একটা অকাল বোধন

একটা অকাল বোধন
-সৌরভ ঘোষ

দেখো অবস্থান নির্ধারণ করাটাই শক্ত কাজ,যেমন খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা।
তুমি বরং গ্লোব নাও। কত আর দাম…
ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে সাড়ে অষ্টআশি ডিগ্রী দ্রাঘিমা বরাবর নীচে নামতে থাক,

সাড়ে বাইশ বা তেইশ ডিগ্রী অক্ষরেখার মিলনস্থলে লাল মার্কারের নিবে ফুটকি দাও,
এর মানে যে বিপদজনক জোন তা নয়, কান রাখো ফুটকিতে,
ঘর বন্ধ করো, পাখি তো নয়ই যেন মশাদের আবদারও কানে না আসে।
শুনতে না পেলে স্টেথোস্কোপ ধার নাও দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে,
স্টেথোস্কোপের চোঙ ফুটকির বুকে রাখ,
শিশুদের কান্না শুনতে পাচ্ছ? খিদের জ্বালায় হতে পারে, আমল দিও না,
এক পা এগোও, নবীনদের কান্না, বেকারত্ব বা ধোকা
দু’ পা এগোয়, মিসক্যারেজ হওয়া মায়ের কান্না
দ্বিরাগমনের আগেই যে নবোঢ়া বিধবা তার কান্না
ছেলেদের কান্নার শব্দ খুব ক্ষীণ।
তিন পা এগোও,জোড় বাড়ছে না!
বানে ভেসে যাওয়া নদীর শব্দ সরিয়ে দেখ কয়েকটা সংসার কাঁদছে,

দেখো শেষ যুদ্ধে নিহত যুবকের বিধবা মা কাঁদছে, দেখো জলে তলিয়ে যাওয়া আত্মীয়ের শবদেহবাহীরা কাঁদছে
দেখো ট্রেনে বাসে ব্রিজের নীচে চাপা পড়া লাশগুলোর দাবীদার কাঁদছে।
যে বিধবা পাঁচ বাড়ি কাজ করে, যে বিধবা সারারাত সেলাই করে,যে বিধবা কাগজের ঠোঙা বেচে ছেলেকে মানুষ করেছিল, সে ছেলে হারিয়ে কাঁদছে।
আর একটু এগোও, রক্ত দেখতে পাচ্ছ?
দাগ মুছে কান পাতো আর্তনাদ শুনতে পাবে, ওরা ধর্ষিতা।
আর একটু এগোয় কিছু শুনছ? গুঞ্জন! ওটা বৃদ্ধাশ্রম, আলোচনা চলছে কার ছেলে কবে আসবে, দেখ আশ্রমের বাইরে কত দিন চাকার দাগ পড়েনি, শুনতে পাচ্ছ ওদের ফুঁপিয়ে কান্না, ওদের কান্নার রঙ চাপা শ্যাওলা,
একটু কোনে তাকাও, অন্ধকারে, ওটা নরক,
ওখানে বেশ্যা থাকে, ছোট ছোট কেবিন, লুকিয়ে কাঁদে।
আর এক পা এগোও, অট্টহাসি শুনতে পাচ্ছ?
ওরা জার্ম…

একি চোখে জল কেন?

‘আমার বাবার কান্না শুনতে পেলাম।
প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে লোনে ল্যাপটপ কিনেছিল বাবা, তিন বছরের ই.এম.আই.পছন্দ হয়নি।তখন কলেজ,মাত্র পঞ্চাশ টাকা হাতখরচ। চলে? বাবা ছেঁড়া লুঙ্গি তালি দিয়ে পড়ত, আমার লজ্জা হত।ভেবেছিলাম এই লোকটা অনুভূতিহীন। আসলে সব অনুভূতিগুলো ফালি ফালি করে কেটে ফেলেছিল বাবা।হুড়মুড় করে বোধনের দিন ঘর ছেড়েছিলাম।
জানতাম না বাবা আড়ালে কাঁদে। আজ বাবা বড় একা আমিও।’

তাহলে একাকীত্বও বুঝলে?
এবার চলে এসো ঝাঁড়ু দিতে হবে, কয়েকটা অশ্বক্ষুর নদী আঁকতে হবে, কয়েকটা স্বচ্ছ বসন্ত, একটা ভোর আনতে হবে, একটা সূর্য নামাতে হবে, সাম্য মৈত্রী স্বধীনতা ইতিহাস থেকে বাস্তবের খুঁটিতে বাঁধতে হবে, দরকার হলে চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে হবে অপুষ্ট সমাজ চেতনাকে।

একবার আয়নাটা ধর ফুটকির সামনে, যেটা দেখতে পাচ্ছ সেটা অসংখ্য বিন্দু সমষ্টির লাবণ্য।মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলে ধৈর্যে চোখ রাখো- দেখবে শিকড়ের বন্ধন, সবাই আত্মীয়, তোমার আমার শীতার্ত জরাজীর্ণ বঙ্গ…

পারবে আর একটা অকাল বোধন করতে…?

Loading

Leave A Comment