার জন্য নতুন টিউটার খুঁজতে হবে। সামনে পরীক্ষা তার। কী যে করি, কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বিষণ্ণতা ভরা মুখে মিতালী বলল।
‘তার মানে আপনি প্রায় এক বছর ধরে চেনেন অমৃত কে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী করে পরিচয় হয়ে তার সাথে আপনার?’
‘আমার এক বান্ধবীর মাধ্যমে। তার ছেলেকেও অমৃত টিউশন পড়াতো।’
‘কী নাম আপনার বান্ধবীর?’
‘রুবি দে। বালিগঞ্জে থাকে।’
পর্ব – ৩
‘আপনি আর আপনার মেয়ে থাকে এই ফ্ল্যাটে?’ মৃত্যুঞ্জয়ের আরেকটা প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ।’
‘আপনার হাসবেন্ড?’
‘মারা গেছেন, প্রায় দু’বছর হলো।’
‘ওঃ! সরি। এই ফ্ল্যাটটা আপনার নামে না আপনার হাসবেন্ডের নামে?’
এই প্রশ্ন অল্প বিরক্ত হলো মিতালী। বলল – ‘এর উত্তরের সাথে কি এই কেসের কোনো যোগাযোগ আছে?’
মৃদু হেসে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘যোগাগোগ আছে কি না সেটা আমরা বুঝে নেবো, ম্যাডাম। আপনি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান।’
চা চলে এলো। চা দিয়ে পরিচারিকার ভেতরে চলে যাওয়ার পর মিতালী বলল- ‘এই ফ্ল্যাটটা আমার। হাসবেন্ড মারা যাওয়ার ছ’মাস পর আমি কিনেছি। আমার শ্বশুর বাড়ী বেহালাতে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সেখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কিনি।’
‘আপনার মেয়েকে দেখছি না।’
‘সে স্কুলে। সকাল আটটা থেকে দুপুর দু’টো পর্যন্ত তার স্কুলে থাকে।’
‘আপনার অফিসের টাইম কী?’
‘এগারোটা থেকে পাঁচটা।’
‘আপনার মেয়ে যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে তখন বাড়িতে কে থাকে?’
‘আমার কাজের লোক। যে বৌটা চা দিয়ে গেলো, সে। তার ডিউটি সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যে ছ’টা অবধি।’
‘কতো দিন ধরে কাজ করছে সে?’
‘আমার এখানে আসার পর থেকেই।’
‘তার সাথে কি কথা বলা যেতে পারে?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু এখন না। আমার অফিসের দেরি হচ্ছে। আপনি বরং কাল আসুন। কাল আপনি তার সাথে কথা বলে নেবেন।’
মৃত্যুঞ্জয় ঘড়ি তে সময় দেখলো। সকাল প্রায় দশটা।
‘কাল যদি আপনার পরিচারিকা না আসে?’
‘সন্দেহ করছেন?’
‘সন্দেহ করা তো আমাদের কাজ, ম্যাডাম। আমরা প্রত্যেককে সন্দেহ করি।’
‘আপনি আজ আমায় যেখানে পেলেন, কালও সেখানেই পাবেন। আমার পরিচারিকাও আগামী কাল থাকবে।’ দৃঢ় কন্ঠে মিতালী বলল।
‘বেশ। যাওয়ার আগে আপনার থেকে তিনটে জিনিস চাইবো।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘কী?’
‘আপনার শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা, আপনার অফিসের ঠিকানা এবং রুবিদের বাড়ির ঠিকানা। আশা করি আপনার আপত্তি হবে না।’
‘না, আপত্তি নেই। তবে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের বিরক্ত না করাই ভালো। তাদের সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘চিন্তা করবেন না। খুব একটা বিরক্ত করবো না। আর হ্যাঁ, আপনার স্বামীর নামটা আপনি বললেন না।’
‘দিবাকর গাঙ্গুলী। বিজনেসম্যান ছিলো, ক্যান্সারে মারা যায়।’
মিতালী গাঙ্গুলীর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় ফোন করলো অরূপকে। মিতালীর শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলল- ‘খোঁজ নাও বাড়িতে কে,কে থাকে এখন। নিজের শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে মিতালীর সদ্ভাব ছিলো কি না। বিশেষ করে নিজের স্বামীর সাথে।’
আগামী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মৃত্যুঞ্জয় বাঘাযতীন থেকে গিরিশ পার্ক গেলো। অমৃত নিজের দ্বিতীয় টিউশন সেখানেই করতো। প্রশান্ত বাগচী নামের এক জনের ছেলেকে পড়াতো সে। প্রশান্ত বাগচীর বাড়ি খুঁজে পেতে অল্প বেগ পেতে হলো তাকে। ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি। বাড়ি খুঁজে পেয়েও কোনো লাভ হলো না মৃত্যুঞ্জয়ের। দরজায় তালা দেওয়া। খবর নিয়ে জানতে পারলো যে প্রশান্ত বাগচী সপরিবার কোনো এক আত্মীয়র বিয়েতে কোলকাতার বাইরে গেছেন। যে কোনো তদন্তের জন্য সময়ের মূল্য সব থেকে বেশি হয়। এখানে আসাতে সময় নষ্ট হলো মৃত্যুঞ্জয়ের। ঘড়িতে সময় দেখলো সে, বেলা বারোটা বেজে গেছে। আর বেশি সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে পড়লো বালিগঞ্জের দিকে। তার আগে রুবি দেকে ফোন করলো সে। মিতালী দিয়েছিল রুবি দের নম্বর।
‘হ্যালো! ‘ এক মিহিন কন্ঠ ভেসে এলো মোবাইলের ওপার থেকে।
‘আমি কি রুবি দের সাথে কথা বলতে পারি?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘বলছি। আপনি?’
‘আমি সি.আই.ডি. থেকে এ.সি.পি. মৃত্যুঞ্জয়।’
খানিক নিস্তব্ধতা পর ওপার থেকে আওয়াজ এলো- ‘বলুন।’
‘আপনার সাথে দেখা করতে চাই?’
‘কারণ জানতে পারি কী?’
‘অবশ্যই পারেন। কিন্তু কারণটা ফোনে বলা যাবে না। অত্যন্ত কনফিডেন্সিয়াল।’
রুবি দে বলল- ‘দেখুন, আমি এই মুহূর্তে নিজের পার্লারে আছি। এখানে পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। সে কোনো পুলিশ অফিসারই কেননা হোক। আপনি বরং এক কাজ করুন, সন্ধ্যে ছ’টার পর আমার বাড়িতে আসুন। সেখানে নিশ্চিন্তে কথা হতে পারবে।’
মাথা গরম হলো মৃত্যুঞ্জয়ের। একে এমনিতেই সময় নষ্ট হয়েছে, এর থেকে বেশি সময় নষ্ট করতে সে নারাজ। বেশ উচ্চ গলায় সে বলল- ‘আপনার সময়ের মতো আমরা চলতে পারবো না, ম্যাডাম। আমাদের প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান। তাই সন্ধ্যে ছ’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব না। আমি এক ঘন্টার ভেতর বালিগঞ্জ চৌমাথায় পৌঁছাবো। আপনি সেখানে দেখা করবেন আমার সাথে।’
চলবে………………