অমৃতের বিষ পান (পর্ব -৩)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
রাহুল ব্যানার্জী রুমমেট ছিলো অমৃতের। অমৃতের হত্যার পর সেও নিজের পুরনো রুম ছেড়ে দেয়। কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। দমদমের হোস্টেলের বাকি ছেলেদের মধ্যে কেউ জানে না যে রাহুল গেলো কোথায়? রাহুলের বাড়ি দুর্গাপুরে। একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করে কোলকাতায়। রাহুলের অফিস গিয়ে তার বাড়ির ঠিকানা পেলো অরূপ, সাথে পেলো তার কোলকাতার বাসার ঠিকানা। আশ্চর্য ব্যাপার এটা যে, অমৃতের হত্যার দিন থেকে রাহুল অফিসে যায়নি। কোলকাতার নিজের নতুন আশ্রয়ের ঠিকানা রাহুল অফিসে দেয়নি। সে ঠিকানা অরূপ পেলো রাহুলের এক বান্ধবীর কাছ থেকে, যে রাহুলের সাথে একই অফিসে কাজ করে। রাহুলের নতুন বাসার ঠিকানা পেয়ে অরূপ নিজের বাকি পুলিশ দলের সাথে সেখানে গেলো। পুলিশ দেখে রাহুলের বাড়িওয়ালা অবাক। রাহুলের ঘরে তালা দেখে অরূপ বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো- ‘চাবি কি আপনার কাছে আছে?’
‘আ…. আজ্ঞে না বাবু।’ আমতা আমতা করে বাড়িওয়ালা বলল।
অতঃপর তালা ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হলো অরূপ। শুরু হলো সে ঘরের খানাতল্লশী।
আকাশে হঠাৎ করে নিজের বাসা বেঁধে নেওয়া মেঘের দারুণ চাঁদ ও তারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুরু হয়েছে অল্প,অল্প বৃষ্টিও। নিজের ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনির এক আরাম কেদারায় বসে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়। আচমকা ঘরের দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালো সে। ঘরে ঢুকেছে অরূপ, হাতে কিছু খবরের কাগজ নিয়ে। মৃত্যুঞ্জয়ের পাশের চেয়ারে বসে সামনের সেন্টার টেবিলে খবরের কাগজগুলো রেখে অরূপ বলল- ‘এগুলো সেই খবরের কাগজ, যেগুলো রাহুলের রুম থেকে পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে মোট বারোটা। শেষ খবরের কাগজ প্রায় এক বছর আগেকার।’
সিগারেটের শেষ অংশটা অ্যাশট্রেতে ফেলে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘আরও কিছু পাওয়া গেলো?’
‘হ্যাঁ। কিছু ক্রাইম থ্রিলার নভেল, কিছু ডক্টরের প্রেসক্রিপশন আর কিছু ঘুমের ট্যাবলেট।’
খবরের কাগজগুলো পুঙ্খানুপঙ্খ ভাবে দেখতে শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়। আধা ঘন্টার ওপর সময় লাগলো খবরের কাগজ গুলো পড়তে। তার পর অরূপকে সে বলল- ‘ডক্টরের প্রেসক্রিপশন গুলো আছে?’
‘হ্যাঁ, নিয়ে আসছি।’
খানিক পর কিছু প্রেসক্রিপশন নিয়ে এলো অরূপ, সাথে নিয়ে এলো রাহুলের ঘর থেকে পাওয়া কিছু ট্যাবলেটের পাতা। সবগুলো ভালো করে দেখে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘বড় থেকে ছোটো । এই খবরের কাগজগুলোর মধ্যে একটা খবরে নজর দিয়েছো?’
‘না। এখন অবধি পড়ে উঠতে পারিনি। সময় আর পেলাম কই?’
‘প্রায় দেড় বছর আগে যাদবপুর থেকে রিতিকা ব্যানার্জী নামের এক মেয়ে নিখোঁজ হয়। যাদবপুরের এক হোস্টেলে থাকতো সে। বাড়ি ছিলো দুর্গাপুরে। এক প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করতো সে। পুলিশ কিছু দিন খোঁজার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু নিজের কাজে তারা সফল হয়েনি। ফাইল বন্ধ হয়ে যায়। খবরের কাগজ কিছু দিন উৎসাহ দেখলো। ধীরে ধীরে খবরের কাগজে এই খবরটা কম স্থান পেতে শুরু করলো।’
‘ঘটনাটা শুনেছি। তখন আমি ঠাকুরপুর থানায় ছিলাম।’ অরূপ বলল।
‘হুম। কিন্তু ব্যাপারটা হলো সেই মেয়েটির মানে রিতিকা ব্যানার্জীর মানসিক অবস্থা নাকি ভালো ছিলো না। ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী নামের এক সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে সে চিকিৎসা করাতো। ডক্টর চক্রবর্তীর কাছে জেরা করে জানা গিয়েছিলো যে রিতিকা নাকি ডিপ্রেশনে ভুগছিলো। তার নাকি ভয় ছিলো, কেউ তার মার্ডার কিম্বা রেপ করতে পারে। রিতিকা পুলিশকে ভয় পেতো। ভেবেছিলো তার ভয়টা হয়তো নিছকই মনের ব্যামো। সাইক্রিয়াটিক কাউন্সিলিং নিলে হয়তো ঠিক হয়ে যেতে পারে। এবার একটা জিনিস এখানে লক্ষ করার। রিতিকা থাকতো দুর্গাপুরে, রাহুলের বাড়িও সেখানেই। দুজনেরই উপনাম ব্যানার্জী। রাহুলও সাইক্রিয়াটিক ট্রিটমেন্টে আছে, এবং সব থেকে বড় ব্যাপার হলো দুজনেরই ডক্টর একই। আমার বিশ্বাস রাহুল শুধু চাকরী করতে কোলকাতা আসেনি, অরূপ। চাকরীর আড়ালে সে রিতিকা অন্তর্ধান কেসের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।’
‘তাহলে অমৃতের খুনের পর রাহুল সেই রুম ছেড়ে পালিয়ে গেলো কেন?’ প্রশ্ন করলো অরূপ।
‘একটা কারণ এটা হতে পারে যে নিজের তদন্তে কোনো প্রকারে বাধার আশংকা অনুভব করেছিলো সে। কিম্বা…’
‘কিম্বা কি? মৃত্যু দা?’
‘অরূপ, অনেক সময় এমন হয়ে যে একটা কেসের তদন্ত করতে গিয়ে আমাদের সামনে অন্য কোনো রহস্য চলে আসে। রহস্যের ইন্টারলিংক। হতে পারে রাহুল রিতিকা ব্যানার্জীর কেস হ্যান্ডেল করতে গিয়ে অমৃতের কিছু গোপন তথ্য জানতে পেরেছিলো। অমৃতের খুনের পর তার নিজের প্রাণের ভয় ঢুকেছে। এবার এটাও সম্ভব যে অমৃতের খুনের পেছনে রাহুলের যোগদান আছে। এভরিথিং ইস পসিবল মাই ডিয়ার। রাহুলকে খুঁজে বার করো, অরূপ। রাহুলকে খুঁজে বার করা খুব দরকার।’
‘লোক লাগিয়ে দিয়েছি। দুর্গাপুরে গিয়েও তাকে খোঁজা হবে। লোক লাগাবার কথায় মনে পড়লো, মিতালীর পেছনেও লোক লাগানো হয়েছে। তার সারা দিনের খবর আমরা পাবো এবার। একটা কথা জিজ্ঞেস করা ছিলো, মৃত্যুঞ্জয়দা।’
‘কী?’
‘মিতালী গাঙ্গুলীকে আমরা অ্যারেস্ট করতে পারি না? জানি, তার এগেনস্টে কোনো প্রমাণ নেই আমাদের কাছে, কিন্তু তবুও আন্ডার বেসিস অফ সস্পিশন।’
মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘পারি। কিন্তু করে লাভ নেই। পাকাপোক্ত প্রমাণ থাকলে অ্যারেস্ট করে লাভ আছে। তার পর অমৃতকে আর পরিচারিকাকে খুন করার পেছনে মিতালীর মোটিভও তো পরিস্কার নয়।’
‘এটা তো পরিস্কার যে মিতালীর সাথে অমৃতের একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। হতে পারে, তাদের ঘনিষ্ঠ কিছু মুহূর্তের ভিডিও বানিয়ে মিতালীকে ব্ল্যাকমেল করছিলো অমৃত। ব্ল্যাকমেলের টাকা দিতে দিতে থকে গিয়েছিলো মিতালী। অমৃতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা তো কিছু কম নেই।’
‘হতেও পারে। মিতালী কোনো লোক লাগিয়ে খুন করিয়েছে অমৃতের। আচ্ছা অরূপ, খুনের দিন ভোরে অমৃতের কাছে যে নম্বর থেকে ফোন এসেছিলো, সে নম্বরে তার আগেও কি কথা হয়েছে?’
‘না। সেই নম্বর থেকে একটাই কল করা হয়েছে, সে দিন ভরে। নম্বরটা দু’দিন আগেই নেওয়া হয়েছিল।’
‘হুম, বুঝলাম। মিতালী গাঙ্গুলী, রুবি দে আর রাহুল ব্যানার্জী, কেউ সন্দেহের বাইরে নেই, অরূপ। আমার সন্দেহের লিস্টে এরা তিনজনেই আছে। তুমি রাহুলের খোঁজ নাও। এদিকে আমি দেখছি কী করা যেতে পারে।’
কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় ঘরের ভেতর চলে গেলো।
প্রায় সারা রাত তুমুল বৃষ্টি হলো। সকালেও বেশ অনেকক্ষণ বৃষ্টি হওয়ার কারণে বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি মৃত্যুঞ্জয়। যখন সে বেরলো তখনও কিন্তু বৃষ্টি থামেনি। দেরি করা মৃত্যুঞ্জয়ের পছন্দ না। তাই বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেলো সে। হ্যাঁ, অমলবাবুর কাছ থেকে তাঁর হোন্ডা সিটি গাড়িটা নিয়ে নিয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়। ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর ঠিকানা তার কাছে আছে। পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগলো।
ঢাকুরিয়াতে ডক্টর চক্রবর্তীর চেম্বার। একটা বড় চারতলা বাড়ির দু’তলায়। বাড়িটা অ্যাপার্টমেন্ট নয়। নিচের তলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। দু’তলা থেকে ফ্ল্যাট টাইপের বানানো। ভাড়া দেন তিনি। দু’তলায় একটা 2BHK নিয়ে ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর চেম্বার। ঢুকতেই ছোট্টো হল-এ এক অল্প বয়সী মেয়ে বসে। দেখেই বোঝা যায় সে রিসেপ্সনিস্ট। মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গেলো তার দিকে। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে যুবতীটি বলল- ‘বলুন?’
‘ডক্টর বাবু আছেন?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘দেখানোর আছে কী?’ জবাবের বদলে পাল্টা প্রশ্ন। বিরক্ত লাগে মৃত্যুঞ্জয়ের।
‘হ্যাঁ, দেখাবো তাঁকে।’
‘500 টাকা ফি, জমা করে দিন।’ রিসেপশনিস্ট যন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছে।
‘সে না হয় করলাম। ডক্টর বাবু আছেন তো?’
‘না। এখনও আসেননি।’
অবাক হলো মৃত্যুঞ্জয়। সাড়ে এগারোটা বাজে। ডক্টরের পাত্তা নেই।
‘কোথায় আছেন তিনি?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘হসপিটালে।’
‘হসপিটাল! কোন হসপিটাল?’
রিসেপশনিস্ট হসপিটালের নাম বলে বলল- ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই ডক্টর বাবু চলে আসবেন। আপনি যদি দেখাতে চান, তাহলে টাকা জমা করে দিন।’
অগত্যা, উপায় নেই। টাকা জমা করে অপেক্ষা করতে হলো মৃত্যুঞ্জয়কে। প্রায় আধা ঘন্টার অপেক্ষার পর ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর আগমন হলো। বেশ সুপুরুষ চেহারা, মাথার চুল বেশ বড় কিন্তু এলোমেলো। বয়স আন্দাজ চল্লিশের আশেপাশে। ভেলভেট কালারের জামার ওপরে কালো সুট সাথে লাল টাই। কালো বুট এবং কালো প্যান্টের নিচে অল্প অল্প কাদার দাগ। মার্বেলের ফ্লোরে কাদা লাগা বুটের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। গাড়ির চাবির রিংকে নিজের ডান হাতের আঙ্গুলে নাচাতে নাচাতে ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী প্রবেশ করলো। মৃত্যুঞ্জয় লক্ষ্য করলো গাড়ির চাবির রিংটা অডি কোম্পানীর। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে অল্প দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের কেবিনে সে ঢুকে গেলো। খানিক পর ভেতর থেকে তলব আসাতে রিসেপ্সনিস্ট ভেতরে গেলো। প্রায় মিনিট খানেক পর বেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে ভেতরে যাওয়ার ইশারা করলো সে। ভেতরে ঢুকেই মৃত্যুঞ্জয় কোনো প্রকারের ভঙ্গিমা না করে ডক্টর চক্রবর্তীকে বলল- ‘এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করে লাভ নেই। সোজা আসল কথায় আসা যাক।’
ডক্টর চক্রবর্তী কিছুই বুঝতে পারলো না। খানিক অবাক দৃষ্টে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চেয়ে বলল- ‘মানে, আমি তো কিছুই বুঝলাম না।’
সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘আপনি রাহুল ব্যানার্জীর বিষয় কী জানেন?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ম….মানে আপনি ট্রিটমেন্ট করাতে আসেননি?’ আবার প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন।
‘না। আমি এখানে কিছু ইনফরমেশন নিতে এসেছি। আমি এ.সি.পি. মৃত্যুঞ্জয় মজুমদার, সি.আই.ডি. থেকে।’
সি.আই ডি.’র নাম শুনে ডক্টর চক্রবর্তীর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু চকিতে নিজেকে সামলে নিলো সে।
‘হ্যাঁ….হ্যাঁ বলুন, কী জানতে চান?’
‘আপনার এক পেশেন্টের বিষয় জানতে চাই। রাহুল ব্যানার্জী।’
‘রাহুল….রাহুল….ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে।’
‘গুড। রাহুল কিসের চিকিৎসা করাচ্ছিলো আপনার কাছে?’
‘ইনসমনিয়া। দিনের পর দিন তার ঘুম হতো না তার। ভোর রাতের দিকে অল্প হলেও যদি চোখ লাগতো, ভয়াবহ কিছু স্বপ্নে তার ঘুম ভেঙ্গে যেতো।’
‘সে কি রোজ আসতো আপনার কাছে?’
‘প্রায়। কিছু বিচিত্র স্বপ্ন নিয়ে। কেউ নাকি তার গলা টিপতে আসছে, সে মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ তার পায়ের নিচের মাটি ফেটে জল বেরিয়ে এলো, সেই জলে ডুবে গেলো সে। এবার আপনি বলুন মশাই, মরুভূমিতে এতো জল কোথায় থেকে আসবে যে মানুষ ডুবে যায়?’
‘আপনি তখন কী করতেন?’
‘ঘুমের ওষুধ বদলে বদলে দিতাম।’
‘শেষ বার কবে আসে আপনার কাছে?’
খানিক ভেবে ডক্টর সিদ্ধার্থ বলল- ‘আজ শুক্রবার, গত শনিবার সে এসেছিলো।’
‘এবার আপনি বলুন রিতিকা ব্যানার্জীর কেস আর রাহুল ব্যানার্জীর কেসের মধ্যে কোনো মিল দেখতে পারছেন কী?’
‘উফ …. আবার সেই রিতিকা ব্যানার্জী।’ একরাশ বিরক্তি নিয়ে সিদ্ধার্থ বলল- ‘দেখুন মিস্টার এ.সি.পি. রিতিকা ব্যানার্জীর কেস নিয়ে আমি অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছি। আর নয়। অনেক বার স্টেটমেন্ট দিয়েছি পুলিশকে। বারবার একই স্টেটমেন্ট দিতে দিতে মুখে ব্যাথা হয়ে গেছে আমার। স্যরি এ.সি.পি.। এই বিষয় আমি আর কোনো সাহায্য আপনাকে করতে পারবো না।’
‘বেশ, তাই ভালো। অনেক ধন্যবাদ, ডক্টর। প্রয়োজনে আবার বিরক্ত করতে আসবো।’
ঢাকুরিয়ার পর মৃত্যুঞ্জয়ের আগামী গন্তব্য সল্টলেক, সেক্টর 5। মৃত্যুঞ্জয় ঘড়িতে সময় দেখলো। এখনও অফিসে লাঞ্চ টাইম হতে অল্প দেরি আছে। ঠিক সময় পৌঁছে যাওয়া যাবে। কোলকাতার বেশ কিছু রাস্তাঘাট জলমগ্ন। গাড়ির গতি বেশি বাড়াতে পারলো না মৃত্যুঞ্জয়। মিতালীর অফিসের নিচে যখন নিজের গাড়িটা পার্ক করালো মৃত্যুঞ্জয়, তখন তার ঘড়িতে দুপুর দুটো দশ। গাড়িতে বসেই মিতালীকে ফোন করলো সে।
‘আপনি নিচে নেমে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি আপনার।’
বেশ বিরক্তই হলো মিতালী। নিচে নেমেই মৃত্যুঞ্জয়কে বলল- ‘আপনি কি আমাকে এবার নিশ্চিন্তে চাকরীও করতে দেবেন না?’
‘ওহঃ .. অতো রাগ করছেন কেন? এটা তো লাঞ্চ টাইম। তার পর জম্পেস খিদেও পেয়েছে। চলুন, কোথাও বসে খেতে খেতে কথা বলা যাক।’
‘আমার আপনার সাথে লাঞ্চ করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই মিস্টার এ.সি.পি.’ রাগে চোয়াল শক্ত হলো মিতালীর।
‘রাগ করবেন না ম্যাডাম। কেন কি এটা আপনার রাগ দেখাবার সময় নয়। আসুন আমার সাথে’ কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় পাশের একটা রেস্তোরাঁর দিকে এগোলো। পিছু নিলো মিতালী।
‘কী হচ্ছে এটা এ.সি.পি.? আপনি তো বলেছিলেন পরের দিন সকালে আসবেন, আমার কাজের বৌয়ের সাথে কথা বলতে।’ মৃত্যুঞ্জয়ের পাশে হাঁটতে হাঁটতে মিতালী বলল।
‘সে কাজ আমার হয়ে গেছে। আপনার বিষয় অনেক কিছুই জানতে পেরেছি ম্যাডাম।’
‘কী জানতে পেরেছেন?’
‘বলবো, সব বলবো। চিন্তা করবেন না আপনি।’
‘তার মানে আপনি কোথাও বাইরে আমার কাজের বৌয়ের সাথে দেখা করেছেন। আপনি তাকে গন পয়েন্টে রেখে আমার এগেনস্টে কিছু ভুল এবং মিথ্যে স্টেটমেন্ট নিয়েছেন। তাই না মিস্টার এ.সি.পি.?’
‘আপনার মাথা অনেক দূর পর্যন্ত চলে দেখছি। এই মাথাটা কোনো ভালো কাজে লাগলে মন্দ হতো কী?’
রেস্তোরাঁর সামনে দুজনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে ঢুকবার আগে মিতালী বলল- ‘কিছু তো একটা গন্ডগোল আপনি করেছেন। না তো সোনালী আজ দেরি করে আসতো না। সোনালী মানে আমার কাজের বৌ।’
‘সেটা জানি। কিন্তু দেরি করে আসতো না মানে?’ এবার মৃত্যুঞ্জয়ের আশ্চর্য হবার পালা।
‘মানে, আজ সকালে সে আমায় ফোন করে বলল যে তার শরীর ভালো না। দেরি করে আসবে। আমি যেন ফ্ল্যাটের চাবিটা ফ্ল্যাটের দরজার সাথে লাগোয়া লেটার বক্সে রেখে দি। আমি তাই করলাম। লেটার বক্সের এক চাবি তার কাছে থাকে। যখন কোনো দিন সে দেরি করে আসতে, আমি সেটাই করে থাকি। কিন্তু সে কোনো দিনই খুব দেরি করে না। আজ হঠাৎ দেরি করলো কেন …..’
‘আপনি কি সিওর যে ফোনটা সোনালী করেছিল আপনাকে?’
‘হ্যাঁ। গলার আওয়াজটা চেঞ্জ মনে হলো, কিন্তু তার শরীর খারাপ তাই।’
‘হতেই পারে না এটা?’ মৃত্যুঞ্জয়ের গলার আওয়াজটা উচ্চ হলো বিস্ময়ের কারণে।
‘কী হতে পারে না?’
‘সোনালী আপনাকে ফোন করতেই পারে না।’
‘কিন্তু কেন?’
‘কেন কি গত কাল সন্ধ্যেতেই সোনালীকে হত্যা করা হয়েছে।’
‘কী? সোনালীর হত্যা?’ ইলেকট্রিকের বড় শক লাগলো যেন মিতালীর।
‘হ্যাঁ, কাল সন্ধ্যেতে আপনার ফ্ল্যাট থেকে বেরোবার পর বাঘাযতীন স্টেশনে কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের সামনে ফেলে দেয়। আততায়ী এখনও ধরা পারেনি।’
‘তাহলে আজ আমাকে ফোন করলো কে? তার পর আমার মেয়ে তো আজ বাড়িতেই আছে।’ ভয়ের সাথে কান্না মেশানো কন্ঠস্বর মিতালীর।
‘দেরি করা যাবে না। চলুন আপনার ফ্ল্যাটে।’
গাড়ি করে মৃত্যুঞ্জয় ও মিতালী বাঘাযতীনের দিকে এগিয়ে গেলো।
ফ্ল্যাটের দরজা অল্প খোলা। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয় ও মিতালী। মিতালী তারস্বরে ডাকতে থাকে নিজের মেয়ে কে- ‘রিয়া …. রিয়া …. ও রিয়া …. রিয়া!’
এ ঘর ও ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ায় নিজের মেয়েকে। কোত্থাও নেই রিয়া।
‘মৃত্যুঞ্জয়, আমার মেয়ে কোথায় গেলো?’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিতালীর গলা।
মৃত্যুঞ্জয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরতে থাকে চারিদিকে। ঠিক তখনই তার নজর যায় একটা জিনিসে।
মাটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল মৃত্যুঞ্জয়। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। তাকে হাসতে দেখে আরও খেপে গেলো মিতালী।
‘হোয়াট দ্য হেল ইউ আর ডুইং এ.সি.পি.? আমার মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে আর আপনি এখানে দাঁড়িয়ে হাসছেন?’
মিতালীর কথার জবাব না দিয়ে একটা ফোন করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘হ্যালো, অরূপ? যা বলছি খুব ভালো করে শোনো। আমার ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর জুতো চাই। হ্যাঁ, জুতো, বুট …. সে সব পরে বলবো। সে নিজের চেম্বারে আছে। কালো বুট সে পরে আছে …. সে তোমার যেমন সুবিধে হোক, তেমন করো। তার বুট নিয়ে তুমি মিতালী গাঙ্গুলীর ফ্ল্যাটে এসো। তোমার অপেক্ষা করছি আমি। আর হ্যাঁ, এক ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে নিয়ে এসো।’
কথা শেষ করে ফোন কেটে দিলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী কে?’ মিতালী প্রশ্ন করলো।
‘জানতে পারবেন ম্যাডাম। সব জানতে পারবেন।’
মৃত্যুঞ্জয় এবার পুরো ফ্ল্যাটটা পুংখানুপুঙ্খ ভাবে দেখতে লাগলো। ড্রয়িং রুমের প্রতিটি জিনিস বিনা ছুঁয়ে ভালো ভাবে নিরীক্ষণ করলো। ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুম, দুটোতেই ঢুকলো সে।
‘ফ্ল্যাটে বলতে আপনারা তিন জন। আপনি, আপনার মেয়ে এবং কাজের বৌ। কাজের বৌ রাতে থাকে না। আপনি তো এক বেডরুমের ফ্ল্যাট নিতে পারতেন। মাস্টার বেডরুম ছাড়া পাশের বেডরুম কোন কাজে আসে?’
খানিক চুপ থেকে মিতালী বলল- ‘কোনো দিন যদি ….’
তার কথাকে মাঝ পথে থামিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘যদি কোনো আত্মীয় স্বজন আসে …. তাই না? বেশ।’
দ্বিতীয় বেডরুমের ভেতরে ঢুকলো সে। কাঁচের জানালার ধারে খাট পাতা। সুন্দর বিছানা করা, দুটো বালিশ পরিপাটি করে সাজানো। খাটের পাশে এক ড্রেসিং টেবিল। সে দিকে এগোলো মৃত্যুঞ্জয়। ড্রেসিং টেবিলের ওপর সাজগোজের বেশ কিছু কসমেটিক্স রাখা। অতি সন্তর্পণে নিচের ড্রয়ারটা মৃত্যুঞ্জয় খুললো। কিছু রিক্ত সিগারেটের ডিবে পেলো সে। একটা ডিবেতে এখনও দুটো সিগারেট ভরা। আড়চোখে মিতালীর দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘এ গুলো নিশ্চয়ই আপনার নয়।’
‘আপনি ফালতু সময় নষ্ট করছেন এ.সি.পি.’
‘আমি সময় নষ্ট করছি? আমি এখানে আছি অমৃতের খুনের তদন্ত করতে। আপনার মেয়ের সন্ধান করতে নয়।’ মৃত্যুঞ্জয়ের কন্ঠস্বর বেশ উচ্চ হলো- ‘আপনি কি শুরু থেকে আমাকে কো-অপারেট করেছেন? করেননি। আপনি কি আমায় বলেছেন যে অমৃতের সাথে আপনার ইললিগাল রিলেশন ছিলো। আপনার কুদৃষ্টি ছিলো তার ওপর। শুধু অমৃত না, আপনার কুদৃষ্টি ছিলো আপনার দেওরের ওপর। তাই আপনি স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজের শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হোন।’
চলবে………………..