মন কি বাত (রম্য)
-সঞ্জিত মণ্ডল
অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে আছি। যে ভাবে ব এ শূন্য র, ড এ শূন্য ড় আর চন্দ্রবিন্দু চাঁদ রা চোখ পাকিয়ে ঘুঁসি বাগিয়ে তাকিয়ে আছে তাতে সহজে শ্বশুর বাড়ির রাস্তা মাড়াবনা ঠিক করেছি। কিন্তু কপালে সুখ সইলেতো।
কোত্থাও কিছু নেই, হঠাৎই আমার গিন্নী ককিয়ে উঠে বলল, শুনছো—-?
আমি পড়ি কি মরি করে ছুটে এসে বলি, শরীর টরীর খারাপ নয়তো?
গিন্নী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, বলে, মরণ! শরীরের দিকে তো খুব নজর, বলি মনের খবর কিছু রাখো?
বললাম, অপরাধ নিয়ো না, মনকে তো চোখে দেখা যায়না তাই —
কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝঙ্কার! কত দিইইন বাপের বাড়ি যাইনি বলোতো?
আমি হিসেব করে বলি এইতো জামাইষষ্টির পরে তেরাত্তিরও পোহায়নি!
গিন্নীর উত্তর,আমার মাথা আর তোমার মুণ্ডু, পাক্কা তিন সপ্তাহ হল, কালকেই আমাকে বাপের বাড়িতে নিয়ে চলো।
অবসর প্রাপ্ত আদর্শবাদী শিক্ষক শ্বশুর মশায়ের মুখোমুখি হওয়ার থেকে বাঘের গলায় মালা পরানো অনেক সহজ। কিন্তু গিন্নীর আবদার বলে কথা। বডি ফেলতেই, মানে আত্মত্যাগটা করতেই হল, এবং গিন্নীর পিছু পিছু শ্বশুর বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে হল।
ভয়ে ভয়ে আছি। অটো,বাস,ট্রেন,ভ্যানরিক্সা ইত্যাদি ঠেঙিয়ে শরীর ক্লান্ত, এক্ষুণি না ওনার মানে শ্বশুর মশায়ের মুখোমুখি হতে হয়। শাশুড়ি পেল্লায় এক গ্লাস জল হাতে ধরিয়ে দিলেন। বিশাল জার্নি করে গলা শুকিয়ে কাঠ, চুমুক মারতে যাচ্ছি, শাশুড়ি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, খেও না খেওনা। আমি হকচকিয়ে যেতে উনি বললেন,ওটা দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেল। তোমার জন্যে ডাব পাড়িয়েছি। তা ডাবের জল আসলো। একটা ডাবে যে এত জল হতে পারে! পুরো পেট ভরে গেল। কিন্তু চমকের বাকী ছিল। ডাবের জলের পিছু পিছু পেল্লায় এক ফলের পাহাড়। কি নেই তাতে, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, সবেদা, আঁশফল আর ফলসা। দেখে আমার ভীরমি খাওয়ার যোগাড়। খুব ভয়ে ভয়ে ছোট একটা আমের টুকরো মুখে ফেলেছি কি ফেলিনি এমন সময় জা– মা– ই–। এইরে, শ্বশুর মশায় ডাকছেন।
ভয়ের চোটে আমের টুকরোটা গলা আর বুকের মাঝখানে এমন ঘুলঘুলিতে লুকিয়ে পড়ল যে তাকে এপার ওপার করে সাধ্য কার!
আবার গম্ভীর নির্ঘোষে শব্দ ভেসে আসে, জা– মা– ই–। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়। দুরু দুরু বুকে সাড়া দিই, আ—জ্ঞে —- এ।
উনি বললেন, কি করছো?
ভয়ে ভয়ে বলে ফেলি আজ্ঞে ফেসবুক করছিনা।
এবারে কিন্তু ওদিকের গলার স্বরে বেশ ঝাঁজ, বললেন,কি করছো না সেটা জানতে চাইনি, কি করছো সেটা বলো।
ভয়ের চোটেই বলে ফেলি, আজ্ঞে ফেস বুক করছি।
উনি বললেন, সত্য বলতে শেখো জামাই, ভাবের ঘরে চুরি কোরো না।
দোষটা আমারই, স্লিপ অব টাং না হলে এমন করে ভাবের ঘরে চুরির কথা উঠতো না। মাথা নিচু করে চুপ করে আছি দেখে ওনার কিঞ্চিৎ দয়া হয়ে থাকবে।বললেন, তোমাদের ফেসবুকে তো দেখি জ্যোতিষী, গুরু আর জ্ঞানদাতে ভরে গেছে।
আমি মিন মিন করে বলি, জ্যোতিষীরা তো নানারকম ঠাকুর-দেবতার ছবি দেখিয়ে বলে, এক্ষুণি শেয়ার করুন আপনার আজকের দিনটা ভালো কাটবে, কেউবা আবার অতিরিক্ত সাহসী হয়ে বলে, আপনার হাতে দুসেকেন্ড সময় আছে? তাহলে এক্ষুনি শেয়ার করুন, আপনার আগামী একমাস ভালো কাটবে।
শ্বশুর মশায় বললেন, তা তোমার কি এমন ভালো কেটেছে?
মাথা নত করেই জবাব দিই, আজ্ঞে, আমি মহা মুখ্যু, তাই আচ্ছেদিন ভালোকরে বুঝতে পারিনি। মনে হল, উনি একটু খুশি হয়েছেন। বুকে বল নিয়ে তাই বলি, গুরুরা কিন্তু বেশ ভালো ভালো কথা বলে। উনি একটু অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, হাঁ, গায়ে নামাবলি আর গলায় কুঁড়োজালি। উনি আবার রেগেছেন দেখে আমার সাহস উবে গেল। উনি বললেন, জানো জামাই এক গুরু লিখেছেন, এতো মানুষ মন্দিরে যায় কিন্তু তারা কেউ দেবতা হতে পারেনা, আর দেখ, পাথর মন্দিরে গিয়ে দেবতা হয়ে মানুষের পূজো পায়।
আমি তেল দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি,বললাম, আপনি দেখে শুনে চুপ করে রইলেন?
উনি বললেন, আমি কি ছেড়ে দেবার মানুষ? আমিও লিখে দিলাম, মানুষ মন্দিরে যায় নিজে দেবতা হবার জন্যে নয়, বরং দেবতার কাছে প্রার্থী হয়ে প্রার্থনা করে ও দেবতার আশীর্বাদ চায়। আর পাথর নিজের পায়ে হেঁটে মন্দিরে যায় না,কোনো ধান্দাবাজ মানুষ পাথর কুড়িয়ে এনে তেল সিঁদুর মাখিয়ে মন্দিরে বা বটতলায় রেখে দিয়ে লোক দেখিয়ে ডুকরে ওঠে, বলে,তুমি পাথর নাকি প্রাণ—-। আর ধর্মভীরু মানুষ পটাপট পয়সা ছোঁড়ে। ইমোশনাল এক্সপ্লয়টেশন। গুরুজীর ধান্দাবাজী সার্থক হয়। ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে।
দীর্ঘ ভাষণের পর শ্বশুর মশায় তৃপ্ত হয়েছেন। ওনার তৃপ্তিটাকে দীর্ঘায়িত করার জন্যে আমি বলি, আপনি জ্ঞানিদা না কি বলছিলেন? উনি আমাকে শুধরে দিয়ে বললেন, জ্ঞানিদা নয় জ্ঞানদা! মনে রেখ, ইনি শরৎ বাবুর অরক্ষণীয়া নন এবং এনার কোনো লিঙ্গ নেই, এনার কাজ শুধু বড় বড় বুকনি মারা আর লম্বা চওড়া জ্ঞানের ফুলঝুরি ছোঁড়া।
বাঘের সামনে বেশীক্ষণ বসে থাকা যায় না। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আমের টুকরোটা বেয়াড়া জায়গায় আটকে গিয়ে অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই বুকে হাত বোলাচ্ছি দেখে উনি বললেন, কী ব্যাপার, বুকে হাত বোলাচ্ছ কেন? ফোঁড়া টোঁড়া উঠছে নাকি?
লজ্জিত হয়ে বলি, না না, আমার ওসব ওঠেনি। তাছাড়া আমি অন্যের নয় আমার নিজের বুকে হাত বোলাচ্ছি, সবে বলতে যাচ্ছি তাতে কার কি কিন্তু, ধমকের চোটে বলে ফেলি আজ্ঞে, বুকে পাথরকুচি।
উনি বললেন, এইতো দিব্যি কথা বলছিলে, তা পাথরকুচি খেলে কখন?
আমি বলি, আজ্ঞে, আমের পাথরকুচি!
উনি অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন, বললেন, তাই বলো! আমের পাথরকুচি! তুমি কি কবিতা টবিতা লিখছো না কি?
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, না না আমি ওসব লিখি টিখি না।মনে পড়ে ছোটো বেলায় বাবা একটা নীল খাতা বাঁধিয়ে দিয়েছিল। তাতে সবে কবিতার মত কিছু লেখার চেষ্টা করছি এমন সময়ে উকিল মেজদির চোখে পড়ে গেলাম। মেজদি আমায় ডেকে বলল, দেখ ভাই, আর যাই করিস কবিতা যেন লিখিস না। মনে হয়েছিল, কবিতা লেখা হয়তো জামিন অযোগ্য অপরাধ। তাই ভয়ে ভয়ে বলি, কেন দিদি?
মেজদি বলেছিল,কবিরা খুব দু:খী হয় জানিস, যারা কবিতা লেখে তারা সারাজীবন কষ্ট পায়। কষ্ট পেতে আমার খুব ভয় লাগে। সেই যে কবিতা লেখা ছেড়েছি আর ও পথ মাড়াইনি। এখন শ্বশুর মশায় আমাকে কবিতা লেখার দোষ দিচ্ছেন, তাই শোধরানোর জন্যে বলি, আপনার কি কবিদের উপর কোনও রাগ আছে?শ্বশুর মশায় একটু গম্ভীর হলেন, বললেন, আধুনিক কবিতার তুমি মানে বুঝতে পার?
আমি তাড়াতাড়ি বলি, আমিতো কবি নই, আমি কবিতা লিখিও না। শুনে বোধহয় উনি খুশি হলেন, বললেন, দেখ জামাই, কবিতা হচ্ছে গভীর জীবনদর্শন, ভাবসমৃদ্ধ অনুভূতির সংপৃক্ত বহি:প্রকাশ। ছন্দোময় ব্যঞ্জনার দ্যুতিতে আলোকোজ্জ্বল সুখ পাঠ্য এক সমৃদ্ধ লেখনী। মুশকিল কি জানো জামাই, আজকালকার কবিতা পড়ে তার মানেই উদ্ধার করতে পারিনা রসাস্বাদন করব কি করে! মাঝে মাঝেই দেখি পাতার পর পাতা শুধুই ব্যঞ্জনাময় শব্দের যাদুকরীখেলা – কবিতার নামে আসলে নেহাৎই একটি অশ্বডিম্ব!
শ্বশুর মশায়ের কঠিন কঠিন বাংলা শব্দবাণে আমার বুকের পাথরচাপা সরি, পাথরকুচির ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে,আমি ঘন ঘন বুকে হাত বোলাচ্ছি দেখে উনি অন্দরের দিকে মুখ করে গর্জন করে উঠলেন, শু– ন– ছো ও ও।
অন্দর থেকে শাশুড়ী ঠাকরণের গলা ভেসে আসে, এখন রান্না বান্নার তদারকি করছি, পড়া ধরলে পারবোনা কিন্তু উ উ।
বউয়ের কাছে কত জজ ব্যারিষ্টার জব্দ, আর সামান্য শিক্ষক মশায়!
আর এমন মওকা কেউ ছাড়ে? তড়িঘড়ি করে বলি, উনি রান্নাঘরে, আমার মাথায় দারুণ একটা রেসিপি এসেছে, যাই ওনাকে এক্ষুুুুণি বলি, নইলে মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে। বলেই কারো সম্মতির অপেক্ষা না করেই এক লাফে অন্দর পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াই।
পিছন থেকে বাঘের অট্টহাসি শুনতে পাই, হা: হা: হা:! য পলায়তি স জীবতি!
মনে মনে বলি, আমারওতো কিছু বলতে ইচ্ছা করে, মন কি বাত তো আমার ও আছে। আমিও বলব, নিয়ম করেই বলব।শ্বশুর বাড়িতে না এলেও বলব।