অমৃতের বিষ পান (পর্ব -২)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
এক ঘন্টার থেকে অল্প বেশি সময় লাগলো মৃত্যুঞ্জয়ের বালিগঞ্জ চৌমাথায় পৌঁছাতে। সে দেখলো বেশ ফরসা এক মহিলা, পরনে লাল শাড়ি, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে এবং বারবার কাউকে ফোন করছে। মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলে রিং হচ্ছিলো। সে বুঝতে পারলো লাল শাড়ি পরা মহিলাটি রুবি দে। ফোন কেটে এগিয়ে গেলো সেদিকে।
‘আপনি কি রুবি দে?’ মহিলাটির পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
মহিলাটি ঘুরে দেখলো তাকে।
‘হ্যাঁ।আপনি সি.আই ….’
‘হ্যাঁ আমি।’
মুখে কৃত্তিম হাসি নিয়ে রুবি দে বলল- ‘আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আমায়। আসুন, এখানে দাঁড়িয়ে তো কথা হবে না। আমার পার্লারেই চলুন।’
‘কিন্তু সেখানে তো পুরুষের প্রবেশ নিষেধ।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘আপনি যেভাবে ফোনে কথা বললেন তাতে এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে ব্যাপার খুবই গুরুতর। আর গুরুতর ব্যাপারের আলোচনা রাস্তায় হয় না। তাই না? কেও যদি কোনো জরুরি ব্যাপারে আমার সাথে দেখা করতে আসে, তাহলে তার জন্য আমার পার্লারের দরজা অবশ্যই খোলা আছে। চলুন, বেশি দূর না, পাশেই।’
রুবি দের পার্লার তার বাড়ির সাথে লাগোয়া, এক তলায়। একটা বোর্ড লাগানো আছে ‘দে বিউটি পার্লার’। পার্লারে দুটো ঘর। সামনের ঘরে পার্লারের কাজ হয়। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো কোনো গ্রাহক নেই। দুটো অল্প বয়সী মেয়ে একসাথে বসে টিফিন করছে। বোধহয় এই পার্লারেই কাজ করে তারা। ভেতরের ঘরটা তুলনামূলক ছোটো। ছোটো আকারের গোল করে এক সোফাসেট পাতা আছে, মাঝখানে একটা গোল সেন্টার টেবিল। মৃত্যুঞ্জয়কে সেই ঘরে নিয়ে গেলো রুবি দে। রুবি দের বয়স মিতালীর বয়সের কাছাকাছি হবে। রুবি দেকেও দেখতে মন্দ না। গায়ের বর্ণ মিতালীর থেকে বেশি পরিস্কার হবে। কাঁধ পর্যন্ত চুল কাটা। চেহারার গঠন অল্প ভারিক্কি। কথা বলার পটুতা যেন মিতালীর থেকে বেশি রুবির। মৃত্যুঞ্জয়কে বসতে দিয়ে বলল- ‘বাইরে প্রচণ্ড রোদ, তায় আপনারা আবার পুলিশের লোক। মাথা সবসময় গরমই থাকে আপনাদের। বসুন, আপনার জন্য শরবত নিয়ে আসি।’
‘ধন্যবাদ। শরবত লাগবে না আমার। এক গেলাস জল হলেই হবে।’
জল পান করার পর মৃত্যুঞ্জয় রুবিকে জিজ্ঞেস করলো- ‘আপনি মিতালী গাঙ্গুলীকে চেনেন?’
‘মিতালী গাঙ্গুলী? যে বাঘাযতীনে থাকে?’
‘হ্যাঁ। খুব ভালো করে চিনি। সে তো আমাদের সমিতির এক সদস্য।’ রুবি জবাব দিলো।
‘কিসের সমিতি?’
‘আমাদের এক মহিলা সমিতি আছে। নাম দিয়েছি, “মহিলা উন্নয়ন সমিতি”। এই ঘরটা আসলে সমিতির মিটিংএ কাজে আসে। সমিতিতে যত সদস্য আছে সবার বাড়িতে একবার, এক বার করে মিটিং হয়। আমার বাড়িতে মিটিং হলে সেটা এখানেই হয়। হঠাৎ মিতালীর বিষয় জিজ্ঞেস করলেন? ও ভালো আছে তো?’
‘হ্যাঁ, সে ভালো আছে। আচ্ছা, আপনি অমৃতকে চেনেন?’ মৃত্যুঞ্জয় আরেকটা প্রশ্ন করলো।
‘কে অমৃত?’
‘অমৃত সামন্ত। দমদমে থাকে। বয়স প্রায় তেইশ, চব্বিশ।’
মনে পড়লো রুবির- ‘ও হ্যাঁ, চিনি বৈকি। আমার ছেলেকে টিউশন পড়াতো।’
‘টিউশন থেকে তাকে সরিয়ে দিলেন কেন?’
‘কারণ ছিলো। আমার ছেলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। অমৃত ইংলিশে কাঁচা ছিলো একটু। অসুবিধে হচ্ছিলো। তাই তাকে সরিয়ে অন্য টিচার নিতে বাধ্য হলাম।’ রুবি বলল।
‘কতো দিন আপনার ছেলেকে পড়িয়েছে সে?’
একটু চিন্তা করে রুবি বলল- ‘প্রায় ছ’মাস।’
‘আপনার সাথে অমৃতের পরিচয় কী করে হয়?’
‘অমৃতের মায়ের সাথে আমার পরিচয়। সে আমার বান্ধবী নয়, আমার থেকে বয়সে তিনি বড়। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের। অমৃতের বাবা তার মায়ের ওপর অত্যাধিক টর্চার করতো। সেই টর্চার সহ্য না করতে পেয়ে একদিন অমৃতের মা বাড়ি ছেড়ে কোলকাতা চলে আসে। শেয়ালদা স্টেশন থেকে আমরা তাকে উদ্ধার করি এবং বাড়ি ফেরত নিয়ে যাই। তবে থেকে অমৃতের সাথে পরিচয় আমার।’
খানিক বিরতি নিয়ে রুবি দে আবার বলল- ‘কেন বলুন তো? হঠাৎ অমৃতের বিষয় প্রশ্ন। সে ভালো আছে তো? অনেক দিন তার খোঁজ নেওয়া হয়নি।’
‘না। সে ভালো নেই। তাকে খুন করা হয়েছে।’
‘কী! খুন করা হয়েছে?’ খুনের কথা শুনে আঁতকে উঠল রুবি দে।
‘হ্যাঁ, খুন করা হয়েছে তাকে।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘কিন্তু কেন? কী দোষ করেছিল সে?’
‘সেটারই তো তদন্ত করছি ম্যাডাম।’
বিষণ্ণতার কালো ছায়া রুবির মুখের ওপর স্পষ্ট ফুটে উঠল। খানিক ঘাড় হেঁট করে বসে রইল সে।
‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার কথায়। অমৃত এক সাধারণ ছাপোষা ছেলে, কেউ অকারণে তাকে খুন করবে কেন?’
‘ম্যাডাম, মাঝে-মাঝে সাধারণ ছেলেও কিছু অসাধারণ কাজ করে ফেলে, যার ফলে তাকে নিজের প্রাণ দিতে হয়ে।’
‘কবে হলো খুনটা?’ রুবি জিজ্ঞেস করলো।
‘দু’ দিন হলো। আপনি অমৃতের বিষয় আরও কী, কী জানেন?’
‘খারাপ কিছুই জানি না। তাকে টিউশনি থেকে বার করতে খারাপ লেগেছিল আমার। দু’ পয়সা রোজগার তো হতো। তার রোজগার বন্ধ করতে আমি চাইনি। তাই একটা পার্ট টাইম জবের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম তাকে। কিছু দিন সেখানে কাজ করলো সে। তারপর ছেড়ে দিলো। বলল যে সে পড়াশোনা করতে চায়। সরকারী চাকরী পাওয়া তার লক্ষ্য।’ কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে রুবি বলল।
‘পার্ট টাইম কাজটা কোথায় করতো সে?’
‘পার্ট টাইম কাজ বলতে আমাদের মহিলা উন্নয়ন সমিতির কাজ দেখাশোনা করতো। হাত খরচা বাবদ কিছু টাকা তাকে দিতাম।’
বাইরের ঘরে বসে থাকা দু’টো মেয়ের মধ্যে এক জন আওয়াজ দিলো- ‘দিদি, কেউ এসেছে।’
‘যাই। প্লিজ, আপনি বসুন, আমি এখনই আসছি।’ কথা বলে বেরিয়ে গেলো রুবি।
ঘরটাকে ভালো করে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়। দেয়ালে শোকেস ঝুলছে। বেশ কিছু পত্রিকা সাজানো তাকে।
বাইরের ঘর থেকে এক পুরুষের কন্ঠস্বর ভেসে এলো- ‘আমি তাহলে আসি এখন। এক ঘন্টা পরে আসবো তোমায় নিতে।’
মৃত্যুঞ্জয় উঁকি মেরে দেখলো মেকআপের একটা চেয়ারে এক মহিলা বসে আছে, এবং দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এক পুরুষ। সেই মহিলাটির স্বামী হয়তো। এবার এখানে থাকা সম্ভব না। রুবি দে এবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। মৃত্যুঞ্জয় ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
‘আমি এবার আসি। শুধু একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিল আপনাকে।’
‘করুন।’ বিনম্র কন্ঠে রুবিদে বলল।
‘আপনার বাড়িতে কে, কে থাকেন?’
‘আমি, আমার ছেলে আর বৃদ্ধ শ্বশুর। বর বিদেশে থাকে। শাশুড়ি মারা গেছেন প্রায় পাঁচ বছর হলো।’
রাত্রে অরূপের ঘরেই কথা হলো দুজনের। অরূপ বলল- ‘অমৃতের ব্যাংক ডিটেল্স চেক করা হয়েছে। তার ব্যাংক ব্যালেন্স শুনলে চমকে যাবে।’
‘কতো?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘এই মুহূর্তে তার এ্যকাউন্টে বাষট্টি হাজার টাকা আছে।’
‘হুম, বুঝলাম। টিউশন থেকে এতো টাকা রোজগার সম্ভব না।’ কথা শেষ করে একটা সিগারটে ধারালো মৃত্যুঞ্জয়।
‘কোনো দু’নম্বর ধান্দাও হতে পারে। সারা দিন না হোক, অমৃতের সাথে সারা রাত থাকতো তার রুমমেট রাহুল। সব না হোক, কিছু তো জানে সে নিশ্চয়ই। আজ সন্ধ্যেতে আবার সেই হোস্টেলে গিয়েছিলাম। রাহুলের সাথে দেখা করতে।’
‘দেখা হলো তার সাথে?’ মৃত্যুঞ্জয় প্রশ্ন করলো।
‘না, হয়নি। সে নাকি হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছে।’
কথাটা শুনে একটুও আশ্চর্য হলো না মৃত্যুঞ্জয়। মৃদু হেসে বলল- ‘সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? তোমরা দেরী করলে, তার লাভ উঠিয়ে নিলো সে। যে দিন অমৃতের খুন হয়েছিল, সে দিনই রাহুলকে জেরা করা দরকার ছিল। সে কোথায় গেছে জানতে পারোনি নিশ্চয়ই।’
‘না।’
‘জানতে পারবে, রাহুলের অফিস থেকে। কাল তার অফিসে যাও। সেখানে দেখা করো রাহুলের সাথে। বেহালার যে বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলাম, সেখানে খোঁজ করেছিলে?’
অরূপ বলল- ‘হ্যাঁ, করেছিলাম। বাড়িতে মিতালী গাঙ্গুলীর শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর এবং দেওরর বৌ থাকে।’
‘তারপর।’
‘দিবাকর গাঙ্গুলী, মানে মিতালীর স্বামী এবং দিবাকরের ভাই ভাস্কর গাঙ্গুলী মিলে এক সাথে একটা দোকান চালাতো। হার্ডওয়ারের দোকান, বেশ বড়, বেহালাতেই। দিবাকর গাঙ্গুলী ছিল এক নম্বরের মাতাল। খবর নিয়ে জানা গেলো সে নাকি কুড়ি বছর বয়স থেকে মদ ধরেছে। শেষের দিকে মদ্যপান নাকি অসম্ভব বাড়িয়ে দিয়েছিল। দোকানের দিকে মন ছিল না তার। দোকানটা প্রায় ভাস্কর গাঙ্গুলী চালাতো। এই নিয়ে বাড়িতে রোজ চরম অশান্তি। লিভার সিরোসিস হয়ে মারা যায় দিবাকর। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি কি দিবাকরের গত হওয়ার আগে থেকেই মিতালীর চালচলন খুব একটা ভালো ছিলো না।’
‘মানে?’
‘মানে, মিতালীর নাকি কুদৃষ্টি ছিলো নিজের দেওর ভাস্করের ওপর। ভাস্করকে দু’ এক বার নাকি সিড্যুস করার চেষ্টাও সে করেছে।’
‘আই সি …. তার পর?’
‘পারিবারিক অশান্তি, যা হয়ে আর কি। দিবাকর মারা যাওয়ার পর নাকি মিতালী এক বিন্দু চোখের জল ফেলেনি। উল্টে ভাস্করকে আরও বেশি করে সিড্যুস করতে শুরু করলো।’
সিগারেটের শেষটা অ্যাশট্রেতে ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘আমার যতো দূর মনে হয়ে মিতালীর কাজের বৌএর থেকে বেশ কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যেতে পারে। অনেক সময় তারা ভেতরের খবর একটু বেশিই রাখে। কিন্তু মিতালীর সামনে তাকে জেরা করে লাভ নেই। মুখ খুলবে না সে। তাকে আলাদা করে জেরা করতে হবে।’
‘তাকে কি থানায় উঠিয়ে নিয়ে আসবো?’
‘না, থানায় না। চারিদিকে পুলিশ দেখলে সে ঘাবড়ে যেতে পারে। আগামী কাল সন্ধ্যে সাতটা, যখন সে মিতালীর ফ্ল্যাট থেকে বেরোবে, তখন। তার আগে আমাকে পাপিয়ার সাথে দেখা করতে হবে। কিছুক্ষণের জন্য মরতে হবে মৃত্যুঞ্জয়কে।’
পাপিয়া মুখার্জী বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মেকআপ আর্টিস্টের কাজ করে। মৃত্যুঞ্জয়ের বহু পুরনো পরিচিত। টালিগঞ্জে একটা ফ্ল্যাটে থাকে সে। সকাল-সকাল বেরিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয় তার সাথে দেখা করার জন্য। বহু দিন পর দেখা হবে পাপিয়ার সাথে। বহু রহস্য সমাধান করতে মৃত্যুঞ্জয়কে পাপিয়ার সাহায্য নিতে হয়েছে। কখনও চার্চের ফাদার, কখনও মসজিদের শেখ কিম্বা মন্দিরের পুরোহিত …. নিখুঁত মেকআপ দিতো পাপিয়া। মৃত্যুঞ্জয়কে মৃত্যুঞ্জয় বলে চেনাই যেতো না। পাপিয়ার সাথে শেষ দেখা হওয়ার কথা মনে পড়লো মৃত্যুঞ্জয়ের। মৃত্যুঞ্জয়ের জীবনে তখন প্রভা নেই। চারিদিক দিয়ে অন্ধকার বিষন্নতায় ঢাকা মৃত্যুঞ্জয়ের জীবন। চাকরী ছাড়ার পর কোলকাতা ছাড়ার আগে পাপিয়ার সাথে দেখা করেছিল সে। পাপিয়ার দু’চোখে ছিল জল। মৃত্যুঞ্জয়কে যেতে দিতে চায়নি সে। চেষ্টা করেছিল যাতে সে না যাক। কিন্তু নিজের চেষ্টায় বিফল হয়েছিল সে। এই মুহূর্তে মৃত্যুঞ্জয়কে নিজেকে বড্ড স্বার্থপর মনে হলো। এক সময় পাপিয়ার অনুরোধ সে রাখেনি। পাপিয়া হাত জোর করে অনুরোধ করেছিল- ‘যেও না মৃত্যুঞ্জয়। তুমি চলে যাওয়াটা সমস্যার সমাধান নয়। তুমি কিছু দিন চাকরী থেকে ছুটি নিয়ে নাও। কোথাও ঘুরে এসো। জানি, এগুলো ভোলা এতো সহজ না। কিন্তু মানুষকে ভুলে থাকতে হয়ে।’
রাখতে পারেনি সে পাপিয়ার অনুরোধ। আজ সেই পাপিয়ার সাথে আবার সে যাচ্ছে, সাহায্য চাইতে। সত্যি, পরিস্থিতি মানুষকে মাঝে মাঝে স্বার্থপর করে দেয়।
পাপিয়ার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘কে?’ পাপিয়ার সে চেনা কন্ঠস্বর ভেসে এলো মৃত্যুঞ্জয়ের কানে।
জবাব দেওয়ার বদলে এক বার আরও বেল টিপলো সে।
কিছু সেকেন্ড পর মৃত্যুঞ্জয়ের সামনের বন্ধ দরজাটা খুলে গেলো। দরজা খুলে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল পাপিয়া।
‘মৃত্যুঞ্জয়!’ অবাক কন্ঠে পাপিয়া বলল।
‘চিনতে পারলে তাহলে।’
মৃত্যুঞ্জয়কে ভেতরে নিয়ে গেলো পাপিয়া। দুজনেরই একে অপরকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো, অনেক কিছু বলার ছিলো। সংক্ষেপে নিজের কথা পাপিয়ার সামনে পরিবেশন করলো মৃত্যুঞ্জয়। কোলকাতা আসার কারণ বলল, অমৃত হত্যার ঘটনা বলল এবং অবশেষে পাপিয়ার কাছে আসার কারণটাও সে বলল।
‘তুমি রহস্যকে ছেড়ে দিলে কী হবে মৃত্যুঞ্জয়, রহস্য তোমায় ছাড়বে না। আমি সেই রহস্যের প্রতি কৃতার্থ যার কারণে তুমি আমার কাছে এলে তো, মনে পড়লো তো আমার কথা। বলো, আজ কী সাজে সাজাবো তোমায়?’
‘তোমার ইচ্ছে, পাপিয়া। তোমার যেমন ইচ্ছে, তেমন আমাকে সাজিয়ে দাও।’
মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, পরনে গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবী ও সাদা পায়জামা। কাঁধে এক কাপড়ের ব্যাগ। মৃত্যুঞ্জয়কে চেনা দুস্কর। বাঘাযতীনের এক চায়ের দোকানে বসে চা পান করছে মৃত্যুঞ্জয়। তার হাত ঘড়িতে বাজে ঠিক সন্ধ্যে সাতটা। মিতালী গাঙ্গুলীকে অ্যাপার্টমেন্টে প্রায় আধ ঘন্টা আগে সে ঢুকতে দেখেছে। মিতালীর পরিচারিকার এবার বেরোবার সময় হয়ে এসেছে। চা শেষে করে দোকানিকে টাকা দিতে যাবে সে, ঠিক সেই সময় পরিচারিকার ওপর নজর গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের। চায়ের মূল্য দিয়ে অতি সন্তর্পণে পরিচারিকার পিছু নিলো সে। পরিচারিকা ধীরে ধীরে বাঘাযতীন রেলওয়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলেছে। তার থেকে প্রায় কুড়ি হাত দূরে মৃত্যুঞ্জয়। পরিচারিকা স্টেশনে ঢুকে সব থেকে আগে কাটলো একটা টিকিট। না, আর বেশি সময় নষ্ট করা চলবে না। এ সময় ট্রেনে ভিড় খুব হয়। ট্রেনে এক বার চড়ে গেলে পরিচারিকাকে খুঁজে বার করা খুব কঠিন। পরিচারিকা এগোলো প্ল্যাটফর্মের দিকে, মৃত্যুঞ্জয় ভিড় ঠেলে এগোলো তার দিকে। শেয়ালদা যাওয়ার এক ট্রেনের ঘোষনা হলো। মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গিয়ে পরিচারিকার কাঁধে হাত দিলো। পরিচারিকা ঘাবড়ে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো।
‘বেশি প্রশ্ন না। ব্যাগে বন্দুক আছে। আসুন আমার সাথে।’ পরিচারিকার কানে ফিসফিস করে বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘আ – আ – আপনি ….’
পরিচারিকা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার মুখ নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘বেশি কথা নয় বললাম না।’
পরিচারিকাকে টানতে টানতে স্টেশনের এক ধারে নিয়ে গেলো সে। একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়ালো তারা। পরিচারিকার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘আমি গত কাল সকালে মিতালীর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। সেই পুলিশের লোক আমি।’
‘পুলিশের লোক!’ আরও ঘাবড়ে গেলো পরিচারিকা।
‘হ্যাঁ। যা,যা জিজ্ঞেস করবো, সঠিক উত্তর দেবে।’
‘আ ..আমি তো জানি না কিছু।’ পরিচারিকার কন্ঠে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
‘বলতে গেলে সারা দিন তুমি মিতালী গাঙ্গুলীর বাড়িতে থাকো। কিছু জানি না বললেই যে আমি বিশ্বাস করে নেবো তোমার কথা, সেটা ভাবলে কী করে? যতটুকু জানো, ততো টুকুই বলো।’
পরিচারিকা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। অশ্রু ভেজা কন্ঠস্বরে বলল- ‘আমি সাধারণ মানুষ বাবু। বাড়িতে স্বামী আর দুটো বাচ্চা আছে। আমাকে কেন এই ঝঞ্ঝাটে ….’
‘তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমি যে তোমার থেকে কিছু জানতে পেরেছি, সেটা কাউকে বলবো না। বিশ্বাস রাখতে পারো আমার ওপর। আমি শুধু অমৃত আর মিতালীর বিষয় কিছু জানতে চাই।’
‘আমি বেশি কিছুই জানি না বাবু। অমৃত সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টায় পড়াতে আসতো আর আমি সাতটায় বেরিয়ে পরতাম।’ পরিচারিকা বলল।
‘মিতালী বাড়ি ফেরে কটায়?’
‘ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার ভেতর। মিতালীদি’র ঢুকবার কিছুক্ষণ পরেই অমৃত আসতো বিটিয়াকে পড়াতে।’
‘তোমার মিতালীদি’র সাথে অমৃতের সম্পর্ক কেমন ছিল? মানে, মিতালী কোনো দিন তোমার সামনে অমৃতের প্রশংসা বা নিন্দে করেছে?’ প্রশ্ন করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘না, কোনো দিন কিছু বলেনি। তবে এক দিন ..’
যেন কিছু মনে পড়লো পরিচারিকার। কিছু বলতে গিয়েও যেন সে থেমে গেলো।
‘কী বলো তবে এক দিন কী?’ মৃত্যুঞ্জয় জোড় দিলো।
‘এক দিন …. এক দিন সন্ধ্যে সাতটায় আমি বেরিয়ে পরলাম। আমার অদ্ভুত লাগতো যে সাতটা বাজাতে না বাজতেই মিতালীদি আমায় চলে যেতে বলতো। যদি আমার কোনো কাজ বাকি রয়ে যেতো তাহলে মিতালীদি বলতো যে সে কাজটা সে নিজেই করে নেবে। সে দিনও আমি ঠিক সাতটায় বেরিয়ে গেলাম। কিছু দূর এগোবার পর আমার মনে হলো , মিতালীদি’র কাছ থেকে টাকা চাইতে আমি ভুলে গেছি। টাকার প্রয়োজন ছিলো সে দিন। মিতালীদিকে আমি সকালেই টাকার কথা বলেছিলাম। দিদি বলেছিল যে সন্ধ্যে বেলায় এসে দেবে। আমি ফিরে গেলাম টাকা চাইতে। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিলো। দিদি হয়তো বন্ধ করতে ভুলে গেছিলো। দরজার ফাঁক দিয়ে যা দেখলাম, সেটা কোনো দিন ভুলবো না।’ এতো দূর বলে বিরাম নিলো পরিচারিকা।
কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় তাকে বিরাম দিতে নারাজ।
‘কী দেখলে?’
‘দেখলাম …. দেখলাম, অমৃত বিটিয়াকে পড়াচ্ছে, আর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে দিদি। একটা নাইটি পড়ে। খুবই খোলামেলা নাইটি। মাঝে মাঝে এমন ভাবে অমৃতের সামনে আসছিলো যে ….’
কথাটা বলতে গিয়ে পরিচারিকা থেমে গেলো। চোখে মুখে একরাশ ঘৃণার ছাপ। খানিক চুপ থাকার পর পরিচারিকা আবার বলল- ‘আগে আমি দিদিকে ভালবাসতাম, সম্মান করতাম। কিন্তু সে দৃশ্য দেখার পর ভালোবাসা, সম্মান সব চলে গেছে। পেটের দায়ে পড়ে আছি বাবু।’
‘কতো দিন আছো মিতালীর সাথে?’
‘শুরু থেকে। তার শ্বশুর বাড়ির চাকরানি আমি। মিতালীদি’র চলে আসাতে আমিও চলে আসি।’
‘নিজের দেওরের সাথে ….’
‘না বাবু ..’ মৃত্যুঞ্জয়কে মাঝপথে থামিয়ে পরিচারিকা বলল- ‘আমি আর কিছু জানি না বাবু। আমায় খ্যামতে দিন।’
পরিচারিকা চলে গেলো। শেয়ালদা যাওয়ার একটা আরও ট্রেন চলে আসছিলো। ট্রেনের অপেক্ষা করছিলো পরিচারিকা। একটা সিগারটে খাওয়ার জন্য মৃত্যুঞ্জয় স্টেশনের বাইরে ঠিক তখনই এক বিকট চিৎকার শুনতে পেলো সে। প্ল্যাটফর্মের দিকে দৌড় দিলো মৃত্যুঞ্জয়। ট্রেন ততক্ষণে ঢুকে গেছে, সাথে শুরু হয়েছে হৈহল্লা।
‘বাঁচা…বাঁচা।’
‘ট্রেন থামা।’
‘ধর, ধর পালিয়ে গেলো।’
নানাবিধ কথা।
মৃত্যুঞ্জয় কাছে গিয়ে দেখলো, প্রায় দু’টুকরো হয়ে পড়ে আছে মিতালীর পরিচারিকা।
‘কেউ ধাক্কা দিলো, দাদা। অন্ধকারে ঠিক দেখতে পেলাম না তাকে। ধাক্কা দিয়ে ঝড়ের বেগে পালিয়ে গেলো।’ এক জনকে বলতে শুনলো মৃত্যুঞ্জয়।
চলবে……….