অমৃতের বিষ পান (পর্ব -৪/শেষ)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে রইল মিতালী। তার দু’চোখ লাল, জলে ভেজা ।
‘কী বললেন? দেওরের ওপর কুদৃষ্টি? আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আমি নিজের দেওরের ওপর কুদৃষ্টি দিয়েছি? এ সব তথ্য আপনারা পান কোথা থেকে? মানে …. মানে যে দোষী তাকে বেকুসুর খালাস করে, যে বেকুসুর তাকে দোষী করবেন? বাঃ এ.সি.পি.বাঃ! এই আপনাদের ইনভেস্টিগেশন? কে কার ওপর কুদৃষ্টি দিয়েছিল, সেটা বুঝবার ক্ষমতা আপনারা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন যদি আমি কিছু বলি আপনাকে তাহলে আপনি কস্মিনকালেও বিশ্বাস করবেন না। শরীরে দাগ নেই এ.সি.পি. এতো দিনে সব দাগ মুছে গেছে। যদি থাকতো তাহলে নিজের সমস্ত কাপড় খুলে আপনাকে দেখিয়ে দিতাম। সেটাই হতো সেই শুয়োরের বাচ্চা ভাস্কর গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে আমার প্রমাণ। শরীরের দাগ মুছে গেলে কী হবে, মনের ভেতরকার ক্ষত এখনও রয়ে গেছে। সেটা কোনো দিন মুছবে না। আপনারা অন্ধ এ.সি.পি. আপনারা অন্ধ।’ কথা শেষ করে ডুকরে কেঁদে উঠলো মিতালী।
মৃত্যুঞ্জয় নিস্তব্ধ। মিতালীর কথাগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে নিজের করা এই ভুলের ক্ষমা নেই। খানিক পর নিজেকে সামলে নিয়ে মিতালী পুনরায় বলতে শুরু করলো- ‘আমারও ভালোবাসার অধিকার আছে স্বামীকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে ভালোবাসার মর্ম বুঝতে পারলো না। স্বামী মারা যাওয়ার পর ভাস্করের হাত থেকে কোনোক্রমে নিষ্কৃতি পেয়ে আমি যখন এখানে আসি, তখন আমি মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছি। আমি আর আমার মেয়ে, এটাই ছিলো আমার সংসার। তার পর হঠাৎ করে আমার জীবনে আসে অমৃত। ছেলেটা ছিলো খুব শান্ত, কিন্তু কথা বলতে বেশ ভালোবাসতো। আসতে আসতে তার সাথে গল্প করা শুরু করলাম। নিজের অতীতের কথা তাকে বলতাম। মনটা বেশ হালকা হতো আমার। হ্যাঁ, আমি ভালবেসেছি, ভালবেসেছি অমৃতকে। নিজের থেকে বয়সে ছোটো কোনো ছেলেকে ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, তাহলে সেই অপরাধ করেছি আমি। আর আমার তাতে কোনো আফসোস নেই।’
মৃত্যুঞ্জয় পুনরায় ঘরের এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করলো। এবার সে মাস্টার বেডরুমে গেলো। প্রতিটি জিনিস অতি সন্তর্পণে নিরীক্ষণ করছিলো সে। হঠাৎ তার নজর গেলো শোকেসে রাখা এক ফটো ফ্রেমের ওপর। হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো। এক পরিবারের গ্রুপ ফটো। এটা যে গাঙ্গুলী পরিবার সেটা বুঝতে দেরি হলো না তার।
‘কে কে আছে এই গ্রুপ ফটোতে?’ মিতালীকে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
মিতালী আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে শুরু করলো- ‘ইনি আমার শ্বশুর, আমার স্বামী, আমার দেওর, দেওরের স্ত্রী ….’
হাত দেখিয়ে থামবার ইশারা করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘এটা আপনার দেওর?’ ভাস্কর গাঙ্গুলীর ছবির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ, এটাই সেই পিশাচ।’ রক্তবর্ণ নেত্রে মিতালী বলল।
মৃত্যুঞ্জয় আর কিছু বলল না। ভ্রুকুটি করে সে দিকে একাগ্রচিত্তে চেয়ে রইল।
ইতি মধ্যেই মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলটা বাজলো। অরূপের ফোন।
‘হ্যাঁ অরূপ, বলো।’
‘দুটো খবর আছে। প্রথম খবর হলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে পাঠিয়ে দিয়েছি অনেকক্ষণ আগে, আর দ্বিতীয় খবর হলো ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর জুতো পাওয়া গেলো না। সে নিজের চেম্বারে নেই। চেম্বার বন্ধ, তালা লাগা।’
মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘তুমি এই মুহূর্তে একটা কাজ করো অরূপ। কিছু ফোর্স নিয়ে পার্ক সার্কাসের দিকে রওনা দাও। সেখানে ‘কেয়ার ফর ইউ’ নামের এক নার্সিং হোম আছে, সেখানে যাও। যত দূর সম্ভব সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীকে সেখানেই পাবে। একটা আরও কথা, আজ সকালে মিতালী গাঙ্গুলীর মেয়ে রিয়াকে তার ফ্ল্যাট থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ফ্ল্যাটের মেঝেতে কাদা মাখা জুতোর ছাপ রয়েছে। আমার বিশ্বাস সে জুতোর ছাপ ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে অ্যারেস্ট করো।’
মৃত্যুঞ্জয় ফোন কেটে দিয়ে মিতালীকে বলল- ‘আপনি যে মহিলা উন্নয়ন সমিতির এক সদস্য, সেটাও আপনি বলেননি।’
মিতালী নিরুত্তর।
‘রিতিকা ব্যানার্জীকে আপনি চেনেন?’
মিতালী চমকে তাকালো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
‘রিতিকা ব্যানার্জী?’
‘হ্যাঁ। যাদবপুরে থাকতো। প্রায় বছর খানেক আগে থেকে নিখোঁজ।’
চাপা কন্ঠে মিতালী বলল- ‘চিনি। আমাদের সমিতিরই এক সদস্য ছিলো সে।’
‘সে কোনো ডক্টরকে দিয়ে নিজের চিকিৎসা করাচ্ছিল সেটা জানতেন?’
‘না। জানতাম না।’ দৃঢ় কন্ঠে মিতালী বলল।
‘আচ্ছা, একটা কথার জবাব দিন। আপনি তো বেহালাতে বহু দিন থেকেছেন। সেখানে কি কোনো বিউটি পার্লার নেই?’
মৃত্যুঞ্জয়ের এই বিচিত্র প্রশ্নে অবাক হলো মিতালী।
‘থাকবে না কেন? অনেক আছে।’ জবাব দিলো সে।
খানিক শূন্যের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে চিন্তা করলো মৃত্যুঞ্জয়, তার পর বলল- ‘ঠিক আছে, আমি তাহলে এবার আসি। আপ্রাণ চেষ্টা করবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার মেয়েকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিতে।’
কথা শেষ করে হনহন করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলো সে।
মিতালীর ফ্ল্যাট থেকে বেরোতেই সামনের সিঁড়িতে কিছু আবছা দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। যেন সিঁড়ি দিয়ে কেউ ওপরে উঠছিল, মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে পেয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলো। কে হতে পারে? আজ লিফট্ খারাপ, তাই হয়তো সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসেছে। মৃত্যুঞ্জয়ও দ্রুত পায়ে পিছু নিলো তার। চারিপাশে অকারণ কিসের যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসা দুজনের পদধ্বনি ভিন্ন অতিরিক্ত কোনো শব্দ নেই। মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলো যার পিছু সে নিচ্ছে সে অতি তীব্র গতিতে দৌড়াতে সক্ষম। খানিক পর আগন্তুক দ্রুত বেগে মুখ্য ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেলো। দারোয়ানের পাত্তা নেই। সেই লোকটির ফটক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় পাঁচ সেকেন্ড পর মৃত্যুঞ্জয় ফটক পার করলো। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল বেশ ভালোই। সেই লোকটি এগিয়ে চলল বাঘাযতীন স্টেশনের দিকে। দুজনের দূরত্ব প্রায় কুড়ি হাত। ক্রমে সেই দূরত্ব কমছে। পনেরো হাত …. দশ হাত …. পাঁচ হাত …. দু হাত …. অবশেষে তাকে নিজের নাগালে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। সেই লোকটির জামার কলারে মৃত্যুঞ্জয়ের হাত গেলো। মৃত্যুঞ্জয়ের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে গেলো সে। বিফল হলো। সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়লো। অল্প আঘাত পেলো, সেটা বলাই বাহুল্য। তাকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে তার ওপর চড়ে বসলো মৃত্যুঞ্জয়। দু হাতের মুঠোয় তার জামার কলার ধরে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘আমাকে ফলো করা হচ্ছে? কে তুই?’
সে চুপ করে থাকলো। দু’ গালে দুটো কষিয়ে থাপ্পড় কষালো মৃত্যুঞ্জয়। চোট ও থাপ্পড়ের দরুণ তার ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।
‘যদি আরও মার না খেতে চাস তাহলে বল তুই কে আর কেন আমাকে ফলো করছিস?’ মৃত্যুঞ্জয় প্রায় চিৎকার করে কথাগুলো বলল।
অল্প কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে ছেলেটা বলল- ‘আমি …. আমি রাহুল , রাহুল ব্যানার্জী।’
অরূপ হালদার বেশ কিছু পুলিশ ফোর্স নিয়ে পৌঁছালো পার্ক সার্কাস অবস্থিত ‘কেয়ার ফর ইউ’ নার্সিং হোমে। তার আগে লোকাল থানার বড় বাবু সমেত কিছু কনস্টেবলকে সে নিয়ে নিয়েছে। লোকাল থানার বড় বাবুর নাম শ্রীধর হাজরা। বেশ মোটাসোটা লোক, বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছে।
‘কী ব্যাপার অরূপ বাবু? অতো হন্তদন্ত কেন?’
অরূপ হালদার সংক্ষিপ্তে পুরো ঘটনাটা বলে শেষে বলল- ‘আমার মনে হয়ে কোনো বড় স্ক্যান্ডালের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।’
‘আর যদি কিছু না পাওয়া যায়?’ হাজরা বাবু সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলেন অরূপকে।
‘কিছু না পাওয়া গেলে ডক্টর সিদ্ধার্থকে অ্যারেস্ট করবো।’ অরূপ বলল।
‘বিনা কোনো প্রমাণে?’
‘আন্ডার সস্পিশন।’
নার্সিং হোমে বেশ কিছু পুলিশকে এক সাথে ঢুকতে দেখেই রিসেপশনিস্ট ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
‘ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী আছে?’ জিজ্ঞেস করলো অরূপ।
‘না….মানে….মানে…হ্যাঁ ….’ মেয়েটি সংলগ্ন কিছুই বলতে পারলো না।
‘কী হলো? আছে কি না বলতে এতো সময় লাগে?’ বড় বাবু হাজরা এক ধমক দিলেন।
‘হ্যাঁ, আছেন।’ মেয়েটি জবাব দিলো।
‘কোথায়?’ প্রশ্ন করলো অরূপ।
‘ওপরে …. ওপরে।’
চার তলা নার্সিং হোম। প্রতিটি ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলো তারা। নার্সিং হোমের মালিকের কেবিনে তালা। শেষে তারা পৌঁছালো চার তলায়। সেখানে আছে দুটো অপারেশন থিয়েটার , একটা বড় আই.সি.ইউ. এবং একটা হল ঘর। হল ঘরের দরজাটা অল্প খোলা ছিলো। ধাক্কা দিয়ে সেটা পুরো খুলে দিয়ে ভেতরে ঢুকলো অরূপ। ঘরে দুজন ভদ্রলোক।
‘আপনাদের মধ্যে সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী কে?’
সিদ্ধার্থ গোলগোল চোখে অরূপকে দেখলো। দরদর করে ঘামছে সে। তার হাবভাব দেখে অরূপের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে এই সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী। অরূপ এগিয়ে গেল তার দিকে।
‘আপনি কিছু নিলেন এনার কাছ থেকে। তাই না?’
অরূপের সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটি বলল- ‘না না, আ..আমি তো কিছুই দিইনি একে।’
‘সার্চ করে দেখবো?’
সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর কোর্টের পকেট থেকে বেরোল নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা।
‘এবার বলুন চক্রবর্তী বাবু, মিতালী গাঙ্গুলীর মেয়ে রিয়া কোথায়?’
অরূপের এই প্রশ্নে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। আকাশে আর মেঘ নেই। দিনের শেষে বিদায় নেওয়ার পূর্বে নিজের দর্শন দিয়েছেন সূর্য দেবতা। বালিগঞ্জে রুবি দে’র বিউটি পার্লার উক্ত বাড়ির সামনে এক হোন্ডা সিটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে পার্লারের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয়। পার্লারে কাজ করা দুই মেয়ের মধ্যে একজনও নেই। দরজা খোলার শব্দে ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রুবি দে। নিজের সামনে আচমকা মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার। চকিতে নিজেকে সামলে মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে বলল- ‘আপনি এখানে? এই সময়?’
‘আমাদের সময়ের ঠিক থাকে না ম্যাডাম। আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেলেন দেখছি।’
‘না, না , ঘাবড়াবার কী আছে? বলুন।’
‘ভেতর ঘরে বসতে পারি কী?’
মুখটা পুনরায় ফ্যাকাসে হয়ে গেলো রুবি দে’র।
‘মানে….মানে….লোক আছে আর কি। জরুরি মিটিং চলছে।’ আমতা আমতা করে বলল রুবি দে।
‘চলুন, আমিও দেখি কার সাথে আপনার এই জরুরি মিটিং।’
কথা শেষ করে ঘরের ভেতর ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয়। ভেতর ঘরের সোফাতে বসে এক ভদ্রলোক । বয়স চল্লিশ ঊর্ধে। গায়ের রং পরিস্কার না বললেই চলে। এক মাথা চুল, ব্যাক ব্রাশ করা, জামাকাপড় দেখে বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের বলেই অনুমান করা যেতে পারে।
‘ওঃ! তাহলে আপনিও এখানেই আছেন?’ সেই ভদ্রলোককে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
রুবি দে পাথরের মূর্তির ন্যায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চাইলে। মৃত্যুঞ্জয় তার দিকে ইশারা করে বলল- ‘বসুন আপনি। দাঁড়িয়ে কেন?’
রুবি দে তাও বসলো না।
‘আপনার পরিচয়? বিনা অনুমতিতে এখানে ঢোকার কারণ? আপনি কি জানেন না যে এটা লেডিস বিউটি পার্লার , পুরুষের বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।’ সেই ভদ্রলোকটি এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো মৃত্যুঞ্জয়কে বলে গেলো।
‘আপনার কোন প্রশ্নের জবাব আগে দেবো? আমার পরিচয়? আমি আই.পি.এস. মৃত্যুঞ্জয়। বিনা অনুমতিতে ঢুকবার কারণ? তদন্ত চলাকালীন আমাদের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।’
মৃত্যুঞ্জয় এবার দেয়ালের শোকেশের কাছে গেলো। যে পত্রিকা গুলো সাজানো ছিলো সে গুলো একে একে বার করে সেন্টার টেবিলের ওপর ফেলল।
‘ম্যাডাম, এ পত্রিকাগুলো এখানে সাজিয়ে রাখবার কথা না। এগুলো তো গোপন জিনিস। তাই নয় কি? এগুলো তো নিজের বেডরুমে বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখতে হয়।’
লজ্জা এবং ক্রোধে রুবি দে’র মুখোমণ্ডল রাঙ্গা হয়ে উঠলো।
‘আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি নিম্ফোমেনিয়ার বিষয় কী জানেন? ‘ রুবি দেকে প্রশ্ন করলো মৃত্যুঞ্জয়।
রুবি দে’র মুখে কথা নেই।
‘কী হলো ম্যাডাম? এই ম্যাগাজিনগুলো তো বেসিকালি নিম্ফোমেনিয়ার ওপরেই। তাই নয় কী?’
ভদ্রলোকটি এবার উঠে দাঁড়ালেন।
‘আপনি এক ভদ্রমহিলার সাথে অসভ্য ব্যবহার করছেন।’ কর্কশ গলায় বললেন মৃত্যুঞ্জয়কে।
‘করতে বাধ্য হয়েছি মিস্টার। কেন কি এই নিম্ফোমেনিয়াই হলো অমৃত সামন্তের মৃত্যুর মুখ্য কারণ। কেন ম্যাডাম, আমি কি ভুল বলছি কিছু? যদি কিছু ভুল বলি তাহলে শুধরে দেবেন। আপনি বেশ বহু দিন ধরে নিম্ফোমেনিয়া নামের এক সাইকোলজিকাল রোগে আক্রান্ত। সেই রোগের কারোণেই আপনার নজর পড়েছিলো অমৃত সামন্তের ওপর।’
‘আপনি খামোখা এক ভদ্রমহিলাকে অপমান করছেন।’ ভদ্রলোকটি চিৎকার করে উঠলো। ক্রোধে দিশাহারা হয়ে রক্তবর্ণ নেত্রে এগিয়ে এসেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। মৃত্যুঞ্জয় তার ডান গালে সজোরে একটা থাপ্পড় লাগাতে তিনি ছিটকে পড়লেন সোফাতে গিয়ে।
‘আপনি কি রুবি দে’র প্রেমে পড়েছেন নাকি মিস্টার ভাস্কর গাঙ্গুলী? দুঃখের বিষয় তো এটা যে রুবি দে আপনার সাথে শুধু নিজের স্বার্থের জন্য সম্পর্ক রেখেছে। নিজের শারীরিক স্বার্থের জন্য।’
রুবি দে’ র দিকে ফিরে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘ম্যাডাম রুবি, আপনি রিতিকা ব্যানার্জীর নাম তো নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন?’
এতক্ষণ ঘাড় হেঁট করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো রুবি দে। মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে রিতিকা ব্যানার্জীর নাম শুনে চমকে উঠলো সে।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা। আকাশ পুনরায় মেঘাচ্ছন্ন। আজ অরূপের ঘরে শুধু অরূপ আর মৃত্যুঞ্জয় নেই , আছে আরেক জন। অরূপ আজ খুশি। থানার বড় বাবু হিসেবে তার প্রথম কেস সফল। এই সফল কেসের জন্য সে মৃত্যুঞ্জয়ের চিরকৃতজ্ঞ। অরূপের কথায়, আজকের রাতটা সেলিব্রেট করার। তাই বাড়ির প্রত্যেকের শুতে যাওয়ার পর তিন জনে মিলে রাত সেলিব্রেট করা শুরু করলো। হ্যাঁ, এখনও তো তৃতীয় ব্যক্তির কথা বলাই হয়েনি। সে হলো, রাহুল ব্যানার্জী।
সবার গেলাসে পেগ ঢালার পর অরূপ মৃত্যুঞ্জয়কে বলল- ‘তুমি না থাকলে এতো সহজে এই কেসের মিটমাট হতো না, মৃত্যুঞ্জয় দা।’
পাশে বসে থাকা রাহুল ব্যানার্জী অরূপের উদ্দেশে বলল- ‘মৃত্যুঞ্জয়দা যে কষিয়ে থাপ্পড় মারলো আমায়, ব্যথা এখনও আছে। এক আই.পি.এস. এর থাপ্পড়, চিরকাল মনে থাকবে।’
অট্টহাস্য করলো সবাই।
প্রথম পেগে এক চুমুক দিয়ে রাহুল আবার বলল- ‘দুর্গাপুর থেকে আমি এখানে গোপনে গোয়েন্দাগিরি করতে আসি। বেশ কিছু দূর এগিয়ে অবশেষে নিজের খেই হারিয়ে ফেললাম। আচ্ছা মৃত্যুঞ্জয়দা, তুমি এতো সহজে কী করে সব কিছুর কূলকিনারা বার করলে?’
মৃত্যুঞ্জয়ের প্রথম পেগ শেষ হয়ে গেছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বলল- ‘শুরুর দিকে কূলকিনারা আমিও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবে অমৃত যে কোলকাতায় এসে সোজা পথে এগোচ্ছিল না সেটা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। সে এখানে টিউশনি করতো, দুটো। দুটো টিউশনি থেকে মাসে কতো রোজগার হতে পারে? দেড় হাজার, দু হাজার, তিন হাজার? বাড়ির আর্থিক অবস্থা ঠিক না। বাড়ি থেকে ধরে নিলাম মাসে চার হাজার টাকাই আসে। সব মিলিয়ে মাস গেলে হাতে সে ছ’সাত হাজার টাকা পায়। কোলকাতায় থাকার খরচও আছে। দমদমে প্রায় প্রতিটি হোস্টেলে থাকা খাওয়ার খরচ মাস গেলে প্রায় চার হাজারের ওপরে। কতই বা বাঁচতো তার হাতে? কিন্তু তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ছিলো বাষট্টি হাজার টাকা। রুটিন এনকোয়ারি শুরু করলাম। রুবি দে’র বাড়ি পার্লারে প্রথম দিন গিয়েই আমি নিম্ফোমেনিয়ার বিষয় কিছু ম্যাগাজিন দেখতে পেয়েছিলাম। এটা একটা সাইকোলজিকাল রোগ। একে হাইপার সেক্সসুয়ালিটিও বলা হয়। শরীরে অতিরিক্ত সেক্সের কারণে রুগীরা সর্বক্ষণ নিজেদের সেক্স পার্টনার খুঁজে বেড়ায়। ভাস্কর গাঙ্গুুুুলীর সাথে রুবি দে’র সম্পর্ক বহু দিনের। মিতালী বহু দিন ধরে মহিলা উন্নয়ন সমিতির এক জন সদস্যা। মিতালীর বাড়িতেও মাঝে – মাঝে মিটিং হতো । সেখানেই ভাস্কর গাঙ্গুলী ও রুবি দে’র পরিচয়। ভাস্কর যখন দেখলো মিতালীকে নিজের বশে আনা তার পক্ষে সম্ভব হলো না, তখন সে এগোলো রুবি দে’র দিকে। রুবি দে’র তো বলতে গেলে মনের ইচ্ছাপূরণ হলো । একে তো তিনি নিম্ফোমেনিয়ার পেশেন্ট, তায় আবার স্বামী বিদেশে। কিন্তু অসুবিধে হলো ভাস্কর সারা দিন নিজের কাজে ব্যস্ত। রুবি দেকে সময় দিতে পারতো না সে। ঠিক সে সময় রুবি দে’র নজর পড়লো অমৃত সমান্তর ওপর। অমৃতের মাকে তার বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে অমৃতের সাথে আলাপ তার। অমৃত জানায় যে তার কোলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে। উৎসাহ দেয় রুবি দে। তার পর আর কী? কোলকাতায় এসে শুরু পায়রাডাঙ্গাতে থাকা অমৃতের জীবনের নতুন অধ্যায়।’
ইতিমধ্যেই দু পেগ শেষ হয়ে গেছে প্রত্যেকের। তৃতীয় পেগে এক চুমুক দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘সত্যি বলতে অমৃতের জীবনটা এখানে বেশ ভালোই কাটছিলো। সে উপভোগ করছিলো দু’দুটো নারীর সংসর্গ। সময় সময় আর্থিক সাহায্য হয়ে যাচ্ছিলো তার। মিতালীর ওপরেও আমার সন্দেহ ছিলো। সন্দেহটা প্রবল হয় যখন জানতে পারি সে দুশ্চরিত্রা। কিন্তু তখনও আমি ভুল পথেই হাঁটছি। এবার রাহুলের কথায় আসি। অমৃতের হত্যার পর থেকেই সে উধাও। খুঁজে পাওয়া যায় না তাকে। সেটার কারণ জানার প্রবল ইচ্ছে হয়। রাহুলের রুম থেকে পাওয়া খবরের কাগজ আমায় হেল্প করেছিলো। সেখান থেকেই জানতে পাই রিতিকার বিষয়, জানতে পাই ডক্টর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর বিষয়। রাহুলের বিষয় বিশদ ইনফরমেশন নেওয়ার উদ্দেশে আমি সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর কাছে যাই। জানতে পারি রাহুলের কোনো রোগ নেই। নিছকই ইনসমনিয়ার বাহানা করে রাহুল যায় সেখানে। তার উদ্দেশ্য নিজের নিরুদ্দেশ বোনের তদন্ত করা। ডক্টর সিদ্ধার্থর হাতে আমি অডি গাড়ির চাবির রিং দেখি। তার পেশা খুব একটা চলে না, সেটা তার রিক্ত চেম্বার দেখেই মনে হয়। তারপর অডি গাড়ি। মিতালীর ফ্ল্যাটের জুতোর ছাপ ও ডক্টরের চেম্বারের জুতোর ছাপ মিলে যায়। রিয়ার কিডন্যাপিং আমার সন্দেহকে আরও প্রবল করে। রিয়ার কিডন্যাপিংএর পেছনে উদ্দেশ্য কী হতে পারে? জানবার জন্য ডক্টর সিদ্ধার্থকে নাগালে পাওয়া দরকার ছিলো। গুড জব অরূপ। প্রকাশ্যে এলো অরগ্যান ট্রাফিকিংএর স্ক্যান্ডাল। হসপিটালের অপারেশন থিয়েটার থেকে উদ্ধার করা হলো অচেতন রিয়াকে। রিতিকা মহিলা উন্নয়ন সমিতির সাথে যুক্ত ছিলো। সেই সমিতির দারুণ রুবি দে’র সাথে যে সিদ্ধার্থর পরিচয় হয়েছিল সেটা সে হয়তো জানতো রিতিকা। কোনো এক ভয় তার মনে বাসা বেঁধেছিলো। তাকে ডক্টর সিদ্ধার্থর কাছে চিকিৎসার জন্য রুবি দে পাঠায়। অরগ্যান ট্রাফিকিং এর শিকার হয়ে রিতিকা।’
‘অমৃত হত্যার পেছনে উদ্দেশ্য?’ জিজ্ঞেস করলো রাহুল।
‘উদ্দেশ্যটা থানাতে গিয়ে রুবি দে নিজেই পরিস্কার করেছে। অমৃতের সাথে দুর্বল মুহূর্তের সময় কিছু গোপন তথ্য সে ফাঁস করে। অমৃতের সাথে মিতালীর এক একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে সেটা রুবি দে অনুমান করতে পারে এবং সহ্য করতে পারে না। অমৃতকে গোপন তথ্য জানিয়ে তার মনে ভয় জন্মায়। সে ভাস্করের সাহায্য নেয় অমৃতকে পথ থেকে সরাতে । যে নম্বর দিয়ে অমৃতকে শেষ কল করা হয়েছিল সেটা অমৃত কিনে রুবি দেকে দিয়েছিল । কেন সেটা রুবি দে’ই ভালো বলতে পারবে। আগে অমৃত, তারপর মিতালীর পরিচারিকা। আমার বিশ্বাস মিতালীর পরিচারিকা রুবি দে’র গুপ্তচর ছিলো। যাই হোক, মামলা শেষ। অরূপ, মিতালীর বাড়ি থেকে কার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেলো?’
অরূপ বলল- ‘ডক্টরের আর রুবি দে’র।’
একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে সিগারেটের শেষ অংশটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিলো মৃত্যুঞ্জয়।
সমাপ্ত….