বোধন
-শ্ৰী ভট্টাচার্য্য দে
“ধুর ধুর আর ভালো লাগছেনা!” গজগজ করতে করতেই বাজারের ব্যাগটা নামিয়ে রাখল সুকুমার। প্রবীণ এই মানুষটির বাড়িতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী ভিন্ন প্রাণী নেই দুটি। ছেলে অনিন্দ্য, স্ত্রী এবং তাদের একমাত্র কন্যা রাহীকে নিয়ে দিল্লীতে থাকে। রাহী বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যা এবং সবার আদরের। বিশেষত দাদানের প্রিয় নাতনী। পুজোর আর কটা মাত্র দিন বাকি। বছরে এই একটা সময়েই দেখা হয় দুই প্রিয় বন্ধুর অথচ এ বছর হবেনা। তাই মন মেজাজ খারাপ সুকুমারের। কাল রাত অবধি সে জানত যে ওরা আজ সকালের ফ্লাইটে কলকাতা আসছে কিন্তু ভোরে অনিন্দ্য ফোন করে জানায় যে হঠাৎ কিছু জরুরী কাজ এসে পড়ায় তারা এ বছর আসতে পারছেনা। তখন থেকেই মেজাজ খারাপ সুকুমারের। সুকুমারের স্ত্রী মলিনা কিন্তু এসব নিয়ে আদপেই চিন্তিত নন। পুত্র-পুত্রবধূর প্রতি টান একটু কম বললেই চলে তবে নাতনীর না আসাটা তাঁকেও কিঞ্চিৎ বেগ দিয়েছে তা বোঝা যায়।
মলিনা, ভাঙবে তবু মচকাবেনা প্রকৃতির মানুষ তাই সুকুমারের কথাতে কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন, ” কথায় কথায় এত ভালো না লাগার কি আছে শুনি?” সুকুমার জানেন যে মলিনাও ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট বিরক্ত তাই আর কথা না বাড়িয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন। মলিনা এ বছর তাঁর প্রিয় নাতনীর জন্য নিজের হাতে একটি জামা বানিয়েছিলেন। দাদান অবশ্য নাতনীর মায়ের পছন্দ অনুযায়ী বড় নামী দোকানের দামী জামা কিনেছিলেন রাহীর জন্য। কিন্তু যার জন্য এই আয়োজন সেই তো আসছেনা!
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। ষষ্ঠীর সকাল, বোধনের দিন। পাড়ার পুজো মন্ডপ থেকে মাইকে ভেসে আসছে নির্ঘন্ট তালিকা। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সুকুমার তখন ইজি চেয়ারে বসে শারদীয়া বই পড়ছিলেন। কড়া নাড়ার শব্দে অবাক হলেন। এত সকালে আবার কে এল! মলিনা এসে দরজা খুললেন। একটা ছোট্ট মেয়ে একগুচ্ছ শিউলী কুড়িয়ে এনেছে। কচি গলায় মলিনাকে জিজ্ঞেস করল, “ফুল নেবে দিদা?” বড় মায়া হল ওকে দেখে। পরনে একটা আধ ময়লা ছেঁড়া জামা। বুকে সেফটিপিন দিয়ে কোন রকমে আটকে রাখা আছে। তারই মধ্যে জ্বলজ্বল করছে ওর মুখ খানা। সুকুমার দেখলেন মলিনা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিস্তব্ধতা ভেঙে সুকুমার জিজ্ঞেস করল, “তুই ফুল কুড়িয়েছিস?” ও ঘাড় নেড়ে বলল হ্যাঁ। মলিনা ওকে ডেকে ঘরে আনল। তারপর একটা ঝুড়ি এনে সব ফুল কিনে নিল। ওর খুশি মুখটা দেখে বেশ ভালো লাগছিল সুকুমারের। হঠাৎ মলিনা ওকে একটু দাঁড়াতে বলে ভেতরে চলে গেল। ফেরত এল একটা জামা নিয়ে। ওই জামাটা যেটা রাহীর জন্য বড় যত্ন করে বানিয়েছিলেন তিনি। জামাটা হাতে নিয়ে ওর খুশি যেন দশ গুণ বেড়ে গেল কিন্তু সুকুমারের ভালো লাগাটা যেন একটু খারাপ লাগায় বদলালো, তবে মুখে কিছু বলল না। মাঝের কদিনে মলিনা একটা কথাও বলেনি অনিন্দ্যদের আসার ব্যাপারে। তবে মনে মনে যে ভালোই অভিমানের মেঘ জমেছে তা অজানা নয় সুকুমারের।
সন্ধ্যেয় পুজো মন্ডপে প্রতিমার সামনে বসে একদৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল সুকুমার। কোথাও অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তাকে। আসলে কাজ না, পুত্রবধূর আবদারেই পুত্র এবারের পুজোয় কলকাতা না এসে সপরিবারে অন্যত্র ঘুরতে যাবার বন্দোবস্ত করছিল। মলিনাকে সেকথা মুখ ফুটে জানাতে পারেনি সুকুমার। এমনিতেই মলিনার সাথে খুব একটা সদ্ভাব নেই তাদের তার উপর…. এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ যায় পাশে। ফুটফুটে হলুদ জামা পরা একটা মিষ্টি মেয়েকে দেখতে পান তিনি। ভালো করে চেয়ে দেখেন আরে এটা তো সেই মেয়েটা! সকালে যে এসে শিউলী দিয়ে গেল। রাহীর জামাটা কি সুন্দর মানিয়েছে ওকে, যেন ওর জন্যই তৈরী হয়েছিল ওটা! সমস্ত শরৎ যেন ওর হাসিতে নেচে উঠল। সুকুমার হঠাৎ দেবী দর্শন করলেন! মৃন্ময়ীর হাসি চিন্ময়ীতে ধরা দিল। এমন সময়ে পেছন থেকে দুটো চেনা হাত গলা জড়িয়ে ধরল সুকুমারের। তিনি শুনতে পেলেন, “দাদান আমরা এসে গেছি। বাবাই আমাকে এখানে নিয়ে এল, মাম্মাম, আর দিম্মা আসছে। আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবনা।” ঝাপসা চোখে সুকুমার দেখলেন মায়ের সন্ধ্যা আরতি শুরু হল।